post

মুদ্রাস্ফীতি কী এবং কেন এ থেকে উত্তরণের উপায়

শাহরিয়ার ফয়সাল

২৯ জুন ২০২২

বর্তমানে বাংলাদেশ তথা সমগ্র পৃথিবী এক গভীর অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশসমূহ। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অর্থনীতিও আজ বিপর্যস্ত। বাংলাদেশে বর্তমানে তেলের মূল্য অস্বাভাবিক (পেট্রোল-১২৫ টাকা, অকটেন-১৩৫ টাকা, সয়াবিন ১৯০ টাকা), প্রতি ডলারের মূল্য ১০৭ টাকা, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী, দেশে রিজার্ভ সংকট, বিদেশে অর্থপাচার, রেমিট্যান্স প্রবাহে ঘাটতি, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশীয় উৎপাদনে স্থবিরতা, বেকারের পরিমাণ বৃদ্ধি, আমদানি পণ্যে নিষেধাজ্ঞা এবং অতিরিক্ত করারোপ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে দেশে অর্থনীতি টালমাটাল। এ দিকে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম সবকিছুকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। মানুষের কষ্টার্জিত ব্যাংকে জমানো টাকা লুটপাট চলছে মহাসমারোহে। কোনো বিচারই তাদের হচ্ছে না এ যেন এক হরিলুটের দেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে নভেম্বর-২২ এ ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি ১ লক্ষ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। তবে আইএমএফ বলছে দেশে ঋণখেলাপির পরিমাণ ২ লক্ষ কোটি টাকা। কোনো কোনো অর্থনীতি বিশ্লেষক মনে করেন প্রকৃত মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ৪ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। গত মাসের নভেম্বরে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় ইসলামী ব্যাংকে ঋণ প্রদানের অনিয়ম নিয়ে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ২টি কোম্পানি ২৪৬০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৫ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি (চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে মোট ঋণের ২০.৭ শতাংশই খেলাপি ঋণ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে যার পরিমাণ ৫.৪৭শতাংশ)। এ সব ঋণ খেলাপিদের প্রায় সবাই সরকার দলীয় লোক। বড় বড় সরকারি মদদপুষ্ট প্রতিষ্ঠান ছাড়া ব্যাংকগুলো সাধারণ উদ্যোক্তাদের ঋণ খুবই কম দিয়ে থাকে। ফলে পুরো অর্থনীতি অল্পকিছু রাঘববোয়ালদের হাতে জিম্মি। এরাই আবার মন্ত্রী এবং দেশের আইনপ্রণেতা। অপরদিকে মানুষের বেতন স্থির থাকা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হবার কারণে মধ্যবিত্তদের জীবন পরিচালনায় নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। দেশে ৫০% মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। 

উপরোক্ত সকল সংকটের সাথে মুদ্রাস্ফীতি শব্দটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানা একটি অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি বছরই মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে থাকে। ২০২২ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের Monetary policy অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি ৫.৩ শতাংশের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সর্বশেষ অক্টোবর-২২ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি ৮.৯ শতাংশ। সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি এখন ৭.৭ শতাংশ। এ বছরের জুলাই মাসে ছিলো ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে বর্তমান পৃথিবীতে অনেক দেশ রয়েছে যাদের মুদ্রাস্ফীতি ১-২ শতাংশের মধ্যে (যেমন: ম্যাকাও ১.০২%, পানামা ১.৬৭%, হংকং ১.৮%)। আবার অনেক দেশ রয়েছে যাদের মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ অনেক বেশি (যেমন: লেবানন ১৫৮%, জিম্বাবুয়ে ২৬৯%)। এখন আমরা জানবো এই মুদ্রাস্ফীতির কারণ কী এবং উচ্চমুদ্রাস্ফীতির হার কিভাবে একটি দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে।


মুদ্রাস্ফীতি কেন ঘটে?

মুদ্রাস্ফীতির সাথে সাধারণত তিনটি সত্তা জড়িত- সরকার, ব্যাংক এবং জনগণ। আসুন এবার একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক- মুস্তাফিজ, মুহসিন এবং আলামিন তিন বন্ধু একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করছিলো। হঠাৎ মুস্তাফিজ বলল, আলামিন মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে কি তোমার কোনো ধারণা আছে? আলামিন জবাব দিলো- না, এমন জটিল বিষয় আমার মাথায় ঢোকে না। তখন মুহসিন বলল, আমি তোমাদের বিষয়টি সহজে বুঝিয়ে দিচ্ছি। মনে করো আমরা তিনজন একটি পৃথিবীতে থাকি। আমি বাংলাদেশ ব্যাংক, মুস্তাফিজ বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং আলামিন সাধারণ জনগণ। আমি বাংলাদেশ ব্যাংক হওয়ায় দেশে শুধু আমিই টাকা ছাপাতে পারবো আর কারো কোনো এখতেয়ার নাই। সুতরাং আমি টাকা ছাপালাম। এখন জনগণের এই টাকা প্রয়োজন কেনাকাটা ও দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য কিন্তু সমস্যাটা হলো আমি টাকা সরাসরি জনগণকে দেই না। এই কাজটি করে মুস্তাফিজ (বাণিজ্যিক ব্যাংক)। তাই আলামিন (সাধারণ জনগণ) বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে গেলো। এখন বাণিজ্যিক ব্যাংক সাধারণ জনগণকে লোন দেওয়া, উক্ত লোন আদায় এবং ব্যবসা ইত্যাদি কাজে জনগণকে টাকা দিয়ে থাকে। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকের টাকা ছাপানোর কোনো ক্ষমতা নাই। তাই সে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আসবে টাকা নিতে। বাংলাদেশ ব্যাংক এমনিতেই তাকে টাকা দিবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে সিকিউরিটি (collateral) বাবদ কিছু জমা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক টাকা ধার নিবে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের তখন দায় (Liabilities) এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য তা সম্পদ (Asset) হবে। এই টাকা বাণিজ্যিক ব্যাংক নিয়ে জনগণকে কিছু দিবে আবার নিজের কাছে কিছু রেখে দিবে। এভাবে জনগণ ঐ টাকা দিয়ে চাহিদা পূরণ করবে বা ব্যবসায়িক কোন কাজ করবে। এভাবে জনগণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেলে তার আরো টাকার প্রয়োজন হবে তখন সে আবার কোন সিকিউরিটি জমা রেখে টাকা আনবে। আবার বাণিজ্যিক ব্যাংক টাকা আনবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে (সিকিউরিটি জমা দিয়ে)। আর প্রয়োজনের আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকও টাকা ছাপাবে। এভাবে কত টাকা সমাজে সমাজে দেওয়া হয়েছে তার একটি হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থাকে। দেশের অভ্যন্তরে যখন হঠাৎ দ্রব্যের উৎপাদন কমে যাবে (প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট কারণে) তখন দেশে টাকার পরিমাণ ঠিক থাকলেও দ্রব্য কম থাকায় বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে। ধরা যাক ২০২১ সালের আগস্টে এক কেজি আপেল ক্রয় করতে ১০০ টাকায় সেই একই আপেল ২০২২ সালের আগস্টে কিনতে হচ্ছে ১৫০ টাকায় এই অতিরিক্ত ৫০ টাকাই হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। এই মুদ্রাস্ফীতি দূর করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটারি পলিছি গ্রহণ করে আর সরকার ফিসক্যাল পলিসি গ্রহণ করে থাকে। অর্থাৎ বিভিন্ন পন্থায় টাকা জনগণের কাছ থেকে উঠিয়ে ব্যাংকে জমা করতে পারলে সাময়িক এই মুদ্রাস্ফীতি কমে আসে। এটি একেবারে সাধারণ একটি ধারণা মাত্র। এবার মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।

তাত্ত্বিকভাবে দুই কারণে সাধারণত মূল্যস্ফীতি ঘটে। যেমন চাহিদা বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি। কোভিড অতিমারীর ধাক্কা অনেকটা কেটে গেলে গত জানুয়ারি থেকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হতে শুরু করে এবং চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সরবরাহ সংকট ও উৎপাদন কম থাকায় সে সময় থেকেই বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। এরপর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করলে পুরো ইউরোপজুড়ে তীব্র জ্বালানিসংকট দেখা দেয় এবং এতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে বিশ্বব্যাপী গম, অপরিশোধিত তেল এবং খাদ্যশস্যের সরবরাহ কমে যায়। ফলে বিশ্বে একই সময়ে চাহিদাজনিত (ডিমান্ড পুল) ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির (কস্ট পুশ) কারণে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে, যা ইতিহাসে ইতঃপূর্বে দেখা যায়নি।

অর্থনীতিবিদরা মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে গণ্য করেন। কারণ মুদ্রাস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দেয় এবং ভোক্তাদের জীবনমানকে দুর্বিষহ করে তোলে। মানুষ একসময় হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। গত জানুয়ারি থেকেই বাংলাদেশে অল্প অল্প করে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও শেষ তিন মাসে বৃদ্ধির গতি অনেকটাই অসহনীয়। অর্থনীতিবিদেরা বলেন, মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে থাকা জনজীবনের জন্য স্বস্তিদায়ক বা ভালো। ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকা মানেই বিপদ এবং এর চেয়ে বেশি হলে মহাবিপদ। অর্থাৎ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিপদসীমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি মানেই জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও জনজীবনে অসহনীয় অস্বস্তি। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে টিকে থাকা কঠিন। 

অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি বলতে সাধারণত মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধিকেই বোঝানো হয়। সহজ ভাষায়, অনেক বেশি টাকা দিয়ে সামান্য কিছু পণ্য ক্রয় করা যায়। তাই অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে গেলে এবং পণ্য ও সেবার সরবরাহ অপরিবর্তিত থাকলে মূল্যস্ফীতি ঘটে। এতে চাহিদা ও মূল্যস্তর দুটিই বেড়ে যায়। শাস্ত্রীয় ও আভিধানিক অর্থেও মুদ্রাস্ফীতির অর্থ সব ধরনের পণ্য ও সেবামূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি, যা সাধারণত ঘটে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে এবং এতে অর্থের মূল্য হ্রাস পায়। তবে শুধুমাত্র একটি, দুইটি বা সামান্য কয়েকটি দ্রব্য বা পরিষেবার যদি মূল্যবৃদ্ধি হয়, তবে তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয় না। সামগ্রিকভাবে জিনিসপত্র এবং পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধি হলে তবেই বলা হয় মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বলা যায় বর্তমানে ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সারা বিশ্বে প্রায় সমস্ত জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এই অবস্থা হলো মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা।

মুদ্রাস্ফীতিকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। যদি কোনো মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, তাহলে সেই অবস্থাকেও মুদ্রাস্ফীতি বলা চলে। যেমন ২০১২ সালে ১ কেজি চালের দাম ছিল ২৫ টাকা অথচ ২০২২ সালে ১ কেজি চালের দাম ৫০ টাকা। অর্থাৎ ২০১২ সালে ২৫ টাকায় যে পরিমাণ চাল পাওয়া যেত, আজ ২০২২ সালে ওই একই টাকায় তার চেয়ে কম পরিমাণ চাল পাওয়া যায়। এর অর্থ হলো মুদ্রার ক্ষমতা বা তার মূল্যের অবনমন হয়েছে, যার ফলস্বরূপ মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা তৈরি হয়েছে। সাধারণত দুটি কারণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।

প্রথমত, চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি-এক্ষেত্রে যদি কোনো দেশে পণ্য ও পরিষেবার সুবিধা নেয়ার চাহিদা বৃদ্ধি পায় অথচ সেই অনুপাতে পণ্যের উৎপাদন বা পরিষেবা সরবরাহ না থাকে, তাহলে যেটুকু পণ্য ও পরিষেবা পর্যাপ্ত আছে, তার মূল্যবৃদ্ধি হয় এবং মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা তৈরি হয়। আমরা জানি যদি কোনো জিনিস খুব স্বল্প পরিমাণেই সরবরাহ থাকে অথচ তার চাহিদা বেশি, তাহলে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মই সেই দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি হবে। এই ধরনের মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা তৈরি হতে পারে যদি সরকার আয়কর কমিয়ে দেয় বা সুদের হার হ্রাস করে, অথবা কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি হয়। 

দ্বিতীয়ত, মূল্যবৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি- এক্ষেত্রে যদি কাঁচামাল অথবা সেই সব পণ্য বা পরিষেবা যার ওপর কোনো দেশের অর্থনীতি প্রবলভাবে নির্ভরশীল তার মূল্যবৃদ্ধি হয় তবে মুদ্রাস্ফীতির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যেমন ধরা যাক, কোনো দেশে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি হলো। এখন যেকোনো উৎপাদন বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় উৎপাদিত দ্রব্য এবং সেবাকর্মের মূল্যও অনেক বেড়ে যাবে। কারণ উৎপাদিত পণ্য তখন গ্রাহক অবধি বিদ্যুতের পিছনে অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ চালিত সকল সেবাসমূহকে সচল রাখতে হলে অতিরিক্ত খরচ গুণতে হবে। আবার এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যদি শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করতে হয়, বা সরকার কর বৃদ্ধি করে, অথবা এইরূপ অন্য কারণগুলোর জন্যও। মুদ্রাস্ফীতির অন্য কারণগুলো হচ্ছে অর্থের জোগান বৃদ্ধি, অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ, ট্রেড ইউনিয়নের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ ও মহামারী, যাতায়াত ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, উৎপাদন হ্রাস, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, মজুদদার ও চোরাকারবারি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, উদার ঋণনীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি।


মুদ্রাস্ফীতিকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়

মুদ্রাস্ফীতি সমাজে আয় বণ্টনের বৈষম্যকে ত্বরান্বিত করে, সামাজিক অসন্তোষের সৃষ্টি করে এবং অর্থনীতিতে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই একটা দেশের জন্য মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি। মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার প্রধানত দুই ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।


প্রথমত, আর্থিক নীতি ((Monetary policy)- আর্থিক নীতি সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রহণ করে থাকে। আর্থিক নীতি সাধারণত স্বল্প সময়ের জন্য গ্রহণ করা হয়ে থাকে। মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণই হলো অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি। ব্যাংকব্যবস্থায় ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের সাহায্যে এ লেনদেন হয়ে থাকে। এ ঋণের পরিমাণ কমাতে পারলে মোট প্রচলিত অর্থের পরিমাণ কমে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ উদ্দেশ্যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক নীতির সাহায্যে অর্থের জোগান নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দেয় সেই ব্যাংক হার বৃদ্ধি, খোলাবাজার নীতির মাধ্যমে খোলাবাজারে সরকারি ঋণপত্র বিক্রয় করে ব্যাংকসৃষ্ট অর্থের পরিমাণ কমাতে চেষ্টা করে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য নগদ জমার অনুপাত বা সংরক্ষণ বাড়িয়ে দিতে পারে। 


দ্বিতীয়ত, রাজস্বনীতি (Fiscal policy)- বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থিকনীতি অপেক্ষা রাজস্বনীতি অনেক বেশি কার্যকর। রাজস্বনীতি একটি দেশের সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়। মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হলো অতিরিক্ত ব্যয়। মুদ্রাস্ফীতির সময় সরকার অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে দিতে পারে। আবার, চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার জনগণের ওপর আরোপিত করের মাত্রা বৃদ্ধি করে কিংবা নতুন নতুন কর আরোপ করে জনগণের ব্যয়যোগ্য আয়ের পরিমাণ কমাতে পারে। অর্থনীতিতে খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে বা উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে সরকার উৎপাদন ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান করতে পারে। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ ঋণ-মুদ্রাস্ফীতির সময়ে সরকার দেশের অভ্যন্তরে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রিজার্ভ। একটি দেশের কাছে বৈদেশিক লেনদেনের জন্য যে পরিমাণ অর্থ মজুদ থাকে তাকে রিজার্ভ বলা হয়। আমাদের দেশে রিজার্ভ হিসেবে ডলার মজুদ করে রাখা হয়। ডলারের দাম যখন বেড়ে যায় তখন মুদ্রাস্ফীতিও বৃদ্ধি পায়। গত বছর ডলার প্রতি দাম ছিলো ৮৬ টাকা আর এ ডিসেম্বর মাসে ডলারের দাম ১০৭ টাকা। অর্থাৎ আমাদের দেশের চাহিদা পূরণের জন্য আগে যত টাকার পণ্য বিদেশ থেকে আনতে হতো সেই একই পণ্য এখন অনেক বেশি টাকায় কিনতে হচ্ছে। ফলে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। নভেম্বর মাসের পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪ বিলিয়ন ডলার (ঋণের পরিমাণ বাদ দিলে ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে)। তবে বছরের শুরুতে এর পরিমাণ ছিলো ৪২ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ কমা একটি দেশের জন্য খারাপ। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। আর এই টাকা ডলারের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত টাকা দিয়ে খাদ্য ও জ্বালানি ক্রয় করতে গিয়ে রিজার্ভের এই বেহাল দশা। এজন্য সরকার কিছু আমদানি পণ্যে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং খাদ্য উৎপাদনের প্রতি সরকার বিশেষ নজর দিতে জনগণকে অনুরোধ করেছে। বলাবাহুল্য যে, আমাদের মত জনবহুল এই দেশে উন্নয়নের নামে বিদেশনির্ভরতা বাড়ানো এবং নিজস্ব উৎপাদনের প্রতি নজর না দেওয়ার কারণে দেশ আজ গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে। ফলে ঘটছে দেশের অভ্যন্তরে এই মুদ্রাস্ফীতি। ক্ষমতাসীনদের মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দেওয়া, অল্পকিছু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা লুটের ফলে ঋণখেলাপির পরিমাণ বৃদ্ধি অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও মুদ্রাস্ফীতির জন্য অনেকাংশে দায়ী।

তবে সরকার যাই বলুক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি ও কষ্টের সম্মুখীন হয় স্বল্প আয়ের মানুষ। সুতরাং এদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বাজারের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ী যাতে তার ইচ্ছামতো দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সে জন্য দেশের জনগণকেও সচেষ্ট থাকতে হবে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার ও নিরাপত্তা। 

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির