post

রমাদান অবারিত রহমের ফল্গুধারা

এম মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্ফার

২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আরবি বছরের ১২টি মাসের মধ্যে পবিত্র রমাদান মাসকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশেষ মর্যাদা তথা ফযিলতপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র রমাদান মাসের এ মর্যাদা তথা ফজিলতের মূল কারণটা হলো এ মাসেই আল্লাহ প্রদত্ত বিধান মহাগ্রন্থ কুরআনুল কারিম নাজিল হয়। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন ‘রমাদান এমন একটি মাস যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে যা স্পষ্ট হিদায়াত ও শিক্ষায় পরিপূর্ণ এবং যা হিদায়াতের পথ প্রদর্শক এবং হক ও বাতিলের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য সূচনাকারী...।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)। মূলত পৃথিবীতে হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব চিরন্তন যা অব্যাহত গতিতে চলমান। পৃথিবী এমন একটি বসতভূমি যেখানে দুঃখ, সুখ, রোগ, শোক, জন্ম-মৃত্যু, যুদ্ধ-শান্তিসহ অসংখ্য সমস্যা তথা উত্থান পতনের ঘটনা পরিক্রমায় নিরবচ্ছিন্ন ধারায় চলছে এবং চলবে। মানুষকে এসব বিষয়ের মুকাবিলা করেই পৃথিবী নামক বাসভূমিতে টিকে থাকতে হবে এবং এখান থেকে বিদায় নিতে হবে।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাঁর সকল সৃষ্টির ওপর মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মানুষকে যে সম্মান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তার উদ্দেশ্য হলো মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিধান সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহর সকল সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবে। মহান রাব্বুল আলামিন এ মর্মে অতি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন ‘আদম সন্তানকে আমি শ্রেষ্ঠত্বের বৈশিষ্ট্য দান করেছি, তাদেরকে স্থল ও জলপথে যানবাহন দান করেছি এবং তাদেরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জিনিস দ্বারা রিজিক দিয়েছি, আমার বহুসংখ্যক সৃষ্টির ওপর সুস্পষ্ট প্রাধান্য দান করেছি, এসব আমারই একান্ত দয়া ও অনুগ্রহ।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৭০)। পবিত্র কুরআনুল কারিমের এ আয়াতের মর্মার্থ থেকে এ বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, মানুষকে আল্লাহ যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন তা তাঁর অসীম দয়া ও অনুগ্রহের ফলশ্রুতি মাত্র। আর আল্লাহর এ অনুগ্রহের মর্যাদা রক্ষার জন্য মানুষকে বিশ্বে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই।

মানুষ তার প্রাণান্তকর চেষ্টা সাধনা আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের জন্যই ব্যয় করবে ও খালেসভাবে তাঁর দাসত্ব করবে। এ মর্মে মহান রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন ‘অতএব একমুখী হয়ে নিজেদের সমগ্র লক্ষ্য এ দ্বীনের দিকে কেন্দ্রীভূত করে দাও, দাঁড়িয়ে যাও সে প্রকৃতির ওপর যার ওপর আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর বানানো কাঠামো বদলানো যেতে পারে না, ইহাই সর্বতোভাবে সত্য নির্ভুল দ্বীন, কিন্তু অনেক লোকই তা জানে না।’ (সূরা রূম : ১০)। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে খিলাফাত দান করেছেন এবং আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। মানুষ পৃথিবীতে এসে আল্লাহর হুকুম পালনের ক্ষেত্রে যে বাধার সম্মুখীন হয় তাহলো ইবলিস শয়তানের প্রতিবন্ধকতা। ইবলিস সে আদি পিতা হযরত আদম (আ)এর ছিল বড় কঠিন দুশমন। আল্লাহ মানুষের আদি পিতা হযরত আদম (আ)কে সৃষ্টি করে সকল ফিরিশতাকে সিজদা করতে আদেশ করলে ইবলিস তা অস্বীকার করে বসে এবং আল্লাহর লানতে সে অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়।

শয়তান আদম সন্তান তথা মানুষকে ভ্রান্ত পথে চলার প্ররোচনা দিয়ে আল্লাহর বিধান লংঘনে উৎসাহিত করবে এটাই স্বাভাবিক। মানুষকে এ কুচক্রী শয়তানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিশ্বে আল্লাহর বিধান মেনে চলতে হবে। আদম (আ) এবং শয়তান যে পরস্পরের দুশমন এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন ‘শেষ পর্যন্ত শয়তান উভয়কেই সে গাছ সম্পর্কে প্রলোভিত করে আমার নির্দেশ অমান্য করতে প্রস্তুত করলো এবং তারা যে অবস্থায় ছিলো তা হতে তাদেরকে দূরে নিক্ষেপ করে ছাড়লো; আমি আদেশ করলাম যে, এখন তোমরা সকলেই এ স্থান থেকে নেমে যাও, তোমরা একে অপরের দুশমন; একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত তোমাদেরকে পৃথিবীতে থাকতে এবং সেখানেই জীবন যাপন করতে হবে।’ (সূরা বাকারা : ৩৬)। 

শয়তান যে মানুষের ঘোর শত্রু এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারিমের বহু জায়গায় আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মানুষকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। এ মর্মে তিনি অন্য আয়াতে ঘোষণা করেন ‘হে আদম সন্তান, আমি কি তোমাদেরকে হিদায়াত করিনি যে, তোমরা শয়তানের বন্দেগি (দাসত্ব) করবে না, সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।’ (সূরা ইয়াসিন : ৬০)। এভাবে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মানুষকে শয়তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম চালিয়ে পৃথিবীতে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্যই পাঠিয়েছেন। মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র হুকুম মানতে হবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অন্যকোনো সত্তার নয়। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মাহে রমাদানে শুধু তাঁর বিধানই নাজিল করেননি এ বিধান বাস্তবায়নের জন্য মানুষের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছেন। খাদ্য গ্রহণ, আরাম-আয়েশ, যৌনক্ষুধা নিবারণের জন্য স্ত্রী সহবাস এগুলো বৈধ উপায়ে উপভোগ করা নিষেধ নয় কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিনের নির্দেশে রমাদান মাসে দিবাভাগে এগুলো নিষিদ্ধ। এর দ্বারাই মানুষ যেন স্থায়ীভাবে মহান রাব্বুল আলামিনের হুকুম পালনের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এটাও মাহে রমাদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আহবান।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাঁর অলংঘনীয় আসমানি বিধান পবিত্র কুরআনুল কারিম নাজিলের সূচনার এ রমাদান মাসটিকে সিয়াম সাধনা ও অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ নৈশকালীন ইবাদত লাইলাতুল ক্বদরের ঘোষণা দিয়ে খুবই বরকতপূর্ণ ও মর্যাদাময় করে তুলেছেন। মাহে রমাদানের সিয়াম সাধনা নিছক ক্ষুৎপিপাসায় কষ্ট করার নামমাত্র নহে। আমরা যদি এর শিক্ষণীয় দিকগুলো বিচার বিশ্লেষণ করতে চাই তাহলে দেখতে পাবো যে সিয়াম সাধনা মানবসভ্যতার সঠিক দিক নির্দেশনার গাইড হিসেবে কাজ করে। এটা আল্লাহভীতি অর্জন, আর সে আল্লাহভীতির সাহায্যেই মানুষ সভ্যতা, শালীনতা, সহমর্মিতা, জবাবদিহিতার মানসিকতা, ভদ্রতা ও সহনশীলতার উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে। তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জন করলেই কেবল মানুষ বর্বরতা, অসভ্যতা, অন্যায়, জুলুম, অত্যাচারসহ সবরকম বেঈনসাফি হতে দূরে থাকতে পারে। এ জন্যই আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন ‘হে বিশ্বাসীগণ তোমাদের ওপর সিয়াম (রোজা) ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল; ফলে আশা করা যায় যে, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য জাগ্রত হবে।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)। পবিত্র কুরআনুল কারিমের এ ভাষণে যা বুঝানো হয়েছে তার মর্মার্থ এভাবে করা যেতে পারে যে, মানুষ পৃথিবীতে যত হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, খুনোখুনিসহ যত প্রকার অশান্তির কারণ ঘটিয়েছে তার মূলে রয়েছে তিনটি বিষয়। ১. মানুষ খাদ্যের চাহিদা পূরণের স্বার্থে অর্থ উপার্জনের জন্য উপর্যুক্ত ন্যক্কারজনক কাজ করে থাকে। ২. সুন্দর নারী লাভ ও তার সাহচর্যে যৌনক্ষুধা মিটানোর আকাক্সক্ষার জন্য সে নানা প্রকার ন্যক্কারজনক কাজ করে। ৩. আরাম আয়েশের চাহিদা পূরণের জন্য গাড়ি, বাড়ি, অট্টালিকাসহ চাকচিক্যময় বাসভূমি লাভের চিন্তায় ও মানুষ অন্যের অধিকার হরণ, জুলুম, নির্যাতনসহ আল্লাহদ্রোহী সমস্ত পন্থা পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। মানুষ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার ভয় অন্তরে লালন করে রমাদান মাসে সিয়াম সাধনা পালন করবে এবং সভ্যতাবিধ্বংসী ঐ সমস্ত অসৎ দোষ থেকে মুক্ত হয়ে এক আল্লাহর গোলামি করার শিক্ষাই মাহে রমাদানের সিয়াম সাধনার মুখ্য বিষয়। পবিত্র রমাদান মাসে পানাহার থেকে আল্লাহর নির্দেশে বিরত থেকে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ তথা পরিপূর্ণ হালাল পথে উপার্জনের শিক্ষা লাভ, এ মাসে রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে সালাতে তারাবিহ, লাইলাতুল ক্বদরের ইবাদত ও শেষ রাত্রে সাহরি খাবারের জন্য জাগ্রত হবার মাধ্যমে আরাম আয়েশ সীমিত করার শিক্ষা অর্জনসহ সাদকাতুল ফিতরের দ্বারা আর্থিক কুরবানির মানসিকতা তৈরি এবং অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন বর্জনের দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণই এ রমাদান মাসের সিয়াম সাধনার যে উদাত্ত আহবান তাতে সন্দেহের কিছু নেই।

মাহে রমাদানের সিয়াম নিছক পানাহার থেকে বিরত থাকার নামমাত্র নয়। এটা আত্মশুদ্ধি তথা আত্মোপলব্ধি ও আত্মসমালোচনার একটি উত্তম প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রও বটে। যে রাব্বুল আলামিন মানুষকে সালাত, যাকাত, হজ্জ ও সিয়াম পালনের আদেশ করেছেন সে আল্লাহই পবিত্র কুরআনুল কারিমে অন্যায়, জুলুম, হত্যা, ব্যভিচার, অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন, অন্যের অধিকার হরণ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এবং এ সমস্ত অপরাধ মানুষ করলে তার দণ্ডবিধি সংক্রান্ত আইন পবিত্র কুরআনুল কারিমে ঘোষণা করেছেন। মাহে রমাদানে আল্লাহর হুকুমে যেভাবে বান্দা সিয়াম পালন করবে সেভাবেই পবিত্র কুরআনুল কারিমের যাবতীয় আদেশ নিষেধ মেনে চলার শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষ বাস্তব জীবনে তা বাস্তবায়ন করবে, এটাই হলো মাহে রমাদান মাসের মর্যাদার আসল বৈশিষ্ট্য।

পবিত্র মাহে রমাদানের এ শিক্ষা অর্জন করতে পারলেই কেবল এ মাসের সিয়াম সাধনা মানুষকে জান্নাতে রাইয়্যানে পৌঁছে দিতে পারে। যে সম্পর্কে একটি হাদিস এভাবে এসেছে ‘সাহল রা. থেকে বর্ণিত- নবী সা. বলেছেন জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। কিয়ামতের দিন এটি দিয়ে রোজাদাররা প্রবেশ করবে। রোজাদার ছাড়া আর একজন লোকও এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (সেদিন) বলা হবে, রোজাদাররা কোথায়? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে, তখন তারা ছাড়া আর একজন লোকও সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না, তাদের প্রবেশের পরই তা বন্ধ করে দেওয়া হবে, তারা প্রবেশ করে দেখতে পাবে তাদের পূর্বে ঐ দরজা দিয়ে আর একজনও প্রবেশ করেনি।’ (সহিহ আল বুখারি, কিতাবুস সাওম, হাদিস নং ১৭৬১)। এ হাদিস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মাহে রমাদানের মর্যাদা ও সিয়াম সাধনার ফাজায়েল কত বেশি!

তবে রমাদান মাসের প্রকৃত শিক্ষা তথা মানুষের নৈতিক চরিত্র সংশোধন ছাড়া উপবাস করে লাভ কতটুকু তা আরেকটি হাদিসে এভাবে এসেছে- আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত- নবী সা. বলেছেন, (সাওম করেও) কেউ যদি মিথ্যা কথা বলা ও তদনুযায়ী কাজ করা পরিত্যাগ না করে তবে তার শুধু খাদ্য ও পানীয় পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ আল বুখারি, হাদিস নং ১৭৬৮)। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে মাহে রমাদানের গুরুত্ব যথাযথভাবে অনুধাবন করে সিয়াম সাধনার সওয়াব লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন। 

লেখক : সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, দরগাহ রোড, সিরাজগঞ্জ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির