রেমিট্যান্সে ভাটা বিপর্যস্ত অর্থনীতি
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
২১ ডিসেম্বর ২০১৬
সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই বহির্বিশ্বে জনশক্তি রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদগণ। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সঙ্কুচিত হয়েছে এবং সে ধারা এখনও অব্যাহত আছে। অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। বর্ধিত জনশক্তির কারণেই মধ্যপ্রাচ্যসহ বৈদেশিক শ্রমবাজারে আমাদের অপার সম্ভাবনা থাকলেও সে সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। আগামী দিনেও যে তা হবে তা আশা করাও সঙ্গত মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য হওয়ায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি। ফলে দেশের অর্থনীতি কিছুটা হলেও গতি হারিয়েছে, ঘটেছে বড় ধরনের ছন্দপতন।
মূলত দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সে অবস্থা থেকে উত্তরণের সহসাই কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে মধ্যপ্রাচ্যের ৮টি দেশ থেকে। এককভাবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে সৌদি আরব থেকে, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। গত অর্থবছরে এই দেশ থেকে রেমিট্যান্স আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭৯ কোটি ডলার কমে দাঁড়ায় ২৫৬ কোটি ডলার। মূলত সৌদি আরবের শ্রমবাজার সঙ্কুচিত হওয়ার কারণেই এমন দুর্ভাগ্যজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, যা আমাদের সাম্প্রতিক সময়ে ভঙ্গুর অর্থনীতির জন্য মড়ার উপর বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু তা সমাধানে সহসাই কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না।
উল্লিখিত পরিসংখ্যান থেকে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটার বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। আসলে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে কমতে এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ যেভাবে কমেছে তা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য সত্যিই অশনিসঙ্কেত। মূলত বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারণে সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণেই শ্রমবাজার সম্প্রসারণের পরিবর্তে তার পরিসরটা অনেকটাই কমে এসেছে। আর এ ধারা এখনও অব্যাহত আছে। দেশে সুশাসনের অনুপস্থিতি ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ না থাকাও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিও মোটেই উপেক্ষার নয়।
কারণ, কেউই তার কষ্টার্জিত অর্থ নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চান না বা তা সঙ্গতও নয়। তাই ক্ষেত্রবিশেষে প্রবাসীরা তাদের অর্জিত রেমিট্যান্স দেশে বিনিয়োগের পরিবর্তে প্রবাসেই নিরাপদে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। বা অন্যকোনো নিরাপদ স্থানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। ফলে আমরা কাক্সিক্ষত রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। শুধুই পরিবার-পরিজনের স্বাভাবিক জীবিকা নির্বাহে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই পাঠানো হচ্ছে দেশে। ফলে প্রবাসীদের অর্জিত রেমিট্যান্সের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ থেকে আমরা স্বাভাবিকভাবেই বঞ্চিত হচ্ছি। তাই দেশের অর্থনীতির ভঙ্গুর দশার জন্য দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সুশাসনের অনুপস্থিতি অনেকটাই দায়ী।
সরকার অবশ্য দাবি করছে, দেশে জনশক্তি রফতানি কোনো অবস্থায় কমেনি বরং তা আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। সরকারি ভাষ্যমতে, জনশক্তি রফতানি বাড়লেও ধারাবাহিকভাবে কমছে রেমিট্যান্স। কিন্তু সে দাবির খুব একটা সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো আয় কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। আর একক মাস হিসেবে শুধু সেপ্টেম্বরে কমেছে ২৩ শতাংশ। অবৈধ চ্যানেল ব্যবহার করে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা, প্রবাসী শ্রমিকদের আয় হ্রাসসহ নানা কারণে রেমিট্যান্স কমছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। কিন্তু সরকার পক্ষে নতুন করে জনশক্তি রফতানিতে যে ধরনের সাফল্যের কথা প্রচার করা হচ্ছে, তা অনেকটা সারবত্তাহীন বলেই মনে হয়। কারণ, জনশক্তি রফতানি বাড়লে এভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহে পতনের কোনো প্রশ্নই আসে না।
সাধারণভাবে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ঈদের আগে রেমিট্যান্স বাড়ে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও এবার বেশ ব্যত্যয় ঘটেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের মধ্যে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়েছে। এরপরও রেমিট্যান্স প্রবাহে কোনো ইতিবাচক ভাব লক্ষ্য করা যায়নি বরং আগের তুলনায় বেশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা ৩২৩ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৯৩ কোটি ডলার। এতে আগের একই সময়ের তুলনায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কম এসেছে ৭০ কোটি ডলার বা ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
একক মাস হিসেবে গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১০৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত বছরের একই মাসে যা ১৩৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার ছিল। এতে একক মাস হিসেবে শুধু গত সেপ্টেম্বরেই কমেছে ৩০ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ২২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবাসীরা এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠান। আগের অর্থবছরের তুলনায় যা কম ছিল ৩৯ কোটি ডলার বা ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
প্রবাসী আয় ধারাবাহিকভাবে কমলেও জনশক্তি রফতানি বাড়ছে বলে দাবি করা হচ্ছে। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫৩৭ জন শ্রমিক বিভিন্ন দেশে গেছেন। আগের অর্থবছরে ছিল চার লাখ ৬১ হাজার ৮২৯ জন শ্রমিক। এতে এক বছরে শ্রমিক রফতানি বেশি হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার জন যা প্রায় ৪৮ শতাংশ। কিন্তু জনশক্তি রফতানি বেড়েছে বলে যে সরকার পক্ষ আষাঢ়ে গল্প শোনাচ্ছেন তার সাথে বাস্তবতার খুব একটা মিল খুঁজে পাচ্ছেন না তথ্যাভিজ্ঞমহল।
দেশের রেমিট্যান্স আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও কর্তৃপক্ষের তৎপরতাও বেশ দায়সারা গোছের। তারা এ বিষয়ে মহল বিশেষের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে চাইছেন। দেশের অর্থনীতিতে হারানো ছন্দ ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এখনো দেখা যায়নি। ধারাবাহিকভাবে রেমিট্যান্স কমার কারণ পর্যালোচনায় বিভিন্ন ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নিয়ে গত জুনে একটি বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের প্রতিনিধি বলেন, হুণ্ডির মাধ্যমে অর্থপাচারকারীরা কৌশলে বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে অর্থ সংগ্রহ করছে।
সরকারি ভাষ্যমতে, ছোট আকারের রেমিট্যান্স আহরণ করা হচ্ছে এ উপায়ে। কিন্তু তা জাতীয় অর্থনীতির ওপর খুব কম প্রভাব রাখতে সক্ষম হচ্ছে। এরপর এখানকার এজেন্টের যোগসাজশে তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে সুবিধাভোগীর কাছে। এ নিয়ে বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা হয়নি। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক আর একটি বৈঠক ডেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেছে বলে জানা যায়নি। ফলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর সর্বশেষ প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’-এ রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে থাকতে পারে। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের নিম্ন মূল্যের কারণে নির্মাণ খাতে নেতিবাচক প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর প্রভাব পড়েছে। বেকারত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি মজুরি কমে যাওয়া অথবা জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সঞ্চয় কমছে, যা রেমিট্যান্স কমার অন্যতম কারণ হতে পারে। কিন্তু এসবই দেশের রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে মধ্যপ্রাচ্যের ৮টি দেশ থেকে। এককভাবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে সৌদি আরব থেকে। গত অর্থবছরে এই দেশ থেকে রেমিট্যান্স আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭৯ কোটি ডলার কমে দাঁড়ায় ২৫৬ কোটি ডলার, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য রীতিমতো উদ্বেগজনক।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে। ব্যাংকটির একটি সূত্রের বরাতে জানা যাচ্ছে, তারা বিভিন্ন দেশে খোঁজ নিয়ে রেমিট্যান্স কেন কমছে তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে পারেনি। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের উচিত বিষয়টি খতিয়ে দেখা।
মূলত দেশে কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমান উপার্জনের আশায়। তারা উপার্জন করে যেমন নিজের আর্থিক সচ্ছলতা আনছে তেমনি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্বভাবতই যখন একটি দেশের নাগরিকদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয় সার্বিকভাবেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি ঘটায়। এখানেই শেষ নয়, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের আয়ের বড় একটা অংশে পরিণত হয়েছে। মূলত রেমিট্যান্স আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অস্থিতিশীলতা ও রফতানি আয় কমে যাওয়ার কারণে দেশের অর্থনীতি ক্রমেই খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী, বিনিয়োগকারী, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার অনুদান ও ঋণ ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। ফলে একটা শোচনীয় অবস্থায় আছে অর্থনীতি। এই ক্ষেত্রে আশার আলো বৈদেশিক রেমিট্যান্স। ২০১১-১২ অর্থবছরে বিদেশীদের পাঠানো অর্থ থেকে দেশ আয় করেছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। এ রেমিট্যান্স বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমপরিমাণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য মতে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস প্রবাসীদের রেমিট্যান্স নিয়ে কথা বলতেই আমরা পুলকবোধ করি। কিন্তু যারা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে এমন প্রবাসীদের আমরা কোনো খোঁজখবরই রাখি না। তাদের স্বার্থে কাউকে কথা বলতেও শোনা যায় না। আমরা তাদের জন্য কার্যকর কিছুই করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। বাংলাদেশীদের জন্য সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার ছিল সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুরের মত দেশগুলো। এরপর যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, দুবাইয়ের শ্রমবাজার বাংলাদেশীদের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। আমেরিকাতেও লোক পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে।
এমন অবস্থায় বিদেশে জনশক্তি রফতানি হুমকির মুখে। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই বাজার ধরে রাখতে সরকারকে যেভাবে সচেষ্ট থাকা দরকার বাস্তবতা কিন্তু তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এর জন্য প্রয়োজন জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপ কিন্তু সরকারের কূটনৈতিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তারা কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। বিদেশে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হলে দূতাবাসগুলোর কাছে থেকে আশানুরোপ সাহায্য সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন না। শুধু দেশের বাইরে নয়, দেশের অভ্যন্তরে তারা হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। কিছুদিন আগে জাপান ফেরত এক ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছিলাম। জানলাম তাঁর প্রবাস জীবনের ইতিবৃত্ত। প্রবাসীদের উপর হয়রানির অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়। যাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের উদাসীনতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, একটা ঔষধ ঠাণ্ডা রাখার যন্ত্র এনেছিলেন হাতে করে লাগেজের বাইরে জনৈক একজন প্রবাসী। বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তারা সেটির জন্য অযৌক্তিক অর্থ দাবি করলে তিনি দিতে অস্বীকার করলে তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে। এমনকি তাকে এও বলে বেশি বাড়াবাড়ি করলে পায়ের জুতাতে যে সুতার সেলাই আছে সেটারও ট্যাক্স দিতে হবে। এমনকি তাদের দাবির প্রতিবাদ করলে লাগেজ ছুড়ে ফেলে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় আমরা প্রবাসীদের প্রতি আন্তরিক নই। তারা দেশের জন্য অনেক বড় অবদান রাখলেও আমরা তাদের প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছি না, যা শুধু দুঃখজনকই নয় রবং বেশ আত্মঘাতী। কোনো সভ্য সমাজে প্রবাসীদের এমনভাবে অপদস্থ করা হয় না।
দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসছে তার ২২ শতাংশ অর্থ হুণ্ডিতে প্রবেশ করে। ৭৮ শতাংশ আসে বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে। তবে যে অর্থ আসে তার ২৫.৩৩ শতাংশ বিনিয়োগে যাচ্ছে। আর বিদেশে যাওযার জন্য যে ঋণ নেয়া হয়েছে তাতে ব্যয় হচ্ছে ১০.৮৭ শতাংশ অর্থ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত এক জরিপে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রবাস আয়ের বিনিয়োগ জরিপ রিপোর্টে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। জরিপে বেরিয়ে এসেছে যে, ৮৬ লাখ বাংলাদেশী বিদেশে কর্মরত আছে। ২০১৫ সালে প্রবাস আয়ের ৯৬ শতাংশ আসে নগদে এবং ৪ শতাংশ আসে দ্রব্যমূল্য হিসেবে। বিকাশের মাধ্যমে ১৪.৩১ শতাংশ আসে। পাঠানো টাকার ৪৪.১৮ শতাংশ টাকা পিতা-মাতা এবং ৪১.৭৮ শতাংশ পরিবারের স্বামী বা স্ত্রী গ্রহণ করে। ৪০.৭১ শতাংশ খানা প্রবাস আয়ের টাকা সঞ্চয় করে। বিবিএস বলছে, বিনিয়োগের সিংহভাগ বা ৭৪.৭৮ শতাংশ যাচ্ছে নির্মান খাতে। জমি কেনাতে যাচ্ছে ৯.০৮ শতাংশ টাকা। বেশির ভাগ প্রবাসী বাংলাদেশী কম বয়সী। যাদের প্রায় ৫৪.৯০ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৫.১১ শতাংশ।
মূলত নানাবিধ কারণেই দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটির টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ জন্য একক কোনো কারণ নয় বরং সৃষ্টি হয়েছে নানাবিধ অনুষঙ্গ, প্রতিকূলতা ও অনিয়ম। তবে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বিষয়টিও যে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর এটিই হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মধ্যপ্রাচ্যসহ বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোতে শ্রমবাজার সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প নেই। এমনিতেই দেশের অর্থনৈতিক সেক্টর খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। এরপর আবার যদি রেমিট্যান্স প্রবাহ ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে তাহলে তা আমাদের জন্য অশনিসঙ্কেতই বলতে হবে। সাথে সাথে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের ক্ষেত্রে আরও যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা খতিয়ে দেখে তা সমাধানে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। হ
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
আপনার মন্তব্য লিখুন