post

রাজনীতির অঙ্গনে চাই সমঝোতা এবং চাই দেশে শান্তি ও স্বস্তি

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

রাজনীতিতে ভুল বা অন্যায় আচরণের কারণে একটি দেশের যতখানি সর্বনাশ হয় অন্য কোনো কারণে তা হয় না। ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা- ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না’। বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনীতির ক্ষেত্রে চলছে চরম অনিশ্চয়তা। দেশের রাজনীতিতে চলছে আস্থার সংকট। রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টরা অনর্গল মিথ্যা বলে। এক্ষেত্রে জোসেফ গোয়েবলস-এর অনুসারীর আধিক্যই লক্ষ করা যায়। হিটলারের তথ্যমন্ত্রী ড. গোয়েবলস-এর দর্শন ছিল একটি মিথ্যাকে বারবার বললে সেটি সত্যে পরিণত হয়। স্বৈরশাসকের পতন যে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যায় না সে তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে। হিটলারের আত্মহত্যার পর গোয়েবলস নিজের ছয়টি সন্তানকে হত্যা করার পর সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেছিল। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের ধারণা, মিথ্যা বলাটা কোনো পাপ নয়, এটি তাদের রাজনীতিক কৌশল। ফলে একে অপরকে কেউ বিশ্বাস করে না। সরকার পরিবর্তনের সর্বোত্তম পন্থা হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশ করবে। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে তারাই সরকার গঠন করবে। পরপর দু’টি নির্বাচনে সীমাহীন অনিয়ম ও কারচুপির কারণে দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় সেটি দেশ ও বিদেশের কাছে স্পষ্ট। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে তত উত্তেজনা। সবার মধ্যে এক শংকা ও ভয় কাজ করছে। 

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ১৪ বছর দেশ শাসন করছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্থিতিশীল সরকার খুবই সহায়ক। সেই সুযোগ এই সরকার পেয়েছিল। ফলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিশেষ করে যোগাযোগ ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটেছে। চার লাইন রাস্তা, সেতু, বিশেষ করে পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল আমাদের যোগাযোগব্যবস্থায় গতি এনেছে। কিন্তু সুশাসনের অভাব সরকারের সকল উন্নয়নকে ম্লান করে দিয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি সরকারঘেঁষা পত্রিকা সমকাল (মালিক- শিল্পপতি আবুল কালাম আজাদ) হেডলাইন করেছে- ‘সুশাসনে ঘাটতি, উন্নয়ন ম্লান’। বিরোধীদলের উপর চরম দমনপীড়ন বিশেষ করে আলেম-উলামা ও ইসলামপন্থী জনগোষ্ঠীকে জেল-জুলুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা (গুম-খুন), সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট জনগণের কাছে সরকারকে অপ্রিয় করে তুলেছে। আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল, লড়াই-সংগ্রাম ও আন্দোলনে সবসময় অগ্রভাবে থাকে, তাদের অনেক অর্জন রয়েছে বিশেষ করে কেয়ারটেকার সরকার প্রশ্নে বিএনপির বিরুদ্ধে সকল বিরোধীদলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ইতিহাস একেবারেই জীবন্ত।

সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রাণ। ইউরোপ-আমেরিকার উন্নয়নের পেছনে বড়ো কার্যকর শক্তি হলো গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ও অনুশীলন। সেসব দেশে সরকারের পরিবর্তন অত্যন্ত সাধারণ বিষয়। ব্রিটিশরা অল্প সময়ের ব্যবধানে বেশ কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী পেলো। স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তিবন্দনা প্রবল এবং ব্যক্তিকে অপরিহার্য মনে করা হয়। ফলে যে কোনো প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় টিকে থাকার একটা প্রয়াস সবসময় চলে। বাংলাদেশ সামরিক শাসন উত্তরাধিকার সূত্রে পাকিস্তান থেকে লাভ করেছে। রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে আইউব খান দেশের সামরিক শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন এবং টানা দশটি বছর দেশ শাসন করেছেন। মৌলিক গণতন্ত্র নামে এক অদ্ভুত গণতন্ত্র কায়েম করেন। রাজনীতিক স্থিতিশীলতার কারণে সেসময়ে প্রভূত উন্নয়ন বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু স্বৈরশাসকদের উন্নয়ন টেকসই হয় না। ফলে আইউব খান যখন সাড়ম্বরে উন্নয়ন দশক উদযাপন করছিলেন তখনই দেখা দেয় গণবিস্ফোরণ এবং তাতে তার পতন ঘটে। পার্শ্ববর্তী ভারত বিশাল দেশ এবং বহু ভাষাভাষী ও সংস্কৃতি থাকার পরও কেবল গণতন্ত্রের কারণেই টিকে আছে। একটি মুহূর্তের জন্যও সেখানে সামরিক শাসন আসেনি। আসলে রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণেই জনগণ সামরিক শাসনকে অভিনন্দন জানায়।

স্বৈরশাসকরা জনমতকে ভয় পায়। জনগণ অবাধে তাদের মতামত প্রকাশ করুক তা কখনই চায় না। এরশাদ সাহেব দশটি বছর দেশ শাসন করেছে এবং উপজেলা ব্যবস্থা কায়েমসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন কম হয়নি, ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করলেও জনগণ উন্নয়নকে সানন্দে গ্রহণ না করে ক্ষমতা থেকে তাকে টেনেহিঁচড়ে নামায়। নিকট ইতিহাসে স্বৈরশাসক হিসেবে আমরা আরো দেখেছি ইরানের শাহ, লিবিয়ার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের পরিণতি। তারা শুধু নিজেদেরই ধ্বংস করেনি সাথে সাথে দেশকেও ধ্বংস করেছে। এমন পরিণতির পেছনে কারণ একটিই এবং সেটা হলো গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি। গণতন্ত্রে ক্ষমতায় আরোহণ এবং ক্ষমতা থেকে প্রস্থানের নিরাপদ ব্যবস্থা হলো সুষ্ঠু নির্বাচন। নির্বাচন ব্যবস্থা কলুষিত করায় দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় তা গত দু’টি নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। জনগণের দল আওয়ামী লীগ বর্তমানে জনগণের প্রতি আস্থা আনতে পারছে না। সময় যত পার হবে আস্থাহীনতা তত বাড়বে এবং পরিস্থিতি ক্রমেই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে চবে। এমন অবস্থা কারো জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাই দরকার সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা। তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে বিবদমান পক্ষদের পরস্পর আলোচনায় বসার ব্যবস্থা হওয়া দরকার। রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে একটি স্লোগান শুনি- ব্যক্তির চেয়ে দল বড়ো এবং দলের চেয়ে দেশ বড়ো। ফলে আমরা চাই, দেশের স্বার্থে সরকার ও বিরোধী দল পরস্পর আলোচনার টেবিলে বসুক। আল্লাহর বান্দাদের মাঝে সমঝোতা-সন্ধি আল্লাহর পছন্দ। সুরা হুজুরাতে আল্লাহপাক বিবদমান গ্রুপের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার জন্য যারা কোনো পক্ষের নয় তাদেরকে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন।

মানুষের মৌলিক মানবীয় গুণসমূহ হারিয়ে আমরা পশুর পর্যায়ে নেমে পড়েছি। মৌলিক মানবীয় গুণ বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি- সততা, বিশ্বস্ততা, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন, আমানত সংরক্ষণ, উদারতা, ক্ষমাশীলতার মতো গুণকে এবং যারা এসব গুণের অধিকারী তারাই সেরা, বিশ্বশাসনের অধিকার আল্লাহপাক তাদেরকেই দিয়ে থাকেন। এসব গুণ যাদের মাঝে নেই তারা সত্যিকার অর্থে মুসলিম নয়। ঈমানের দাবিদার অথচ যারা মিথ্যা বলে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, আমানতে খেয়ানত করে ও অশ্লীল ভাষায় ঝগড়া-ঝাঁটি করে রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকে মুনাফিক বলেছেন আর মুনাফিকের অবস্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে। মুহাম্মদ সা. আরো বলেছেন, আমার উম্মতেরা সব পারে, পারে না মিথ্যা বলতে ও বিশ্বাসঘাতকতা করতে। আমাদের যে চরিত্র তাতে কি আমরা মুহাম্মদ সা.-এর উম্মত দাবি করতে পারি? ঘুষ, দুর্নীতি, জনগণের অর্থ আত্মসাৎ, সম্মানহানি সবই জুলুম এবং আমার উপলব্ধি জালেমের জন্য জান্নাতে এক ইঞ্চি জায়গাও বরাদ্দ নেই (যদি তওবা না করে)। আমাদের সমাজে হিংসা-বিদ্বেষের চাষ হয় এবং বংশপরম্পরায় তা চলে। বিশেষ বিশেষ দিনে আল্লাহ তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন, করেন না কেবল মুশরিক ও হিংসুককে। বর্তমানে ক্ষমা করাকে দুর্বলতা মনে করা হয় অথচ আল্লাহপাক ক্ষমা করাকে সাহসিকতার পরিচায়ক বলেছেন। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে ক্ষমা প্রসঙ্গে অনেক কথা রয়েছে। প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করলে ক্ষমাকারীকে পুরস্কৃত করার প্রতিশ্রুতি স্বয়ং আল্লাহপাক করেছেন। কতো পুরস্কার দেবেন সেটি আল্লাহই ভালো জানেন। ক্ষমার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ সা.। মক্কা বিজয়ের পর তিনি তাঁর দুশমন সকলকেই ক্ষমা করেছিলেন। নিকট ইতিহাসের উদাহরণ হলেন নেলসন মেন্ডেলা, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন প্রমুখ। তাঁর বিখ্যাত উক্তি- ‘শাস্তির চেয়ে ক্ষমা মহৎ’।

আমরা একটি বিশ^াসী জাতি। জালেম ও মজলুম উভয়ই প্রতিদান পাবে এবং প্রতিদান এই দুনিয়ায় না পেলেও আখেরাতে পাবে- তাতে কোনো ভুল নেই। আল্লাহপাক ন্যায়বিচারক ও ইনসাফকারী। বিচারের দিনে জালেম থেকে মজলুমের সকল পাওনা আদায় করে মজলুমকে তিনি দান করবেন এবং তাতে পরিশোধ না হলে মজলুমের সকল গুনাহ জালেমকে দিয়ে তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। শিক্ষা গ্রহণের জন্য জালেমের শাস্তি অনেক সময় দুনিয়াতেও দিয়ে থাকেন। পরবর্তী প্রজন্ম যাতে সুখী ও সুন্দর জীবন যাপন করতে পারেন তার জন্য একটি নিরাপদ দেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা নিতেই হবে। তা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম তাদেরকে অভিশাপ দেবে। আল্লাহপাক আমাদের রাজনীতিবিদদের মাঝে উদারতা, সহনশীলতা ও ক্ষমাশীলতার গুণ দান করুন এবং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দেশ ও জাতির স্বার্থে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব:), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির