post

মেধাবীদের অবমূল্যায়নে হলুদ মিডিয়ার কূটচাল

নূরুল ইসলাম

২৪ জুন ২০২২

আলোচনার শুরুতেই ‘হলুদ মিডিয়া’ শব্দটি কোথা থেকে এলো সেই গল্প দিয়েই শুরু করি। জোসেফ পুলিৎজার (১৮৪৭-১৯১১) ছিলেন একজন ইহুদি বংশোদ্ভূত হাঙ্গেরিয়ান নাগরিক। গৃহযুদ্ধ চলাকালে তিনি আমেরিকায় আসেন। তিনি ছিলেন একজন জাত সাংবাদিক। ছোটখাটো পত্রিকা চালিয়ে তিনি নিউ ইয়র্কে বসতি স্থাপন করেন। ১৮৮৩ সালে তিনি ‘দ্য নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকার মালিক হন। তিনি তার পত্রিকায় সংগ্রামী মানুষের জীবনী তুলে ধরতেন। অবশ্য তার নিজের জীবনেও ছিল অনেক ঘাত-প্রতিঘাত। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন নিউ ইয়র্কের পত্রিকা জগতের মিডিয়া কিং। কিন্তু তাকে অনুসরণ করছিলেন মিডিয়া জগতের আরেক দিকপাল ‘উইলিয়াম হাস্ট’। তিনি ১৮৮৭ সালে নিউ ইয়র্ক আসেন এবং ‘দ্য নিউ ইয়র্ক জার্নাল’ নামে পত্রিকাটি কিনে পুলিৎজারকে টপকাতে চাইলেন। শুরু হয়ে গেল দু’জনের মধ্যে অসুস্থ খেলা। পুলিৎজারের পত্রিকা ছিল ৮ পৃষ্ঠা; দাম ছিল ২ সেন্ট। অপরদিকে উইলিয়াম হাস্ট তার পত্রিকা ১৬ পৃষ্ঠা বানিয়ে দাম রাখল ১ সেন্ট। পুলিৎজারের পত্রিকায় কার্টুন আঁকতেন সে সময়ের বিখ্যাত কার্টুনিস্ট রিচার্ড আউটকাল্ট। হলুদ রঙের পোশাক পরিয়ে বাচ্চাদের মুখ দিয়ে খুব মুখরোচক কথা বলিয়ে নিতেন পুলিৎজার আর তাতে রং ঢং মেখে তৈরি করতেন রিচার্ড আউটকাল্ট। হলুদ রঙের কার্টুনটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

উইলিয়াম হাস্ট এ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বেশি বেতন দিয়ে রিচার্ড আউটকাল্টকে নিয়ে আসেন তার পত্রিকায়। হলুদ রঙের কার্টুন ছাপা হতে লাগল হাস্টের পত্রিকায়। হলুদ রঙের কার্টুনকে কেন্দ্র করে দুই সাংবাদিকের দ্বন্দ্ব পরবর্তীতে ‘ইয়েলো জার্নালিজম’ বা হলুদ ‘সাংবাদিকতা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আজও ভুয়া রংচং মাখা তোষামুদে সাংবাদিকতা ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ নামে পরিচিত। পুলিৎজার আর হাস্টের দ্বন্দ্ব নতুন রূপ পায় ১৮৯৮ সালে। কিউবার রাজধানী হাভানার উপকূলে ১৮৯৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজে আগুন লেগে ২৫০ জন নাবিক নিহত হয়েছিল। মার্কিন তদন্ত দল জানায় এটি ছিল জাহাজের অভ্যন্তরীণ যান্ত্রিক ত্রুটি। কিন্তু থামলেন না পুলিৎজার আর হাস্ট। তারা স্পেনকে দোষারোপ করে একটার পর একটা মিথ্যা গল্প বানাতে লাগলেন। কে কার চেয়ে বেশি মিথ্যা লিখে পত্রিকার শিরোনামকে আকর্ষণীয় করতে পারে সেটি ছিল তাদের টার্গেট। দুটি পত্রিকাই চলত লাখ লাখ কপি। আর পত্রিকার উপর ছিল মানুষের অগাধ বিশ্বাস। ফলে মার্কিন নাগরিকরা ক্ষেপে উঠল স্পেনের ওপর। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মার্কিন প্রশাসনের উপর চাপ প্রয়োগের দায় এই দুই সাংবাদিকের। কিন্তু মিথ্যে কখনো স্থায়ী হয় না। স্পেন-আমেরিকার যুদ্ধ শেষ হলে সাংবাদিকতার বাজার শেষ হয়ে যায়। উইলিয়াম হাস্ট পেশা বদল করে চলে যান হলিউডে। আর পুলিৎজার খুবই অনুতপ্ত হলেন। পরে তিনি ২ মিলিয়ন ডলার দান করেন কলম্বিয়া বিশ^বিদ্যালয়ে। এ টাকায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা কোর্স চালু হয়। ১৯১১ সালে পুলিৎজারের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর ১৯১৭ সাল থেকে সাংবাদিকতার সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার ‘পুলিৎজার পুরস্কার’ চালু করা হয়।

পুলিৎজার বা উইলিয়াম হাস্টের বিদায় হয়েছে ঠিকই কিন্তু সাংবাদিকতা জগতে তাদের দেখানো পথ বন্ধ হয়নি। এই পবিত্র পেশাকে কেন্দ্র করে নানা গোষ্ঠী নানাভাবে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। সবচেয়ে বড় আক্রমণের শিকার হচ্ছে ইসলাম আর আলেমসমাজ। বর্তমান মিডিয়ার সিংহভাগ তাদের দখলে থাকার কারণে যেভাবে ইচ্ছা রং মাখিয়ে দিনকে রাত আর রাতকে করছে দিন। জাতির জাগ্রত বিবেক বলা হয় সাংবাদিকদের। আর গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। অমর্ত্য সেন বলেছেন, যে দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না। আর নেপোলিয়নের বক্তব্য হচ্ছে, চারটি আক্রমণাত্মক সংবাদপত্র হাজারটা বেয়নেটের চাইতেও ক্ষতিকর। বর্তমান বাংলাদেশে হলুদ মিডিয়ার দখলে গোটা সাংবাদিকতা। ইসলাম ও ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে হেয়প্রতিপন্ন করার মহোৎসব চলছে দেশজুড়ে। নিজেদের অপকর্মকে লুকিয়ে রাখছে সাংবাদিকতার উর্দির নিচে। তার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত নিয়ে আজ আলোচনা করব। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধ অবস্থান নতুন কিছু নয়। তারা মনে করে মাদ্রাসা শিক্ষা ও মাদ্রাসার ছাত্রদের দমিত করতে পারলেই তাদের আদর্শ তারা খুব দ্রুতই বাস্তবায়ন করতে পারবে। তাই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার এতটুকু সফলতাও তারা সহ্য করতে পারে না। অথচ তারা বেমালুম ভুলে যায় এ উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পুরাতন ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। এ কারণে স্কুল, কলেজ আর বিশ^বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য যত টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় তার খুব কম অংশই মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় পড়লেও সরকারি মাদ্রাসার সংখ্যা মাত্র তিনটি। এত অবহেলার পরেও যখন তারা দেখে এই মাদ্রাসা থেকেই পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষায় বিশেষ করে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়সমূহে প্রতি বছরই মাদ্রাসার ছাত্রদের চান্স পাওয়ার পরিমাণ অবাক করার মত। তাও আবার প্রতি বছরই প্রায় মেধাতালিকায় প্রথম দিকে থাকছে মাদ্রাসার ছাত্ররা।

এ অবস্থা দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে আমি চোখের উপর একটি মাদ্রাসায় পরিণত হতে দেখছি। ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় রেজাল্টের উপর নম্বর থাকে ৮০; আর মাদ্রাসায় বোধ হয় নম্বর দেয়াই শুরু হয় ৯০ থেকে। মাদ্রাসার ছাত্রদের ইংরেজির ভিত খুবই খারাপ। মাদ্রাসায় যে ইংরেজি পড়ে আসছে তা ক্লাস ফোরের সমমান।’ যে কেউ এই শিক্ষকের মন্তব্য শুনে অকপটে বলে ফেলবেন এটি সুস্পষ্ট বৈষম্যের ইঙ্গিত এবং বিবেকহীন একটি বক্তব্য। পাশাপাশি এ বক্তব্য সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা বিরোধী একরোখা বক্তব্য। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কারো দয়ায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না বরং ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মেধার স্বাক্ষর রেখেই ভর্তি হয়। ২০২১ সালের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও সর্বোচ্চ নম্বর (১০০.৫) পেয়ে খ-ইউনিটে প্রথম স্থান অধিকার করেছে ঢাকার দারুন নাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসার ছাত্র জাকারিয়া সাখাওয়াত। উল্লেখ্য, এ বছর এসএসসি/সমমান এবং এইচএসসি/সমমানের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে মাত্র ২০ নম্বর বরাদ্দ ছিল। সুতরাং যোগ্যতার পরিচয় দিয়েই তিনি ঢাবিতে চান্স পেয়েছেন।

উক্ত ফলাফল ঘোষণার পরপরই বিভিন্ন মিডিয়ায় খবরটি প্রচারিত হতে থাকে। সাথে সাথে বাড়তে থাকে অসাধু কিছু কোচিংয়ের নগ্ন রূপ। জাকারিয়া মূলত কোচিং করেছিল ফোকাস বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ে। তাকে যখন কোচিং কর্তৃপক্ষ সংবর্ধনা দেয়ার জন্য নিয়ে আসে তখন ফোকাস কোচিংয়ে এসে আরেকটি কোচিংয়ের কর্তৃপক্ষ জাকারিয়াকে দিয়ে জোরপূর্বক ছবি তোলার জন্য সরকারি দলের সহযোগিতায় অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। একপর্যায়ে তাকে তারা আঘাত করতেও দ্বিধা করে না। মুহূর্তের মধ্যেই তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হলে আপাতত বিষয়টি সুরাহা হয়। এসকল ঘটনা প্রিন্টিং মিডিয়া খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে প্রচার করে। প্রথম আলো সেদিন শিরোনাম করে ‘ঢাবির খ-ইউনিটে পাস ১৬.৮৯%, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী প্রথম’। এ যেন এক আশ্চর্য ঘটনা!! অথচ ‘ক’ বা ‘গ’ ইউনিটের রেজাল্টের ক্ষেত্রে কখনই লেখে না যে, ‘কলেজ ছাত্র প্রথম’। মুসলমানদের এ দেশে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত একদল যোগ্য লোক যখন স্বাধীনতার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যখন নিজেদের তৈরি করছে তখনই শকুনের দৃষ্টি পড়ছে এ দিকে।

দুর্বল ছাত্ররাই মাদ্রাসায় পড়ে, দান বা অনুগ্রহে মাদ্রাসা চলে, মাদ্রাসার ছাত্ররা রাষ্ট্র পরিচালনার অযোগ্য বা মাদ্রাসায় জঙ্গি তৈরি হয়- এ শব্দগুলো মাদ্রাসার সাথে এখন আর মানানসই নয়। বরং এ কথা আজ প্রমাণিত যে, মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা আজ সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করে প্রতি বছর শত শত শিক্ষার্থী মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ^বিদ্যালয় ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাচ্ছে। তাদের অনেকে উচ্চতর গবেষণায় অংশ নিয়ে দেশের সম্মান বৃদ্ধি করছে। পাশাপাশি মাদ্রাসা ছাত্রদের একটি বড় অংশ সমাজের মানুষকে নৈতিকতাসম্পন্ন ও আল্লাহ ভীরুতার দিকে পরিচালিত করতে অবদান রাখছে। নৈতিক শিক্ষা ব্যতীত একটি জাতিকে সভ্য করে গঠন করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে নৈতিকতা বিবর্জিত উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা লাঞ্ছিত হয়, বদরুল আর ঐশীর মত ছেলেমেয়েদের জন্ম হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে, সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে, কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে যুবসমাজ আজ নৈতিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য জাতি হিসেবে আমাদের বোধটুকু জাগ্রত করার এখনই সময়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির