আল্লাহর বাণী, ‘(হে নবী), তুমি বলো, হে রাজাধিরাজ (মহান আল্লাহ), তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে সাম্রাজ্য দান করো, আবার যার কাছ থেকে চাও কেড়েও নাও, যাকে ইচ্ছা তুমি সম্মানিত করো, যাকে ইচ্ছা তুমি অপমানিত করো; সব রকমের কল্যাণ তো তোমার হাতেই নিবদ্ধ; নিশ্চয়ই তুমি সব কিছুর ওপর একক ক্ষমতাবান।’ (সূরা আলে ইমরান : ২৬) এই আয়াতে স্পষ্ট যে, কাউকে রাজত্ব দেয়া না দেয়া একান্তভাবে নির্ভর করে আল্লাহর মর্জির ওপর। যেহেতু বিষয়টি আল্লাহর হাতে তাহলে স্বাভাবিকভাবে আশা করা যায় জমিনে ঈমানদার বান্দাদের উপস্থিতি থাকলে দেশ পরিচালনার ভার তারাই লাভ করবে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি, দেশে দেশে রাজত্ব করছে আল্লাহর নাফরমান বান্দারা (যাদের অধিকাংশই জালেম)। আসলে এ ব্যাপারে আল্লাহর নিয়মটি আমাদের জানা দরকার। তার আগে আমরা জানতে চাইবো রাজত্বের সাথে সম্মান ও দ্বীনদারির সম্পর্ক কতটুকু।
উপরোক্ত আয়াতে বোঝা যায় দুনিয়ার জীবনে মান-ইজ্জত-সম্মানের সাথে রাজত্বের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কর্তৃত্বের আসনে আসীন ব্যক্তির নাম-যশ-খ্যাতি-সম্মান চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে ও সেই ব্যক্তি প্রশংসায় ভাসতে থাকে এবং কর্তৃত্বের আসন থেকে ছিটকে পড়লে তার জীবনে নেমে আসে লাঞ্ছনা-অপমান-জিল্লতি; অনেক সময় জীবনও সংশয়ে পড়ে যায়। বিশ^ব্যাপী এমন অবস্থা থাকলেও আমাদের মত অনুন্নত দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রশংসা ও লাঞ্ছনা তীব্রভাবে লক্ষণীয়। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের প্রতি আকাক্সক্ষা প্রকৃতিগত। এই আকাক্সক্ষা একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত দোষেরও নয় বরং এতটুকু না থাকলে কারো মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশও ঘটে না। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, অফিস-আদালত, সামাজিক, রাজনীতিক সংগঠন সকল ক্ষেত্রে মানুষ চায় তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক ও সবাই তাকে মেনে চলুক। এ জন্য ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে একজন সমাজকর্মী হিসেবে সে কাজ করবে এবং সমাজের মানুষের কল্যাণে যারা কাজ করে আল্লাহর সুন্নাহ (নিয়ম) হলো সমাজে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। রাষ্ট্রের বিষয়টিও তাই। সৎ নেতৃত্বের পক্ষেই সম্ভব জনগণের কল্যাণ সাধন। তাই সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম এটিকে উপেক্ষা করেনি; বলা যায় সমাজে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তার সকল কর্মতৎপরতা।
আল্লাহপাক তাঁর সকল নবী-রাসূলকে সমসাময়িককালের শাসকদের মোকাবেলায় দাঁড় করিয়েছেন। বলা যায়, সব শাসকই নবী-রাসূলদেরকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গ্রহণ করে খুব শক্তভাবে বিরোধিতা করেছে। নবী-রাসূলগণ ছিলেন সমাজের সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী এবং স্বাভাবিকভাবে তাঁদের দাওয়াতে দলে দলে মানুষের ছুটে আসার কথা। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল শাসক ও তাদের থেকে সুবিধাভোগী শ্রেণি। কুরআন মজিদে এসব কাহিনী লক্ষণীয়। সত্যি কথা বলতে প্রকৃত দ্বীনদারি এখানেই রয়েছে। আল্লাহর নাফরমানদের হাত থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নবী-রাসূল বা সৎ লোকদের গ্রহণের লক্ষ্যেই বলা হয়েছে ‘আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের অনুসরণ/আনুগত্য করো’। এই আনুগত্য বা অনুসরণ তখনই সম্ভব যখন সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নবী-রাসূল বা তাঁদের অনুসারীদের হাতে আসে।
হেরা গুহায় প্রথম অহিপ্রাপ্তির মাধ্যমে নবী হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর মুহাম্মদ সা.-এর মৌলিক কাজ ছিল মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা। শত বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতা মাড়িয়ে অব্যাহতভাবে তিনি ও তাঁর সাথীরা মানুষকে কালিমা তাইয়্যেবার দাওয়াত দিয়েছেন এবং এক পর্যায়ে তাঁর দাওয়াত মক্কা ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় মদীনাসহ আশপাশের এলাকায়। মদীনায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণের ফলে সেখানে একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং সে সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের নির্দেশ আসে। আল্লাহপাক সে সময়ে তাঁকে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাওয়ার জন্য দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘তুমি বলো, হে আমার রব (যেখানেই নিয়ে যাও), তুমি আমাকে সত্যের সাথে নিয়ে যেও এবং (যেখান থেকেই বের করো) সত্যের সাথে বের করো এবং তোমার কাছ থেকে আমার জন্য একটি সাহায্যকারী রাষ্ট্রশক্তি প্রদান করো।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৮০)
মক্কায় রাসূল সা.-এর নেতৃত্বে একদল যোগ্য লোক তৈরি হয়েছিল, কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশের কারণে সাধারণ জনগণ দ্বীন গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু মদীনায় হিজরত করার পর দু’টি শর্তই (যোগ্য নেতৃত্ব ও জনসমর্থন) পূরণ হওয়ায় আল্লাহপাক তাঁর রাসূল সা.কে রাজত্ব দান করেন। মদীনায় নবগঠিত রাষ্ট্রে মুহাম্মদ সা. রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, প্রধান বিচারপতি, প্রধান সেনাপতি-এক কথায় সর্বেসর্বা। মদীনায় দশটি বছর তিনি যা করেছেন সব নবী হিসেবেই করেছেন এবং পুরোটাই দ্বীনের অংশ ও উম্মতের জন্য অনুসরণীয়। বদর, ওহুদ, খন্দক এবং মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে কুফরি শক্তির ধ্বংস সাধিত হয়। মান-ইজ্জত-সম্মান সবই মুহাম্মদ সা. ও তাঁর অনুসারীদের হাতে চলে আসে। আর কুফরি শক্তির জন্য নেমে আসে অপমান-লাঞ্ছনা। রাসূল সা.-এর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ফলে আবু জেহেল-আবু লাহাবদের বংশধররা ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে মূল স্রােতে ফিরে আসে। সূরা আন নসরে আল্লাহপাক দ্বীনের এই বিজয়কে তাঁর সাহায্য হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, মানুষ সে সময়ে দলে দলে দ্বীনের মধ্যে শামিল হয়েছে এবং নবীকে বেশি বেশি আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেছেন। দ্বীনের বিজয়ের ফলে দ্বীন বিশ^ব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমান্বয়ে সকল পরাশক্তির পতন ঘটে এবং যার ফলশ্রুতিতে আমাদের পূর্বপুরুষদের পক্ষে মুসলমান হওয়াটাও সম্ভব হয়েছে। দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যেই মুহাম্মদ সা.-এর সকল কর্ম-প্রচেষ্টা এবং আল্লাহর ঘোষণাও তাই। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কুরআন মজিদে তিন জায়গায় সূরা তাওবা (৩৩ নং), সূরা ফাতাহ্ (২৮ নং) ও সূরা সফে (৯ নং) উল্লেখ করেছেন। তাঁর বাণী, “তিনি আপন রাসূলকে হেদায়াত ও সঠিক জীবনব্যবস্থা (দ্বীনে হক) দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে সকল জীবনব্যবস্থার ওপর একে বিজয়ী করে দিতে পারেন, মুশরিকদের কাছে তা যতই অসহনীয় হোক।” (সূরা সফ : ৯) নবী মুহাম্মদ সা. জিহাদকে ঈমানের সাথে সম্পর্কিত করেছেন। তিনি বলেছেন, যে লোক মারা গেল অথচ না জিহাদ করলো আর না জিহাদের বাসনা অন্তরে পোষণ করলো তার মৃত্যু হলো মুনাফিকের মৃত্যু।
রাজত্ব যদিও আল্লাহর হাতে, কিন্তু ঈমানদার জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ জিহাদবিমুখ। অর্থাৎ তারা দ্বীনের বিজয় চায় না বা সে জন্য তারা চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় না এবং যারা চেষ্টা চালায় তাদের সমর্থন না করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি করে উম্মাহর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে। বিভেদ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী আল্লাহর নাফরমানদের সহযোগী হিসেবেই ভূমিকা পালন করে। আবার ঈমানদার জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নামায, রোযা, হজ, যাকাতে আন্তরিকতা দেখালেও দ্বীন কায়েমের বিষয়টিকে রাজনীতি বলে মনে করে এবং গর্বভরে বলে ‘আমরা রাজনীতি করি না’। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লুটেরাদের কবলে। তাদের এই মানসিকতা লুটেরাদের সহযোগিতা হিসেবেই কাজ করে।
বাংলাদেশসহ বিশব্যাপী আল্লাহর দ্বীন কায়েমের এক জোর প্রচেষ্টা চলছে। এ জন্য প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মানুষের কাছে ইসলামের বিপ্লবী আহবান পৌঁছে দেয়া। লুটেরাদের আনুগত্য নয়, আনুগত্য কেবল আল্লাহর এই স্লোগানে এক বিরাট সংখ্যক যোগ্য নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। এই লোকগুলো জনসম্পৃক্ত হয়ে সমাজের মানুষের কল্যাণে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করলে এবং জনসমর্থন সৃষ্টি হলে ঈমানদারদের হাতে রাজত্ব না দেয়ার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ ঈমানদারদের কাছ থেকে বেশি কিছু চাননি। আল্লাহপাক রাজত্ব দানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁর বাণী, “আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দ্বীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরিক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক।” (সূরা নূর : ৫৫)
আল্লাহপাক স্পষ্ট করেছেন যে রাজত্ব তাঁর হাতে এবং রাজত্ব দান ও কেড়ে নেয়াও নির্ভর করে তাঁর ওপর। রাজত্ব পেতে হলে তাঁর দেয়া নিয়ম অনুসরণ করতে হবে এবং সে নিয়ম তিনি তাঁর নবীর মাধ্যমে আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন। কাজ হলো, মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া এবং তাদেরকে নেক আমলে ভূষিত করা অর্থাৎ পরিশুদ্ধ করা। এটি সম্ভব হলে আল্লাহপাক তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন। দ্বীন কায়েমের নামে যারা সন্ত্রাস করে ওরা ইসলামের কেউ না, ইসলামের দুশমনদের ক্রীড়নক ও শয়তানের দোসর। রাসূলুল্লাহ সা.-এর মক্কার তেরো বছরের জীবন আমাদের সম্মুখে রয়েছে। এই তেরোটি বছর তিনি শুধু মার খেয়েছেন, একটি মারও দেননি। গুপ্ত হত্যা বা কোনো ধরনের সন্ত্রাসের ঘটনা একটিও ঘটেনি। যুদ্ধ সবই মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হয়েছে। যুদ্ধ রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকেই হতে পারে, কোনো ব্যক্তি বা দলের সে অধিকার নেই। সেটি কেউ করতে চাইলে তা হবে ফিতনা সৃষ্টি, যা হত্যাযোগ্য অপরাধ। মানুষের জন্য আল্লাহপাকের বড় নিয়ামত হলো হিদায়াত ও দ্বীন কায়েমের সুযোগদান। কোনো লোকালয়ের মানুষ দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আকাক্সক্ষা পোষণ না করলে এত বড় নিয়ামত সাধারণত তিনি দেন না। মানুষ যখন আল্লাহর নাফরমানির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায় বিশেষ করে গুম-খুন-রাহাজানি, সীমাহীন দুর্নীতি ও অশ্লীলতা তখন আল্লাহপাক নানা ধরনের বালা-মুসিবত বা জালেম শাসক তাদের ওপর চাপিয়ে দেন এবং সে সময়ে ঈমানদারদের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন লাঞ্ছনা-অপমান ও জিল্লতি।
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে আল্লাহ তায়ালা পূর্বাহ্নেই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘তোমরা কি দ্বীনের কিছু অংশ মানবে এবং কিছু অংশ অমান্য করবে, তাহলে দুনিয়ার জীবনে রয়েছে জিল্লতি ও আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব।’ (সূরা বাকারা : ৮৫) আজ মুসলমানরা আল্লাহর ঘোষিত জিল্লতিরই মুখোমুখি। দুনিয়ার জীবনে জিল্লতি ভোগের সাথে সাথে আখিরাতে আজাব ছাড়া ভিন্নতর কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। হ্যাঁ, আখিরাতে বাঁচতে পারে কেবল তারাই যারা সকল ভয়-ভীতি, জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালায়। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব:), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ
আপনার মন্তব্য লিখুন