কুরআনুল কারিমের একটি আয়াত অনেকেরই মুখে প্রায়ই শোনা যায়। তা হলো, “হে নবী, আমি তোমাকে সারাবিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি”। [সূরা আম্বিয়া : ১০৭] আমরা জানি তিনি যে যুগে, যে সময়ে ধরার বুকে আগমন করেছেন, সে সময়টি কতো ঘন—কালো—তমসাবৃত ছিলো। কতোটা উচ্ছৃঙ্খল আর পশুসুলভ জীবনাচারণ ছিলো সে যুগের মানুষদের। মানবিক শূন্যতায় কীভাবে কাতরাচ্ছিলো মানুষ, জুলুমের যাঁতাকলে কীভাবে পিষ্ট হচ্ছিলো মানবতা। অজ্ঞানতা, সীমাহীন মুর্খতা, সহস্র কুসংস্কার ও পাপাচারে নিমজ্জিত ছিলো জাজিরাতুল আরব। সেরকম একটি বর্ববর—পৈশাচিক—অমানবিক ও অন্যায়—অবিচারপূর্ণ সমাজকে এক সোনালি সভ্যতার তোরণের দিকে এগিয়ে নিতে পেরেছেন কীভাবে? কী এমন গুণ ছিলো তাঁর মধ্যে; যে গুণের প্রভাবে তিনি একটি প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থাকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে, সকালের সোনারোদ হয়ে, প্রভাতের রঙিন সূর্যের হাসি হয়ে উষার আকাশে উদিত হলেন মুক্তির দূতরূপে? মানবতার মহান বন্ধুরূপে? এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ অবশ্যই রয়েছে। তাই না? প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো মহান আল্লাহর অপার—অসীম অনুগ্রহ। কিন্তু এর পাশাপাশি তাঁর ভেতরে মানুষ হিসেবেও ছিলো অগণিত গুণাবলির সমাহার। আজ আমরা মহানবী মুহাম্মাদ ﷺ—এর কিছু গুণাবলি আলোচনা করবো। ইনশাআল্লাহ!
সর্বশ্রেষ্ঠ ইনসাফকারী ও শান্তিকামী ব্যক্তিজীবনে মুহাম্মাদ ﷺ সব সময়ই ছিলেন ইনসাফকারী—শান্তিকামী। অন্যের অধিকারের ব্যাপারে ছিলেন সদা তৎপর। আমরা জানি, তিনি যখন দুগ্ধ পান করার বয়সী ছিলেন, সে সময়েও কিন্তু তিনি একটি স্তন থেকে পান করতেন। অন্যটি তাঁর দুধ ভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। কখনো জোর করেও তাঁকে অন্যটি থেকে পান করানো যায়নি। যখন কৈশরে পদার্পণ করলেন; তখন তাঁদের সমাজের রাহাজানি, বেহায়াপনা, গোত্রে গোত্রে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ—সংঘাত দেখে তিনি খুব কষ্ট পেতেন। তিনি তাঁর সমাজের সেসব অসঙ্গতি নিয়ে ভাবতেন। ভাবতেন, তাদেরকে এসব থেকে কীভাবে রক্ষা করা যায়! সে কারণে তিনি তাঁর সমচিন্তার লোকজনকে সাথে নিয়ে গড়ে তুললেন “হিলফুল—ফুযুল” নামক একটি শান্তিসংঘ। সে সংঘটি দুর্বলদের নিরাপত্তা বিধান করা এবং মানুষকে গোত্রে—গোত্রে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধসমূহ থেকে নিবৃত করার কাজে দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করেছিলো। ইতিহাস যার সাক্ষী।
মদিনায় যখন রাষ্ট্রনায়ক হলেন, তখন তিনি সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা—ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছেন। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তার অধিকার খর্ব করে, তাকে কষ্ট দেয় এবং তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক নিয়ে যায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করবো।’’ [আবু দাঊদ—৩০৫২] একবার একজন মুসলিম এবং অমুসলিমের একটা বিচার এসেছে রাসূলুল্লাহ ﷺ—এর কাছে। তিনি সব কিছু শুনে—পর্যবেক্ষণ করে রায় দিলেন অমুসলিমের পক্ষে। [তাফসীরে ইবনে কাসীর : ৪র্থ খন্ড, সূরা নিসা : ৬৫ ] আদল—ইনসাফের ক্ষেত্রে তিনি কতোটা আপোষহীন ছিলো এই ঘটনা থেকে তা স্পষ্ট—ই বুঝা যায়। সত্য—ন্যায়—ইনসাফ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে যদি নিজ দলের, নিজ অনুসারীর বিপক্ষেও যাওয়া লাগে, তাহলে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ তা—ই করতেন। হুদাইবিয়ার সন্ধির যে চুক্তিগুলো; সে চুক্তিগুলোর দিকে তাকান, সেখানে মুশরিকদের যে অমূলক—অনভিপ্রেত দাবি, সে দাবিসমূহ তিনি কী সহজেই না মেনে নিয়েছেন। হুদাইবিয়ার ঘটনা ও চুক্তির ধারাগুলোই প্রমাণ করে মুহাম্মাদ ﷺ কতোটা মানবিক ছিলেন। ছিলেন কতোটা সহনশীল ও শান্তিকামী। বাহ্যিক দৃষ্টিতে সাময়িক পরাজয় এবং কষ্টকে মেনে নিয়েও কীভাবে সংঘাতকে এড়িয়ে গিয়েছেন।
দাসদের সাথে সন্তান সূলভ ব্যবহার আমরা বাসা—বাড়িতে কাজের লোক রাখি না? অনেকেই রাখি। তাদের সাথে আমাদের ব্যবহার কেমন হয়? কিরূপ আচরণ করি আমরা তাদের সঙ্গে? অধিকাংশই খুব বেশি ভালো আচরণ যে করি তা নয়। আমরা যদি অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হই, তাহলে দেখা যায় যে সেখানেও অধীনস্থদের সঙ্গে খুব বেশি সুন্দর আচরণ করি না। কিন্তু নবীজির আচরণ, তাঁর মানবতাবোধ এতোটাই উন্নত ছিলো যে, দাস পর্যন্ত স্বাধীন জীবনের তুলনায় তাঁর অধীন থাকতে বেশি পছন্দ করতো। এবং সেটাকে গৌরবের বিষয় বলেই মনে করতো। যেমন যায়িদ বিন হারিস রা.; তাঁকে খাদিজা রা. নবীজির জন্য সেবক হিসেবে উপহার দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তাঁর সঙ্গে দাস সূলভ আচরণ কখনোই করলেন না। যখন যায়িদ রা.—এর পিতা এবং চাচা মিলে তাঁকে অর্থের বিনিময়ে আজাদ করে নিতে আসলেন, তখন কিন্তু তিনি তাদের সাথে গেলেন না। থেকে গেলেন নবীজির সঙ্গে। এতে তাঁর বাবা—চাচা যখন বিস্মিত হয়ে বললো “যায়িদ, তোমার সর্বনাশ হোক! পিতা—মাতাকে ছেড়ে তুমি দাসত্ব বেছে নিলে?’ জবাবে তিনি বললেন; “এ ব্যক্তির মাঝে আমি এমন কিছু দেখেছি, যাতে আমি কখনো তাঁকে ছেড়ে যেতে পারিনা।’’ [আসহাবে রাসুলের জীবন কথা]
অখ্যাতকে বিখ্যাত ব্যাক্তির মর্যাদা ইথিওপিয়া থেকে আগত একজন কালো—দাসী নারী ছিলেন। তিনি নারী পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন, এবং তারপর নিয়মিত মাসজিদে নববীতে ঝাড়ু দিতেন। আল্লাহর রাসূল সা. সেই মহিলাটিরও নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। একদিন সকালে ওঠে তিনি তাঁকে আর দেখতে পাননি। সাহাবীদের কাছে জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পারেন মহিলাটি ইন্তিকাল করেছেন। এবং উক্ত মহিলার দাফন কার্যও শেষ। রাত গভীর হওয়ায় তাঁকে ডাকেননি ঘুম থেকে। এতে নবীজি ﷺ সাহাবাদের ওপর অসন্তুষ্ট হন। পরবর্তীতে তিনি আরেকটি জানাজার সালাত আদায় করেন মহিলাটির জন্য। ইসলামের ইতিহাসে সেদিন সেটাই ছিলো প্রথম কোনো মানুষের জন্য দ্বিতীয় জানাজা। দেখুন, এই যে দ্বিতীয় জানাজা, এটা কোনো বিশেষ ভিআইপি ব্যক্তিবর্গের জন্য নয়। নিতান্তই সাধারণ একজন নারীর জন্য। যে মানুষটি ছিলো কুচকুচে কালো ও দাসী। গরীব। অসহায়। সামাজিকভাবে অগুরুত্বপূর্ণ। [বুখারি—৪৩৯]
সহকর্মীদের ভুলগুলো উপেক্ষা উহুদ যুদ্ধের কথা আমরা সকলেই জানি। কিছু সংখ্যক সাহাবীদের ভুলে নিশ্চিত বিজয় হয়ে যায় হাতছাড়া। স্বয়ং নবীয়ে রহমত—রহমাতাল্লিল আ’লামিন নিজেও প্রচণ্ড আহত হয়। তিনি হারান তাঁর দাঁতও। কিন্তু তবুও তিনি সেই সাহাবীদের সাথে কর্কশ ব্যবহার—রূঢ় আচরণ করেননি। তাঁদের প্রতি ছিলেন রহম দিল। উহুদ যুদ্ধের যে পরিস্থিতি, সেরকম পরিস্থিতিতে যেকোনো সেনানায়ক নিজ—অধীন সৈনিকদেরকে ভুলের জন্য নিন্দে করা—বকাঝকা করাটা ছিলো অতি স্বাভাবিক। কিন্তু নবীজি ﷺ এসবের কিছুই করলেন না। বিষয়টি কুরআনুল কারিমে এভাবেই এসেছে “অতএব আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণে আপনি তাদের জন্য ন¤্র ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী হয়েছিলেন। যদি আপনি তিক্ত স্বভাব এবং কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে যেতো। সুতরাং তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। তাদের জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করুন। [সূরা আলে—ইমরান : ১৫৯]
সাথীদের প্রতি সহমর্মিতা একবার জারির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. নবীজির একটি দারসে উপস্থিত হন। সেই দারসে এতো বিপুল পরিমাণ মানুষের সমাগম হয়েছে যে, তাঁর ঘরে আর কোনো জায়গা অবশিষ্ট্য ছিলো না। তখন জারির রা. বাহিরে—মাটিতে বসে পড়েন। তা দেখে মুহাম্মাদ ﷺ নিজ গায়ের চাদরটা গুছিয়ে তাঁকে বসতে দেওয়ার জন্য তাঁর দিকে নিক্ষেপ করলেন। [আখলাকুন নবী] এই মানব দরদি মহামানব সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন, তোমাদেরকে যা কিছু কষ্ট দেয় তা তার নিকট খুবই বেদনাদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মু’মিনদের প্রতি করুণাসিক্ত এবং বড়োই দয়ালু।” [সূরা তওবা : ১২৮] সে কারণেই দেখা যাচ্ছে যে জারির রা.—এর মাটিতে বসতে কষ্ট হবে বা হচ্ছে বিধায় তিনি তা মানতে পারেননি। যার জন্যে নিজের পরিহিত চাদরটা খুলে তাঁকে বসতে দিয়ে দিলেন।
অতিশয় বিনয়ী ও ধৈর্যশীল বিনয়—ভদ্রতা আর ধৈর্য ছিলো নবীজির মাথার মুকুট। তাঁর সব কাজকারবারই ছিলো অতি—সাধারণ। অন্যদের থেকে তিনি নিজেকে আলাদা করে উপস্থাপন করতেন না। অথচ তিনি একজন রাষ্ট্র প্রধান, আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। যাঁর মর্যাদা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। সেই মানুষটিই যখন সাহাবায়ে কেরামের সাথে থাকতেন, তখন এমনভাবেই থাকতেন যে; অপরিচিত কেউ এলে জিজ্ঞেস করতে হতো “তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ কে?” [বুখারি—৬৩]
অনেক সময় কোনো কোনো বেদুঈন এসে তাঁর সাথে মারাত্মক অসৌজন্যমূলক আচরণ করতো। তিনি সেগুলো ধৈর্যের সাথে হাসিমুখেই সহ্য করতেন। একদিন নবীজি মোটা পাড়ের নাজরানী চাদর পরে হাটাবস্থায় এক বেদুঈন এসে প্রচণ্ড জোরে সে চাদর টান দিলো। হঠাৎ জোরে টান দেওয়ার কারণে নবীজির কাঁধে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গিয়েছে। এরপর বেদুঈন লোকটি বললো, তোমার কাছে আল্লাহর যে সম্পদ রয়েছে তা থেকে আমায় দিতে বলো। দেখুন, রাসূল ﷺ—এর কাছে সম্পদ চাইতে এসেছে বেদুঈনটি। তখন তিনি রাষ্ট্র প্রধান। তার উচিত ছিলো ভদ্রতা এবং বিনয়ের সঙ্গে চাওয়া। অথচ সে করে বসলো দুঃসাহসিক এক অমার্যিত—অভদ্র আচরণ। আমাদের শাসক কিংবা আমরা হলে কী করতাম? নিশ্চয়ই কঠিনভাবে তাকে শায়েস্তা করতাম। কিন্তু আল্লাহর রাসূল কিছুই করেনি। তিনি আরো উল্টো বেদুঈনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন এবং বাইতুলমাল থেকে তাকে কিছু দিয়ে দিতে বললেন। [বুখারি—৩১৪৯] মক্কার মহাবিজয়ের দিনেও প্রিয় নবী ছিলেন বিনয়ী। বিজয়ীর বেশে যখন মক্কায় প্রবেশ করছিলেন তখনও তাঁর চোখে—মুখে ছিলো না অহংকারের সামান্যতম ছাপটুকুনও। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর রা. বলেন, “রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহ প্রদত্ত বিজয় দেখে বিনয়ে মাথা এতোটাই নিচু করেছিলেন, যেনো তার দাড়ি বাহনজন্তুর পিঠ স্পর্শ করছিলো।” [সীরাতে ইবনে হিশাম]
তিনি জনগণকে তাঁকে ভয় পেতে বারণ করতেন আমরা যদি কোনো পদ—পদবীর অধিকারী হই, তখন আমরা চাই মানুষেরা তথা অধঃস্থনেরা আমাকে একটু সমীহ করে চলুক। ভয় পেয়ে চলুক। নবীজিও পদ—পদবীর অধিকারী ছিলো। একজন শাসকও ছিলেন। রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনায় অনেক মানুষের সমস্যা সমাধান করতে হতো। তাঁর কাছে অনেক অভিযোগ—অনুযোগ ও বিচার—আচার আসতো। অপরাধীদের বিচার করতে হতো। অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে হতো। কিন্তু সবাই তাঁর কাছে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আসুক কিংবা তাঁর ভয়ে কাঁপতে থাকুক এমনটি তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি জনগণকে তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকতে বারণ করতেন। নিজেকে তিনি জনগণের কাতারেই সাধারণ মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতেন। একবার এক লোক নবীজির সাথে কথা বলতে এলো। লোকটি তখন ভয়ে ভীষণ কাঁপছিলো। তিনি লোকটিকে বললেন, “শান্ত হও। আমি কোনো রাজা—বাদশা নই। আমি একজন সাধারণ নারীর সন্তান।” [ইবনে মাজাহ—৩৩১২]
পারিবারিক কাজে সহযোগিতা করতেন অনেকেই তো আছি আমরা, নিজেদের স্ত্রী—পরিজনের সাথে উত্তম আচরণ করি না। নিজেদেরকে পরিবারের দায়িত্বশীল কর্তা মনে না করে বাদশাহীসূলভ আচরণ করি। নবীজি ঘরে এলেও থাকতেন খুব সাধারণভাবে। নিজের কাজগুলো নিজেই করতেন। নিজ হাতে কাপড়ে তালি লাগাতেন। বকরির দুধ দোহন করতেন। নিজের জুতো ছিঁড়ে গেলে তা নিজেই ঠিক করতেন। নবীজি ঘরে কী করতেন তা উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রা.—কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বললেন, “তিনি পরিবারের কাজে সহযোগিতা করতেন।” [বুখারি—৬৭৬]
কোনো সাহায্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করতেন না আল্লাহর রাসূল ﷺ—এর কাছে যখন যে মানুষটি, যেভাবে কোনো সাহায্য চেয়েছে, কোনো কিছুর জন্য আবেদন করেছে; তিনি কোনো অবস্থাতেই কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না। নিজের কাছে না থাকলেও তিনি অন্যভাবে ম্যানেজ করে দিতেন। শায়খ আবু ইস্পাহানি রহিমাহুল্লাহ রচিত “আখলাকুন নবী” গ্রন্থে এমন একটি কাহিনি বর্ণিত আছে এক অভাবী ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে কিছু চাইলো। আল্লাহর রাসূলের কাছেও তখন কোনো কিছুই ছিলো না। তিনি সেই লোকটাকে বললো, তুমি আমার নামে বাকিতে কিনে নাও। তখন ওমর রা. রাসূল ﷺ—কে বলে বসলেন, হে আল্লাহর নবী! আল্লাহ তো আপনাকে সাধ্যের বাহিরে কিছু করতে নির্দেশ করেননি। আপনি কেনো নিজের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে নিচ্ছেন? একবার এক নারী নবীজিকে একটি চাদর উপহার দিলেন, তখন সেই চাদরটি একজন সাহাবী তাঁর কাছে চেয়ে বসে। রাসূল ﷺ উক্ত সাহাবীকে তা দিয়ে দিলেন। তখন অন্যান্য সাহাবাগণ উক্ত সাহাবীর প্রতি রেগে গেলেন। এবং বললেন “তুমি কাজটি মোটেও ঠিক করোনি। রাসূল ﷺ—এর প্রয়োজন ছিলো বলেই তো তিনি উপহারটি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তুমি তাঁর কাছে তা চেয়ে বসলে, অথচ তুমি জানো তিনি কাউকে কিছু চাইলে ফিরিয়ে দেয় না। তখন উক্ত সাহাবী বললেন; যেহেতু নবীজি এটি পরেছেন, তাই এই চাদর থেকে তাঁর বরকত হাসিলের জন্যই আমি এ কাজ করেছি, যাতে এ চাদরে আমার কাফন হয়। [বুখারি—৬০৩৬]
মানুষের সবধরনের বৈধ আবদারগুলো রক্ষা করতেন কনকনে শীতের সকালগুলোতেও মদিনার অনেক নর—নারী রাসূল ﷺ—এর কাছে পানির পাত্র নিয়ে উপস্থিত হতো। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো যেনো তাঁর পবিত্র হাতের ছোঁয়া দিয়ে তিনি তাদের পাত্রগুলো স্পর্শ করে দেন। তাদের আবেগের দিকে চেয়ে তিনি এমন শীতের মধ্যেও তা করতেন। আনাস রা. বলেন, মদিনার একটি ছোট্ট শিশুও নবীজিকে নিজের অভিযোগ শুনানোর জন্য তাঁর হাত ধরে যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারতেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ অসহায়—দুর্বলদের সাথে গিয়ে তাদের প্রয়োজন পূরণ করে দিতে অস্বীকৃতি জানাতেন না এবং একে নিজের জন্য অসম্মানেরও মনে করতেন না। [আলমু’জামুল কাবীর, তবারানী—৮১০৩]
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মজলুমের পাশে দাঁড়াতেন মানবিক মহাপুরুষ মুহাম্মাদ ﷺ, যিনি মাজলুমের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকিও নিতেন। যেমন মাক্কি জীবনের একটি ঘটনা। এক ইয়াতিম বাচ্চার ধনসম্পদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলো আবু জাহল। এই পাপিষ্ঠ ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করে তাকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করলো। বাচ্চাটি যখন বড়ো হলো, সে তার পিতার রেখে যাওয়া সম্পদের দাবি করলে আবু জাহল তাকে তাড়িয়ে দেয়। সে ফিরে আসার সময় মুশরিকরা ঠাট্টার ছলে নবীজিকে দেখিয়ে দিয়ে বলে ওই যে মুহাম্মাদ বসে আছে, তার কাছে যাও। সে তোমার সম্পদ থেকে উদ্ধার করে দেবে। সহজ—সরল বালকটি তাদের এহেন তাচ্ছিল্য উপলব্ধি করতে না পেরে চলে এলো মুহাম্মাদ ﷺ—এর কাছে। তিনি বালকটির কথাগুলো সবিস্তারে শুনে হাজির হলেন আবু জাহলের দরোজায়। আবু জাহল বালকটির সাথে নবীজিকে দেখেই হতচকিত হয়ে গেলো। আল্লাহর রাসূল সা. ছিলেন স্বল্পভাষী। অধিক কথা তিনি পছন্দ করতেন না। আবু জাহলের সাথে তিনি কথা না বাড়িয়ে বললেন এই বালকটির সম্পদ ফিরিয়ে দাও। আবু জাহলও সুবোধ বালকের মতো সোজা ঘরের ভেতর ঢুকে তার সমুদয় সম্পদ ফিরিয়ে দিলো। আরো একবার আবু জাহল একজন ব্যক্তি থেকে কিছু উট ক্রয় করে মূল্য পরিশোধ করেনি। লোকটি তখন কুরাইশ—নেতাদের কাছে বিষয়টি জানায়। কিন্তু কেউই তাকে সহযোগিতা করেনি। লোকটি আল্লাহর রাসূলের নিকট এই জুলুমের কাহিনি বললে রাসূল ﷺ সোজা আবু জাহলের কাছে গিয়ে বললেন, এই লোকটির পাওনা চুকিয়ে দাও। আবু জাহল সেদিনও বিনা বাক্যব্যায়ে লোকটির উটের মূল্য চুকিয়ে দিয়েছে। [ইবনে হিশাম] দেখুন, রাসূল ﷺ যে সময়ে আবু জাহলের সামনে গিয়ে মাজলুমদের পাশে দাঁড়ালেন, তখন কিন্তু ওনার কোনো শক্তি—সামর্থ্য ছিলো না। মুশরিকদের সাথে তখন তাঁর ঘোরতর দুশমনি। তিনি নিজেই নানাভাবে তাদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার। এদিকে আবু জাহল হলো মুশরিকদের নেতা। এ—সময় আবু জাহলের কোনো বিষয়ের প্রতিবাদ করা মানে সুনিশ্চিতভাবে তাদের আরো অধিক শত্রুতা ও হিং¯্রতার মুখোমুখি হওয়া। নিজ জীবনের বড়োসড়ো একটা ঝুঁকি নেওয়া। কিন্তু মাজলুমের প্রতি জালিমের জুলুম তাঁকে স্থির থাকতে দিলো না। তাই তো সব ভয়—বাঁধার দেয়াল ভেঙে—চুরে সাহসের সাথে আবু জাহলের মতো এক জাঁদরেল সমাজপতির সামনে জুলুমের প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।
নিজেকে জাহিরের জন্য কৃত্রিমতার আশ্রয় নিতেন না মুহাম্মাদ ﷺ—এর পুত্র ইবরাহিম যেদিন মারা যান, সেদিন সূর্যগ্রহণ হয়। আরবব— প্রাচীন কুসংস্কার অনুযায়ী চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো যে, মুহাম্মাদের সন্তানের মৃত্যুতেই সূর্যগ্রহণের মাধ্যমে আকাশ শোকাভিভূত হয়ে পড়েছে। দেখুন এ—সময় প্রিয় নবীজির জবাব কী ছিলো, তিনি বলেছেন, ‘‘চন্দ্র—সূর্য আল্লাহরই নিদর্শন, কারো জীবন—মরণের সঙ্গে এগুলোর গ্রহণ লাগা কিংবা না লাগার কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। এর দ্বারা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সতর্ক করেন। অতএব যখন গ্রহণ লাগে, তখন তোমরা আল্লাহর জিকিরে মশগুল হও। যতোক্ষণ না তা আলোকিত হয়ে যায়।” [মুসলিম—১৯৭২] তিনি কিন্তু ইচ্ছে করলেই পারতেন নিজের এমন কেরামতি জাহির হওয়া দেখে চুপচাপ বসে থাকতে। তবুও তিনি তা করলেন না। সূরা আবাসার দিকে যদি তাকাই, এর প্রথম দিকের আয়াতগুলো নাজিল হয়েছে কিন্তু তাঁকে সংশোধনী দিয়েই। তবুও তিনি কোনো লুকোচুরি না করে মানুষের সামনে তা তুলে ধরলেন, যেনো মানুষ তা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।
চরম শত্রুদেরকেও ক্ষমা করতেন মক্কা বিজয়ের পরে রাসূল ﷺ ভয়ে জড়োসড়ো কুরাইশদের উদ্দেশ্যে ভাষণের একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করেন; “হে কুরাইশগণ, আমার কাছে আজ তোমরা কীরূপ আচরণ প্রত্যাশা করছো?” তাদের মধ্যে চলছিলো তখন পিনপতন নীরবতা। অবশেষে নীরবতা ভেঙে কুরাইশদের মাঝ থেকে ইসলাম ও প্রিয় নবীর তৎকালীন চরম দুশমনশ সোয়াহিল ইবনে আমর বলে উঠলো, ‘আপনি আমাদের মহানুভব ভাই এবং সম্মানিত ভ্রাতুষ্পুত্র! আপনার কাছে আমরা শুধু ভালো আচরণই প্রত্যাশা করি!’ এই সোয়াহিল ইবনে আমর মক্কা বিজয়ের দিন ভোরেও অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো মুসলিমদের ওপর। যদিও পরবর্তীতে খালিদ বিন ওয়ালিদের প্রতিরোধে সে পালিয়ে গিয়েছিলো। অথচ এখন তার কণ্ঠ থেকেই কিনা ভেসে এসেছে প্রাণ বাঁচানো এই নিবেদন। বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ তখন দৃপ্ত ও দীপ্ত কণ্ঠে বললেন, “আজ এসময়ে আমি আমার ভাই ইউসুফ (আ) যে কথাটি তাঁর ভাইদের প্রতি বললো, আমিও তোমাদেরকে তা—ই বলছি; তোমাদের কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করা হলো। তোমরা সবাই মুক্ত।” [আর—রাহিকুল মাখতুম] মুহাম্মাদ ﷺ—এর মহানুভবতায় কুরাইশদের ক্বলব থেকে সেদিন বংশ পরম্পরায় লালিত ঘৃণা—বিদ্বেষের বরফ মুহূর্তেই গলে গলে বাষ্প হতে শুরু করলো। তারা এতোটা মহানুভবতা আর আনুকূল্য পাবে বিজয়ী বীর বিশ্বনবী থেকে, তা ছিলো তাদের ভাবনা—কল্পনারও ঊর্ধ্বে। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সূলুল। হেন কোনো ষড়যন্ত্র নেই, যা সে রাসূলﷺ—এর জন্য করেনি। নিফাকির নজিরবিহীন উদাহরণ আছে তার বিরুদ্ধে। কতোভাবেই না আল্লাহর রাসূলকে সে কষ্ট দিয়েছে। একদিন দাওয়াতি কাজরত অবস্থায় নবীজিকে সে সরাসরিই বলেছিলো তুমি যা কিছু বলবে, তা কিছুতেই আমি ভালো মনে করবো না। এবং তা যদি সত্য—ও হয়, তবুও। [মা’আল মুস্তফা—১৫৯] তবুও কখনোই তিনি তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেননি। মৃত্যুকালে তার শিয়রে গিয়েছেন, মৃত্যুপরবর্তীতে নিজের জামা দিয়েছেন তার গায়ে, জানাজা পড়িয়েছেন।
এরকমই ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী। এমন অসংখ্য গুণাবলি আর মানবিক আচরণ দিয়েই জয় করলেন তিনি মানুষের হৃদয়কে। আর চিরতরে জাজিরাতুল আরবকে মুক্ত করলেন জাহিলিয়াতের শৃঙ্খল থেকে। সারা বিশ্বব্যাপী প্রস্ফুটিত করলেন দ্বীন—ইসলামের আলো।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন