আমরা প্রায়ই শুনি ও দেখি পিতা-মাতা দ্বীনদার অথচ তাদের সন্তান-সন্ততি দ্বীন মানে না বা অনেকেই আছেন দ্বীনের কট্টর দুশমন। অথচ মুমিনদের প্রার্থনা, ‘হে আমাদের রব! তুমি আমাদের স্ত্রী (স্বামী) ও সন্তানদেরকে নয়নশীতলকারী বানাও এবং আমাদের করে দাও মুত্তাকিদের ইমাম।’ (সূরা ফুরকান : ৭৪) একজন মুসলিম পিতা-মাতার কাছে তাদের সন্তান ইসলামের প্রতি উদাসীন বা বিরোধী হওয়া বড়ই কষ্টের। এমন পিতা-মাতা খুব কমই আছে যারা চায় তাদের পুঁজি (সন্তান-সন্ততি) সব ব্যাংকে জমা থাকুক এবং যখন যেটা প্রয়োজন হবে কাজে লাগাবে। ইসলাম বিজয়ী হলে ইসলামের পক্ষের সন্তানকে সামনে ধরবে, আবার ইসলামের শত্রুরা বিজয়ী হলে ইসলাম না মানা ছেলেকে এগিয়ে দিবে। এমন চরিত্র কারো যদি থেকে থাকে তাহলে সে একজন নিরেট মুনাফিক বৈ আর কিছু নয়। ঈমান গ্রহণকারী একজন ব্যক্তির প্রথম কাজ হলো তার স্ত্রী/স্বামী, সন্তান-সন্ততি ও নিকটবর্তী লোকজনকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া। আল্লাহর বাণী, ‘হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা নিজেদের ও পরিবার-পরিজনদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, যার জ¦ালানি হবে মানুষ আর পাথর।’ (সূরা তাহ্রিম : ৬) রাসূল সা. আল্লাহপাকের সেই নির্দেশ অনুসারে প্রথমেই তাঁর পরিবার-পরিজন ও নিকটতম লোকদের নিকট দাওয়াত প্রদান করেছিলেন। রাসূল সা.-এর দাওয়াতে প্রথম ঈমান এনেছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী ও আমাদের মা খাদিজা রা.। তারপর তাঁর পরিবারের সদস্য কিশোর আলী রা. ও প্রিয় বন্ধু আবু বকর রা.। ঘরে যদি স্বামী/স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি ইসলামের পক্ষে হয়ে থাকে তবে সেটি হয় বড় প্রশান্তির; সেটি হয় পিতা-মাতার পরম চাওয়া ও পাওয়া। সন্তান-সন্ততির গড়ে ওঠার ভিত্তি হলো পরিবার। পারিবারিক শিক্ষাই সন্তানকে শিশু অবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে ইসলামের পথে চলার ক্ষেত্রে প্রেরণা জোগায়। রাসূল সা.-এর একটি হাদিস- ‘প্রত্যেকটি মানব শিশু ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে। তারপর তাদের পিতা-মাতা তাদেরকে ইহুদি, খ্রিষ্টান বা মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলে’। এতে বোঝা যায়, সন্তান কেমন হবে তা বহুলাংশে নির্ভর করে তার পিতা-মাতার আচরণ ও পারিবারিক পরিবেশের ওপর। সন্তানের লালন-পালন, লেখাপড়া, ভালো চাকরি বা প্রতিষ্ঠা লাভ বা বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে বাবা-মা যতখানি আন্তরিক, নৈতিক চরিত্র তথা দ্বীন শিক্ষাদানে ততখানি আন্তরিকতা অনেকের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। অথচ রাসূল সা. বলেছেন, ‘সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষাদান অপেক্ষা পিতা-মাতার দেয়ার কিছুই নেই’। নৈতিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নামায অনন্য। নামাযের উপকারিতা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই নামায মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে।’ আল্লাহর রাসূল সা. সন্তানকে নামায শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে জোর তাগিদ দিয়েছেন। আমাদের মসজিদগুলো সব শিশুশূন্য। মনে হয় এ জাতি যেন বন্ধ্যা হয়ে গেছে। অথচ রাসূল সা. তাদেরকে নামাযে অভ্যস্ত করা ও দশ বছর বয়সে উপনীত হলে হালকা মারপিটের কথাও বলেছেন। সন্তান স্কুলে না গেলে বা লেখাপড়ায় গাফিলতি করলে আমরা যতখানি পেরেশানি অনুভব করি, নামায না পড়লে মনে হয় না তেমন কষ্ট অনুভব করি। অথচ এই সন্তান জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের পাশাপাশি যদি অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে তখন সে তার দুনিয়া ও আখিরাত দু’টি হারায়। সন্তানদের নৈতিক অধঃপতন বা ইসলামবৈরী আচরণের কিছু কারণ এখানে উল্লেখ করতে চাই। আমার আলোচনায় নাস্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ বা তথাকথিত প্রগতিশীল (ধর্মহীন) ব্যক্তিবর্গ বিবেচনায় নেই। ধর্মপরায়ণ হিসেবে পরিগণিত এমন ব্যক্তিকে নিয়েই আমরা আলোচনা।
ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ না করা
আমাদের সমাজে এমন অনেকেই আছেন যারা আচার-আচরণে অত্যন্ত ধার্মিক। নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাতসহ সকল আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগিতে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামকে মেনে চলার ক্ষেত্রে বেশ দুর্বল। এই শ্রেণির মুসলমানের সন্তানরা সাধারণত সেক্যুলার ধ্যান-ধারণায় অভ্যস্ত হয়ে থাকে।
সন্তানদের সামনে পিতা-মাতাকে আদর্শ হিসেবে পেশ করতে না পারা
সন্তান পিতা-মাতাকে খুব নিকট থেকে দেখে। ইসলামের দায়ী অথচ তার আচার-আচরণ, লেন-দেনে যতখানি স্বচ্ছতা থাকা দরকার সন্তানরা সেটি না পেলে পিতা-মাতার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং এই অনাগ্রহ অনেক সময় ইসলামের ওপর চলে আসে। আল্লাহর জিজ্ঞাসা- ‘এমন কথা কেন বলো যা নিজেরা করো না? এটি আল্লাহর কাছে বড়ই ক্রোধ-উদ্রেককারী বিষয়, তোমরা যা বলো তা নিজেরা করো না।’ (সূরা সফ : ০৩)
ঘরে ইসলামের অনুশাসন না মানা
ঘরগুলোকে কবরখানায় পরিণত না করা প্রসঙ্গে রাসূল সা. নফল নামায ঘরে পড়ার তাগিদ দিয়েছেন। এতে বাচ্চারা বাবা-মাকে অনুসরণ করে নামাযে অভ্যস্ত হতে পারে। অনেক পর্দানশিন মা ছোট্ট মেয়েকে শখ করে পুরুষের পোশাক শার্ট-প্যান্ট বা টাইট পোশাক পরিধান করিয়ে থাকেন। আবার অনেক মাকে দেখা যায় নিজে নেকাব পরিধান করে স্কুলপড়–য়া মেয়েকে পর্দাহীন অবস্থায় সাথে নিয়ে চলেন। সেই মেয়ে মা’র দৃষ্টিতে এখনো ছোট। কিন্তু মেয়ে এভাবে চলায় অভ্যস্ত হলে এক সময় বাবা-মা চাইলেও পর্দা মানাতে সক্ষম হবে না।
হারাম উপার্জন
আনুষ্ঠানিক ইবাদত পালনে অভ্যস্ত এমন অনেকে আছেন যাদের রুজি হালাল নয়। এমন ধরনের লোকের সন্তানরা সাধারণত বাড়তি অর্থ পেয়ে ইসলাম থেকে দূরে সরে যায়।
পরিবারে সময় না দেয়া
একজন মানুষের ওপর তার নিজের, স্ত্রী/স্বামী, সন্তান ও পরিবারের হক রয়েছে এবং তাদের হক আদায় দ্বীনেরই অংশ। এই বোধ-উপলব্ধি আমরা অনেক সময় হারিয়ে ফেলি। এমতাবস্থায় পিতা-মাতার সাথে সন্তানের বন্ধন হালকা হয়ে যায় এবং পিতা-মাতাকে বন্ধু হিসেবে না পেয়ে বাইরে বন্ধু তালাশ করে। ইসলামবৈরী হওয়ার ক্ষেত্রে এটিও একটি কারণ।
রূঢ় আচরণ
শাসন করার নামে সন্তানের সাথে পিতা-মাতার রূঢ় ও কর্কশ ব্যবহার অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়।
পিতা-মাতা যথাযথ দায়িত্ব পালনের পরও অনেক সময় সন্তানরা চোখশীতলকারী না হয়ে চোখের কাঁটা হয়ে থাকে। অনেক নবী-রাসূলের স্ত্রী ও সন্তানরাও তাঁদের কষ্টের কারণ হয়েছিল। নূহ (আ)-এর ছেলে, লুত (আ)-এর স্ত্রী ও আসিয়া (আ)-এর স্বামীর উদাহরণ আমাদের সম্মুখে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী- হে ঈমানদাররা! তোমাদের স্ত্রী/স্বামী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। অবশ্য তোমরা যদি তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দাও, তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করো, তাদের মাফ করার নীতি অবলম্বন করো, তাহলে আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি একটি পরীক্ষা। আর কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে আছে বিরাট প্রতিদান।’ (সূরা তাগাবুন : ১৪-১৫) এখানে আল্লাহ নিজেই স্ত্রী/স্বামী ও সন্তানদের মধ্যে কাউকে শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তাদের থেকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। অর্থাৎ স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির কারণে আমরা যেন ঈমান ও নীতি-নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত না হই। কিন্তু আল্লাহ তাদের সাথে রূঢ় আচরণ করতে বলেননি বা সন্তানকে ত্যাজ্য বা স্ত্রী/স্বামী থেকে বিচ্ছেদ হতে বলেননি। এমনটি করলে তো সংশোধনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। বরং আল্লাহ বলেছেন, তাদেরকে ক্ষমা করতে ও দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করতে এবং বিনিময়ে আল্লাহকে পাওয়া যাকে অতীব ক্ষমাশীল ও দয়ালু হিসেবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক উন্নয়ন ও সন্তানদের সংশোধনের লক্ষ্যে আল্লাহ চান তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করতে ও ক্ষমা করতে। আল্লাহপাক নবী-রাসূলদের দৃষ্টান্ত আমাদের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন। নবীর স্ত্রী হয়েও নবীকে অস্বীকার ও শত্রুদের সাথে সম্পর্ক রাখার পর লুত (আ.) পরম ধৈর্য অবলম্বন করেছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব আসার পর লুত (আ.) স্ত্রীকে সাথে নিতে চাইলে আল্লাহ স্পষ্ট না করে দেন। ছেলে সম্পর্কে নূহ (আ.)-এর আচরণও তেমনি ছিল এবং নৌকায় উঠাতে চাইলে আল্লাহ স্পষ্ট নিষেধ করেন। আসিয়া (আ.) ফিরাউনের সকল নিপীড়ন-নির্যাতন নীরবে সহ্য করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়েছেন। আখিরাতে বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গ খুব সহজেই দুনিয়ায় না পাওয়ার বেদনা ও সকল দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে পরম ধৈর্য অবলম্বন করতে পারে। মু’মিনদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি সব সময় চোখশীতলকারী নাও হতে পারে। এজন্য হতাশ হয়ে তাদের সাথে রূঢ় আচরণ বা সম্পর্কচ্ছেদ নয়। বরং তাদেরকে হিকমত ও দরদের সাথে আল্লাহর পথে ডাকতে হবে এবং আল্লাহর শেখানো পন্থায় তাঁরই কাছে কাতরভাবে দোয়া করতে হবে, ‘হে আমাদের রব! তুমি আমাদের স্ত্রী (স্বামী) ও সন্তানদেরকে নয়ন শীতলকারী বানাও এবং আমাদের করে দাও মুত্তাকিদের ইমাম’। লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব:), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ
আপনার মন্তব্য লিখুন