post

মুসলিম কোররাষ্ট্র গঠন একটি সময়ের দাবি

তাসনীম মাহমুদ

০৮ মে ২০২০

মুসলমানদের ক্ষেত্রে ‘শিয়াইট’ ((Shiait)) এবং ‘সুন্নি’ (Sunni) ভাগাভাগি যেভাবে তাদের বৃহত্তর মিলন এবং তার ফলে যে কাক্সিক্ষত কল্যাণ তা থেকে তাদের বঞ্চিত করছে; খ্রিষ্টানদের মাঝেও ‘লুথারিজম’ (Lutherism) এবং ক্যালভিনিজম’ (Calvinism) ভাগাভাগি তাদের আন্তঃদ্বন্দের বৃহত্তম কারণ। যদিও পশ্চিম নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া বিশ্ব খ্রিষ্টান্দের আন্তঃদ্বন্দের বিষয়টি ঢেকে ঢুকে রাখলেও তাদের চির জাতশত্রæ বলে বিবেচিত মুসলমানদের খণ্ড-বিখণ্ডের চিত্র ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে থাকে। বিষয়টিকে যদি তারা এমনভাবে নেয়- ১. অধিকাংশ মুসলমান খ্রিষ্টানদের আন্তঃদ্বন্দের ভাগাভাগি হওয়া উল্লিখিত গ্রুপ দু’টি সম্পর্কে জ্ঞান রাখবে না; খ্রিষ্টানদের দুর্বলতাও প্রকাশ পাবে না। ২. মুসলমানেরা ভাগাভাগির চিত্রে বিপর্যস্ত হয়ে নিজেদেরকে একটি একক প্লাটফর্মে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে পারবে না; তদুপরি অব্যাহতভাবে নিজেদের ভাগাভাগির ‘ইগো’ (Igo) নিয়ে নিজেরাই নিজেদের দুর্দশার জন্য কপাল চাপড়াবে। ৩. পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের দুর্বলতা, ফাঁকফোকর ইত্যাদি তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষার কৌশলেই ঢেকে রাখবে। ৪. বিশ্ব শাসনে মুসলমানদের ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি অবলম্বন করবে। যেমন- মূলধারার মুসলমানেরা গণতান্ত্রিক নিয়মে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলেও তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা মেনে নেয়া হবে না; ইত্যাদি। ব্যাপারটিকে যদি মুসলিম বিশ্ব গভীরভাবে তাদের পর্যালোচনায় আনেন এবং এর থেকে উত্তরণের পথ বের করতে চান তাহলে অবশ্যই মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি কোররাষ্ট্রের প্রয়োজন আছে বলে আমার বিশ্বাস। কেননা শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্ব, বর্তমান বিশ্ব এবং ভবিষ্যৎ বিশ্ব কোররাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই তার সভ্যতা-সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে লালন করছে-করবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- বিগত ১৫ শত বছরের ইতিহাসে মুসলমানেরা উল্লেখযোগ্য সময় বিশ্ব শাসন করলেও তারা তাদের নিজেদের ভেতরের দুর্বলতা, আন্তঃকলহ, ভাগাভাগি ইত্যাদি কারণে সে শাসনক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি; যেখানে একটি কোররাষ্ট্রের অভাব সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। অন্য দিকে পশ্চিমা বিশ্বের শাসকেরা সর্বশেষ অটোম্যান সাম্রাজ্য ধ্বংসের মাধ্যমে বিশ্ব শাসনে পূর্ণ ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। তারা শাসনপ্রাপ্ত হয়ে তাদের নিজেস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতির আদলে কোররাষ্ট্র গড়ে তোলে; যেমন- ইউএসএ এবং গ্রেট ব্রিটেন। তারা মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতি নির্বিচারে ধ্বংস করে; এমনকি ইতিহাসের পাতা থেকে মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক শাসনামলকে মুছে ফেলতে যাবতীয় আগ্রাসন চালায় এবং যা এখনও চলমান। এ ধ্বংসযজ্ঞ তৎপরতায় তারা যে সমস্ত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করে তার মধ্যে রয়েছেÑ ১. কোররাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে তারা তাদের নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতির মনা রাষ্ট্রসমূহকে বেছে নেয় এবং এক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে মুসলিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে এড়িয়ে (আড়রফ করে)। ২. বিশ্বজনীন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির আদলে শিক্ষাপদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। ৩. তারা তাদের সংস্কৃতির সর্বজনীন করতে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির আদলে তৈরি নাটক, ছায়াছবি, সাহিত্য, কাব্য, কার্টুনচিত্র, কৌতুকচিত্র ইত্যাদির ব্যাপক প্রচার- প্রসারকরণ। ৪. তথ্যভাণ্ডার নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ মিডিয়ার নিজস্বকরণ এবং তার মাধ্যমে ঐতিহাসিক সত্যাবলিকে আড়াল করে নিজেদের ভাল- গুণগত ঐতিহ্যসমূহ বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা। ৫. মুসলিম রক্ত কলুষিত করা; যেমন- পরিকল্পিত ধর্ষণ ইত্যাদি। ৬. সন্ত্রাসী, জঙ্গি, উগ্রবাদী, মৌলবাদী ইত্যাদি তকমা লাগিয়ে দেশে দেশে মুসলিম নিধন। ৭. আগ্রাসীভাবে সমগ্র বিশ্ব থেকে সম্পদের ব্যাপক আত্তীকরণ। ৮. মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে পরিকল্পিতভাবে বিবাদ জিইয়ে রাখা এবং তাদের ভূ-খণ্ডসমূহ ভেঙে টুকরো টুকরোকরণ। ৯. মুসলিম মিল্লাতের বড় একটা অংশকে ভোগ-বিলাস আর গৃহমুখী হতে উদ্বুদ্ধকরণ। ১০. মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের ওপর পরিকল্পিত যুদ্ধ এবং অবরোধ চাপিয়ে দেয়া। ১১. মুসলমানদের মিশনারিজ দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে সন্ন্যাসী, সুফিবাদ ইত্যাদি মতাদর্শ লালনে প্রয়োজনীয় (Back-up) দেয়া। ১২. বহুত্ববাদ, প্রজাতন্ত্র, রাজতন্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র, গণতন্ত্র, সংস্কারবাদ, পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, মানবাধিকার ইত্যাদির শ্লোগান মুখরে ব্যস্ত রেখে মুসলমানদের খেলাফত প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গির কবর রচনাকরণ; ইত্যাদি। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো, শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্ব রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষমতায়ন, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, চুক্তি ইত্যাদির সংরক্ষণ-সম্প্রসারণে পশ্চিম- ইউরোপসহ বিভিন্ন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে তাদের সভ্যতা- সংস্কৃতি, ধর্মের আদলে কোররাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি ব্যাপকাকারে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়Ñ ১. যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইত্যাদি কোররাষ্ট্র গড়ে তুলেছে এবং অবশ্যই এক্ষেত্রে কোররাষ্ট্রের সীমানায় প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে এড়িয়ে (আড়রফ) যাওয়া হয়েছে। ২. সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী রাশিয়া নিজম্বার্থে কোররাষ্ট্র গঠনে তৎপর হয়ে বুলগেরিয়া, বেলারুশ, গ্রিস, সার্বিয়া, ইউক্রেন, সাইপ্রাস, আর্মেনিয়া ইত্যাদি সম-সভ্যতা, সংস্কৃতিসম্পন্ন রাষ্ট্রসমূহকে কাছে টানতে তৎপর হয়েছে। ৩. সিনিক সভ্যতা ধারণ করে চীন তার সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গী হংকং, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড- ইত্যাদি রাষ্ট্রের সাথে সার্বিক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রয়াস হয়; যা প্রকারান্তরে সিনিক সভ্যতার আদলে কোররাষ্ট্র গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। এখানে উল্লেখ্য যে, মুসলিম গোষ্ঠীর মত নিজস্ব সভ্যতা- সংস্কৃতি লালনকৃত জাপান এবং ভারতের বিশ্ব নেতৃত্ব দেয়ার মত সমুদয় সকল সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও তারা পূর্ণ কোররাষ্ট্র গঠনে ব্যর্থ। মুসলিম শাসকগোষ্ঠী এবং মুসলমানদের মনে রাখা দরকার,- সভ্যতা-সংস্কৃতি এমন এক ধরনের আদি এবং শক্তিশালী উপাদান যা বিশ্ব সংসারে গোত্র, সমাজ, রাষ্ট্র গঠনের (অর্থাৎ শাসন ক্ষমতা প্রাপ্তি এবং প্রতিষ্ঠার) সম্পর্ক নির্ধারণে রক্তের সম্পর্কের পরপরই এটি মূল হাতিয়ার হিসেবে আবশ্যক হয়। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম সভ্যতা- সংস্কৃতি লালনকৃত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ নিয়ে একটি কোররাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব বলে আমার মনে হয়। যা আগামীর অসহিষ্ণু বিশ্ব মুসলমানদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং তাদের অধিকারসমূহ আদায়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে

বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা কে বাঁধবে? এক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য পছন্দনীয় বা বিবেচ্য যা হতে পারে তা হলো- ১. পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া মূলত ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তা ছাড়া ‘দক্ষিণ এশীয় ধারার ইসলামধর্মী’ এদেশটিতে বিদ্যমান মিশ্র সংস্কৃতি দেশটির মুসলিম কোররাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে তোলে। ২. মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রে এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হয়েও মিসর তার দরিদ্রতা, বিজ্ঞানভিত্তিক অনগ্রসরতা; উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্থনৈতিক নির্ভরতার কারণে মুসলিম কোররাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ। ৩. সার্বিক যোগ্যতা থাকা সত্তে¡ও শিয়া-সুন্নি ভাগাভাগি ইরানের কোররাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনাকে অসম্ভব করে তুলেছে। যেহেতু মুসলিম বিশ্বের ৯০ ভাগ মুসলমান সুন্নি। ৪. যোগ্যতার নিরিখে পিছিয়ে না থাকলেও দরিদ্রতা, নৃগোষ্ঠীক দ্ব›দ্ব, আঞ্চলিক বিবাদ, আন্তঃ রাজনৈতিক অস্থিরতা মুসলিম কোররাষ্ট্র গঠনে পাকিস্তানের সমূহ এ সম্ভাবনাকে লীন করে দেয়। ৫. ১৯৭০-১৯৮০ এর দশকে মুসলিম বিশ্বে একক প্রভাবশালী সৌদি আরব নিজ রাজতন্ত্র ধরে রাখতে এবং বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বের তল্পিবাহক হওয়ায় মুসলিম কোররাষ্ট্র গঠনের যোগ্যতা হারায়। ৬. ইতিহাস, ঐতিহ্য, কাক্সিক্ষত জনসংখ্যা-অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ঐক্যানুভূমি- সামরিক শক্তি- সামর্থ্যরে নিরিখে যে দেশটি মুসলিম কোররাষ্ট্র গঠনে বর্তমান যোগ্যতা রাখে সেটি হলো তুরস্ক।

স্পষ্টভাবে বলতে গেলে বর্তমান বিশ্বে একটি মুসলিম কোররাষ্ট্র গঠনে প্রতিটি মুসলিম দেশের তুরস্কের নেতৃত্বে এগিয়ে আসা আবশ্যক বলে আমার কাছে মনে হয়। যদিও মতপার্থক্য, ভেদাভেদ ইত্যাদি আছে এবং থাকবে তথাপি মুসলমানদের নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থে এবং কল্যাণে এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। যা প্রকারান্তরে মুসলিম সালতানাত তথা খিলাফত পুনঃজাগরণের প্রারম্ভিকা। লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির