post

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের করাল গ্রাসে ব্যাংক খাত

হারুন ইবনে শাহাদাত

১৯ জানুয়ারি ২০২৩

রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র কেউ রাজনীতিমুক্ত নয়। তাই রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ রাখতে না পারলে, কোনো কিছুই শুদ্ধ থাকে না এবং থাকবে না। রাজনীতিতে পচন ধরলে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই সত্য উপলব্ধি করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মরহুম আকবর আলি খান তাঁর পরার্থপরতার অর্থনীতি গ্রন্থে শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি প্রবন্ধে লিখেছেন, “আধুনিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আজকের রাজনীতিবিদগণ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান না করে রাজনৈতিক সমাধান দিতে চান আর রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না করে আর্থিক সমাধান দিতে চান। এর কারণ হলো রাজনীতিবিদগণ অত্যন্ত অসহিষ্ণু। ক্ষণভঙ্গুর হলেও তারা চটজলদি জাদু দেখাতে চান ভোটারদের দেখাতে চান যে, তারা সব সমস্যার সমাধান জানেন। অথচ বাস্তবে এখন অনেক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা রয়েছে যার কোনো নিশ্চিত সমাধান নেই। এর ফলে হিতে বিপরীত হয়।” 

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে অর্ধ শতাব্দীরও আগে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। বরং সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বেড়েছে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’- বর্বর নীতির জয়জয়কার সর্বত্র। দুর্নীতিবাজরা দখল করে আছে রাজনীতিতে বড় বড় অনেক আসন। রাজনীতির সিঁড়ি তাদের দিয়েছে ক্ষমতা। ক্ষমতার দণ্ড হাতে পাওয়ার পর তা ব্যবহার করে নানান কূটকৌশলে তারা ব্যস্ত সম্পদের পাহাড় গড়তে। বিভিন্ন প্রজেক্ট-প্রকল্পের বারো বাজানোর সাথে সাথে হাত বাড়িয়েছে জনগণের আমানত ব্যাংকের দিকে। অথচ আধুনিক দুনিয়ায় আমানতদার ব্যাংক ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা অসম্ভব। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের কবলে পড়ে দেশের ব্যাংক খাত আজ শুধু আস্থা সংকটে নয় ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে আছে। দেশের অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই মনে করেন, দেশের ব্যাংক খাত এ মুহূর্তে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমনকি এই দুগর্তি থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও মুক্ত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনা যে দুর্গতির বড় উদাহরণ। পৃথিবীর আর কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এমন ডিজিটাল কায়দায় রিজার্ভ চুরির ঘটনা আরো ঘটেছে কি না তা এই প্রতিবেদকের জানা নেই।

দেশের ব্যাংক খাতের এই চরম অবস্থা তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে উল্লেখ্য করেছে, ‘ঋণ খেলাপ, বেনামি ঋণ ও অর্থ পাচারের মহোৎসবে জর্জরিত খাতটি।’ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রকৃত মালিকানার স্বচ্ছতা আইন প্রণয়ন ও কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডে যুক্ত হওয়ার তাগিদ দিয়েছে টিআইবি। ইসলামী ব্যাংকসহ কমপক্ষে তিনটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ভুয়া ও অস্তিত্বহীন কোম্পানির বিপরীতে কয়েক হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঋণের নামে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সরিয়ে নেওয়া হয় এসব অর্থ। গগনচুম্বী খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার এরই মধ্যে জর্জরিত ব্যাংক খাতকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়ার সংবাদ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য ভয়ঙ্কর উদ্বেগজনক।

ইসলামী ব্যাংকের বিষয়টি দিবালোকে আসার পর দেশে-বিদেশে ব্যাংক খাতের কেলেঙ্কারি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তবে এটিই প্রথম ঘটনা নয়। এর আগের ঘটনাগুলো আলোচিত হলেও সাধারণ জনগণের মধ্যে অতটা আতঙ্ক সৃষ্টি করে নাই। এর অবশ্য একাধিক কারণ আছে- ১. ইসলামী ব্যাংকের আমানতকারীদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ, ২. ব্যাংকটির প্রতি অগাধ আস্থা ছিল  গ্রাহকদের ৩. ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত ব্যক্তি এবং তাদের প্রভাবে প্রভাবিত বিপুল সংখ্যক মানুষের কল্যাণে সব সময় নিবেদিত ৪. রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের প্রিয় ব্যাংক। দেশের মহানগর, নগর থেকে নিয়ে গ্রামগঞ্জের প্রতিটি মানুষেই কোনো না কোনোভাবে এই ব্যাংকের সাথে জড়িত হওয়ার কারণে গোটা দেশেই সাড়া পড়েছে। কিন্তু আগে যেসব কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, তার প্রভাব সারা দেশে না পড়ার কারণ সেই ব্যাংকগুলোর সাথে দেশের একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িত ছিল, এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১৭ সালে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় জোরপূর্বক পরিবর্তন হয়। এ সময় দুই ব্যাংকের এমডিদেরও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। সেই সময় গ্রাহকদের মধ্যে কিছুটা আস্থার সংকট তৈরি হলেও এসব পরিবর্তনে তড়িঘড়ি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্মতি দিয়েছিল। তাই সাময়িক ধাক্কা আসলেও দ্রুতই তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। অবশ্য এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই ব্যাংক দুটিতে বড় অনিয়মের সূচনা ঐ পথ ধরেই। ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শনে বিশ্বাসী লোকদের কাছে থেকে ছিনতাই করে সরকার সমর্থক সাধারণ ব্যবসায়ীদের হাতে বিশেষ কায়দায় ইসলামী ব্যাংক তুলে দেওয়ার পর এমন সংকটজনক অবস্থা হয়েছে, বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

আরো যত ব্যাংক কেলেঙ্কারি ও ঋণ জালিয়াতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইসলামী ব্যাংক থেকে কাগুজে কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার ঘটনা প্রকাশের পর আবারও আলোচনায় এসেছে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি। আগে যেসব অনিয়ম হয়েছে, তার আদায় ও বিচারের কতটা অগ্রগতি হয়েছে, সে বিষয়টিও সামনে আসছে। গত এক যুগের প্রধান ঘটনাগুলোর মধ্যে আছে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা। এরপরই বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জনতা ও প্রাইম ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের অনিয়ম, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ অনিয়ম। এ ছাড়া আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম, ইউনিয়ন ব্যাংকের বেনামি ঋণ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ঘটনা। আবার ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের ঘটনা কয়েক বছর ধরেই আলোচনায়। উল্লিখিত ঘটনাগুলোর দিকে একটু নজর দেওয়া যাক-

১. হলমার্ক কেলেঙ্কারি : ২০১১ সালে হলমার্কসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (হোটেল শেরাটন) শাখা থেকে ঋণের নামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়, যা নিয়ে তখন বড় আলোচনা তৈরি হয়। বাতিল করা হয় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। আটক করা হয় সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও হলমার্কের মালিককে। সেই ঘটনার বিচারকাজ এখনো চলছে। টাকাও আদায় করতে পারছে না সোনালী ব্যাংক।

২. বেসিক ব্যাংকে অনিয়ম : ২০১১-১২ সালে বেসিক ব্যাংকের প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে প্রধান ভূমিকা রাখেন বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। এই টাকা থেকে ১১০ কোটি টাকা দিয়ে ঢাকায় সেনানিবাসে দেড় বিঘা জমির ওপর একটি বাড়ি কিনেছিলেন তিনি। এত বড় বাড়ি কেনার অর্থ আবদুল হাইয়ের ব্যাংক হিসাবে কিভাবে এসেছিল, তারও বিবরণ বিএফআইইউ পাঠিয়েছিল দুদককে। তবে শেখ আবদুল হাইয়ের কিছুই হয়নি। ব্যাংকও বড় অংশ টাকা আদায় করতে পারেনি।

৩. বিসমিল্লাহ গ্রুপ : ২০১২-১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপ কয়েকটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। ঘটনা প্রকাশের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান, পরিচালক আনোয়ার চৌধুরী, নওরীন হাসিবসহ ঋণগ্রহীতারা। ওই কেলেঙ্কারির ঘটনায় ক্ষতিতে পড়ে জনতা, প্রাইম, যমুনা, প্রিমিয়ার ও শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক।

৪. অ্যাননটেক্সের একক ঋণে বড় কেলেঙ্কারি : অ্যাননটেক্স গ্রুপের মালিক ইউনুস বাদল একাই। তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদারভাবে ঋণ দেয় জনতা ব্যাংক। এক গ্রাহককেই মাত্র ছয় বছরে তারা দেয় ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা। নিয়মনীতি না মেনে এভাবে ঋণ দেওয়ায় বিপদে ব্যাংক, গ্রাহকও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে পাওনা এখন সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি, যার বড় অংশই এখন খেলাপি।

৫. ক্রিসেন্ট কেলেঙ্কারি : ভুয়া রফতানি নথিপত্র তৈরি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। এভাবে সরকারের নগদ সহায়তা তহবিল থেকে ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা নিয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। অপকর্মে সহায়তা করার পাশাপাশি ক্রিসেন্ট গ্রুপকে অর্থায়নও করেছে জনতা ব্যাংক। ক্রিসেন্টের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা দুই হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। বিদেশে রফতানির ১ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। ফলে আটকে গেছে বড় অঙ্কের অর্থ। এ ঘটনায় কারও বিচার হয়নি।

৬. ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম : অনুমোদন পাওয়ার পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে ফারমার্স ব্যাংক। ফলে একসময় গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। সরকারের উদ্যোগে ব্যাংকটি বাঁচাতে মূলধন সহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও একটি বিনিয়োগ সংস্থা। এখন ঘুরে দাঁড়াতে নাম পরিবর্তন করে ফারমার্স ব্যাংক হয়েছে পদ্মা। তবে ঋণের টাকা আদায় করতে পারছে না।

৭. ইউনিয়ন ব্যাংকের বেনামি ঋণ : ভল্ট কেলেঙ্কারির পর ঋণেরও বড় অনিয়ম হয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকে। শুধু ট্রেড লাইসেন্সের ভিত্তিতে কোম্পানি গঠন করে ঋণের বড় অংশই বের করে নিয়েছে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান। আবার অনেক ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্সও ছিল না। কাগুজে এসব কোম্পানিকে দেওয়া ঋণের বেশির ভাগেরই খোঁজ মিলছে না এখন। ফলে এসব ঋণ আদায়ও হচ্ছে না। ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ।

৮. সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ : সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত ৩৪ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা ও বিতরণ করা ঋণ ছিল ৩১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। কিন্তু ২০২১ সালভিত্তিক পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এসআইবিএল-এর আরও ৫ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য। এতে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ২৩ শতাংশের বেশি।

৯. ন্যাশনাল ব্যাংক : পরিচালকদের মধ্যে কোন্দল, ক্রেডিট কার্ডে ডলার পাচার, বড় অঙ্কের সুদ মওকুফসহ নানা কারণে সংকটে ন্যাশনাল ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণও আটকে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ব্যাংকটিকে উদ্ধারে সমন্বয়ক নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি উত্তরণের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক খাতের এই অবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দায়ী করেছেন সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এখন অনেক ভুল সিদ্ধান্ত আসে। সেসব নীতিমালা ঋণখেলাপিদের আরও উৎসাহিত করছে। বিপরীতে ভালোমানের গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ আদায়ে বিমুখ হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এসব নিয়েও জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগুলো হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী। যাতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল, প্রভিশন ঘাটতি কমে আসে। এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা উচিত। এর আগেও কমিশনের মাধ্যমে ঋণখেলাপি সমস্যার সমাধান হয়েছে।’ 


তেলা মাথায় তেল ন্যাড়া মাথায় বেল

কথায় আছে, ‘তেলা মাথায় তেল ন্যাড়া মাথায় বেল ভাঙা হয়।’ এই বৈষম্যমূলক আচরণের সুযোগ পান দুর্বৃত্তরা। একজন সাধারণ গ্রাহক বাবা-মায়ের চিকিৎসা, ছেলে-মেয়ের টিউশন ফি পাঠাতে ব্যাংকে গেলে ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ফটোকপি লাগে, আয়ের উৎস কী, কেন পাঠানো হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি লিখে জমার চেক পূরণ করতে হয়। কারণ হিসেবে বলা হয় জঙ্গি অর্থায়ন ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা। কারো অ্যাকাউন্টে বিশেষ প্রয়োজনে ১০ লাখের ওপরে টাকা জমা হলেই অনুসন্ধান চলে এত টাকা তিনি কোথায় পেলেন? যে দেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৮২৪ ডলার অর্থাৎ  প্রায় ৩ লাখ টাকা। সে দেশের কোনো নাগরিক ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো বিশেষ প্রয়োজনে ব্যাংকিং চ্যালেঞ্জে ১০ লাখ টাকা লেন-দেন করলে নজরদারি করা ব্যক্তি অধিকার ক্ষুণœ হওয়ার শামিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এমন আচরণ ও হয়রানির ভয়ে হুন্ডির মাধ্যমে বৈধ অর্থের অবৈধ পথে লেনদেন বাড়ছে বলে তারা মনে করেন। সাধারণ গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে ন্যূনতম অংকের ঋণ নিতে গেলেও পরিমাণ হাজার রকম কাগজপত্র প্রদান করতে হয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রভাবে ভুয়া কিংবা নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে অবলীলায় হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে তুলে নেওয়া হচ্ছে? গত ১৪ বছরে পূর্বের তুলনায় মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ যখন প্রায় ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, বারবার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে কিংবা পুনঃতফসিল করেও খেলাপি ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না, তখন কাদের স্বার্থে কিংবা কাদের দেখে অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে এমন আগ্রাসী ঋণ প্রদান করা হয়? প্রকৃতপক্ষে কারা এ বিপুল পরিমাণ অর্থের সুবিধাভোগী? এ প্রশ্নের কারো কাছে নেই।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারের নির্ভরযোগ্য বহু তথ্য প্রতিনিয়ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রকাশ হচ্ছে। বিশেষ করে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনায় খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, পণ্য আমদানিতে ২০ থেকে ২০০ ভাগ পর্যন্ত বাড়তি দাম দেখানোর শতাধিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অন্যদিকে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রকাশিত হিসাব বলছে, বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৮২৭ কোটি মার্কিন ডলার।’ 

সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ না হলে শুধু ব্যাংক খাত নয় দেশের গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশবাসীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশে বিনিয়োগ বন্ধ হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে কয়েক বছর আগেও টাকার পাহাড় জমেছিল। সেই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, ব্যাংকে ক্রমাগত জমা টাকার পাহাড়সহ অর্থনীতির বেশ কিছু সূচক সাধারণের চোখে ইতিবাচক মনে হলেও দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা মন্তব্য করেছিলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জালে আটকা পড়েছে দেশের অর্থনীতি। অবশ্য এ দেশের অর্থনীতিবিদদের অনেক অনেক বছর আগে সেই ১৯৯৫ সালে গ্যারি স্নাইইডার (Gary snyder) তার প্লেস ইন স্পেস (place in space)  গ্রন্থে লিখেছেন, “a continually`growing economy' is no longer healthy but a cancer” তিনি অর্থনীতির এমন অগ্রগতিকে মানবদেহের মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে তুলনা করেছেন। ক্যান্সার আক্রান্ত মানবদেহে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধি মৃত্যু ডেকে আনে, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি তেমন ক্ষতিকর। এই প্রতিবেদক উল্লিখিত সতর্কবাতা দিয়ে ২০১৪ সালে সেপ্টেম্বরে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। কিন্তু সেই বার্তার আলোকে দেশে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং ২০১৮ সালে রাতের ভোটে নির্বাচিত সরকারের অপশাসনে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আরো বেড়েছে। তাদের করাল গ্রাসের কবলে পড়ে দেশের অর্থনীতিকে মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ইসলামী ধারার ব্যাংকিং খাত। অর্থনীতির এই ক্যান্সার দূর করতে দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। অর্থনীতিবিদ হ্যান্স এফ সেনহলজ (Hans F. Sennholz)-এর ভাষায়, The connection between economics and politics is clearly visible. Economic production sustains human life which, for most people, is the most important concern in life. The prestige of democratic government, its rise and fall, usually depend on its economic performance. Economic policies must please the greatest number of people who decide democratic elections and re-elections. অর্থাৎ অর্থনীতির সাথে রাজনীতির সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। অর্থনীতির উৎপাদনমুখী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার সাথে অধিকাংশ মানুষের অস্তিত্ব জড়িত। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের উত্থান-পতন নির্ভর করে তাদের আর্থিক কর্মকাণ্ডে সাফল্যের ওপর। অধিকাংশ জনগণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত বা পুনঃনির্বাচিত তাদেরকেই করার সিদ্ধান্ত নেয়, যাদের অর্থনৈতিক পলিসি তাদের উন্নয়নে সহায়ক।’

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও এমপিদের অনেকেই মনে করেন দেশের উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের প্রয়োজন নেই। তারা প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা ক্ষমতার অন্ধ মোহে তা উপলব্ধি করতে চাননি। তাদের এই লোভের আগুনে গোটা দেশ আজ জ¦লছে। তারা উন্নয়নের নামে লুট-পাটের চমকের ফাঁকি আর গোপন নেই। অর্থনৈতিক সংকটে পড়া অসহায়  মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। এই ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই দেশ ও জনগণকে বাঁচাতে গড়তে জনগণের ভোটাধিকার দিয়ে দেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের রাজপথের বিরোধী দলগুলো এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের আহবানে সাড়া না দিলে শুধু ব্যাংক কিংবা অর্থনীতি নয় গোটা দেশই দুর্র্বৃত্তদের করাল গ্রাসের ভোগে পরিণত হবে। অতএব সাধু সাবধান!

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক 

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির