post

রাসূলুল্লাহর (সা) বিদায় হজ্জ : মানবিক সংস্কৃতির বিজয়

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

২৪ জুলাই ২০২৪

হযরত মুহাম্মদ (সা) এর নবীজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যায় বিদায় হজ্জ। এই হজ্জে গণমানুষের জন্য তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় বিভূষিত। বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য এমন কোনো দিক নেই, যার ছোঁয়া এই মূল্যবান ভাষণে লাগেনি। মূলত বিদায় হজ্জের ভাষণ মহানবী (সা)-এর তেইশ বছরের নবুয়তি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস। এ ভাষণে আছে কিয়ামত অবধি বিপদসংকুল পৃথিবীর উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান। এ ভাষণ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার এক পূর্ণাঙ্গ ও বাস্তব কর্মসূচি। মানবিক সংস্কৃতির প্রাগ্রসরমান প্রক্রিয়া ও রূপরেখার যে ধারাবাহিকতা হযরত আদম (আ) থেকে শুরু হয়েছিল, তারই পূর্ণ বিকাশ ও পরিসমাপ্তি ঘটেছিল এ ভাষণের মধ্য দিয়ে। এ ভাষণের পর তিন মাস অতিবাহিত হতে না হতেই তিনি এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চিরকালীন প্রশান্তির জগতে পাড়ি জমান। 

হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জন্মকালের সময়টাকে বলা হয় আইয়্যামে জাহেলিয়াত। বিশ্বমানবতা তখন মহাকালের মহাদুর্যোগে নিপতিত। ঘরে ঘরে পারিবারিক দ্বন্দ্ব। সামাজিক বৈষম্য ও সংঘাত পুরো বিশ্বজুড়ে। অর্থনৈতিক বঞ্চনা আর রাজনৈতিক শোষণের শিকারে মানবিক সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে পড়েছিলে। মুক্তির সন্ধানে উপায়ান্ত হারিয়ে মানবতা তখন পুরোপুরি নিস্তেজ। মানবিক সংকটের এমন সময়ে মানব মুক্তির জন্য আল্লাহর করুণা হয়ে মহানবী (সা)-এর আবির্ভাব হয়েছিল এই পৃথিবীতে।

হযরত মুহাম্মদ (সা) জন্মের পর থেকে দীর্ঘ চল্লিশটি বছর নিজের মেধা আর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে সামাজিক অস্থিরতা দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। পরে চল্লিশ বছর বয়প্রাপ্তির পর নবুওয়ত লাভ করে মহান আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী তেইশ বছরের বিরামহীন চেষ্টায় মানব সমাজে বিরাজিত সকল পঙ্কিলতার অবসান ঘটিয়ে মুক্তির ঠিকানায় উপনীত হতে পেরেছিলেন তিনি। বাকি ছিল শুধু চূড়ান্ত ঘোষণা। সেই ঘোষণাই তিনি দিয়েছিলেন হিজরি দশম বর্ষে বিদায় হজ্জের সমাবেশে।

জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাখো জনতার কণ্ঠে নবুয়তি দায়িত্ব যথার্থভাবে পালনের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুখে ‘আল-বিদা’ ‘আল-বিদা’ শব্দ শুনে মুসলিম মানসে কষ্টের পাহাড় জমেছিল। আকাশ বিদীর্ণ করা আর্তনাদ ও নিঃশব্দ আকুতিতে সেদিন ভারী হয়েছিল আরাফার আকাশ। ‘আমি কি পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি?’ অশ্রুসিক্ত নয়নে সকলেই একবাক্যে উচ্চারণ করেছেন ‘নায়াম’ হ্যাঁ। মূলত বিদায় হজ্জে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি ভাষণ প্রদান করেছিলেন। এক. আরাফার ময়দানে। দুই. কুরবানির দিন, মিনায়। তিন. ‘আয়্যাম-ই-তাশরিকে’র মধ্যবর্তী স্থানে, মিনায়। এই পূর্ণাঙ্গ ভাষণকে ‘হাজ্জাতুল বালাগ’ ‘হাজ্জাতুত তামাম’ বা ‘হাজ্জাতুল বিদা’ বা বিদায় হজ অভিহিত করা হয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিদায় হজ্জ অনুষ্ঠিত হয় দশম হিজরি সনে। লক্ষাধিক সাহাবী উপস্থিত ছিলেন সেখানে। এটাই তাঁর জীবনের সর্বশেষ হজ্জ ও সর্বশেষ বিশ্ব সম্মেলন। সে কারণেই বিদায় হজ্জের ভাষণ ছিল কেয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির জন্য স্থায়ী দিক নির্দেশক। এই হজ্জ অভিযাত্রার আমীর ও প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি নিজে। সীরাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এ উল্লেখ আছে যে, এই হজ্জে আরাফাতের ময়দানে ও মিনায় তিনদিনে বিভিন্ন সময় ৩১টি বিষয়ে তিনি উম্মতকে সতর্ক করেন। 

সাম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষনা ছিলো বিদায় হজ্জে। ধর্ম, জাতি, বর্ণবৈষম্যের কারণে হারিয়ে যায় মানবিক মূল্যবোধ। মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারির মতো অমানবিক সংস্কৃতি। প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান ইসলামের অন্যতম মৌলিক সংস্কৃতি। অথচ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে আধুনিক পৃথিবীর রাতগুলোকে যতোই দিনের আলোর মতো জ্বলজ্বল করে তোলার চেষ্টা চলছে, ততোই মানুষের অন্তঃকরণ ক্রমেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর সর্বত্র আজ হত্যা, লুণ্ঠন, ছিনতাই, সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই। ভূলুণ্ঠিত মানবতা নিভৃতে কাঁদছে। তাইতো বিদায় হজ্জের মানবিক সংস্কৃতির সুবাতাস ছড়িয়ে দেওয়া আজ অপরিহার্য বিষয়।

আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ। তার জীবন, সম্পদ আর ইজ্জতের নিরাপত্তায় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবিকতার ঘোষণা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হামদ ও সালাতের পর সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন, হে মানব সকল! আজকের দিন, এই মাস আর এই সমাবেশের স্থান তোমাদের নিকট যেমন পবিত্র; তেমনি তোমাদের জীবন, সম্পদ আর ইজ্জত পরস্পরের নিকট পবিত্র ও সুরক্ষিত। এগুলোর ক্ষতিসাধনকে আল্লাহ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। ‘শুনে রাখো, জাহেলী যুগের সকল কিছু আমার পায়ের তলে পিষ্ট হলো। জাহেলী যুগের সকল রক্তের দাবী পরিত্যক্ত হলো। আমাদের রক্তসমূহের প্রথম যে রক্তের দাবি আমি পরিত্যাগ করছি, তা হলো রাবীয়াহ ইবনুল হারেছ বিন আব্দুল মুত্তালিব-এর শিশু পুত্রের রক্ত। যে তখন বনু সাদ গোত্রে দুগ্ধ পান করছিল, আর হোযাইল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করেছিল’। 

শ্রেণী, গোত্র ও বর্ণের ভিত্তিতে চলে আসা কৌলিন্য ভড়ং মানব সমাজকে বহুধা বিভক্ত করে রেখেছিল। এসবের অবসানকল্পে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন, ‘হে মানবম-লী! তোমাদের রব একজন। তোমাদের আদি পিতা একজন। প্রত্যেকেই আদমের সন্তান। আর আদম মাটির তৈরি। আল্লাহ তায়ালা পারস্পরিক পরিচিতির সুবিধার্থে বিভিন্ন সমাজ ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছেন। আরবের ওপর যেমন অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তেমনি অনারবের ওপর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই আরবের। একইভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের আর কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব বা বৈশিষ্ট্য নেই। শ্রেষ্ঠত্ব, বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার একমাত্র ভিত্তি হলো তাকওয়া তথা আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে।’ ‘যদি তোমাদের উপর নাক-কান কাটা কৃষ্ণকায় গোলামও আমীর নিযুক্ত হন, যিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত করেন, তোমরা তাঁর কথা শোনো ও মান্য করো’।

‘হে মানবম-লী! আল্লাহর কসম, আমি জানি না আজকের পরে আর কোনোদিন তোমাদের সঙ্গে এই স্থানে মিলিত হতে পারব কি না। অতএব আল্লাহ রহম করুন ঐ ব্যক্তির উপরে যে ব্যক্তি আজকে আমার কথা শুনবে ও তা স্মরণ রাখবে। কেননা অনেক জ্ঞানের বাহক নিজে জ্ঞানী নয় সে অন্যের নিকট জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায় এবং অনেক জ্ঞানের বাহক তার চাইতে অধিকতর জ্ঞানীর নিকটে জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়। 

জেনে রেখো, তিনটি বিষয়ে মুমিনের অন্তর খিয়ানত করে না : (ক) আল্লাহর উদ্দেশ্যে এখলাসের সাথে কাজ করা। (খ) শাসকদের জন্য কল্যাণ কামনা করা এবং (গ) মুসলমানদের জামায়াতকে আঁকড়ে ধরা। কেননা তাদের দোয়া তাদেরকে পিছন থেকে রক্ষা করে’।

সুদ সকল প্রকার সামাজিক বৈষম্যের উৎস। পুঁজিবাদী সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট আজকের মানবসমাজ। সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চিরতরে মূলোৎপাটন করেছেন এই ভাষণে। ইসলামের সাম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জাকাতকে প্রাতিষ্ঠানিকরূপ দিতে সুদব্যবস্থা উচ্ছেদের বিকল্প নেই। তাই হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন, জাহেলি যুগের সুদপ্রথা চিরদিনের জন্য বাতিল করা হলো। এখন থেকে তোমরা শুধু তোমদের পাওনার আসলটা ফেরত পাবে। আর এই ঘোষণা এই মুহূর্ত থেকে কার্যকর করার জন্য আমি আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের পাওনা সুদ-আসল সম্পূর্ণটাই বাতিল করে দিলাম।

নারী ছিল তৎকালীন সমাজে পুরুষের ভোগের সামগ্রী। জীবন, সভ্যতা ও সমাজের সূতিকাগার নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন ছিল সব থেকে বড় বিষয়। আধুনিক সমাজে ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে প্রচার করে নারীর অধিকার রক্ষার সস্তা শ্লোগানধারী কিছু মানুষ বলে থাকে, নারী নির্যাতনের জন্য ধর্ম ও ধর্মীয় ফতোয়াই দায়ী। এই চটকদার শ্লোগান দিয়ে তারা নিজেরা নারীকে জাহেলি যুগের মতো ভোগ্য পণ্য হিসেবে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে। অথচ বিদায় হজ্জের ভাষণে এসেছে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। বিদায় হজ্জের দিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন, পুরুষ নারীর ওপর দায়িত্বপ্রাপ্ত। সুতরাং তোমরা নারীদের ব্যপারে আল্লাহকে ভয় করবে। জেনে রেখো, স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে। তেমনি তোমাদের ওপরও স্ত্রীদের অধিকার আছে। তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ আল্লাহর আমানত হিসেবে, আর আল্লাহর বিধানমতে তোমরা তাদেরকে হালাল করে নিয়েছ।

‘মনে রেখ, অপরাধের শাস্তি অপরাধী ব্যতীত অন্যের ওপরে বর্তাবে না। পিতার অপরাধের শাস্তি পুত্রের ওপর এবং পুত্রের অপরাধের শাস্তি পিতার ওপর বর্তাবে না’। মুসলিম সেই, যার জবান ও হাত থেকে অন্যেরা নিরাপদ থাকে। আর মুজাহিদ সেই, যে আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত করে এবং মুহাজির সেই, যে সকল প্রকার অন্যায় ও পাপকর্মসমূহ পরিত্যাগ করে’।

অতীত থেকে চলে আসা দাসপ্রথা ছিল মানব সমাজের জন্য সব থেকে ঘৃণ্য প্রথা। মানুষ মানুষের মালিক, এ এক বিরাট অভিশাপ! বর্তমান বিশ্বে দাস প্রথার মতোই শ্রমিক সমস্যা সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিদায় হজ্জের ভাষণ দাসপ্রথা বিলুপ্তির পথই রচনা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রমনীতিও ঘোষণা করেন। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে- এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শ্রমনীতি। তিনি সেদিন ঘোষণা করেছিলেন, ‘সাবধান! দাস-দাসীদের ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থাকবে। মনে রাখবে, তারা তোমাদের ভাই। তোমাদের যেমন একটি হৃদয় আছে তেমনি তাদেরও একটি হৃদয় আছে। তারা বেদনায় আহত হয়, আনন্দে আপ্লুত হয়। তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তাই খেতে দেবে, তোমরা যেমন কাপড় পরবে তাদেরকেও তেমনি কাপড় পরতে দেবে। তাদের ওপর সাধ্যাতিরিক্ত শ্রমের বোঝা চাপিয়ে দেবে না। যদি কোনো কারণে চাপিয়ে দিতে হয়, তবে তুমিও তাতে অংশীদার হও।’

মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও ঐক্যের ভিত মজবুত করা ও নিরপরাধ মানুষ হত্যা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে লোক সকল! শুনে রাখো, মুসলমান জাতি পরস্পর ভাই ভাই। অতএব কোনো মুসলমানের জন্য তার ভাই-এর কোনো বস্তু হালাল নয় কেবল অতটুকু ব্যতীত যতোটুকু সে তাকে খুশী মনে দেয়। আর তোমরা যুলুম করো না। আমার অবর্তমানে তোমরা পরস্পর মারামারি ও হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়ে কাফির হয়ে যেও না। মনে রেখো! শয়তান এ বিষয়ে নিরাশ হয়ে গেছে, যারা নামাজ আদায় করে তারা শয়তানের পূজারি হবে না। তবে হ্যাঁ, সে তোমাদের বিভিন্ন রকমের চক্রান্তের উসকানি দেবে।’ ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি এবং তার সাথে যুদ্ধ করা কুফরি।’ 

‘হে জনগণ! শুনে রাখো আমার পরে কোনো নবী নেই এবং তোমাদের পরে কোনো উম্মত নেই। অতএব ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করো। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করো। রমজান মাসের সিয়াম পালন করো। তোমাদের মালের যাকাত দাও। তোমাদের আমীরের আনুগত্য করো। তোমাদের প্রতিপালকের জান্নাতে প্রবেশ করো’।

সত্যিকার অর্থে ইসলামে মানবাধিকার রক্ষা করাকে সচয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মূলনীতি হলো, কাউকে তার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে কথা দিয়ে বা কাজ দিয়ে কষ্ট দেওয়া ও মানহানি করা নিষেধ। তা শারীরিক বা আত্মিক যাই হোক। ইসলামে অন্যায়ভাবে অন্যকে আঘাত করা নিষিদ্ধ। কারও সম্পর্কে কুৎসা প্রচার, বিদ্রুপ আচরণ, গালাগাল করা ও মিথ্যা অপপ্রচার চালানো অবৈধ। জীবিত ও মৃত সব মানুষের মর্যাদা রক্ষায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে তার মৃতদেহ নিয়ে উল্লাস করা, মৃতদেহকে ক্ষতবিক্ষত করে বিকৃত করা ইসলাম সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যায়ভাবে মানুষের রক্তপাত বন্ধ, সুদের কুফল, বর্ণবৈষম্যের ভয়াবহতা, স্বজনপ্রীতির বিরূপ প্রভাব, জাহেলি যুগের মানসিকতা পরিহার করার বিষয়ে মুসলমানদের জোরালো নির্দেশ প্রদান করেন। বিদায়ি ভাষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর সুন্নাহর কথা ঘোষণা করেছেন। লেনদেন, বিচার, অর্থনীতি, জ্ঞানবিজ্ঞান, শিক্ষাদীক্ষা, চরিত্র, শান্তি-নিরাপত্তাসহ জীবনের সব বিষয়েই সঠিক ও যথার্থ দিকনির্দেশনাই এখানে আছে। তিনি বলেন, ‘হে জনগণ! আমি তোমাদের নিকট এমন বস্তু রেখে যাচ্ছি, যা মজবুতভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ’। ‘হে জনগণ! আমি কি তোমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছি (এ কথা তিনি দুবার বললেন)? লোকেরা বলল, হ্যাঁ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক! আর তোমাদের উপস্থিতগণ যেন অনুপস্থিতগণকে কথাগুলো পৌঁছে দেয়। কেননা উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকের চাইতে অনুপস্থিত যাদের নিকট এগুলো পৌঁছানো হবে, তাদের মধ্যে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি থাকতে পারে’। এভাবে বিদায় হজ্জের ভাষণের বার্তা বিশ্ব মানবতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে লাখ লাখ সাহাবী আপন বাসস্থান ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। ঘরে ঘরে আজ পৌঁছে গেছে ইসলামের শান্তির বাণী। এ দায়িত্ব আজো চলমান। আমাদের সজাগ হতে হবে মানবিক সংস্কৃতির এই সুবাতাস ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার জন্য।

লেখক: কবি ও গবেষক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির