রাসূল সা.
ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ
১৭ মার্চ ২০২২
সর্বকালের মহামানব এবং শ্রেষ্ঠ আদর্শের প্রতীক হজরত মুহাম্মাদ সা.। শ্রেষ্ঠত্বের উপমা হিসেবে তাঁকেই আমরা পেয়ে থাকি। তাঁর জীবনের প্রত্যেকটি দিকই মানুষের জন্য অনুসরণীয় ও গবেষণার বিষয়। নবুয়ত-পূর্ববর্তী জীবন পর্যালোচনা করলে তাঁর জীবন থেকে এক ধরনের আলোকের দেখা মেলে। বিশেষ করে শিশু মুহাম্মদের ইনসাফপূর্ণ আচরণ, কিশোর মুহাম্মদের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড, যুবক মুহাম্মদের ব্যবসায়িক বিচক্ষণতা ও ন্যায়পরায়ণতা, হজরত খাজিদার সাথে বিবাহ-উত্তর সম্পদের মালিকানা এবং দানশীলতার উৎকৃষ্টতম উদাহরণ সৃষ্টি, সমাজ-সংস্কারের নিমিত্তে হালফ উল ফজল পুনর্গঠন আজও গবেষণার দাবি রাখে। প্রাক-ইসলামি সমাজে নবুয়তের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার আগেই শান্তি প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে এ ধরনের কর্মকাণ্ড সত্যিই বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। প্রত্যেকটি পদক্ষেপেই তাঁর সমাজ-সংস্কারের অকৃত্রিম প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। কর্মসূচির মধ্যে আছে এক ধরনের দাওয়াতি কর্মকৌশল। সে দাওয়াত ছিল ভালো মানুষ তৈরির দাওয়াত। সে দাওয়াত ছিল শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণের দাওয়াত।
রাসূল সা.-এর মাক্কি জীবন
নবুয়তি জিন্দেগি আলোচনার জন্যও দু’টি পর্বের উপর ভর করতে হয়। মাক্কি ও মাদানি জীবন। মাক্কি জীবনে তাওহিদ, রিসালাত এবং আখিরাতের প্রচার-প্রসারে হজরত মুহাম্মাদ সা.কে যে ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে দেখা যায় ঠিক মাদানি জীবনে দেখা যায় তা থেকে একটু ভিন্নমাত্রা। প্রতিটি কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে দাওয়াতি কৌশল তাতেও পরিবেশের আলোকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে দেখা যায়। নবুয়তের প্রথম তিন বছরে একান্ত নীরব তৎপরতায় এগিয়ে নিয়েছেন তাঁর মিশন। দাওয়াতি কৌশলও ছিল একান্তভাবে পারিবারিক এবং ঘনিষ্ঠতম বন্ধুমহলে। নবুয়তের চতুর্থ ও পঞ্চম বছরে প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলায় আত্মগঠনের নিমিত্তে রাত্রি জাগরণের প্রশিক্ষণে নিয়োজিত ছিলেন। দাওয়াতের কৌশলও অপরিবর্তিত রাখেন। বন্ধু-বান্ধব ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনকেই কোমল-ভাষায় দাওয়াতের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। মাক্কি জীবনের তৃতীয় স্তরটি ছিল ষষ্ঠ থেকে দশম বছর পর্যন্ত। এ দীর্ঘ সময়ে ইসলামের দাওয়াত বেশ খানিকটা সম্প্রসারিত হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন গোত্রের অবহেলিত মানুষদের পাশাপাশি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষেরাও এগিয়ে আসে ইসলামের ছায়াতলে। এতে মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ফলে, বিরোধিতা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। বিরূপ সমালোচনা, গালি-গালাজ থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতনের চরম পর্যায়ে চলে আসে। এ প্রেক্ষাপটে আসহাবে রাসূলের একাংশ হাবশায় হিজরত করেন। কিছু সাহাবিসহ গোত্রীয় লোকজন তিন বছরব্যাপী শিয়াবে আবি তালিবে বয়কট অবস্থায় বন্দিজীবন যাপন করেন। এ সময় এতো কষ্টের সাথে জীবন-জীবিকা পরিচালনা করতে হয়েছে যে, খাদ্যের অভাবে গাছের ছাল-বাকল খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা চালাতে হয়েছে। নির্যাতনের চরম মাত্রার মধ্যেও দাওয়াতের মিশন থেমে থাকেনি। এ সময়ে তিনি মন্দের মোকাবিলায় ধৈর্য ও সহনশীলতা এবং উত্তম পরিভাষায় কথা বলার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মাক্কি জীবনের চতুর্থ পর্ব ছিল নবুয়তের একাদশ, দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ বছর। এ সময়ে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত খাদিজা রা. এবং প্রিয়তম চাচা আবু তালিব ইন্তেকাল করেন। ভীষণ অসহায়ত্ব অনুভব করেছিলেন হজরত মুহাম্মাদ সা.। এ অবস্থাতেও জুলুম নির্যাতনের সকল সময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। আসহাবে রাসূলের জন্য জীবন ভীষণভাবে সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। তবুও থেমে নেই দাওয়াত। মিরাজে ডেকে নিয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে দিলেন তাঁর প্রিয়বন্ধু মহান আল্লাহ। তিনি সাহাবিগণকে ধৈর্যহারা হতে বারণ করলেন। অবশেষে সকল সাহাবিসহ রাসূলে করিম সা. মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন।
মাদানি জীবনে দাওয়াত
মদিনার জীবন ছিল বিজয়ের। হিজরতের পরেই ‘মদিনা সনদের’ মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ অবস্থায় দাওয়াতের বিষয়বস্তুতেও কিছুটা নতুনত্ব আসে। আলঙ্কারিক দিক থেকে দাওয়াতি পরিভাষায় তেমন মৌলিক কোনো পরিবর্তন না এলেও প্রতিবাদের ভাষা যুক্ত হয়েছে দাওয়াতি মিশনে। বদরের যুদ্ধের পরে এ ধারা আরও বেশি বেগবান হয়। হুদাইবিয়ার সন্ধির পরে আল কুরআনে একে ‘ফাতহুম মুবিন’ বলে ঘোষণা করা হয়। এ সন্ধির পরে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধের ঘোষণা হওয়ায় দাওয়াতি মিশনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত হয়। হজরত মুহাম্মাদ সা. বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্র ও গোত্র প্রধানদের কাছে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে সর্বমোট ৫৬ খানা পত্র প্রেরণ করেন। এর মধ্যে আটজন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে এমন পত্র প্রেরণ করেন তিনি। সর্বপ্রথম পত্র প্রেরণ করেন হাবসার বাদশাহ নাজ্জাশির কাছে। বাদশাহ নাজ্জাশি পত্র পাঠ করে মুগ্ধ হন এবং হজরত মুহাম্মাদ সা.কে স্বীকৃতি প্রদান করেন। পরবর্তী পত্র মিসরের শাসনকর্তা মুকাওয়াকিমের কাছে প্রেরণ করেন। মুকাওয়াকিম পত্রবাহককে সম্মান জানান এবং রাসূল সা.-এর জন্য অনেক উপঢৌকন পাঠান।
তৃতীয় পত্র পাঠান স¤্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে। তিনি পত্র পেয়ে বেশ প্রভাবিত হন। তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, হজরত মুহাম্মাদ সা. ইঞ্জিল বা বাইবেলে উল্লিখিত শেষ নবী। সে সময় তিনি ব্যাবসা উপলক্ষে আগত কুরাইশ প্রধান আবু সুফিয়ানের সাথে তাৎপর্যপূর্ণ বেশ কিছু কথোপকথন করে তার মনের উপলব্ধিকে আরও চাঙ্গা করে তোলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, তার আপন লোক ও সভাষদদের ভয়ে দ্বীন ইসলাম কবুল করেননি।
চতুর্থ পত্র প্রেরিত হয় পারস্যের স¤্রাট খসরু পারভেজের কাছে। খসরু পারভেজ রাসূলে করিম সা.-এর পত্রকে প্রকাশ্য রাজদরবারে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন এবং তার ইয়েমেনি গভর্নরকে হজরত নবী করিম সা.কে গ্রেফতার করে দরবারে হাজির করার আদেশ করেন। ইয়েমেনি গভর্নরের দূত মদিনায় পৌঁছে রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে পারস্য স¤্রাট খসরু পারভেজ গ্রেফতারি ফরমানের কথা জানান। রাসূলে করিম সা. দূতদের জানান, ফিরে যাও এবং তাকে বলো মুসলিম সা¤্রাজ্য অচিরেই তার রাষ্ট্র পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। অন্য বর্ণনায় জানা যায়, হজরত সা.-এর পত্র খসরু পারভেজ টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলার সংবাদ শুনে তিনি সা. বলেছিলেন, আল্লাহ তার সা¤্রাজ্যকেও টুকরো টুকরো করে ফেলবেন এবং তার সা¤্রাজ্যও মুসলিম সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। অচিরেই পারভেজের সা¤্রাজ্য মুসলিমদের পদানত হয়েছিল।
পঞ্চম পত্র প্রেরণ করা হয় বাহরাইনের শাসনকর্তা আল মুনজির বিন সাবিরের প্রতি। আল মুনযির রাসূল সা.-এর দূত ও পত্র পেয়ে ইতিবাচক সাড়া দেন এবং তিনি তার রাষ্ট্র পরিচালনায় রাসূল সা.-এর পরামর্শ ও নির্দেশিকা চেয়ে পত্র পাঠান।
ষষ্ঠ পত্র প্রেরিত হয় ইমামার রাষ্ট্রপ্রধান হুজা বিন আলির কাছে। রাসূলুল্লাহ সা. তাকে ইসলাম কবুলের আহবান জানান এবং অবহিত করেন যে, অচিরেই ইসলামি রাষ্ট্র খাফা (স্থানের নাম) হতে আল-হাফেবের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করবে। তিনি তাকে আরও জানান, ইসলাম কবুল করলে আপনি শান্তিতে থাকতে পারবেন এবং আপনার যাবতীয় সম্পদ আপনারই থাকবে। সপ্তম পত্র প্রেরণ করা হয় দামেস্কের শাসনকর্তা হারেস বিন শামরের কাছে। হজরত সা. হারেসকে সরাসরি ইসলাম কবুল করতে অনুপ্রেরণা দান করেন। অষ্টম পত্র প্রেরিত হয় ওমানের শাসক জায়ফার ও তার ভাই আবদ বনি আল কালন্দির প্রতি।
বিভিন্ন গোত্র এবং রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে চিঠি ও প্রতিনিধি পাঠানোর মধ্য দিয়ে দাওয়াতি মিশনে নতুনমাত্রা যোগ হয়। হুদাইবিয়ার সন্ধি এবং মক্কা বিজয়ের পরে রাসূলুল্লাহর সা. দাওয়াতি মিশনে বৈপ্লবিক ধারার সাথে বিজয়ের বিষয়টিও পুরোপুরিভাবে যুক্ত হয়। বিদায় হজের বক্তব্যে তিনি দাওয়াতি মিশনের চূড়ান্তপর্বের অবস্থান ঘোষণা করেন। বিষয়বস্তু, বাচনিক মাধুর্যতা, ভাষার আলংকারিক উপস্থাপনা- সবকিছু মিলে দাওয়াতি কৌশল এবং ভাষার বিষয়ে সর্বসেরা দীক্ষা দিয়ে গেলেন।
দাওয়াতের কৌশল ও
ভাষার নান্দনিকতা
রাসূলুল্লাহর সা. দাওয়াতি কৌশলের একটি বড় দিক হচ্ছে- প্রত্যেক মুসলমান এক একজন দায়ী। নবীর ওয়ারিশ হিসেবে প্রত্যেক জ্ঞানবান মুসলমানের উপর দাওয়াতি কর্মকাণ্ডকে ফরজ করে দেয়া হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক সাহাবিই এক একজন বড়ো মাপের দায়ী ছিলেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগেই দায়ী হিসেবে সফল ভূমিকা পালন করেছিলেন হজরত আবু বকর রা.। তাঁর সাথে যাঁদের বন্ধুত্ব ছিল, তাঁর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল যাঁদের; তাদের প্রত্যেকের কাছেই তিনি ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন। হজরত আবু বকর রা.-এর দাওয়াতে হজরত উসমান ইবনে আফফান, হজরত সাদ, হজরত তালহা, হজরত জুবাইর এবং আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন।
রাসূলুল্লাহর সা. দাওয়াতি মিশনের একটি বড় কৌশল ছিল যে, তিনি বাস্তবতা বিবর্জিত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না। প্রত্যেকটি কাজে যুতসই পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতেন। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের মধ্যেও তিনি পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ছয়টি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। হিজরতের সময় রাসূলুল্লাহর সা. সফরসঙ্গী কে হবেন, পথিমধ্যে কোথায় গিয়ে রাত্রি যাপন করবেন, আশ্রিতস্থানে কতদিন থাকবেন, সেখানে তাঁদের কে খাবার পৌঁছাবেন, এ সময়ে মক্কার সামগ্রিক অবস্থার গোয়েন্দা রিপোর্ট তাঁকে কে অবহিত করবেন এবং সেখান থেকে কে তাঁদের গাইড হিসেবে মদিনায় পৌঁছে দেবেন? দ্বীনি আন্দোলনের দাওয়াতি কৌশল থেকে শুরু করে প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি পরিকল্পিত রণকৌশলও নির্ধারণ করতেন।
স্থান-কাল এবং পাত্রভেদে তিনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। মাক্কি জীবনে বিরোধী শক্তির সাথে কখনো প্রতিরোধে যেতেন না; বরং সাহাবিগণকে ধৈর্যসহকারে ভালোর মাধ্যমে মন্দের জবাব দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করতে বলতেন। মাক্কি জীবনে কাবাঘরের মূর্তি বিষয়ে কোন কথাই তিনি উচ্চারণ করেননি। মদিনায় স্বীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হলেও কাবাঘরের ভেতরের মূর্তি সম্পর্কে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। মূর্তিভর্তি কাবাকেই কিবলা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এমনকি বিদায় হজের পূর্বে সাহাবিগণ যতবার কাবা তাওয়াফ করেছেন তাঁরা কখনো কাবার মূর্তি নিয়ে কোনো কথা বলেননি। অবশেষে মক্কা বিজয়ের পরে কাবাঘরকে মূর্তিমুক্ত করেছেন। সুতরাং ইসলামি আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে, নিজেদের তাকওয়া, যোগ্যতা, সামর্থ্য এবং বিজয় রক্ষার যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করাই রাসূলুল্লাহ দাওয়াতি আন্দোলনের সুন্নতি মিশন। কোনো ধরনের উচ্চাভিলাষী হটকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইসলামি আন্দোলনের দাওয়াতি মিশন হতে পারে না।
একজন নবী সর্বশ্রেষ্ঠ দায়ী। তাই সুস্পষ্ট ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য প্রদানের যোগ্যতা নবুয়তের একটি অপরিহার্য গুণ। বক্তৃতায় ভাষার বিশুদ্ধতা ও বর্ণনাধারার অলংকরণে আরবদের স্থান ছিল শীর্ষে। পারস্য ও গ্রিসের চিন্তাধারা ও জ্ঞান-সাধনার উচ্চস্থানের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ভাষার বিশুদ্ধতা ও বর্ণনার আলংকারিক প্রয়োগের গুণাবলিতে ভূষিত করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী ছিলেন। কেননা তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশোদ্ভূত এবং প্রতিপালিত হয়েছিলেন বানু সাদ গোত্রে। ফাসাহাত ও বালাগাত তথা বিশুদ্ধ ভাষা ও আলংকারিক বর্ণনা শক্তিতে এ এই দুই বংশ ছিল সমগ্র আরবের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। তাদের ভাষা সকলের জন্য নমুনাস্বরূপ ছিল। কুরায়শদের ভাষাকেই আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট বিশুদ্ধ বর্ণনারূপে অভিহিত করেছেন। আরবের ভাষাবিদ ও কবি-সাহিত্যিকগণ রাসূলুল্লাহ সা.-এর ভাষার বিশুদ্ধতা ও সাহিত্যালংকরণের ভূয়সী প্রশংসা করেছে এবং আল কুরআনের পর তাঁর ভাষাকেই আরবি সাহিত্যের বিশুদ্ধতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মহানবীর সা. ভাষাশৈলী ফাসাহত ও বালাগাত এবং অনবদ্য বর্ণনারীতি ছিল আল্লাহ তায়ালার বিশেষ দান। তিনি সাবলীল ভাষায় অতি সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয়ও মনোজ্ঞ করে তুলতেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আরবের সকল গোত্রের ভাষা ও বর্ণনারীতি সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছিলেন।
আল-জাহিজ লিখেছেন যে, রাসূলুল্লাহকে সা. কখনও কোনো শব্দের স্থানে কিংবা কোনো ভাবের অভিব্যক্তিকে কষ্টক্লেশ করতে হয়নি। তিনি বলতেন, ‘আমি সর্বদা কষ্টকল্প ও কৃত্রিমতাপূর্ণ বক্তব্য পরিহার করে থাকি; অতিরঞ্জনকারী বাচাল প্রকৃতির লোক আমার নিকট পছন্দনীয় নয়।’ সাহাবায়ে কিরাম সর্বদা তাঁর বক্তব্যে ভাষার বিশুদ্ধতা ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ হতেন। তাঁর ভাষা কখনও রূঢ় হতো না।
আল-জাহিজ রাসূলুল্লাহর সা. অনেকগুলি জাওয়ামিউল কালিম অর্থাৎ ব্যাপক ভাবপ্রকাশক সংক্ষিপ্ত বাক্য ও বক্তৃতা উদ্ধৃত করে তাঁর ফাসাহাত ও বালাগাতের মনোজ্ঞ ব্যাখ্যা করেছেন। রাসূল সা.-এর বাচনভঙ্গি সম্পর্কে তিনি বলেন যে, তাঁর কথা ও বাণী সংক্ষিপ্ত শব্দসংবলিত হওয়া সত্ত্বেও অধিক সমৃদ্ধ ও অর্থবহ হতো। তিনি বাকচাতুর্য ও কপটভাষণ হতে দূরে থাকতেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর বাণী আল্লাহ তায়ালার এই নির্দেশের বাস্তব ব্যাখ্যা ছিল, ‘হে রাসূল! আপনি বলে দিন যে, আমি মিথ্যা ভাষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ প্রয়োজন হলে তিনি বক্তব্য বিশদ বর্ণনা করতেন, অন্যথায় সুস্পষ্টভাবে অল্প কথায় বক্তব্য প্রকাশ করতেন। তাঁর বক্তব্যে কখনও অপ্রচলিত দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহৃত হতো না এবং তিনি অমার্জিত শব্দও প্রয়োগ করতেন না। কথা বললে মনে হতো যেন জ্ঞানের প্র¯্রবণ উৎসারিত হচ্ছে। তাঁর বাকধারা আল্লাহ তায়ালার সাহায্যধন্য ছিল। তাঁর অনন্য সাধারণ অমর বাণী হতে প্রতীয়মান হয়, তিনি আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রিয় ও সমাদৃত ছিলেন। এতে যেমন ছিল ভাবগাম্ভীর্য, তেমনি ছিল মাধুর্য। শব্দ কম হতো, অথচ মর্ম সহজ ও সর্বজনবোধগম্য। তাঁর কথা এত স্পষ্ট ও সাধারণের পক্ষে বোধগম্য হতো যে, তা পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন হতো না। তথাপি যদি কেউ পুনরাবৃত্তির আবেদন জানাত, তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করতেন না। তাঁর কথায় কখনও ত্রুটিবিচ্যুতি পরিলক্ষিত হতো না। তাঁর বক্তব্য হতো যুক্তিপূর্ণ ও প্রমাণসিদ্ধ। যুক্তিতর্কে কেউ কখনও তাঁকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়নি।
তাঁর দীর্ঘ ভাষণেও বাক্য সারগর্ভ ও সংক্ষিপ্ত হতো। তিনি সত্য ও সঠিক তথ্যপূর্ণ কথাই বলতেন। শব্দের মারপ্যাঁচ এবং অপরের ছিদ্্রান্বেষণ হতে সর্বদাই বিরত থাকতেন। তিনি অত্যন্ত শ্লথভাবে কিংবা দ্রুতভাবে তাড়াহুড়া করে কথা বলতেন না। তিনি অহেতুক কথা দীর্ঘ করতেন না এবং কখনও সুস্পষ্ট ভাষায় ভাব প্রকাশে অসমর্থ হতেন না। পূর্ণ সামঞ্জস্য রক্ষা করে জনগণের জন্য কল্যাণকর ও মহোত্তম আদর্শ ও লক্ষ্য-সংবলিত বক্তব্য উপস্থাপনায় তাঁর অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী বাগ্মী পরিলক্ষিত হয় না। তাঁর বাণীসমূহ ছিল প্রেরণাদায়ক ও প্রভাব বিস্তারকারী। বর্ণনাধারা ছিল সহজ, মনোজ্ঞ; ভাষণ বিশুদ্ধ শব্দ সংবলিত বক্তব্য উপস্থাপনায় তাঁর অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী বাগ্মী পরিলক্ষিত হয় না। তাঁর বাণীসমূহ ছিল প্রেরণাদায়ক ও প্রভাব বিস্তারকারী। রাসূল সা.-এর যুগে কবি সাহিত্যিক ও বাগ্মীগণ প্রায়শই বলতেন, তিনি যদি অন্য কোনও গুণে বিভূষিত নাও হতেন, তবুও তাৎক্ষণিক তাঁর ভাষণের উচ্চতম মানের ভাষা সৌকর্য, ফাসাহাত ও বালাগাতের মু‘জিযাই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের জন্য যথেষ্ট ছিল। সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব রা.-এর নিকট জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সাহিত্যালংকারে সমৃদ্ধ সর্বশ্রেষ্ঠ শুদ্ধভাষী কে? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, রাসূলুল্লাহ সা.। মুহাম্মদ ইবন সাল্লাম, ইউনুস ইবন হাবিবের নি¤েœাক্ত উক্তি উদ্ধৃত করেন: রাসূল সা.-এর ভাষণে ফাসাহাত ও বালাগাতের যে উচ্চতম নমুনা আমরা দেখিতে পাই, তা অন্য কোনো বক্তার বক্তব্যে পরিলক্ষিত হয় না।
একবার আবু বাকর সিদ্দিক রা. রাসূল সা.-এর নিকট আরজ করেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আরব দেশগুলিতে বহু পরিভ্রমণ করেছি; অসংখ্য আরবি সাহিত্যিকের বক্তব্য শুনেছি কিন্তু আপনার অপেক্ষা সেরা অলংকারযুক্ত বিশুদ্ধ শব্দ ও বাক্য ব্যবহারকারী বক্তা, ফাসিহ ও বালগি আর কাউকেও দেখিনি। ফাসাহাত ও বালাগাতের এই সর্বোচ্চ স্থান আপনি কী করে অর্জন করলেন?’ তিনি উত্তর দিলেন, আমাকে আমার প্রতিপালক আদব শিক্ষা দিয়েছেন এবং সর্Ÿোত্তমভাবেই তিনি আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা. বক্তার মার্জিত বর্ণনা পছন্দ করতেন। একবার হজরত আব্বাস রা. তাঁকে জিজ্ঞাস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের সৌন্দর্য কিসে নিহিত? তিনি উত্তরে বললেন, মানুষের সৌন্দর্য ও মাধুর্য তার রচনা বা ভাষায় নিহিত। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. অশিক্ষিত লোকদের ন্যায় তাড়াহুড়া করে কথা বলতেন না; বরং তাঁর বর্ণনাধারা হতো সম্পূর্ণ পরিষ্কার ও স্পষ্ট। শ্রোতাগণ অতিসহজেই তাঁর কথা মুখস্থ করে নিতে পারত। বুখারির রিওয়ায়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. যখন আলোচনা করতেন, তখন স্বীয় বক্তব্য তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন, যাতে শ্রোতাগণ তাঁর বাণী ভালোভাবে বুঝে মুখস্থ করতে সক্ষম হয়। কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করলে তাঁর বক্তব্যে শব্দসমূহ গণনা করতেও সক্ষম হতো। তাঁর বক্তব্য হতো স্বতঃস্ফূর্ত, বর্ণনাধারা প্রাঞ্জল এবং কথার মধ্যে দক্ষতা প্রতিভাত হতো। আবুল হাসান আলমাদাইনি বর্ণনা করেন, একদিন হজরত আম্মার ইবন ইয়াসির রা. সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন, শ্রোতাগণ তাঁকে আরও বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ করতে থাকলে তিনি বললেন- রাসূলুল্লাহ সা. আমাদিগকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন সালাত দীর্ঘ করি এবং বক্তব্য সংক্ষেপ করি।
রাসূল সা.-এর কণ্ঠস্বর যেমন ছিল মধুর, তেমনি উদাত্ত। হজরত কাতাদা রা. হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহকে সা. সুন্দর দেহাবয়বের সাথে সুন্দর কণ্ঠস্বরও দান করা হয়েছিল। তাঁর কণ্ঠস্বর এত দূরে পৌঁছাত, যতদূরে আর কারও স্বর পৌঁছাত না। তিনি মিনাতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, লোকেরা তা অনেক দূরদূরান্ত হতে শুনতে পেয়েছিল। হজরত উম্মে হানি রা. হতে বর্ণিত আছে যে, অর্ধ-রজনীকালে যখন রাসূলুল্লাহ সা. কাবাগৃহে আল কুরআন তিলাওয়াত করতেন, তখন আমরা আমাদের ঘরের ছাদ হতে তাঁর আওয়াজ শুনতে পেতাম।
সাহিত্য সমালোচকগণ রাসূল সা.-এর ফাসাহাত, বালাগাত এবং তাঁর বাণী ও ভাষণসমূহের সাহিত্যমান সম্পর্কে আলোচনা পর্যালোচনা করেছেন। তৎকালীন পরিবেশ পরিস্থিতি এবং তাঁর জীবনধারার ওপর প্রভাব বিস্তারকারী সমুদয় কার্যকরণ ও সূত্র তাঁরা গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছেন। তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আরবি ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যেকোনো ন্যায়নিষ্ঠ বিজ্ঞলোকই এ কথা স্বীকার করতেন যে, আরবি ভাষায় আল কুরআনের শৈল্পিক সাহিত্যিক মান সর্Ÿোচ্চ। এর পরই রাসূলুল্লাহ সা.-এর বাণী ও ভাষণের স্থান।
রাসূলুল্লাহ সা. সর্বশ্রেষ্ঠ অলংকারময় বিশুদ্ধ ভাষাভাষী আরব হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ বলেন যে-
প্রথমত, তিনি বানু হাশিম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন এবং কুরায়শদের মধ্যে লালিত পালিত হন।
দ্বিতীয়ত, তাঁর দুগ্ধপানকালীন শৈশবকাল অতিবাহিত হয়েছে বানু সাদ ইবন বাকর বা বানু হাওয়াজিন গোত্রে। আরবি সাহিত্যে ফাসাহাত ও বালাগাতে কুরায়শদের পরই তাদের স্থান স্বীকৃত ছিল। এছাড়া তাঁর মাতুল ছিলেন বানু জুহরা এবং তাঁর জীবনসঙ্গিনী হজরত খাদিজাতুল কুবরা রা. ছিলেন বানু আসাদ গোত্রীয়া। এরা সকলেরই গোত্র আরবি ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তৃতীয়ত, আল্লাহ তায়ালার শেষ কিতাব আল কুরআন নাজিল হয় সুস্পষ্ট বিশুদ্ধ আরবি ভাষায়; যার অনবদ্য ভাষাশৈলী ও বর্ণনারীতির সামনে সকল প্রখ্যাত আরবি সাহিত্যিক তথা মানব ও জিনজাতি নতশির ছিল। এই সমুজ্জ্বল মহাগ্রন্থ কিতাবুম মুবিন এর অনন্য সাধারণ বর্ণনাশৈলীও রাসূল সা.-এর বাচনশক্তিকে আরও উৎকর্ষ করছে। তাঁর বাণীতে আল্লাহর বাণীর প্রভাব সুস্পষ্ট।
চতুর্থ এবং প্রধান কারণ হলো, রাসূলুল্লাহর সা. মহোত্তম স্বভাব-প্রকৃতি, যা আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রকার মহান গুণাবলীতে বিভূষিত করেছিলেন। এ কারণেই তাঁর ফাসাহাত ও বালাগাত সমৃদ্ধ সাহিত্যালংকারপূর্ণ বাণী পরবর্তীকালীন বিদ্বান ও সাহিত্যিকদের আত্মার এবং মনের খাদ্যে পরিণত হয়। তাঁর বাণীসমূহ মুখস্থ করে আরবি সাহিত্যকে সুশোভিত করা হয়েছে। হাদিসসমূহের উদ্ধৃতি দ্বারা লেখকগণ তাঁদের রচনাকে অলংকৃত করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সা. মৌখিক দাওয়াত বা বক্তব্যের পদ্ধতি, উদ্দেশ্য ও রীতিনীতি সম্পর্কে এমন কতিপয় পরিবর্তন সাধন করেন যা প্রাচীন আরব বক্তাগণের মধ্যে প্রচলিত ছিল না। হামদ ও সানা বা আল্লাহর প্রশংসা এবং দরুদ ও সালামের মাধ্যমে বক্তব্যের সূচনা তিনিই প্রবর্তন করেন। একটি বর্ণনামতে বক্তব্যের শুরুতে হামদ ও সানার পর আম্মাবাদ বা ‘অতঃপর’ শব্দের প্রথম ব্যবহার তিনি করেন; যা পরবর্তীকালে মুসলিম উম্মাহর একটি সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়। রাসূল সা.-এর পূর্বে আরব বক্তাগণ নিছক ফাসাহাত ও বালাগাত প্রদর্শন অথবা নিজ গোত্রের স্তুতিগান কিংবা শত্রুপক্ষের নিন্দাবাদের জন্যই বক্তৃতার আশ্রয় গ্রহণ করতেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা. তাওহিদের প্রচার, সদুপদেশ দান, ন্যায়পরায়ণতা ও সৎকর্মের দাওয়াত, পারস্পরিক সহযোগিতা, আত্মসংশোধন, জিহাদের প্রতি উৎসাহ দান এবং মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ এবং সাফল্যের উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করতেন। ইবন আবদি রাববিহ বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূল সা.-এর ভাষণসমূহ ধারাবাহিক পাঠ করে দেখতে পাই যে, হামদ ও সানা, ইসতিগফার ও আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলজ্ঞাপক বাক্য দ্বারাই সর্বদা বক্তব্যের সূচনা হতো। শুধুমাত্র দুই ঈদের খুতবাই তিনি তাকবির দ্বারা আরম্ভ করতেন। অধিকাংশ ভাষণে তিনি আল্লাহভীতির উপদেশ দিতেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের ভাষণে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। যে সকল ভাষণে তাওহিদের শিক্ষা থাকত কিংবা জাহান্নাম হতে সতর্ক করা যার উদ্দেশ্য হতো, সেসব বক্তৃতা অত্যন্ত তেজোদীপ্ত হতো।
তেজোদীপ্ত ভাষণের সময় রাসূল সা.-এর চক্ষু রক্তিম হয়ে যেত, শব্দ গুরুগম্ভীর ও বলিষ্ঠ হতো, পবিত্র মুখাবয়বে মাহাত্ম্য ফুটে উঠত, আবেগের প্রবলতায় অঙ্গুলিসমূহ উত্তোলিত হতে থাকত এবং মনে হতো, যেন ইসলামি সেনাদলকে জিহাদের জন্য হাতের ইশারায় উদ্বুদ্ধ করছেন। পবিত্র দেহ আন্দোলিত হতো, হস্ত সঞ্চালনের সময় গ্রন্থি মটকানোর শব্দ শোনা যেত, বক্তৃতার মাঝে মাঝে হাত কখনও মুষ্টিবদ্ধ করতেন আবার কখনও তা খুলে ফেলতেন। আব্দুল্লাহ ইবন উমার রা. রাসূল সা.-এর একটি ভাষণে বাগ্মীসুলভ উদ্দীপনার চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছি যে, মহা প্রতাপশালী সৃষ্টিকর্তা আসমান জমিনকে মুষ্টিবদ্ধ করবেন, এ কথা বলে তিনি স্বীয় হস্ত মুষ্টিবদ্ধ করতেন। আমি দেখলাম, তিনি একবার ডানদিকে ঝুঁকছেন, আরেকবার বামদিকে ঝুঁকছেন। এমনকি তাঁর মিম্বরও এই কারণে আন্দোলিত হচ্ছিল। এ অবস্থা দৃষ্টে আমার আশঙ্কা হচ্ছিল যে, মিম্বরটি যেন উল্টে না যায়। আককাদ স্বীয় গ্রন্থে লিখেছেন যে, যেহেতু ইসলামের প্রচার ও প্রসার ছিল রাসূল সা.-এর মিশন ও দায়িত্ব, তাই বিশুদ্ধ ভাষা বর্ণনা ও বালাগাতই ছিল তাঁর ভাষণ ও বাণীর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তিনি বিদায় হজের ভাষণে বারবার এই বাক্য উচ্চারণ করছিলেন, ‘আমি কি সঠিক ও সন্তোষজনকভাবে আল্লাহর বাণী প্রচার করেছি?’
আতিয়া আল আবরাশি লিখেছেন, আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা.কে আরবের সকল গোত্রের ভাষা ও বাগধারা সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছিলেন। এ কারণেই তিনি প্রত্যেক গোত্রের লোকদের সঙ্গে তাদের বাকভঙ্গিতে কথা বলতে সক্ষম ছিলেন। তিনি মক্কার কুরাইশ, মদিনার আনসার এবং নাজদ ও হিজাজবাসীদের সঙ্গে যেই ভঙ্গিমায় ও বাগধারায় কথা বলতেন, এটি কাহতানি আরবদের সাথে তাঁর কথাবার্তা হতে ভিন্ন ছিল। সাহাবা-ই-কিরাম যখন বিস্ময়ের সাথে তাঁর ফাসাহাত ও বালাগাতের কারণ জিজ্ঞাসা করতেন, তখন তিনি বলতেন, ‘আমার প্রতিপালক আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তিনি আমার ভাষাতেই অর্থাৎ কুরাইশদের ভাষায় আল কুরআন নাজিল করেছেন।’
রাসূলে করিম সা. যখন জিহাদের ময়দানে মুজাহিদগণের সামনে ভাষণ দিতেন, তখন ধনুকের ওপর ভর করতেন। কখনও আবার কোনো কিছুতে ঠেস দেওয়া ছাড়াই ভাষণ দিতেন। অনেক সময় উটের ওপর সওয়ার হয়েও বক্তব্য রাখতেন। হিজরতের পর যখন তিনি মসজিদুন নববিতে বসে বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদের সামনে বক্তব্য রাখা শুরু করেন, তখন তিনি একটি খেজুরকাণ্ডে ভর করতেন। মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সাহাবা-ই-কিরাম তাঁর জন্য একটি মিম্বর নির্মাণ করে দেন, যাতে সকলে তাঁকে দেখতে পায়। কখনও তিনি লাঠির ওপর ভর দিয়েও বক্তৃতা দিতেন। আল জাহিজ বর্ণনা করেন যে, এ লাঠিখানি খুলাফা-ই-রাশিদিনের নিকট হস্তান্তর হতে থাকে এবং তাঁরা এই সুন্নাত-ই-নববির অনুসরণ করতে থাকেন। সর্বশেষ উমাইয়া খলিফা স্বীয় পরিণতি দেখে গোলামকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, রাসূল সা.-এর চাদর এবং লাঠি যেন কোথাও দাফন করে দেয় কিন্তু সে ওটি ক্ষমতাসীন আব্বাসীয় খলিফার নিকট পৌঁছে দেয়।
বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি বলেন, ‘জনগণ! আমি কি আল্লাহর বাণী পৌঁছাইলাম? হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক। তোমরা আমার অবর্তমানে পরস্পরের রক্তপাত করে আবার কাফির হয়ে যেও না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা আঁকড়িয়ে ধরলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব। আমি কি আল্লাহর বাণী পৌঁছাইলাম? হে আল্লাহ! সাক্ষী থাক। লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালক এক। তোমাদের পিতাও এক। তোমরা সকলে আদম সন্তান। আদম ছিলেন মাটির সৃষ্টি। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক মুত্তাকি। কোনো আজমির বা অনারবের ওপর কোনো আরবীয় শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তাকওয়াই আসল। আমি কি আল্লাহর বাণী পৌঁছাইলাম? হে আল্লাহ! সাক্ষী থাক।’ সমবেত জনগণ বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আপনি পৌঁছিয়েছেন।’ তিনি বললেন, তাহলে উপস্থিত ব্যক্তি অনুপস্থিতের নিকট আমার এই বাণী পৌঁছে দেবে।
রাসূল সা.-এর সুন্নাহ এবং
একবিংশ শতাব্দীর দাওয়াত
একবিংশ শতাব্দীর এ যুগসন্ধিক্ষণে মুসলমানরা বিশ্বব্যাপী চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও মিডিয়ার মাধ্যমে মুসলমানদের চিন্তা ও আদর্শকে বিকৃতরূপে উপস্থাপিত করা হচ্ছে। তারা এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে, মুসলমান মানেই অজ্ঞ, মূর্খ এবং মোটা চিন্তাধারার জাতিগোষ্ঠী। সমকালীন পরিবেশ পরিস্থিতি এবং উপযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে দাওয়াতি কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে-
প্রথমত, রাসূলুল্লাহর সা. দাওয়াতি মিশনে প্রাথমিক পর্বে একান্তভাবে কাছের মানুষ অর্থাৎ নিকট আত্মীয়গণই সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। স্বীয় প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজাতুত তাহিরা রা., প্রিয়বন্ধু আবুবকর ইবনে কুহাফা রা., স্বীয়গৃহে লালিত-পালিত চাচাতো ভাই আলি ইবনে আবি তালিবসহ রা. প্রায় সকল সাহাবিই ছিলেন তাঁর একান্ত কাছের মানুষ- নিকট আত্মীয়। সুতরাং দাওয়াতি সুন্নাত হচ্ছে সবার আগে নিজের প্রিয়জনদের নিকট আগে দাওয়াত পৌঁছানো।
দ্বিতীয়ত, আপনজন ছাড়া যাঁরা ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন তাঁরা সবাই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। নবুয়তের পূর্বকাল থেকেই সমাজের অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত, নির্যাতিত-নিষ্পেষিত, অধিকারবঞ্চিত অসহায় মানুষের পাশে থাকতেন হজরত মুহাম্মাদ সা.। সকলের কাছেই যেমন বিশ্বস্ত ছিলেন তেমনি ছিলেন সহায়ক শক্তি। ফলে তারাই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। সুতরাং জনকল্যাণমুখী দাওয়াতি কর্মসূচি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করতে হবে।
তৃতীয়ত, হজরত উমর বিন খাত্তাব, আমির হামজাহ এবং আমর বিন হিশামের মতো প্রভাবশালী ও প্রতিভাবান ব্যক্তিদের বিশেষ টার্গেট নিয়ে দাওয়াতি মিশন প্ররিচালনা করেছেন হজরত মুহাম্মাদ সা.। তাঁদের হিদায়াতের জন্য নাম ধরেও দুআ করেছেন। সুতরাং সমাজের প্রভাবশালী ও বিশেষ প্রতিভাবানদের টার্গেট করে দাওয়াতি মিশন পরিচালনা রাসূলুল্লাহর সা. অন্যতম সুন্নাত।
চতুর্থত, সমাজপতি এবং রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের নিকট রাসূলুল্লাহর সা. দাওয়াতি মিশন ছিল আরও বেশি সুকৌশলী এবং সুপরিকল্পিত। পত্র মারফত তাদের কাছে দাওয়াত প্রেরণ করলেন প্রেরিত মিশনে বিশেষ ব্যক্তিদেরকেই দূত হিসেবে প্রেরণ করতেন। সেইসাথে লক্ষ্যস্থিত ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মান প্রদানেরও নজির সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াতি মিশনে চতুর্থ পর্বটিকে বিশেষ কৌশলগত দৃষ্টিতে রাখা একান্ত জরুরি।
পঞ্চমত, রাসূল সা.-এর দাওয়াতি পরিভাষা ছিল ভীষণ মোলায়েম। শব্দপ্রয়োগ ছিল খুবই সহজ-সরল ও সর্বমহলে বোধগম্য। অথচ কম কথায় বেশি অর্থপ্রকাশক বাক্য ব্যবহার করতেন। বেশি কথা বলা বাচাল স্বভাবকে তিনি অপছন্দ করতেন। ভাষার আলঙ্ককারিক মাধুর্য, বালাগাত-ফাসাহাত এবং পরিশুদ্ধ কাব্যময়তা তাঁর কথার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। ভাষার মতো মুখের বাক্যভঙ্গিও ছিল আকর্ষণীয়। একজন দায়ী হিসেবে ইসলামী আন্দোলনের প্রত্যেকের জন্য এ সুন্নাতের অনুসরণ খুবই প্রাসঙ্গিক।
ষষ্ঠত, দাওয়াতি মিশনে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা রাসূলুল্লাহর সা. অন্যতম সুন্নাহ। মাক্কি জীবনে তিনি তাওহিদ, রিসালাত এবং আখিরাতের দাওয়াত এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। ইসলামের প্রতিটি বিধান নাজিল করা হয়েছে ক্রমশ। মদ হারাম হওয়ার প্রেক্ষাপটে বেশ কয়েক পর্বে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। ইসলামের প্রায় প্রত্যেকটি মৌলিক বিধানের ক্ষেত্রেই এমন নজির পাওয়া যায়। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবালকে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে প্রেরণের সময় রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, প্রথমে তুমি তাদেরকে ইসলাম অর্থাৎ কালিমার দাওয়াত দেবে। যদি তারা তা গ্রহণ করে তবে সালাত কায়েম করার নির্দেশ দেবে। অতঃপর জাকাত প্রদানের নির্দেশ দেবে। এখানেও ধারাবাহিকতার বিষয়টি লক্ষণীয়।
পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতা এবং ভার্চুয়ালবিশ্বের এখন রমরমা অবস্থা। এ উপযোগসমূহকে অস্বীকার করে দাওয়াতি মিশন সফল সম্ভব নয়। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়াসহ বিশ্বায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তির সকল বৈধ উপযোগকে কাজে লাগিয়ে দাওয়াতি মিশনকে মানসম্মত উপায়ে কর্মচঞ্চল রাখতে হবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, আধুনিক উপযোগিতানির্ভর দাওয়াতে হৃদ্যতার অভাব থাকে। এতে আন্দোলনের প্রাণ সঞ্চারিত হয় না।
এ জন্য ব্যক্তিগত যোগাযোগের বিষয়টি সবসময় মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে। এটাও সত্যকথা যে, আধুনিকতা মানেই ইসলামের বাইরের চিন্তা, নান্দনিকতা মানেই অশ্লীলতা, শিল্পসৌকর্য মানেই অন্য সংস্কৃতির চাষবাস, কথাবার্তা কিংবা আলোচনার শিল্পবোধ মানেই মুক্তচিন্তার নামে ইসলামের বিরোধিতা- এ ধরনের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণে যথাযথ ভূমিকা পালন এখন সময়ের দাবি। প্রমাণ করতে হবে যে, সকল ধরনের সৌন্দর্যবোধ, মননশীলতা ও শিল্পসৌকর্যের পুরোধা হচ্ছেন আমাদের প্রিয় নবী সা.; বিশ্বসভ্যতার সর্বাধুনিক রূপকার, পরিশীলিত জীবনধারার প্রবর্তক হজরত মুহাম্মাদ সা.। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত গোটা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই তাঁর দাওয়াতি কৌশলকে নান্দনিক জীবনধারায় পরিচালিত করতে পারলেই ইহলৌকিক ও পারলৌকিক বিজয় নিশ্চিত হবে।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও প্রফেসর; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মন্তব্য লিখুন