post

রমাদান জাগ্রত বিবেকের হাতছানি

জাফর আহমাদ

৩১ জানুয়ারি ২০২৩

মানুষের ভেতর দুটো জিনিস অবস্থান করে। একটি হলো, ‘নাফস’ আর অন্যটি হলো ‘বিবেক’। নাফস দুনিয়াকে অবাধে ভোগ করার জন্য মানুষকে ক্রমাগত লালসার লোভ দেখায়। অর্থাৎ খাও-দাও ফুর্তি করো দুনিয়াটাই মস্তবড়। আল কুরআনে উল্লেখ রয়েছে, “আমি নিজের নফসকে দোষমুক্ত করছি না। নফস তো খারাপ কাজ করতে প্ররোচিত করে, তবে যদি কারোর প্রতি আমার রবের অনুগ্রহ হয় সে ছাড়া। অবশ্যই আমার রব বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।” (সূরা ইউনুফ : ৫৩)। পক্ষান্তরে বিবেক মানুষকে সবসময় ভালো কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। যার বিবেক দুর্বল এবং নফস সবল তার কাছে হালাল-হারাম ও ভালো-মন্দ একই রকম। আর যার বিবেক সবল তার কাছে হালাল ও ভালো কাজই শুধু গ্রহণযোগ্য। নফসের খাদ্য হলো, দুনিয়াকে অবাধে ভোগ করা ও হালাল-হারামের পার্থক্য না করা। আর বিবেকের খাদ্য হলো, ভালো কাজ করা, হালালকে গ্রহণ করা হারামকে বর্জন করা। রমাদানের এক মাস ট্রেনিং হলো, বিবেকের এক বিশেষ খাদ্য। রমাদানের মাধ্যমে নফস দুর্বল হয় এবং বিবেক শক্তিশালী হয়।  

‘বিবেক’ মানুষের এক মূল্যবান সম্পদ। মানুষ নামক যে যন্ত্রটি পৃথিবীতে বিচরণ করে বেড়ায়, সেই যন্ত্রটির মৌলিক মানবীয় প্রাণশক্তিই হলো ‘বিবেক’। এটি ছাড়া মানুষ কখনো মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে না। আলবত সে পশুর কাতারে নেমে আসে। সব মানুষই বিবেকসম্পন্ন। কিন্তু এটিকে মানুষের শরীর-স্বাস্থ্যের মতো যত্ন নিতে হয়। আমাদের সমাজব্যবস্থায় কেউ কেউ তার নিয়মিত পরিচর্চা করেন আবার অনেকেই তাকে অবহেলা ভরে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয়। বিবেকের পরিচর্চা ও শান দেওয়ার মাধ্যমেই মানুষ ভালো মানুষে পরিণত হয়। সুস্থ ও সবল বিবেকের তাড়নায় এ সমস্ত মানুষেরা সমগ্র আবেগ-উচ্ছ্বাস, হৃদয়বৃত্তি এবং সকল প্রকার লোভ-লালসা নিয়মানুগ ও বিধিবদ্ধ করে নেয়। মানুষের মধ্যে নফসও আছে, যে সকল সময় মানুষকে কামনা-বাসনায় আবদ্ধ করতে চায়। ক্রমাগত মানুষকে মায়াবী পৃথিবীর রঙিন জালে আবদ্ধ রাখতে চায়। এই নফসের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিবেকের সাহায্য একান্ত প্রয়োজন হয়। তাই নফস থেকে বিবেক অবশ্যই অধিকতর শক্তিশালী হতে হবে। এ জন্য বিবেকের নিয়মিত পরিচর্চার প্রয়োজন হয়। বিবেক যত শক্তিশালী হবে নৈতিক মান তত উন্নত হবে। নৈতিক মান যত উন্নত হবে নফস তত দুর্বল হতে থাকবে। এবং এক সময় নফস বিবেকের গোলামি করতে বাধ্য হবে। যার বিবেক শক্তিশালী তিনিই মুত্তাকি। কিন্তু যদি এই বিবেককে ক্রমাগত অবহেলা করা হয় তবে এটি অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে যায় এবং এক সময় তার অপমৃত্যু ঘটে এবং তখন মানুষ অমানুষে পরিণত হয়। সমাজ ও সভ্যতায় নেমে আসে অরাজকতা ও বিপর্যয় এবং সমাজ পরিণত হয় অন্যায় ও অবিচারের অভায়রণ্যে। যেখানেই এভাবে মরহুম বিবেকের সংখ্যা বাড়তে থাকে সেখানটায় পশুর খোঁয়াড়ে পরিণত হয়। 

সব মানুষ জানে বিবেকের গুরুত্ব কতটুকু। কিন্তু তার পরিচর্চা করতে জানে না অথবা জানার সেই পরিবেশও পায় না। আমাদের সমাজব্যবস্থায় কেউ ছোট্ট একটি অপরাধ করলে, মানুষ তাকে বলে থাকে ‘লোকটির বিবেক নাই’ অথবা ‘এটি বিবেকহীনের কাজ’। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, মানুষ ও পশুর মধ্যে তফাৎ করা হয় ‘বিবেক’-এর মাধ্যমে। অর্থাৎ মানুষের বিবেক আছে, পশুর নেই। কিন্তু এখানে এ-ও মনে রাখা প্রয়োজন যে, মানুষ যখন বিবেকহীন হয়ে পড়ে তখন তার মান পশুর চেয়েও অধিকতর নিচে নেমে আসে। কারণ পশুরা শুধুমাত্র নিজের ক্ষুধার জ্বালা নিবারণের জন্য অন্য পশুকে শিকার করে। হিংসা-বিদ্বেষ, প্রভাব-প্রতিপত্তি বা হিংসাত্মক মনোভাব চরিতার্থ করার জন্য কোনো পশু অন্য পশুর উপর হামলা করে না বা আক্রমণ চালায় না। কিন্তু বিবেকহীন মানুষ হেন হীনতার কাজ নাই যা সে করতে পারে না। যে কোন জায়গায় সামাজিক বিপর্যয় ঘটানোর জন্য গুটিকয়েক বিবেকহীন ব্যক্তিই যথেষ্ট।   

আমাদের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট চিন্তা করা হলে, সহজেই পরিমাপ করা যায় যে, সেই বিবেকের মৃত্যুহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু কেন? কেন আজ বিবেকের মৃত্যুহার বেড়ে যাচ্ছে? কেন সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ উঠে যাচ্ছে এবং কেন আজ সামাজিক বন্ধন হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে? সমাজের সর্বস্তর থেকে আজ ধৈর্য, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান, পরশ্রীমুখরতা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে মানছে না। ছোট বড়কে সম্মান করছে না, বড় ছোটকে স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারছে না। জাতির মেরুদণ্ড সোজাকারী শিক্ষক লাঞ্ছিত হচ্ছেন স্বীয় গুণধর ছাত্রের দ্বারা। ছাত্র তার ছাত্র বন্ধু দ্বারা নিহত হচ্ছে। তথাকথিত মেধাবীরা চরম বেহায়াপনার কাজে জড়িয়ে পড়েছে। সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে যত্রতত্রভাবে। স্বাধীন দেশের অধিবাসীরা স্বাধীনভাবে মুক্ত বাতাসে নিঃশঙ্কায় চলাফেরা করতে পারছে না। কিসের ভয় যেন সদায় তাদের তাড়া করে ফিরে। হত্যা, মাস্তানি ও  চাঁদাবাজির কারণে সমাজের হা-হুতাশ শুরু হয়েছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই আজ বিশাল ধ্বংসের দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে শুধু অবক্ষয় আর অবক্ষয়। ব্যক্তি ও জাতীয় চরিত্রের অধঃপতন, পারিবারিক ও সামাজিক সুশৃঙ্খল অবকাঠামোর ভাঙন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা দেশ আজ অগ্নিগর্ভে রূপ নিয়েছে। ভোগের রাজ্যে চলছে অত্যধিক মাতলামি। মোটকথা মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবন আজ মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত। তাহলে কি বিবেকের মৃত্যুহার বেড়ে গিয়ে বিবেকশূন্য পৃথিবী বিবেকহীনদের ভার সইতে পারছে না? হ্যাঁ পূর্বেই বলা হয়েছে যে, বিবেকের নিয়মিত পরিচর্চা না করার কারণেই বিবেকের মৃত্যুহার বেড়ে গেছে। ফলে বিবেকের অনুপস্থিতির কারণে উপরোক্ত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।  

আমার ধারণা, আমাদের নেতৃত্বের কারণে বিবেকের এ মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে। নেতৃত্বই এজন্য দায়ী। কারণ নেতৃত্বের মনোভাব ও আচার-আচরণ সংশ্লি­ষ্ট দেশের সাধারণ নাগরিকদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করে থাকে। নেতৃত্ব যদি ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন হয়, দেশের জনগণ সর্বক্ষেত্রে ইতিবাচক হবে। একটি উন্নয়নশীল দেশের উন্নতির জন্য যতগুলো বিষয়কে গণ্য করা হয়, তন্মধ্যে ‘ইতিবাচক মনোভাব’ সর্বোচ্চ গুরুত্বের দাবি রাখে। নেতিবাচক মনোভাব ও আচার-আচরণ দিয়ে উন্নতির চিন্তা করা যায় না এবং এ ধরনের মনোভাব দিয়ে মানুষের চরিত্র গঠন করাও সম্ভব নয়। বরং নেতিবাচক আচার-আচরণ রাষ্ট্রের বা সমাজের সর্বস্তরে অসহিষ্ণুতা, অসৌজন্যতা ও উগ্রতাকে এমনভাবে উসকে দেয় যে, মানবসভ্যতা ও মানুষের জীবন মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। এখানে আরো অনেকগুলো কারণ পেশ করা যাবে, কিন্তু এসমস্ত কারণের পিছনে নেতৃত্বের প্রভাব প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কাজ করে। যার বিবেক লোপ পায়, তিনিই সর্বদা নেতিবাচক পথে হাঁটেন।

বিবেক রক্ষা করার জন্য রমাদান হলো সবচেয়ে বড় মহৌষধ। রমাদান মানুষের নফসকে ক্রমাগত একটি মাস শাস্তি প্রদান করে তার লালসা-বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। নফসের কয়েকটি মৌলিক লালসা হলো খাদ্য গ্রহণ, পিপাসা নিবারণ ও যৌনকর্ম সাধন। রমাদান ইসলামের হালাল কর্মগুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নফসকে ক্রমাগত একটি মাস শাস্তি দেয় ফলে সে বৈধ চাহিদাগুলোও পূরণ করতে না পেরে দুর্বল হয়ে পড়ে পক্ষান্তরে বিবেক শক্তিশালী হয়ে উঠে। রমাদানের একটি মাস বিবেক এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে পরবর্তীতে নফস আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। পরবর্তীতে অবৈধ খাদ্য, পানীয় ও যৌনাচার থেকেও তাকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়। রমাদানের তাকওয়ার গুণটিই হলো মূলত বিবেক।

বিবেককে সঠিক ও সরল পথে পরিচালিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পথপ্রদর্শক হলো আল কুরআন। এজন্য এ মাসেই কুরআন নাজিল করে আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন যে, (এই নাও) সেই কিতাব যার মধ্যে সন্দেহের লেশমাত্র নেই, যা মুত্তাকিদের পথ দেখায়।” (সূরা বাকারা : ১-২)

লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির