রাসূল সা.
মুহাম্মদ আবদুল জব্বার
২৬ এপ্রিল ২০২২
রাসূল সা.-এর সমগ্র জীবন আমাদের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। তাঁর সফল জিন্দেগির অন্যতম হলো ইসলামকে মানবতার মুক্তির জন্য পৃথিবীতে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। রাসূল সা. তাঁর সাহাবীদের নিয়ে আল্লাহর নির্দেশে একটি কার্যকর ইসলামী আন্দোলন শুরু করেছিলেন, যার মাধ্যমে মানবতা প্রকৃত মুক্তির দিশা পেয়েছিল। তাই আল্লাহ তায়ালা ইসলামী আন্দোলনকে মুমিনদের জন্য ফরজ করে দিলেন। কুরআনিক ভাষায় ইসলামী আন্দোলকে বলা হয় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্। আন্দোলন মানে কোনো সংগঠিত জনগোষ্ঠীর বিশেষ উদ্দেশ্যে সম্মিলিত প্রয়াস। আর জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্ বা ইসলামী আন্দোলন মানে ইসলামকে মানবজীবনে প্রতিষ্ঠা করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। দুনিয়ায় যার চূড়ান্ত রূপ হলো আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। রাসূল সা. সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মদিনায় ও পরবর্তীতে মক্কাতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। রাসূল সা.-এর তিরোধানের পর খোলাফায়ে রাশেদিনরা ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্ধ জাহান জুড়ে সোনালি যুগের নতুন অধ্যায় রচনা করেন। এতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইসলামী আন্দোলেনের চূড়ান্ত রূপ ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের সুফল পেয়েছিল।
রাসূল সা. আল্লাহর নির্দেশে কিভাবে একটি বাস্তবমুখী বিজ্ঞানসম্মত মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে কায়েমি স্বার্থবাদীদের মূলোৎপাটন করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা বর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত দাবিদার অনেকের নিকট সুস্পষ্ট নয়। যে কারণে ইসলামের সঠিক স্বরূপ নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। শত্রুপক্ষ এমন বিভ্রান্তিকে পুঁজি করে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হচ্ছে। তাই নিরেট ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত জনরা রাসূল সা.-এর ইসলামী আন্দোলনের নীতি ও কৌশলসমূহ হৃদয়ঙ্গম করা জরুরি।
রাসূল সা.-এর ইসলামী
আন্দোলনের নীতি
এক. আল্লাহর নির্দেশের অনুসরণ : রাসূল সা. তাঁর জীবন ও ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্ত পরিচালনা করেছেন আল্লাহর নির্দেশনা মাফিক। তাঁর জীবন পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি ছিল আল্লাহর অহি। “রাসূল সা. নিজ থেকে কোনো মনগড়া কথা বলতেন না, যা বলতেন তা অহি দ্বারা প্রাপ্ত হয়ে।” (সূরা নজম : ৩-৪) রাসূল সা.কে আল্লাহ তায়ালা সেই মোতাবেক তাঁর সাথীদের জীবন পরিচালনার জন্য নির্দেশ করেছেন, “রাসূল তোমাদেরকে যা কিছু প্রদান করেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে বিরত থাকতে বলেন তা থেকে বিরত থাক এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর।” (সূরা হাশর : ৭)
দুই. শাহাদাতে আলান্নাস : রাসূল সা. নিজে এবং নিজের সাথীদেরকে শাহাদাতে আলান্নাস বা বাস্তব সাক্ষী রূপে সমাজের সামনে উপস্থাপন করেছেন। শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-এর অন্যতম পরিচয় যেমনি দায়ী ইলাল্লাহ ছিলেন তেমনি তাঁর অন্যতম প্রধান পরিচয় হলো দাওয়াতের বাস্তব নমুনা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করা। “আমি তোমাদের প্রতি রাসূল পাঠিয়েছি সত্যের সাক্ষীরূপে। যেমন সাক্ষীরূপে রাসূল পাঠিয়েছিলাম ফেরাউনের প্রতি।” (সূরা মুজাম্মিল : ১৫) রাসূল সা. ও তাঁর সঙ্গীদের সাক্ষ্য দানের ব্যাপারে আল্লাহ কুরআনের বিভিন্ন স্থানে নির্দেশ করেছেন। যেমনÑ “এভাবে আমি তোমাদের একটি উত্তম জাতিরূপে গড়ে তুলেছি- যাতে করে তোমরা গোটা মানবজাতির জন্য সত্যের সাক্ষ্যদাতা (বাস্তব নমুনা) হতে পার এবং রাসূল সা. যেন তোমাদের জন্য সাক্ষ্য হন।” (সূরা আল বাকারা : ১৪৩) তিনি আল আমিন ছিলেন; ছিলেন সমাজসেবক। তিনি আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা এবং আদর্শ সেনাপতিও ছিলেন। তিনি শুধুই নসিহতকারী ছিলেন না বরং তিনি নসিহতের প্রকৃষ্ট জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন। রাসূল সা.-এর জীবদ্দশায় প্রতিটি যুদ্ধে তিনি প্রধান সেনাপতির নেতৃত্ব দিয়েছেন, খন্দকের যুদ্ধে মাটি খননের কাজ তিনি নিজেই সর্বাগ্রে শুরু করেছেন। তিনিই সবার আগে সালাম দিতেন, যা নসিহত করতেন তা নিজেই আমল করতেন। রাসূল সা. ছিলেন তাঁর সাহাবীদের জীবনগঠনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
তিন. পরামর্শভিত্তিক কাজ : রাসূল সা. ইসলামী আন্দোলনসহ জনসম্পৃক্ত প্রায় কাজই পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন। আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা.কে সহযোগীদের পরামর্শ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। “নিজেদের যাবতীয় কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন কর।” (সূরা আশ শূরা : ৩৮)
উপরোক্ত মূলনীতিগুলো ছিল রাসূল সা.-এর আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি। যার বদৌলত এবং আল্লাহর রহমতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ইসলাম পৃথিবীর বুকে অন্যতম জীবনব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
রাসূল সা.-এর ইসলামী
আন্দোলনের কৌশল
রাসূল সা. ইসলামী আন্দোলনের চূড়ান্ত মঞ্জিলে পৌঁছার ক্ষেত্রে নানা বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন। সব বাধা মাড়িয়ে ধৈর্য, সাহসিকতা ও কৌশলে তিনি সকল বাধা অতিক্রম করেন। দাওয়াত, সত্যের সাক্ষ্য, কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ্, ইকামাতে দ্বীন ও আমর বিল মারুফ ছিল রাসূল সা.-এর কৌশল প্রক্রিয়ার অন্যতম, যার মাধ্যমে তিনি দ্বীনকে চূড়ান্ত মঞ্জিলে উন্নীত করেন।
ক. দাওয়াত ও তানজিম : মানুষের ওপর যে মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে মানুষকে ওয়াকিফহাল করার জন্য আল্লাহ তায়ালা রাসূলকে তাঁর দিকে আহবান করার পদ্ধতি নির্দেশ করেছেন, “ডাক তোমার রবের দিকে হিকমতের (কৌশলের) সাথে।” (সূরা নাহাল : ১২৫) তাই রাসূল সা.ও দাওয়াতকে তাঁর জীবনের মিশন হিসেবে গ্রহণ করলেন। যে সমাজে যে মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে সে সমাজের মানুষের নিকট প্রথমে তাঁর স্বরূপ বাস্তবে উপস্থাপন করাটা রাসূলদের প্রথম কাজ ছিল। সে কারণে রাসূল সা.-এর জীবনে কথা ও কাজের কোনো হের ফের হয়নি। মক্কায় তিনি গোপনে কৌশলে দাওয়াত দিলেন। মদিনায় হিজরত করে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রকাশ্যে মদিনাবাসীকে দাওয়াত দিলেন। বিভিন্ন দেশের শাসকদেরকে তিনি দূত মারফত ইসলাম গ্রহণ করার দাওয়াত দিলেন। তিনি তাঁর দাওয়াতি মিশন করতে গিয়ে যেখানে যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন বিতর্ক এড়িয়ে নতুন পথে এগিয়ে গিয়েছেন। শত্রুকে আপন করে নিয়েছেন। তায়েফের প্রান্তরে প্রস্তরের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন তবু তিনি এই জনপদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। রাসূল সা. ইসলামী আদর্শের ঝাণ্ডাবাহী একদল মুজাহিদ তৈরি করলেন, যাদেরকে রাসূল সা. যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। রাসূল সা. ছিলেন এদের মূল প্রশিক্ষক। যিনি তাদেরকে পবিত্র করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা প্রদান করেন। যারা নিজেদেরকে চূড়ান্তভাবে আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণ রূপে সোপর্দ করেছিলেন। রাসূল সা. কাফিরদের সহ¯্র বাধা মাড়িয়ে ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও কৌশলের মাধ্যমে মক্কা ও মদিনাবাসীর নিকট ইসলামের আহবান পৌঁছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং জাহেলি অমানিশার অন্ধকার থেকে পরিত্রাণের জন্য ইসলাম তাদের জীবনে এক অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে কারণে রাসূল সা. মদিনায় হিজরত করলে তারা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন।
দুই. আল্লাহর পথে সংগ্রাম : রাসূল সা. তাঁর পরিচালিত আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে নানা ধরনের বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন। গোপনে বেশ কিছুদিন তাঁর আন্দোলনকে সফল করার জন্য চেষ্টা করলেও আরব পৌত্তলিকদের জুলুম-নির্যাতনের কারণে তিনি আল্লাহর নির্দেশে হিজরত করেছিলেন এবং সাহাবীদের মধ্যে যারা জীবন-মরণের সম্মুখীন হয়েছিলেন তাদেরকে আবিসিনিয়ায় ও মদিনায় হিজরতের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরবর্তীতে রাসূল সা. মদিনায় হিজরতের পূর্বেই সাহাবীদের মাধ্যমে মদিনায় ইসলামের আহবান ও আল্লাহর হুকুমাত কায়েমের মিশন শুরু করে দিয়েছিলেন। যে সময়কালে আল্লাহর পথে একদল নিবেদিত ও সমাজপরিচালনার যোগ্য মানুষ তৈরি করেছিলেন। তখনই রাসূল সা.-কে আল্লাহর পথে লড়াইয়ে নির্দেশ দেন, “ফেতনা দূরীভূত হয়ে দ্বীন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করতে থাক।” (সূরা আল বাকারা : ১৯৩) রাসূল সা. কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় জাগতিক দৃষ্টিতে শক্তি সামর্থ্য কম থাকলেও তিনি যুদ্ধের প্রারম্ভেই তাদের ভেতরে কৌশলে ভয় সৃষ্টি করে দিতেন। রাসূল সা. গুপ্তচরের মাধ্যমে তাদের প্রস্তুতির খবর পেয়ে যেতেন, যুদ্ধে যাওয়ার পথ পরিবর্তন করতেন। এছাড়াও যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শত্রুশিবিরের সাথে চুক্তি, যুদ্ধ ক্ষেত্রে বেশি সংখ্যক রান্না করার চুলা খনন করে উনুন জ্বালিয়ে এবং স্বল্প সংখ্যক টয়লেট নির্মাণের মতো কৌশল অবলম্বন করে মুসলিম শিবিরে বেশি সংখ্যক উপস্থিতি জানান দেয়ার মতো কৌশল অবলম্বন করেন!
রাসূল সা. মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করার সময় মদিনাবাসীরা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন। ভিন্ন মতাদর্শীরাও মদিনা চুক্তির মাধ্যমে রাসূল সা.-কে নেতা হিসেবে গ্রহণ করলেন। রাসূল সা. এখান থেকে বদর ও উহুদ যুদ্ধ পরিচালনা করলেন। রাসূল সা. মদিনায় হিজরত করলেও তিনি নিজের মাতৃভূমিকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেননি। তাই মক্কাতেও ইসলামী ঝাণ্ডা কায়েমের লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে লাগলেন। তিনি মক্কায় কাবা তাওয়াফের সিদ্ধান্ত নিলেন। সাহাবীদের নিয়ে তিনি মক্কার দোরগোড়ায় এলে কাফিরদের বাধার সম্মুখীন হলেন। আবু সুফিয়ানরা রাসূল সা.-কে এবার হজ করা থেকে বিরত থাকতে আহবান জানালেন। রাসূল সা. রক্তপাত পছন্দ করলেন না, তিনি এবার হজ না করে ফিরে যাবেন এবং আগামী বছর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে হজ করবেনÑ এই শর্তে কাফেরদের সাথে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’তে আবদ্ধ হলেন। সাময়িকভাবে মনে হয়েছিল এই চুক্তির মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী। তাই হজরত ওমর (রা)সহ অনেকে এই চুক্তির পর মন খারাপ করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা এই চুক্তিকে ফাতহুম মুবিন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পরবর্তী বছর রাসূল সা. তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে মক্কায় আগমন করে হজ পালন করলেন এবং বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করলেন। যারা ‘হুদায়বিয়া সন্ধি’র পর মনোকষ্ট পেয়েছিলেন তারা ফাতহুম মুবিনের অর্থ মক্কা বিজয়ের পরে বুঝতে পেরেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় রাসূল সা. কতটা ধৈর্য ও কৌশল অবলম্বন করে পরিস্থিতি ইসলামের অনুকূলে নিয়ে আসেন!
তিন. ইকামাতে দ্বীন : রাসূল সা. দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষকে আকৃষ্ট করলেন, দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে পরীক্ষিত যোগ্য লোক তৈরি করলেন এবং ইসলামবিদ্বেষী মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে ইসলামকে আরব সমাজে একটি কার্যকর শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উপযুক্ততার দ্বার প্রান্তে উন্নীত করলেন। তখন আল্লাহ রাসূল সা.কে নির্দেশ করলেন, “তোমরা দ্বীনকে কায়েম কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না।” (সূরা শূরা : ১৩) রাসূল সা. বিদায় হজের ভাষণে ইসলামের পূর্ণতার বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বীকৃতি পেলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করলাম।” (সূরা মায়েদা : ৩)
চার. আমর বিল মারুফ ও নেহি আনিল মুনকার বা সৎকাজের আদেশ প্রদান ও অসৎকাজে বাধা দানের কাজ : রাসূল সা. যখন দ্বীন কায়েম করলেন তখন সৎকাজের আদেশ প্রদান ও অসৎকাজে বাধা দানের জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি এটি পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে কার্যকর করেছিলেন। সরকারি প্রশাসনের মাধ্যমে এই কাজের আঞ্জাম পাওয়াটাই শরিয়তের আসল স্পিরিট, যা রাসূল সা. তাঁর জীবদ্দশায় কায়েম করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আল্লাহর নির্দেশ, “তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যেন তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও আর অসৎকাজ থেকে বিরত রাখ।” (সূরা আলে ইমরান : ১১০)
রাসূল সা. ইসলামী আন্দোলন ও
মুসলিম বিশ্ব
যে মতাদর্শ জমিনে প্রতিষ্ঠিত হবে তা মানুষের কাছে প্রচার প্রসার না করে হঠাৎ করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা এটি ইসলামী আন্দোলনের একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ জন্য প্রয়োজন ইসলামী আন্দোলন বা সংগঠন। যে আন্দোলন মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেবে। প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শের পরিবর্তে সেই সমাজের মানুষের মনমগজে নতুন চিন্তা-চেতনা ও প্রচারিত কৃষ্টি কালচারকে মনে প্রাণে জীবনের সর্বক্ষেত্রে কায়েম করার জন্য বাসনা জাগ্রত হবে। রাসূল সা. ও তাঁর সাথীরা তেমনি একটি কার্যকর ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত করেছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে ইসলাম বিজয়ীশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যে আন্দোলনটি বিশ্বব্যবস্থায় সে সময়ের চলমান যেকোনো মতাদর্শের চাইতে উন্নত ও বাস্তবসম্মত ছিল। সেই আন্দোলনের ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় একটি প্রত্যাশিত পরিবেশে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। যার বাস্তব নমুনা ছিলেন রাসূল সা. স্বয়ং নিজেই। যেখান থেকে অনাগত ইসলামী ঝাণ্ডাবাহীরা সঠিক নীতি আদর্শ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। ইসলামী আন্দোলন আমৃত্যু আল্লাহর পথে দায়েম-কায়েম থাকার অন্যতম পথ। কেউ যদি এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করে তাই হবে বাস্তবসম্মত। আর ইসলাম আগমনের উদ্দেশ্যই এটিÑ “এই দ্বীন এসেছে তার বিপরীত সমস্ত দ্বীন বা মত ও পথের ওপর বিজয়ী হওয়ার জন্যই।” (সূরা আত তওবা : ৩৩, আল ফাতহ : ২৮ ও আস সফ : ৯)
কোনো বিপরীত শক্তির ওপর বিজয়ী হওয়ার স্বাভাবিক দাবিই হলো একটি সর্বাত্মক আন্দোলন, একটি প্রাণান্তকর সংগ্রাম, একটি সার্বিক বিপ্লবী পদক্ষেপ। এই কারণেই আল কুরআনে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহকে ঈমানের অনিবার্য দাবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহর পথে জিহাদ বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে হবে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যারা ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত বলে দাবি করছেন তারা অনেকে সঠিক পথে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে ব্রত নন। এদের মধ্যে কেউ কেউ খোদাদ্রোহীদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের কাজ থেকে নিবৃত্ত হয়েছেন, কেউবা খানকা, মাজার ও পীর দরবেশগিরিতে লিপ্ত হয়ে কথিত ইসলাম প্রতিষ্ঠার ফাঁকা বুলি জপছেন। এরা দ্বীনের প্রচার, প্রসার ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা তো দূরে থাক বরঞ্চ এরা জনমনে সঠিক ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ সংশয় অনুপ্রবেশ করাতেই মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন। আরেকটি দল চাইছে ত্রাস করে জনমনে ভয়ভীতি ছড়িয়ে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করবে। যদিওবা এটি রাসূলের দ্বীন কায়েমের সঠিক পদ্ধতি নয়। ইদানীং কালে এভাবে সহজ কায়দায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও কেউ কেউ চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তা টেকসই হয় না। রাসূল সা. অসি নয় মসিতেই ইসলামের বিজয় এনেছিলেন। হক্কানি ওলামায়েকেরামও ইসলামী হুকুমাতের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে না তুলে এই পদ্ধতিতে ইসলামী হুকুমাত কায়েমের পক্ষে নন। রাসূল সা. যুদ্ধের ময়দানেও নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। রাসূল সা. ইসলামকে একটি বিজয়ীশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছেন। “তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যেন তোমরা মানুষের জন্য সত্যের সাক্ষ্য হতে পার।” (সূরা বাকারা : ১৪৩) শেষ পদ্ধতিটির ওপর যারা প্রতিষ্ঠিত আছেন তারাও অনেকে প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করেছেন।
মুসলিম উম্মাহর অনৈক্যের সুযোগে প্রতিনিয়ত সা¤্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী ও খোদাদ্রোহী শক্তিরা বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে মুসলিম নিধনে নেমেছে। মুসলিম শাসক ও ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ দাবিদাররা কৌশলের নামে নীরবতার ফলে ইসলামের শত্রুরা আরো নবোদ্যমে মুসলমানদের হত্যায় মেতে উঠেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় যে মূলনীতি, কৌশল ও ঐক্যের প্রয়োজন তা উম্মাহর নেতৃত্বরা রাসূল সা.-এর ইসলামী আন্দোলনের প্রক্রিয়া থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি। যে কারণে উম্মাহ একটি কঠিন পরিস্থিতি অতিক্রম করছে।
এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক সঠিক ইসলামের প্রচার-প্রসার, যাতে বিরুদ্ধবাদীরা অপপ্রচারের সুযোগ নিতে না পারে। ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে যারা বিশ্ব নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। যারা প্রয়োজনে জুলুমতন্ত্রের অবসান ঘটাতে সংগ্রামে লিপ্ত হবে। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হলে তা হবে টেকসই। যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার সুনিশ্চিত হবে। যে ইসলামী আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় সমাজে আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
সাময়িক পরাজয়ে হতাশ হয়ে গেলে চলবে না। ধৈর্য ও সাহসিকতা নিয়ে অবিরাম ইসলামী আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তবে একগুঁয়েমিতে নিমজ্জিত হয়ে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে ইসলামী চেতনার ক্ষতি ডেকে আনা যাবে না। ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী রাসূল সা.-এর আন্দোলনের পদ্ধতি অনুসরণ করে আল্লাহর সাহায্যের প্রত্যাশী হয়ে অবিরত সম্মুখে এগিয়ে গেলে দ্বীনের বিজয়কেতন মুসলমানরা পুনরায় উড্ডীন করতে পারবে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : কলামিস্ট, গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন