মোবাইল ব্যাংকিং ধারণা ও শরয়ী দৃষ্টিকোণ
সালেহ মো: ফয়সাল
০৪ নভেম্বর ২০১৫
মুসলিমবিশ্বের সর্বত্রই যখন প্রবল এক অস্থিরতা বিরাজমান তখন পুরো বিশ্বের সচেতন লোক মাত্রই নজর ছিল ১ নভেম্বরের তুরস্কের পার্লামেন্ট নির্বাচনের দিকে। এ নির্বাচনটি তুরস্কের জন্যও তো বটেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্যও। মুসলিমবিশ্বের প্রতিটি দেশের জনগণ সম্ভবত তাদের অবিসংবাদিত নেতা রিজেপ তায়েপ এরদোগানের জাস্টিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) এমনই একটি জয়ের প্রত্যাশা করেছিলেন। বাস্তবে হয়েছেও তাই। টানা চতুর্থবারের মতো পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল একে পার্টি।
প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই, ১ নভেম্বরের নির্বাচনটি ছিল একটি পুনর্নির্বাচন, যা গত ৭ জুন, ২০১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত তুরস্কের ২৫তম পার্লামেন্ট নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় এবং পরবর্তীতে কোয়ালিশন করতে ব্যর্থ হওয়ায় এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। ৭ জুনের নির্বাচন পরবর্তীতে তুরস্কের রাজনীতিতে কিছুটা অচলাবস্থা পরিলক্ষিত হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে প্রতিনিয়তই বোমা হামলা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড তুরস্কের সচেতন নাগরিকদেরকে বেশ চিন্তিত করে। সর্বশেষ রাজধানী আঙ্কারার নির্বাচনী সমাবেশে বোমা হামলায় শতাধিক নাগরিক নিহত হওয়ার প্রেক্ষিতে পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যায়। এ ছাড়া তুরস্কের অর্থনীতির চাকার গতিতেও বেশ শিথিলতা দেখা দেয়। ডলারের পরিবর্তে তুরস্কের মুদ্রা লিরার মানের ব্যাপক পতন ঘটে। সব মিলিয়ে নাগরিকরা ছিল অনেকটা উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তায়।
এ পরিস্থিতিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়েপ এরদোগান একটি অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্বকারী সকল দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেন। তুরস্কের প্রায় সকল শহরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে জনসচেতনতা তৈরিতে বিভিন্ন সমাবেশে প্রেসিডেন্ট নিজে উপস্থিত থেকে সফল করেছেন। অবশেষে ৮৫.১৮ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে এ নির্বাচনটি সত্যিই ছিল উৎসবমুখর এবং সফল একটি নির্বাচন। বড় ধরনের কোনো আশঙ্কা ছাড়াই নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়।
নির্বাচনে সকল জনমত জরিপকে ভুল প্রমাণিত করে ক্ষমতাসীন একে পার্টি ৪৯.৪৯% ভোট পেয়ে পার্লামেন্টে ৩১৭টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। যেটা গত ৭ জুনের প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে প্রায় ৯% বেশি। ঐ নির্বাচনে একে পার্টি ২৫৮টি আসন পেয়েছিল। উল্লেখ্য, ৫৫০ সদস্যবিশিষ্ট তুরস্কের পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠনে ২৭৬টি আসন দরকার হয়। নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলারিস্ট দল জেহেপে (ঈঐচ) ২৫.৩১% ভোট পেয়ে পার্লামেন্টে ১৩৪টি আসন লাভ করেছে। জাতীয়তাবাদী মুভমেন্ট মেহেপে (গঐচ) ১১.৯০% ভোট পেয়ে ৪০টি আসন এবং কুর্দিদের দল হেডেপে (ঐউচ) ১০.৭৬% ভোট পেয়ে ৫৯টি আসন লাভ করে। আর বাকি দলগুলো পেয়েছে ২.৫৪% ভোট। উল্লেখ্য, আনুপাতিক হারে আসনপ্রাপ্তির এ নির্বাচনপদ্ধতিতে কোন দল ১০% এর কম ভোট পেলে পার্লামেন্টে আসন পাওয়ার যোগ্য হয় না। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ নির্বাচনে তুরস্কের ১৬টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিলো।
বিশ্বপরিস্থিতি যখন আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে তখন এ নির্বাচনটির দিকে তাকিয়ে ছিল পুরো বিশ্ব। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এরদোগানকে ইসলামের নবসুলতান আখ্যা দিয়ে একে পার্টির নানা দিক নিয়ে প্রতিনিয়তই সমালোচনামুখর ছিল। অন্য দিকে মুসলিমবিশ্ব উৎকণ্ঠায় ছিল তুরস্কের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে। অবশেষে একে পার্টির এ জয়ে পুরো মুসলিমবিশ্ব কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তুরস্কের গণতন্ত্রীকামী সাধারণ মানুষ।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপর তুরস্কের সর্বত্রই জনগণের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়। তারা এরদোগান ও একে পার্টি নিয়ে মুহুর্মুহু শ্লোগান দিতে থাকে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়েপ এরদোগান নির্বাচনের ফলাফলের পর সাধারণ নাগরিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে, ফলাফলে আল্লাহর শুকরিয়া (আলহামদুলিল্লাহ) জ্ঞাপন করেন এবং নতুন তুরস্ক গড়তে সকলকে একসাথে কাজ করার আহবান জানান। একে পার্টির বর্তমান প্রধান ও তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী আহমদ দাওয়াতুলু এ ফলাফলকে গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেন এবং সবাইকে নিয়ে নতুন তুরস্ক গঠনে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষা পুনর্ব্যক্ত করেন।
বলাই বাহুল্য, একে পার্টি তুরস্কে ২০০২ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে এবং তারা “ভিশন-২০২৩”কে সামনে নিয়ে কাজ করছে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা চতুর্থবারের মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল এবং আগামী চার বছর তারা সরকার পরিচালনা করবে। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের ১০০ বছর পূর্তি হবে। ১০০ বছর পূর্তির তুরস্ক কেমন হবে সেটা নিয়েই একে পার্টির ‘‘ভিশন ২০২৩”। রূপকল্প ২০২৩ এ তুরস্কের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল এক পরিকল্পনা যা এরদোগানের একে পার্টি একে একে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
উসমানী খেলাফতের পতনের পর সেক্যুলারিস্ট ধারায় নতুন তুরস্ক প্রজাতন্ত্র গঠন করেছিলেন গাজী মোস্তফা কামাল (আতাতুর্ক)। পরবর্তীতে তিনি এবং তার তার দলের ক্ষমতাসীন সময়গুলোতে তুরস্ক থেকে ইসলামের চিহ্ন অনেকটা মুছেই গিয়েছিল। এরদোগান তার ক্ষমতার এই ১২-১৩ বছরে অনেকটাই পরিবর্তন করেছেন। তৈরি করেছেন প্রচুর মসজিদ, দাড়ি-হিজাব কিংবা ইসলামী পোশাকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে, তুরস্কের সেনাবাহিনীতে জামায়াতে নামাজ পড়ার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে, মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে উসমানী খেলাফতের ভাষা আরবি হরফে আবার চালু করা হয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে অধ্যয়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সর্বোপরি ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার পথ সহজ হয়েছে এবং ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ বিকাশে দুর্বোধ্যতা দূর হয়েছে।
এ দিকে এরদোগান তথা একে পার্টিকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জেরও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দল হিসেবে পার্লামেন্টে প্রবেশ করবে কুর্দিদের রাজনৈতিক দল হেডেপে (ঐউচ)। পূর্বে তারা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করলেও এবারই প্রথম সম্মিলিতভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে পার্লামেন্টে যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, কুর্দিদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র (ইরাক ও সিরিয়ার কুর্দি অঞ্চলসহ)। যারা দীর্ঘদিন তুরস্কের সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। পেকেকে তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী। এরদোগানই তাদের সাথে যুদ্ধবিরতি করেন এবং রাজনীতিতে সুযোগ করে দেন। তুরস্কের সিরিয়া সীমান্তবর্তী ১২টি জেলার এ কুর্দি অঞ্চল থেকে তারা এবার প্রায় ৭০% ভোট পেয়েছে। পার্লামেন্টে কুর্দিদের ৫৯টি আসন যেমন তাদের জন্য বড় অর্জন ঠিক তেমনি তুরস্কের ভবিষ্যতের জন্য চ্যালেঞ্জও। এরদোগান কিংবা একে পার্টি এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটা সফল হবেন এটা সময়ই বলে দেবে।
তুরস্কের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক মন্দা অবস্থার দ্রুত উন্নয়ন, সন্ত্রাস দমন, সিরিয়া থেকে আগত আড়াই মিলিয়ন শরণার্থীর যথার্থ পুনর্বাসনসহ আরো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে একে পার্টির সামনের দিনগুলোতে। ক্যারেসমেটিক লিডারশিপের এরদোগান ও একে পার্টির প্রধান আহমদ দাওয়াতুলু সবাইকে সাথে নিয়ে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নতুন তুরস্ক গঠনে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে সফল হবেন সেটাই সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : পিএইচডি গবেষণারত
গাজি ইউনিভার্সিটি
আপনার মন্তব্য লিখুন