post

রমাদানুল মুবারক তাকওয়া অর্জন ও প্রশিক্ষণের মাস

এ. এস. এম. মুজাহিদ

১৮ মার্চ ২০২২

হিজরিবর্ষের নবম মাসটির নাম রমাদানুল মুবারক। এই মাস সেসব নেয়ামতসমূহের মধ্যে একটি নেয়ামত যা আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহর জন্য দান করেছেন। ধনী-গরিব, বড়-ছোট, শহর-গ্রাম সকলের মাঝে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা নিয়ে আসে মাহে রমাদান। সিয়াম ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। নবী করিম সা. এ মাসটিকে “শাহরুন আযিম” এবং “শাহরুম মুবারক” নামে আখ্যায়িত করেছেন।র রমাদান মাস আমাদের জন্য বার্ষিক প্রশিক্ষণের মাস। মাহে রমাদান মুসলিম মিল্লাতের জন্য রহমতস্বরূপ এ মাসটি তাকওয়া অর্জন, আত্মগঠন, নৈতিক উন্নতি, চারিত্রিক দৃঢ়তা, পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর সমাজগঠন এবং সামাজিক সাম্যের মাধ্যমে ইসলামের আদর্শকে সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছানোর এক অনন্য সুযোগ। ইসলামের প্রত্যেকটা বিধানই নির্ভুল ও সর্বাঙ্গ সুন্দর।

সিয়ামের পরিচয়
সিয়াম শব্দটির অর্থ আত্মসংযম, কঠোর সাধনা, অবিরাম চেষ্টা ও বিরত থাকা ইত্যাদি। রমাদান শব্দটি থেকে নির্গত হয়েছে। এর অর্থ পুড়িয়ে ফেলা বা জ্বালিয়ে দেয়া। গোনাহকে পুড়িয়ে শেষ করে দেয় বলে এর নাম রমাদান। ইংরেজি পরিভাষায় হচ্ছে ঋধংঃরহম. সিয়াম ফরজ হয় রাসূল সা. এর নবুওয়াতের পনেরোতম বর্ষ দ্বিতীয় হিজরিতে।
রমাদান ও সিয়াম কুরআন মাজিদের শব্দ। রমাজান শব্দটি করআন মাজিদে একবার সূরা বাকারা ১৮৫ নম্বর আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে। আর সিয়াম (সাওম) শব্দটি ১৩ বার ব্যবহৃত হয়েছে। আয়াতগুলো হলো সূরা বাকারা- ১৮৩, ১৮৪, ১৮৫, ১৮৭, ১৯৬, ১৯৬; সূরা মরিয়ম- ২৬; সূরা নিসা- ৯২; সূরা মায়েদা- ৮৯, ৯৫; সূরা মুজাদালা- ৪; সূরা আহযাব- ৩৫, ৩৫।
ইসলামের পরিভাষায় সিয়াম বলা হয়: “সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়্যাতের সাথে সিয়াম ভঙ্গের কারণ সমূহ থেকে বিরত থাকা।”রর

সিয়ামের ঐতিহাসিক পটভূমি
ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকায় ‘সিয়াম’ প্রবন্ধের লেখক লিখিয়েছেন, “এমন কোন ধর্ম আমাদের স্মরণে আসে না যার ধর্মীয় নিয়ম-নীতির মাঝে অবশ্যই সিয়ামকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই। তিনি আরো বলেছেন, প্রকৃতই সিয়াম ধর্মীয় কর্মকাণ্ড হিসেবে সকল ধর্মের মাঝেই বিদ্যমান আছে।”iii
হযরত আদম (আ) থেকে হযরত নূহ (আ) পর্যন্ত প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে সিয়াম ফরয ছিল।iv
হযরত নূহ (আ) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন বাদে সারা বছর সিয়াম রাখতেন।v
‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সাওম হযরত দাউদ (আ)-এর সাওম, তিনি একদিন সাওম পালন করতেন এবং একদিন বিনা সাওমে থাকতেন। (মুসলিম-১১৫৯)
উচ্চবর্ণের হিন্দুরা একাদশী উপবাস পালন করেন।

আসমানি কিতাবসমূহ নাজিলের সময় vi
সকল কিতাব রমাদান মাসে অবতীর্ণ হয়।
ক. হযরত ইবরাহিম (আ) এর উপর সহিফাসমূহ নাজিল হয়েছে- রমাদানের প্রথম রাতে।
খ. হযরত মূসা (আ)-এর উপর তাওরাত নাজিল হয়েছে-
৬ রমাদান দিবাগত রাতে।
গ. হযরত দাউদ (আ)-এর উপর যাবুর নাজিল হয়েছে-
১২ রমাদান।
ঘ. হযরত ঈসা (আ)-এর উপর ইঞ্জিল নাজিল হয়-
১৩ রমাদান।
ঙ. হযরত মুহাম্মদ সা.-এর উপর আল-কুরআন নাজিল হয় - ২৪/২৭ রমাদান রাতে। vii

মাহে রমাদান আল কুরআন নাজিলের মাস
রমাদান মাসে সপ্তম আকাশের লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশের বায়তুল ইজ্জতে পবিত্র আল কুরআন একবারে অবতীর্ণ হয়েছে। সেখান থেকে আবার রমাদান মাসে অল্প অল্প করে নবী করীম সা.-এর প্রতি নাজিল হতে শুরু করে সুদীর্ঘ ২৩ বছর পর্যন্ত।
এ সম্পর্কে আল কুরআনে বর্ণিত হচ্ছে, “রমাদান মাস, এতে নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন, হিদায়াতস্বরূপ এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। (সূরা বাকারাহ : ২:১৮৫)
হামীম। এই সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ। আমি এটি এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাজিল করেছি। কারণ, আমি মানুষকে সতর্ক করতে চেয়েছিলাম। (সূরা দুখান : ৪৪:১-৩)
আমি এ (কুরআন) নাজিল করেছি কদরের রাতে। (সূরা কদর: ৯৭:১)

তাকওয়ার পরিচয়
তাকওয়া অত্যন্ত মূল্যবান মানবীয় গুণ, দ্বীনের প্রাণশক্তি এবং কাক্সিক্ষত সকল গুণের অনুপ্রেরণা। এটি এমন জিনিস যার মাধ্যমে সত্যের পথ পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআনে ‘তাকওয়া’ শব্দটি এসেছে ১৫ বার। এটি দৃশ্যমান বস্তু নয়, অন্তরের বিষয়। তাকওয়ার আভিধানিক অর্থ বাঁচা, রক্ষা করা, দূরে থাকা, বিরত থাকা ও সাবধান থাকা ইত্যাদি। যিনি তাকওয়া অবলম্বন করেন, তাকে বলা হয় মুত্তাকি। সিয়ামের সঙ্গে রয়েছে তাকওয়ার নিবিড় যোগসূত্র। সিয়াম মানুষদের তাকওয়ার গুণাবলি সৃষ্টি করে। আবু সাউদ (রহ) বলেন, ‘তাকওয়া হচ্ছে যা আখিরাতে ক্ষতি করে এমন বিষয় থেকে পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকা’। viii হযরত ওমার বিন আবদুল আযীয রহ. বলেছেন, দিনে সিয়াম রাখা কিংবা রাত্রে জাগরণ করা অথবা দুটোর আংশিক আমলের নাম তাকওয়া নয়। বরং তাকওয়া হচ্ছে, আল্লাহ যা ফরয করেছেন তা পালন করা এবং তিনি যা হারাম করেছেন তা থেকে দূরে থাকা।রী রাসূলুল্লাহ সা. ও তাকওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আবু যর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে বললেন, ‘তুমি যেখানেই থাক, আল্লাহকে ভয় কর’। x

তাকওয়ার ফলাফল
১. সুমহান প্রতিদান, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন- ‘তাদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করে এবং তাকওয়া অর্জন করে, তাদের জন্য রয়েছে সুমহান প্রতিদান।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৭২)
২. আল্লাহর বন্ধুত্ব লাভ, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন- ‘আর আল্লাহ মুত্তাকিদের বন্ধু।’ (সূরা জাসিয়া : ১৯)
৩. পাপমুক্তি লাভ, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং বিরাট প্রতিদানে ভূষিত করবেন।’ (সূরা তালাক : ৫)
৪. জান্নাতের সুসংবাদ, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন- ‘যদি আহলে কিতাব গোষ্ঠী ঈমান আনতো এবং তাকওয়া অবলম্বন করতো তাহলে আমি তাদের থেকে পাপসমূহ দূর করে দিতাম আর অবশ্যই তাদেরকে নেয়ামতে ভরা জান্নাতে প্রবেশ করাতাম।’ (সূরা মায়েদা : ৬৫)
৫. জাহান্নাম থেকে রক্ষা, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন- ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে জাহান্নাম অতিক্রম করবে না। এতো একটা স্থিরকৃত ব্যাপার, যা সম্পন্ন করা তোমার রবের দায়িত্ব। তারপর যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাদেরকে আমি বাঁচিয়ে নেবো এবং জালেমদেরকে তার মধ্যে নিক্ষিপ্ত অবস্থায় রেখে দেবো।’ (সূরা মারইয়াম : ৭১-৭২)

তাকওয়া অর্জন ও প্রশিক্ষণের মাসে করণীয়

ইসলামী শিক্ষা অর্জন : ইসলামী শিক্ষা হলো সকল প্রকার শিক্ষার মূল। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘সালাত কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং ফজরে কুরআন পড়ারও ব্যবস্থা করো। কারণ ফজরের কুরআন পাঠ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৭৮) পড়ো (হে নবী) তোমার রবের নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আলাক : ১)

কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন : কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন রমাদান মাসের সাথে নির্দিষ্ট নয় কিন্তু এ মাসে কুরআন মাজিদ অবতীর্ণ হওয়ায় এর সাথে নিবিড় সম্পর্ক। অন্য সময়ের তুলনায় এ মাসে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন এর বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। পবিত্র কুরআন নাজিল করে আল্লাহ পাক সত্যের রোডম্যাপ প্রদান করেছেন। আর আমাদেরকে রমাদানের পরবর্তী সময়ে এর চর্চা চালু রাখা উচিত। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘সালাত কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং ফজরে কুরআন পড়ারও ব্যবস্থা করো। কারণ ফজরের কুরআন পাঠ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৭৮) এটি একটি অত্যন্ত বরকতপূর্ণ কিতাব, যা (হে মুহাম্মাদ!) আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি, যাতে এরা তার আয়াত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে এবং জ্ঞানী ও চিন্তাশীলরা তা থেকে শিক্ষা নেয়। (সূরা সোয়াদ :২৯)

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ইসলাম-নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড থেকে সংযত রাখা : যেসব জিনিস আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ করে দেয়, কিংবা যে সকল জিনিস অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ইসলাম-নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডের দিকে দাবিত করে তা থেকে বিরত থাকায় রমাদানের শিক্ষা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আর তোমরা নির্লজ্জতা-অশ্লীলতার কাছেও যেয়ো না, তা প্রকাশ্য হোক বা অপ্রকাশ্য।’ (সূরা আনআম : ১৫১ ) অন্য সূরায় আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘নিশ্চয়ই কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের সব কিছু জিজ্ঞাসিত হবে।’(সূরা বনি ইসরাইল : ৩৬)

সিয়াম নাজাত ও মাগফিরাত লাভের সুযোগ আনে : আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণপ্রসূ, যদি তোমরা জানতে।’ (সূরা বাকারাহ : ১৮৪)

ধৈর্য ও দৃঢ় সঙ্কল্পের প্রশিক্ষণ : রমাদান মাস মূলত ধৈর্য ও সবরের মাস। সিয়ামের মাধ্যমে মু’মিনগণ দুঃখ কষ্টে ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা পায়। সিয়ামের মাধ্যমে মানুষ নিজের মন ও বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা সিয়ামের নিয়ম বর্ণনা করার পর ইরশাদ করছেন- ‘ঐগুলো আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং ঐগুলোর নিকটবর্তী হয়ো না।’ (সূরা বাকারাহ : ১৮৭) পবিত্র কুরআনের সূরা যুমার ১০ নং আয়াতে বলেছেন- ধৈর্যশীলদের তো বিনা হিসাবে পুরস্কার দেয়া হবে।

সাম্যের শিক্ষা : ইসলাম সাম্যের ধর্ম। কোন ভেদাভেদ ছাড়াই রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, সাদা-কালো, উঁচু-নিচু সব ধরনের প্রাপ্ত সুস্থ মুসলিমের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।’ (সূরা হুজুরাত : ১৩)

আখেরাতমুখী করার প্রশিক্ষণ : কিয়ামতের কঠিন মুহূর্তে সিয়াম বান্দার মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন, ‘সিয়াম ও কুরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। কুরআন বলবে হে প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি, তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে।’ (আহমদ-৬৬২৬)

ইখলাস অবলম্বন করা : একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যাবতীয় কাজ সম্পাদন করার নামই হলো ইখলাস। সিয়াম ছাড়া অন্য ইবাদতে লোকদেখানো মনোভাবের সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু রোজার মধ্যে লোকদেখানো সম্ভাবনা নেই বললে চলে। কারণ মানুষ লোকদেখানোর জন্য দীর্ঘ একমাস কষ্ট স্বীকার করতে পারে না। পবিত্র কুরআনের সূরা আনআমের ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমার সালাত, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।’ ইখলাস যার বিশুদ্ধ হবে তাকে শয়তান কখনো আক্রমণ করতে পারবে না।

নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা : একজন সিয়াম পালনকারী মানুষকে যেমন সময়মতো সাহরি খেতে হয়, সময়মতো ইফতার করে সিয়াম ভাঙতে হয়, সময়মতো জামায়াতে সালাত আদায় করা এবং সময়ের কাজগুলো যথাসময়ে করতে শেখায়। সূরা নিসার ১০৩ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয়ই সুনির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায় করা মুমিনদের জন্য ফরজ করা হয়েছে।’ এই শিক্ষা যদি বাস্তবজীবনে কাজে লাগায় তাহলে মানুষ নিয়ম-নিয়ন্ত্রিত সফল মানুষ হবে। একজন আদর্শ সফল মানুষের জন্য এই গুণ অপরিহার্য। সমাজ ফিরে পাবে সোনালি জীবন। সূরা আসরের ১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘সময়ের (মহাকালের) শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত।’

সালাত : রমাদান মাস আসার আগে যে মানুষটি অলসতা করে সালাত আদায় করতো না। সেই মানুষটি নিজে সালাত পড়ে এবং অন্যকে সালাতের প্রতি আহবান করে। যা একান্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া। এসময় ধনী-গরিব, বড়-ছোট সবাই মসজিদমুখী হয়। এই রমাদান থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্রমান্বয়ে সালাত পড়তে শুরু করে। আর রমাদান মাসটা সালাতের মাস। সূরা আনকাবুতের ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই সালাত মানুষকে অন্যায় এবং অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে।’

সত্যবাদিতা : মিথ্যা হচ্ছে সকল পাপের জননী। রমাদান মাস তাকওয়া শিক্ষা দেয়ায় মিথ্যাবাদী সত্যবাদীতে পরিণত হয়। যা পবিত্র রমাদান মাসে সম্ভব। রমাদান মাস মানুষের সব খারাপ আচরণ ধুয়ে-মুছে সুন্দর জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে তুলে। সিয়ামরত অবস্থায় মিথ্যা বলতে গেলেও তার মধ্যে খারাপ অনুভূতি জাগ্রত হয়। আল্লাহভীরুগণ সত্যপরায়ণ হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যারা সত্য এনেছে এবং যারা সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে তারাই তো মুত্তাকি।’ (সূরা যুমার : ৩৩)

গোনাহমুক্ত করার উপায় : সিয়াম হলো গোনাহের কাফফারা। সিয়ামের এক অর্থ হলো পুড়িয়ে দেয়া। কারণ, নেকি কাজ গোনাহর কাজকে পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয়। হাদিসে সিয়ামকে ঢাল হিসাবে বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন- ‘সৎকর্ম পাপসমূহকে মিটিয়ে দেয়।’ (সূরা হুদ : ১১৪)

সত্যিকার মুমিন হওয়ার অনুপম শিক্ষা : সিয়াম মানবমনে খোদাভীতি জাগ্রত করে এবং ঈমান বৃদ্ধি করে। সংযম ও আত্মশুদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করে এবং মানুষকে চারিত্রিক দৃঢ়তায় উপনীত করে। সিয়াম রাখার নিয়ত করার সাথে সাথে মানুষের মন হতে পাপাচার, মিথ্যাচার, স্বেচ্ছাচারিতা, অসৎ কাজ ও ঝগড়া করার প্রবণতা দূর হয়ে যায়। কারণ, এগুলো পরিত্যাগ না করলে সিয়ামই হবে না। তাই সিয়াম দ্বারা মুমিনগণ নফসের ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ লাভ করে।

পরিমিত নিদ্রা : অনেকের রাত্রে ঘুম আসে না আবার অনেকের চোখে সব সময় ঘুম লেগে থাকে। তখন মনে হয় পৃথিবীতে না এলে মঙ্গলজনক হতো। জীবনের সব আনন্দ যেন ঘুমের মধ্যে। যারা দৈনিক ৪-৬ ঘণ্টা ঘুমায় তারা নিঃসন্দেহে যারা ৮-১০ ঘণ্টা ঘুমায় তাদের থেকে বেশি সফলকাম। আল কুরআনে শান্তি ও আরামের ঘুম সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘তোমাদের জন্য নিদ্রাকে করিয়াছি বিশ্রাম।” (সূরা নাবা: ৭৮:৯)
রাত্রে একটা অংশ ইবাদতে কাটানোর বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-“রাত্রি জাগরণ কর (ইবাদতের জন্য), কিছু অংশ ব্যতীত, অর্ধ-রাত্রি কিংবা তদপেক্ষা অল্প, অথবা বেশি।” (সূরা মুজ্জাম্মিল : ২-৪)
নিঃসন্দেহে রমাদানের সিয়াম পালন করতে গিয়ে এক মাসের কম ঘুমানোর ট্রেনিংটা আমাদের জীবনে পরিবর্তন আনবে।

আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় : কুরআনের ভাষায় আল্লাহর পথে দানকে ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ বলা হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সঠিক পদ্ধতিতে দান করলে তা কখনো বৃথা যাবে না। নিজের পরিবারের জন্য খরচ করার পর যা কিছু অতিরিক্ত থাকে তা থেকে দান করতে বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ২৬১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে তাদের উদাহরণ হচ্ছে সেই বীজের মতো যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়, আর প্রতিটি শীষে একশটি করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দান করেন।

রোগ প্রতিরোধে সিয়াম বা সিয়াম
ডা: জুয়েলস এম ডি বলেছেন, যখনই একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে তখনই দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে। খাদ্যের পরিপাক এবং সদৃশীকরণের উদ্দেশ্যে যেটুকু শক্তি ব্যয়িত হয়, আহার বন্ধ রাখিয়া আমরা যদি সেই শক্তি অন্যদিকে নিয়োজিত করি তাহা হইলে দেহের অপ্রয়োজনীয় বিষাক্ত অংশ বিদূরিত করিতে পারি। ভুক্তদ্রব্য পরিপাক এবং সদৃশীকরণ করিয়া তাকে প্রায় ৩০ ফুট লম্বা নাড়িভুঁড়ির ভিতর দিয়া চালিয়ে নিয়ে যেতে বিরাট শক্তির প্রয়োজন হয় এবং ইহার পুরোই মাশুল দিতে হয় রক্তবাহী ধমনীকে আর এই জন্য হৃৎপিণ্ডকে বর্ধিত শক্তি ক্ষয় করিতে হয়। xi ডা: ক্লিভ তার পেপটিক আলসার নামক গবেষণামূলক পুস্তকে লিখেছেন যে, Fasting does not produce organic lession অর্থাৎ সিয়াম কোন রোগ সৃষ্টি করে না।xii
একাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসক ইবনে সিনা তাঁর রোগীদের তিন সপ্তাহের জন্য উপবাস পালনের বিধান দিতেন।xiii
বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী নাস্টবারনার বলেন, ‘ফুসফুসের কাশি, কঠিন কাশি, সর্দি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা কয়েক দিনের সিয়ামের কারণেই নিরাময় হয়।’ স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডা: আবরাহাম জে হেনরি সিয়াম সম্পর্কে বলেছেন, সিয়াম হলো পরমহিতৈষী ওষুধ বিশেষ। কারণ সিয়াম পালনের ফলে বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে মানুষ কম আক্রান্ত হয়। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিয়ামদার পেপটিক আলসারের রোগীরা সিয়াম রাখলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

মুসলমানদের পাওয়ার হাউজ হচ্ছে আল কুরআন তা রমাদান মাসে নাজিল হয়েছে। আর সিয়াম হচ্ছে ঢালস্বরূপ এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার একটি স্থায়ী দুর্গ। রমাদান হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগি, যিকির-আযকার, তাযকিয়া ও আত্মশুদ্ধি এবং কুরআন তিলওয়াতের মাস। আর এই মাস মুসলিম বিশ্বে অতি পবিত্র মাস। ধন ও সম্পদের যেমন যাকাত আদায় করতে হয় তেমনিভাবে সিয়াম শরীরের যাকাতস্বরূপ। সিয়ামের মাসকে কাজে লাগিয়ে আমাদের কুরআনি সমাজ গড়ার প্রশিক্ষণটা নিতে হবে। আর আমাদের রমাদানের প্রশিক্ষণ পুরো বছর ধরে চালু রাখা উচিত।

তথ্যসূত্র :

i খোশ আমদেদ মাহে রমযান, খুররম মুরাদ, আধুনিক প্রকাশনী, ৮ম প্রকাশ- এপ্রলি ২০১৫; পৃ. ০৭
ii কিতাবুস সাওম, মুহাম্মদ জসীমুদ্দীন রহমানী, পৃ. ০৭
iii ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকা ১০ম খণ্ড, একাদশ সংস্করণ; পৃ. ১৯৩
iv চিকিৎসাবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে সিয়াম, ডা. দেওয়ান একেএম আবদুর রহীম, ই.ফা.বা, পৃ. ০১
v ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৭১৪, আলবানী রহ. বলেছেন হাদিসটি দ’য়ীফ।
vi মাহে রমাদান তাকওয়ার পিরামিড, ওয়ামী ব্কু সিরিজ-১০; ৪র্থ প্রকাশ- পৃ. ১২-১৩
vii মুসনাদে আহমদ, তাবারানী
viii তাফসীরে আবী সউদ, ১/২৭ পৃ:
ix সালাত রোজার হাকীকত, সাইয়েদ আবুল আ’রা মওদূদী (রহ)
x তিরমিজি হা/১৯৮৭, সনদ হাসান।
xi চিকিৎসাবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে সিয়াম, ডা. দেওয়ান একেএম আবদুর রহীম, ই.ফা.বা, পৃ. ১১
xii ডা. দেওয়ান একেএম আবদুর রহীম, প্রাগুপ্ত- পৃ. ১৮
xiii রাহাত, ১৯৭১

লেখক : শিক্ষার্থী, কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির