রেসালাতে মুহাম্মাদীর ওপর ঈমানের দাওয়াত
২৮ জানুয়ারি ২০১২
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ)
রাসূলের (সা) সময়ে দাওয়াতে ইসলামীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ ছিল যে, এক ও লা শারিক আল্লাহকে একমাত্র মাবুদ ও একমাত্র শাসক ও প্রভুত্ব কর্তৃত্বের মালিক মেনে নেয়ার পর এ কথাও মেনে নিতে হবে যে রাসূলই একমাত্র নির্ভরযোগ্য পয়গম্বর, যার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা মানুষকে হেদায়েত দান করেন, হুকুম আহকাম প্রদান করেন, ইবাদতের পন্থাপদ্ধতি শিক্ষা দেন, সঠিক আকিদা বিশ্বাস শিক্ষা দেন, আমল আখলাকের সঠিক ও ভ্রান্ত মূলনীতির পার্থক্য শিক্ষা দেন। তারপর নিজের সেসব আইন কানুনও পাঠিয়ে দেন যার অনুকরণ অনুসরণ মানুষকে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে করতে হয়। এ জন্য আল্লাহর তৌহিদের ওপর ঈমান আনার পর লোকের জন্য এ অপরিহার্য যে, তারা রাসূলের রেসালাতের ওপর ঈমান আনবে। তাঁকে আল্লাহর মর্জির একমাত্র প্রতিনিধি মনে নেবে। সকলের আনুগত্য পরিহার করে তাঁরই আনুগত্য করবে। অন্যান্য সকল আনুগত্য পরিত্যাগ করে ঐসব আহকাম ও হেদায়েতের অনুসরণ করবে যা রাসূল তাঁর প্রেরণকারী এক খোদার পক্ষ থেকে দেন। এভাবে এ রেসালাতের বিশ্বাসই বিরাট বিপ্লবকে বাস্তব রূপ দান করছিল যা আল্লাহর তৌহিদ স্বীকার করিয়ে ইসলাম মানব জীবনে সংঘটিত করতে চাইতো। কারণ তৌহিদ মেনে নেয়ার পর যখন মানুষ এ কথায় নিশ্চিত হয়ে যায় যে, এখন তাকে আল্লাহরই ইবাদত বন্দেগি করতে হবে এবং তাঁরই হেদায়েত অনুযায়ী চলতে হবে, তখন প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, সে তার এ বিশ্বাসকে বাস্তবায়িত করবে কিভাবে? কিভাবে সে জানতে পারবে যে, আল্লাহর ইবাদত বন্দেগির সঠিক পন্থা কী এবং তাঁর সে হেদায়েত কী যা এখন মেনে চলতে হবে। কুরআন বলে সে পন্থা পদ্ধতি চিরকালই এই ছিল যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে কোনো একজনকে তাঁর রাসূল বানিয়ে তাঁকে এমন সব বিষয়ের জ্ঞান দান করেন যার ওপর আমল করা তাঁর মর্জি মোতাবেক। তাঁর বন্দেগি করার এ ছাড়া অন্য কোনো বাস্তব পন্থা নেই যে, রাসূলের রেসালাত মেনে নিয়ে তাঁরই অনুকরণ-অনুসরণ করতে হবে। এভাবে বিভিন্ন বিশ্বাস ও চিন্তাধারা, কুসংস্কার ও ধ্যান-ধারণা, দ্বীন ও ধর্ম, রসম-রেওয়াজ ও রীতিনীতি এবং বিভিন্ন বাতিল খোদার দাসত্ব আনুগত্যে বিভক্ত মানবতা একই কেন্দ্রে একীভূত হয়ে যায় এবং সেই দ্বীন বাস্তবে কায়েম হয়ে যায় যার ওপর মানবজাতিকে একত্র ও একীভূত করা ইসলামী দাওয়াতের উদ্দেশ্য।
সৃষ্টির সূচনাকালে নবী প্রেরণের ঘোষণা
নবুওয়ত সম্পর্কে প্রথম যে কথাটি কুরআনে বলা হয়েছে, তা এই যে, পৃথিবীতে মানবজাতির সূচনালগ্নেই আদমসন্তানদের এই বলে সাবধান করে দেয়া হয় যে, রাসূলগণের মাধ্যমে যে হেদায়েত তাদের নিকটে পাঠানো হবে তার আনুগত্য তাদেরকে করতে হবে।
“হে আদমসন্তানেরা! যদি তোমাদের কাছে স্বয়ং তোমাদের মধ্য থেকে (অর্থাৎ মানুষের মধ্য থেকে) এমন রাসূল আসে যে তোমাদেরকে আমার আয়াত শুনাবে, তা হলে যে কেউ নাফরমানি থেকে দূরে থাকবে এবং নিজের আচরণ সংশোধন করবে তার জন্য ভয়ভীতি ও দুঃখ-কষ্টের কোনো কারণ থাকবে না। আর যারা আমাদের আয়াত প্রত্যাখ্যান করবে এবং তার মোকাবেলায় বিদ্রোহ করবে তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে, যেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” (সূরা আরাফ : ৩৫-৩৬)
রাসূলদের মানা না মানার ওপর মানুষের সাফল্য ও ক্ষতি নির্ভরশীল
এ কথাই সূরা বাকারা ৩৮-৩৯ নম্বর আয়াত এবং সূরা তা’হা : ১২৩-১২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যেখানে পৃথিবীতে আদম ও হাওয়া আলায়হিস সালামকে পাঠানোর উল্লেখ আছে। এখানে এ খবরই দেয়া হয়নি যে, মানুষের হেদায়েতের জন্য রাসূল পাঠানো হবে, বরঞ্চ এ সতর্কবাণীও উচ্চারণ করা হয়েছে যে, তাদের সাফল্য ও ক্ষতি নির্ভর করে এ বিষয়ের ওপর যে তারা রাসূলগণের হেদায়েত কবুল করে তাকওয়া ও সংশোধনের পথ অবলম্বন করেছে কি না! না করলে দুনিয়াতেও শাস্তি ভোগ করবে এবং জাহান্নামের শাস্তিও ভোগ করবে। বস্তুত স্থানে স্থানে দুনিয়ায় বিভিন্ন জাতির ওপর আজাব আসার কারণ এই বলা হয়েছে যে, তারা তাদের নিকটে আগত রাসূলগণের কথা মেনে নিতে অস্বীকার করেছে। যেমন : এবং এরা কি জমিনে চলাফেরা করে দেখেনি যাতে করে তারা এসব লোকের পরিণাম দেখতে পেতো যারা এদের পূর্বে অতীত হয়েছে? তারা এদের থেকে (কুরাইশ থেকে) অধিক শক্তিশালী ছিল এবং অনেক বেশি শক্তিশালী নিদর্শনাদি পৃথিবীর বুকে রেখে গেছে। তারপর আল্লাহ তাদের পাপের জন্য তাদেরকে পাকড়াও করেন এবং তাদেরকে আল্লাহ থেকে বাঁচানোর কেউ ছিল না। এ পরিণাম তাদের এ জন্য হয়েছিল যে, রাসূলগণ তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ এসেছিল। কিন্তু তারা তা মানতে অস্বীকার করে। অবশেষে আল্লাহ তাদেরকে পাকড়াও করলেন। নিশ্চিতরূপে তিনি বড় শক্তিশালী এবং শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর।
প্রায় একই ধরনের কথা সূরা ফাতের ২৫-২৬ আয়াত এবং সূরা তাগাবুন ৫-৬ আয়াতেও বলা হয়েছে। কুরআন ওই সব জাতির গল্প কাহিনীতে ভরপুর যারা তাদের জামানার রাসূলগণকে অস্বীকার করেছে এবং অবশেষে দুনিয়াতেই তারা শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে।
হুজুরের (সা) আগমনের পূর্বে আরববাসী একজন নবীর প্রতীক্ষা করছিল
উল্লেখ্য যে, আরববাসী তাদের চারপাশের ঈসায়ী, ইহুদি এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অধঃপতিত নৈতিক অবস্থা ও তাদের অপকর্মাদি লক্ষ্য করে স্বয়ং এ কথা বলতো, “এসব জাতির নিকটে যে জিনিস এসেছিল তা যদি আমাদের কাছে আসতো (অর্থাৎ রেসালাত এবং খোদার প্রেরিত হেদায়েত), তাহলে আমরা এদের সকলের চেয়ে উৎকৃষ্টতর উন্নত হওয়ার পরিচয় দিতাম।”
কুরআনে এ কথা প্রচার করা হয়েছে কিন্তু এমন কেউ ছিল না যে, এ কথা অস্বীকার করে। “এসব লোক (কুরাইশ ও আরববাসী) কড়া কড়া কসম খেয়ে বলতো, যদি কোনো সাবধানকারী (অর্থাৎ রাসূল) তাদের কাছে আসতো তাহলে তারা দুনিয়ার অন্যান্য জাতি অপেক্ষা অধিক হেদায়াতপ্রাপ্ত হতো। কিন্তু যখন সাবধানকারী তাদের নিকট এসে গেল তখন তার আগমন সত্য দ্বীন থেকে পলায়ন ব্যতীত আর কিছু বৃদ্ধি করেনি। এরা দুনিয়াতে আরো বেশি গর্ব অহঙ্কার করতে লাগলো (তাকে কষ্ট দেয়ার জন্য) নিকৃষ্টতম কলাকৌশল অবলম্বন করতে লাগলো। অথচ এ কলাকৌশল যারা অবলম্বন করে এ তাদেরকেই ধ্বংস করে।” (সূরা ফাতের : ৪২-৪৩)
“এসব লোক আগে তো বলতো হায়রে, যদি আমাদের নিকট সে জিকির (আল্লাহর নসিহতের পয়গাম) থাকতো যা অতীতের জাতিগুলো পেয়েছিল, তাহলে আমরা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাহ হতাম। কিন্তু তা এলো, এখন এরা তা মানতে অস্বীকার করলো। এখন শীঘ্রই এর পরিণাম এরা জানতে পারবে।” (সূরা সাফফাত : ১৬৭-১৭০) এর থেকে জানা গেল যে, রাসূলের আগমন তাদের ঈপ্সিত অভিলাষ ছিল। কিন্তু সে নিয়ামত যখন তাদের কাছে পৌঁছালো তখন তারা বিরোধিতা, জিদ ও হঠকারিতা করা শুরু করলো।
নবী মুহাম্মদের (সা) প্রেরণের উদ্দেশ্য
ইতঃপূর্বে আমরা বলেছি যে, (সূরা হাদিদ আয়াত ২৫ ) তাঁর প্রেরণের উদ্দেশ্য তাই, যা ছিল সব নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য। তথাপি কুরআন মজিদে বিশেষভাবে তাঁকে রাসূল হিসেবে নিয়োগ করার উদ্দেশ্য বিশদভাবে কুরাইশ ও আরববাসীর কাছে বয়ান করা হয়েছে। তা আমরা ধারাবাহিকভাবে উদ্ধৃত করছি।
তাঁর নবুওয়ত চিরন্তন ও বিশ্বজনীন
তিনি কোনো এক বিশেষ জাতির জন্য এবং আপন যুগের সকল মানুষের জন্য নন, বরঞ্চ কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য রাসূল যাদের যাদের নিকট তাঁর পয়গাম পৌঁছে। “এবং এ কুরআন আমার ওপর অহির মাধ্যম এ জন্য পাঠানো হয়েছে যে, তোমাদেরকে এবং যার যার কাছে এ বাণী পৌঁছে তাদেরকে সাবধান করে দেব।” (সূরা আনয়াম : ১৯)
কথা ও কাজের দ্বারা আহকামে ইলাহির ব্যাখ্যাদান ও তাযকিয়ায়ে নফস
নবী মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর শুধু এ দায়িত্ব ছিল না যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে অহির মাধ্যমে যে জ্ঞান তাকে দেয়া হয় তা তিনি লোকের মধ্যে পৌঁছিয়ে দেবেন। বরং এ কাজের দায়িত্ব ছিল যে, স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে ওই সব হুকুম আহকামের যে মর্ম তাঁকে বলে দেয়া হয়েছিল তদানুযায়ী নিজের কথা ও কাজের দ্বারা দ্বীনের আকায়েদ, আহকাম, হেদায়েত, আইন-কানুন প্রভৃতির ব্যাখ্যা করবেন এবং তার ভিত্তিতে লোকের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে তাদের বিকৃত জীবনধারাকে পরিশুদ্ধ ও সুশৃঙ্খল করবেন।
“এ কুরআন তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং পড়িয়ে দেয়া আমাদের দায়িত্ব। অতএব হে নবী! যখন আমরা তা পড়ি তখন তুমি তার পাঠ শুনতে থাক। তারপর তার মর্ম বুঝিয়ে দেয়াও আমাদের দায়িত্ব।” (সূরা কিয়ামাহ : ১৭-১৯)
“এবং (হে নবী) এ যিকির (অর্থাৎ কুরআন) আমরা তোমার প্রতি এজন্য নাজিল করেছি যে, তুমি লোকের কাছে সেই শিক্ষা ব্যাখ্যা করতে থাকবে যা তাদের জন্য নাজিল করা হয়েছে।” (সূরা নমল : ৪৪)
দ্বীনে হককে সমগ্র জীবনব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করা
নবী মুহাম্মদ (সা) আগমনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই দ্বীন ও হেদায়েতকে সকল প্রকার আনুগত্য এবং জীবনের সকল পন্থা পদ্ধতির ওপর বিজয়ী করা যা তিনি খোদার পক্ষ থেকে এনেছেন। কুরআনের তিনটি স্থানে এ উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সূরা তওবা ও সূরা সাফে বলা হয়েছে : “তিনিই সেই আল্লাহ যিনি তার রাসূলকে হেদায়েত ও দ্বীনে হকসহ পাঠিয়েছেন যেন সে তা সকল প্রকার দ্বীন বা জীবনব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করতে পারে। তা মুশরিকদের জন্য যতই অসহনীয় হোক না কেন।” (সূরা তওবা : ৩৩, সূরা সাফ্ : ১৮)
নবী মুহাম্মদের (সা) ওপর ঈমান ও তাঁর আনুগত্যের আদেশ
এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে মানুষকে এ আদেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা তাঁর ওপর ঈমান আনবে এবং তার আনুগত্য করবে এবং এমনসব লোকের আনুগত্য পরিহার করবে যারা আল্লাহ থেকে উদাসীন ও আনুগত্যের সীমালঙ্ঘনকারী। “অতএব ঈমান আন আল্লাহ ও তার রাসূলের ওপর এবং সেই নূরের ওপর যা আমরা নাজিল করেছি এবং তোমরা যা কিছু করছ সে সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত।” (সূরা তাগাবুন : ৮)
“অতএব ঈমান আন আল্লাহ ও তার প্রেরিত উম্মি নবীর ওপর যে আল্লাহ ও তার বাণীসমূহের প্রতি ঈমান রাখে এবং তার আনুগত্য কর যাতে তোমরা সঠিক পথ পেয়ে যাও।” (সূরা আ’রাফ : ১৫৮)
“মেনে চল সেই হেদায়েত যা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য পাঠানো হয়েছে এবং তিনি ছাড়া অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকদের আনুগত্য করো না।” (সূরা আ’রাফ : ৩)
এখন আইন-কানুন তাই যা আল্লাহ মুহাম্মদ (সা)-এর মাধ্যমে দিয়েছেন
এভাবে নবী মুহাম্মদের (সা) রেসালাতের ঘোষণা এবং তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণের সাথে সাথে এও ঘোষণা করা হয় যে, এখন খোদার আইন তাই যা মুহাম্মদ (সা) এর মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। এতে কারো মতবিরোধ করার অধিকার নেই। এর বিরুদ্ধে যা কিছু তা জাহেলিয়াত এবং তাগুতের বন্দেগি। রাসূল (সা) খোদার নিয়োজিত শাসক যাঁর কাজ এই যে, লোকের কায়কারবারের মীমাংসা খোদার নাজিল করা হেদায়েত অনুযায়ী করবেন।
“অতঃপর (বনি ইসরাইলের পর) হে নবী, আমরা তোমাকে দ্বীনের ব্যাপারে একটি সুস্পষ্ট রাজপথের (শরিয়ত) ওপর কায়েম করে দিয়েছি। অতএব তুমি এ পথেরই অনুসরণ কর এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না যারা কোনো জ্ঞান রাখে না।” (সূরা জাসিয়া : ১৮)
“হে নবী! আমরা এ কিতাব সত্যসহ তোমার ওপর নাযিল করেছি যাতে সে সঠিক পথ আল্লাহ তোমাকে দেখিয়েছেন। তদনুযায়ী মানুষের মধ্যে ফয়সালা কর।” (সূরা নিসা : ১০৫)
কুরআন মজিদে স্থানে স্থানে মানবসমাজের জন্য যেসব রীতিনীতি বর্ণনা করা হয়েছে তার জন্য ‘আল্লাহর সীমারেখা’ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ এ এমন সীমারেখা যার ভেতরে থাকারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অতঃপর কোথাও কঠোরভাবে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে এসব সীমারেখার নিকটেও যাওয়া না হয়। কোথাও বলা হয়েছে, এসব অতিক্রমকারী জালেম। কোথাও বলা হয়েছে, এসব অতিক্রমকারী নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করে। কোথাও সাবধানবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে যে, সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সূরা বাকারার ১৮৭, ২২৯, ২৩০ নম্বর আয়াত, সূরা নিসার ১৩ ও ১৪ নম্বর আয়াত, সূরা মুজাদিলার ৪ নম্বর আয়াত, সূরা তাওবার ৯৭ নম্বর আয়াত এবং সূরা তালাকের ১ নম্বর আয়াত দ্রষ্টব্য)
এর থেকে জানা গেল যে, যেসব আইন নাবী (সা)-এর মাধ্যমে মানবজাতিকে দেয়া হয়েছে তার গুরুত্ব কতখানি। তারপর পরিষ্কার ভাষায় সাবধান করে দেয়া হয়েছে : “তবে কি এরা জাহেলিয়াতের ফয়সালা কামনা করে? অথচ যারা আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে তাদের জন্য আল্লাহর চেয়ে ভালো হুকুম ফয়সালা আর কার হতে পারে?” (সূরা মায়েদা : ৫০)
দ্বীনের ব্যাপারে কোনো প্রকার আপস ও নমনীয়তার অবকাশ নেই
রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণের সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে মানুষকে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, খোদার দ্বীনের ব্যাপারে কোনো আপস ও নমনীয়তা হতে পারে না। কোনো আকিদাহ বিশ্বাস, কোন নীতি, কোনো রীতিপদ্ধতি এবং কোনো হুকুমের মধ্যে কারো খাতিরে সামান্যতম রদবদলও হতে পারে না। যে মানতে চায়, তাকে সেই পরিপূর্ণ দ্বীন মেনে নিতে হবে যা রাসূলুল্লাহ (সা) পেশ করেছেন। আর যে মানতে চায় না সে না মানুক। যে মানবে তার নিজেরই মঙ্গল হবে আর না মানলে তার নিজেরই ক্ষতি। এখানে দরকষাকষি ও লেনদেনে বোঝাপড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
(অতএব হে নবী), মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যানকারীদের চাপের মুখে কখনো নতি স্বীকার করো না। তারা চায় যে তুমি কিছুটা নমনীয় হও, তাহলে তারাও নমনীয় হবে। (অর্থাৎ তুমি ইসলামের তাবলিগের কাছে কিছুটা ঢিল দাও তাহলে তারাও তোমার বিরোধিতায় কিছুটা নমনীয়তা অবলম্বন করবে। অর্থাৎ তুমি তাদের গুমরাহির সুযোগ দিয়ে নিজের দ্বীনের মধ্যে কিছুটা রদবদল কর, তাহলে তারা তোমার সাথে আপস করে নেবে।
“এবং যখন তাদেরকে আমাদের আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট করে শুনিয়ে দেয়া হয়, তখন যারা আখেরাতে আমাদের সাথে মিলিত হওয়ার আশা রাখে না তারা বলে, এটা বাদ দিয়ে অন্য কোনো কুরআন নিয়ে আস অথবা এতে কিছু রদবদল কর। (হে মুহাম্মদ) তাদেরকে বল, আমার এ অধিকার নেই যে, আমার পক্ষ থেকে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন পরিবর্ধন করি। আমি ব্যস সেই অহিরই অনুসারী যা আমার নিকটে পাঠানো হয়।” (সূরা ইউনুস : ১৫)
নবী পাকের অহির অধিকারী হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ
কুরআন মজিদে হযরত মূসার (আ) কাহিনী বর্ণনা করার পর এক স্থানে আল্লাহ বলেন : যখন আমরা মূসাকে এ শরিয়তি ফরমান দান করি, আর না তুমি এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে একজন ছিলে। কিন্তু তারপর থেকে তোমার কাল পর্যন্ত আমরা বহু মানব বংশ সৃষ্টি করেছি এবং তাদের পর অনেককাল অতিবাহিত হয়েছে। তুমি মাদইয়ানবাসীদের মধ্যেও ছিলে না যে, তাদেরকে আমাদের আয়াত শুনাতে কিন্তু (সে সময়ের এসব খবর) আমিই পৌঁছাচ্ছি। তুমি তুরের পাদদেশে তখনো ছিলে না যখন আমরা প্রথমবার মূসাকে ডেকেছিলাম। কিন্তু তোমার রবের এ মেহেরবানি যে, (তোমাকে এসব তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে) যাতে তুমি এমন এক জাতিকে সাবধান করে দিতে পার যাদের নিকটে তোমার পূর্বে কোনো সাবধানকারী আসেনি। (সূরা কাসাস : ৪৪-৪৬)
এ তিনটি কথা রাসূলুল্লাহ (সা) এর নবুওয়তের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে যে, আল্লাহর অহি ছাড়া এসব তথ্য জানার আর কোনো উপায় নেই। এ কথা যখন কুরআনে বলা হয়েছিল, তখন মক্কার সকল সমাজপতি ও সাধারণ কাফের এ ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিল যে, যে কোনো উপায়ে তারা তাঁকে অনবী এবং মায়াযাল্লাহ মিথ্যা নবী প্রমাণিত করবে। তাদের সহযোগিতার জন্য ইহুদি ওলামা এবং খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীগণ হেজাজের জনপথগুলোতে বিদ্যমান ছিলেন। কিন্তু নবী মুহাম্মদ (সা) ঊর্ধ্ব আকাশ থেকে এসে এ কুরআন শুনিয়ে যেতেন না, বরঞ্চ তিনি এ মক্কারই অধিবাসী ছিলেন। তাঁর জীবনের কোনো একটি দিকও তাঁর ব্যস্তি ও গোত্রের লোকদের অজ্ঞাত ছিল না, এটাই কারণ যে, যখন এ ধরনের প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের ভাষায় রাসূলুল্লাহর (সা) নবুওয়তের প্রমাণস্বরূপ এ তিনটি কথা বলা হলো তখন মক্কা, হিজাজ এবং গোটা আরবের কোনো একটি লোকও দাঁড়িয়ে সে বেহুদা কথা বলতে পারেনি যা আজ ইসলামবৈরী প্রাচ্যবিদগণ বলছেন। যদিও মিথ্যা রচনায় তারা এদের থেকে কিছু কম ছিল না। কিন্তু এমন নির্জলা মিথ্যা তারা কী করে বলতে পারতো যা এক মুহূর্তের জন্য চলতো না। তারা কী করে বলতো হে মুহাম্মদ (সা), তুমিতো অমুক অমুক ইহুদি আলেম ও খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীদের নিকট থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করে এনেছ। কারণ তারা সারাদেশের মধ্যে এ উদ্দেশ্যে কারো একজনের নাম বলতে পারতো না। কারো নাম নেয়ার সাথে সাথেই প্রমাণ হয়ে যেতো যে, হুজুর (সা) তার কাছ থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ করেননি। তারা কী করে বলতো হে মুহাম্মদ (সা) তোমার নিকট তো অতীত ইতিহাস-জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের এক লাইব্রেরি রয়েছে যার সাহায্যে তুমি এসব ভাষণ দিচ্ছ। কারণ লাইব্রেরি তো দূরের কথা, মুহাম্মদ (সা) এর আশপাশ কোথাও থেকে এক টুকরা কাগজও বের করতে পারতো না যার মধ্যে এসব তথ্য লিখিত। মক্কার আবালবৃদ্ধবনিতা জানতো যে, মুহাম্মদ (সা) ছিলেন নিরক্ষর এবং কেউ এ কথা বলতে পারতো না যে, তিনি কিছু দোভাষীর সাহায্য নিয়েছেন যারা ইরানি, সুরিয়ানি এবং গ্রিক ভাষার বইপুস্তক তরজমা করে করে তাঁকে দিত। তারপর তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় নির্লজ্জ ব্যক্তিও এ দাবি করার সাহস করতো না যে, সাম ও ফিলিস্তিনের বাণিজ্যিক সফরে তিনি এসব তথ্য হস্তগত করে এসেছেন। কারণ এ সফর একাকী হয়নি। মক্কারই বাণিজ্যিক কাফেলা প্রত্যেক সফরে মুহাম্মদ (সা)-এর সাথে থাকতো। কেউ এমনটি দাবি করলে শত শত জীবিত সাক্ষ্যদাতা এ সাক্ষ্য দিত যে, তিনি সেখানে কারো নিকট থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেননি। তা ছাড়া তাঁর ইন্তেকালের দুই বছরের মধ্যেই রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুসলমানগণ যুদ্ধ শুরু করেন। মিথ্যা মিথ্যি এ কথা যদি কেউ বলতো শাম ও ফিলিস্তিনে কোনো খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী অথবা ইহুদি রাব্বির সাথে হুজুর (সা) আলাপ আলোচনা করছেন, তাহলে তো রোম সাম্রাজ্য তিলকে তাল বানিয়ে এ প্রচারণা করতে সামান্য দ্বিধাবোধও করতো না যে, মুহাম্মদ (সা) মায়াযাল্লাহ সব কিছু এখানে শিক্ষা করে যান এবং মক্কায় গিয়ে নবী হয়ে পড়েন। মোট কথা, সেকালে যখন কুরআনের এ চ্যালেঞ্জ কুরাইশ কাফের এবং মুশরিকদের জন্য মৃত্যুঘণ্টার সমতুল্য ছিল এবং তা মিথ্যা বলে চালিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা আধুনিক প্রাচ্যবিদগণ অপেক্ষা অনেক গুণে বেশি ছিল, তাদের এমন অবস্থায় কোনো ব্যক্তিই কোথাও থেকে এমন কোনো তথ্য সংগ্রহ করে আনতে পারেনি যার দ্বারা সে প্রমাণ করতে পারতো যে, মুহাম্মদ (সা)-এর নিকটে অহি ব্যতীত এসব তথ্য জানার অন্য কোনো উপায় ছিল যা চিহ্নিত করা যায়।
পাগল হওয়ার অভিযোগ
যেসব ভিত্তিহীন অভিযোগ হুজুর (সা)-এর বিরুদ্ধে করা হচ্ছিল তার মধ্যে একটি এ ছিল যে, তিনি মায়াযাল্লাহ। পাগল ছিলেন। এ অর্থে তারা তাঁকে জাদুকৃতও বলতো। (তাঁর ওপর জাদু করা হয়েছে) তাদের কথার অর্থ এটাও ছিল যে, তাঁর ওপর জিনের আছর বা প্রভাব পড়েছে। কুরআনে তাদের এ কথা উদ্ধৃত করা হয়েছেÑ “এবং তারা বলে, আমরা কি একজন পাগল কবির খাতিরে আমাদের মাবুদদের পরিত্যাগ করব?” (সূরা সাফফাত : ৩৬)
অন্যত্র বলা হয়েছে, “এবং এ জালেমরা বলে, তোমরা তো জাদুকরা এক ব্যক্তির পেছনে ছুটেছ।” (সূরা ফুরকান)
আর এক স্থানে বলা হয়েছে, “তারা কি বলে যে, এর ওপর জিন সওয়ার হয়েছে?” [(অর্থাৎ জিনের প্রভাবে সে পাগল হয়েছে) সূরা মুমিনুন : ৭০]
এসব অভিযোগের উদ্দেশ্য ছিল একই। কারণ আরববাসীর কাছে পাগল হওয়ার কারণ ছিল দু’টি। হয় কেউ তাকে জাদু করে পাগল বানিয়ে দেবে, অথবা তার ওপর জিন সওয়ার হয়েছে।
কুরআন পাকে অভিযোগগুলো উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ কথা বলার জন্য যে, অভিযোগকারীগণ কতটা অন্ধ বিদ্বেষ পোষণ করতো। তাদের যেসব অভিযোগ এখানে এবং অন্যান্য স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে, তার মধ্যে একটিও এমন নয় যা গুরুত্বসহকারে আলোচনার মতো। তার উল্লেখ এ কথা বলার জন্য করা হয়েছে যে, বিরোধীদের কাছে কোনো যুক্তি প্রমাণ ছিল না এবং কেমন অর্থহীন বেহুদা কথায় একটি যুক্তিপূর্ণ সংস্কারমূলক দাওয়াতের মোকাবেলা করছে। একজন বলছেন ভাইসব! যে শিরকের ওপর তোমাদের ধর্ম ও তামাদ্দুনের বুনিয়াদ কায়েম আছে একটা ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং তা ভ্রান্ত হওয়ার এই এই যুক্তি। জবাবে শিরক সত্য ও সঠিক হওয়ার কোনো যুক্তি প্রমাণ দেয়া হচ্ছে না। ব্যস শুধু বলা হচ্ছে, এ লোকটির ওপর জাদু প্রমাণ বড় ক্রিয়া করেছে। তিনি বলছেন, তোমাদেরকে তোমাদের প্রভুর নিকট ফিরে যেতে হবে এবং আপন আপন কর্মকাণ্ডের হিসাব দিতে হবে। আর এ সত্যকে প্রমাণ করছে এই নৈতিক, ঐতিহাসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ন্যায়সঙ্গত কার্যকলাপ। জবাবে বলা হচ্ছে, এ কবির কথা। তিনি বলছেন, আমি খোদার পক্ষ থেকে তোমাদেরকে সত্য শিক্ষা দেয়ার জন্য এসেছি। আর এ হচ্ছে সেসব শিক্ষা। জবাবে সেসব শিক্ষার ওপর কোনো আলোচনা হয় না। ব্যস বিনা প্রমাণে এ অভিযোগ করা হয় যে, এসব কোথাও থেকে নকল করে বলা হচ্ছে। তিনি তাঁর রেসালাতের প্রমাণস্বরূপ খোদার অলৌকিক বাণী পেশ করছেন। স্বয়ং নিজের জীবন সিরাত ও কর্মকাণ্ড পেশ করছেন। সেই সাথে সেই নৈতিক বিপ্লব পেশ করছেন তাঁর প্রভাবে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে সূচিত হচ্ছে। বিরোধীরা তার কোনটির প্রতিও লক্ষ্য করছে না। ব্যস জিজ্ঞেস করছে, তুমি খানাপিনা কর কেন? বাজারে ঘোরাফেরা কর কেন? তোমার আরদালি হিসেবে কোন ফেরেশতা নেই কেন? তোমার কাছে কোনো ধনভাণ্ডার অথবা বাগান নেই কেন? সেব কথা স্বয়ং প্রমাণ করছে যে, এ দুই পক্ষের মধ্যে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত কে এবং কে মোকাবেলায় অপারগ হতে আবোল তাবোল বকছে।
সকল প্রকার স্বার্থপরতা, প্রবৃত্তির অভিলাষ এবং বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হয়ে নিষ্ঠাসহকারে আল্লাহর জন্য চিন্তাভাবনা করে দেখ। প্রত্যেকে পৃথক পৃথকভাবে নেক নিয়তের সাথে এবং দুই দুই চার চারজন একত্রে মিলে ভালোভাবে আলাপ, আলোচনা করে যাচাই করে দেখ যে, এমন কী ঘটলো যে, তার ভিত্তিতে তোমরা আজ ঐ ব্যক্তিকে পাগল বলছ যাকে তোমরা কাল পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে অত্যন্ত জ্ঞানী মনে করতে? নবুওয়তের কিছুকাল আগেরই তো ঘটনা যে কাবা নির্মাণের পর হজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে যখন কুরাইশ গোত্রগুলো পরস্পরে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়, তখন তোমরাই তো সর্বসম্মতিক্রমে মুহাম্মদকে (সা) সালিস মেনে নিলে। তারপর সে এমনভাবে সে ঝগড়া মিটিয়ে দিল যে তোমরা সকলে সন্তুষ্ট হলে। যে ব্যক্তির জ্ঞান বুদ্ধি প্রজ্ঞা সম্পর্কে সমগ্র জাতির এ অভিজ্ঞতার পর হঠাৎ এমনকি হলো যে এখন তোমরা তাকে পাগল বলছ? জিদ ও হঠকারিতা তো পৃথক বিষয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষেই তোমরা অন্তর থেকে কি তাই মনে কর যা তোমরা মুখে বলছ? সে তোমাদেরকে এক কঠিন শাস্তি আসার পূর্বে সাবধান করে দিচ্ছে। এটাই কি তার অপরাধ যার জন্য তোমরা আজ তাকে পাগল বলছ? তোমাদের দৃষ্টিতে সেই জ্ঞানী ব্যক্তি যে তোমাদেরকে ধ্বংসের পথে যেতে দেখে বলে, বাহ শাবাশ! বড়ো ভালো কাজ করছ? আর পাগল কি সে ব্যক্তি যে তোমাদের মন্দ অবস্থা আসার পূর্বে সাবধান করে দেয় এবং অশান্তি অনাচারের স্থলে সংস্কার সংশোধনের পথ বলে দেয়? “তারা কি এ কথা বলে যে এ ব্যক্তিকে জিনে ধরেছে?” (সূরা মুমিনুন : ৭০)
অর্থাৎ নবী মুহাম্মদকে (সা) অস্বীকার করার কারণ কি তাদের এই যে, তারা সত্যি সত্যিই তাঁকে পাগল মনে করতো? নিশ্চয়ই এ তাদের প্রকৃত কারণ ছিল না। কারণ মুখে তারা যা কিছুই বলুক না কেন? অন্তরে অন্তরে তারা তাঁর বিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা স্বীকার করতো। তা ছাড়া, একজন পাগল এবং সুস্থ মস্তিষ্ক লোকের পার্থক্য কোনো গোপন ব্যাপার নয় যে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন। আসলে একজন হঠকারী ও নির্লজ্জ লোক ছাড়া কে এমন হতে পারে যে, এ কালাম শোনার পর এ কথা বলতে পারে যে এ পাগলের উক্তি? আর এ ব্যক্তির জীবন দেখার পর কে এ অভিমত ব্যক্ত করতে পারে যে, এ একজন মস্তিষ্কবিকৃত লোকের জীবন? আজব ধরনের এ মস্তিষ্কবিকৃত (অথবা পাশ্চাত্যের ইসলামবিদ্বেষীদের মতে মৃগী রোগ যে সে ব্যক্তির মুখ থেকে কুরআনের মতো মহান কথা বের হয় এবং তিনি এমন এক সফল আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন যা আপন দেশেরই নয়, বরঞ্চ গোটা দুনিয়ার ভাগ্য পরিবর্তন করে।
“হে নবী! তুমি তোমার রবের কৃপায় পাগল নও। এবং নিশ্চিতরূপে এমন পুরস্কার রয়েছে যা অফুরন্ত এবং নিঃসন্দেহে তুমি চরিত্রের মহান মর্যাদায় ভূষিত।” (সূরা কলম : ২-৪)
লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, এখানে সম্বোধন প্রকাশ্যত করা হচ্ছে নবী মুহাম্মদকে (সা) কিন্তু প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল কাফেরদের অপবাদের জবাব দেয়া। অতএব, কারো মনে এ সন্দেহ যেন না হয় যে, এ আয়াত নাজিল হয়েছিল হুজুরকে (সা) এ সান্ত্বনা দেয়ার জন্য যে তিনি পাগল ছিলেন না। আসলে নবীর মনে এ ধরনের কোনো সন্দেহ ছিল না যা দূর করার জন্য তাঁকে সান্ত্বনা দেয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল কাফেরদেরকে এ কথা বলে দেয়া যে, তোমরা যে কুরআনের কারণে তার উপস্থাপনকারীকে পাগল বলছ, সেটাই তোমাদের এ অভিযোগ মিথ্যা হওয়ার প্রমাণ।
তারপর এ কথা বলা হয়েছে যে, তাঁর মহান চরিত্র এ কথার সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, কাফের মুশরিকগণ তার প্রতি পাগল হওয়ার অপবাদ আরোপ করছে তা একেবারে মিথ্যা। কারণ চারিত্রিক মহত্ত্ব ও মস্তিষ্কবিকৃত এ উভয়বস্তু একত্র হতে পারে না। পাগল তাকেই বলা হয় যার মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে এবং যার মেজাজ প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য থাকে না। পক্ষান্তরে মানুষের উচ্চ ও মহান চরিত্র এ কথার সাক্ষ্য দান করে যে, সে সুস্থ মস্তিষ্ক ও সুস্থ প্রকৃতির লোক। তার মনমস্তিষ্ক ও মেজাজ প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) এর চরিত্র কেমন ছিল তা মক্কাবাসীদের অজানা ছিল না। এ জন্য তাদের প্রতি শুধু ইঙ্গিত করাই যথেষ্ট যে মক্কায় প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন লোক যেন চিন্তা করতে বাধ্য হয় যে, তারা কতটা নির্লজ্জ যারা এমন মহান চরিত্রের অধিকারী লোককে পাগল বলছে। তাদের এ প্রগলভতা রাসূলুল্লাহর (সা) জন্য নয়, বরঞ্চ স্বয়ং তাদের জন্যই ক্ষতিকর ছিল যে, অন্ধ বিরোধিতায় নেশাগ্রস্ত হয়ে তারা নবী (সা) সম্পর্কে এমন সব কথা বলছিল যা কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তি ধারণাই করতে পারতো না। আধুনিক যুগের জ্ঞান বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণার দাবিদারগণের ব্যাপারও ঠিক তেমনি যারা নবী মুহাম্মদের (সা) প্রতি মৃগীরোগে আক্রান্ত হওয়ার অপবাদ আরোপ করে। কুরআন পাক দুনিয়ার সর্বত্রই পাওয়া যায় এবং নবী পাকের সিরাতও বিশদ বিবরণসহ লিখিত পাওয়া যায়। প্রত্যেকে স্বয়ং দেখতে পারে যে, যারা এ অতুলনীয় গ্রন্থ উপস্থাপনকারীকে এবং এমন মহান চরিত্রের অধিকারীকে মস্তিষ্কবিকৃত বলে, তারা শত্রুতার অন্ধ বিদ্বেষে দিশেহারা হয়ে কী সব প্রগলভ উক্তি করছে।
নবী মুহাম্মদ (সা)। কারণ তিনি মক্কার লোকদের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যেই জীবনযাপন করেন। শৈশব থেকে যৌবনে এবং যৌবন থেকে বার্ধক্যে পৌঁছেন। নবুওয়তের আগে সমগ্র জাতি তাঁকে একজন সুস্থ প্রকৃতি ও সুুস্থ মস্তিষ্ক লোক হিসেবে জানতো। নবুওয়তের পর যখন তিনি খোদার পয়গাম পৌঁছাতে শুরু করলেন, তখন হঠাৎ তারা তাঁকে পাগল বলা শুরু করে। উল্লেখ্য, এ পাগল আখ্যা ওইসব কাজের ওপর দেয়া হয়নি, যা তিনি নবী হওয়ার আগে করতেন। কিন্তু শুধু ওইসব কথার পর দেয়া হয় যার প্রচার তিনি নবী হওয়ার পর শুরু করেন। এ জন্য বলা হচ্ছে যে, তারা কি কখনো এসব চিন্তা করে দেখেছে এসব কথার মধ্যে কোনটি পাগলের উক্তি? কোন কথাটি তাঁর অন্যায়, অসঙ্গত ও ভিত্তিহীন? যদি এরা আসমান ও জমিনের ব্যবস্থাপনার ওপর চিন্তাভাবনা করতো অথবা খোদার সৃষ্ট কোনো বস্তুবিশেষ চিন্তা গবেষণাসহ দেখতো, তাহলে স্বয়ং জানতে পারতো যে, শিরকের খণ্ডন, তৌহিদের স্বীকৃতি, খোদার বন্দেগির দাওয়াত এবং মানুষের দায়িত্ব ও জবাবদিহি সম্পর্কে যা কিছু তাদের ভাই (নবী মুহাম্মদ) তাদেরকে বোঝাচ্ছেন, তার সত্যতা সম্পর্কে এ বিশ্বপ্রকৃতির ব্যবস্থাপনা এবং খোদার সৃষ্টির প্রতিটি অণু-পরমাণু সাক্ষ্য দিচ্ছে।
কবি হওয়ার অভিযোগ
কুরাইশ কাফেরগণ হুজুরের (সা) বিরুদ্ধে কবি হওয়ার অভিযোগও আরোপ করতো এবং বলতো, আমি কি একজন পাগল কবির কথায় আমাদের মাবুদদেরকে পরিত্যগ করব? তার জবাবে বলা হলোÑ “এবং কবিদের পেছনে তো পথভ্রষ্ট লোকেরা চলে।” (সূরা শুয়ারা : ২২৪)
অর্থাৎ কবিদের সাথে সংশ্লিষ্ট লোক তাদের স্বভাব চরিত্রের দিক দিয়ে তাদের থেকে একেবারে ভিন্নতর হয় যাদেরকে তোমরা নবী মুহাম্মদের (সা) সাথে দেখছে। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য এত প্রকট যে, এক নজরেই বোঝা যায় যে, এরা কেমন লোক এবং তারা কেমন। একদিকে দেখা যায় চরম গাম্ভীর্য, ভদ্রতা, সভ্যতা, সততা ও খোদাভীতি। কথায় কথায় দায়িত্বের অনুভূতি। আচরণে লোকের অধিকার সংরক্ষণ। কাজে কর্মে পরিপূর্ণ আমানতদারি ও দিয়ানতদারি। মুখ খুললে মঙ্গল ও কল্যাণের জন্যই খোলে। মন্দ কথা মুখ দিয়ে কখনো বের হয় না। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, তাদের দেখে পরিষ্কার মনে হয়, এদের জীবনের একটা পূত-পবিত্র ও মহান লক্ষ্য আছে যার চিন্তায় তারা দিনরাত মগ্ন রয়েছে। তাদের সমগ্র জীবন এক মহান উদ্দেশ্যের জন্য উৎসর্গীকৃত।
অন্য দিকে অবস্থা এই যে, কোথাও প্রেমপ্রণয় নিবেদন ও মদ্যপানের বিষয় আলোচিত হচ্ছে এবং শ্রোতাগণ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বাহবা দিচ্ছে। কোথাও কোনো বীরাঙ্গনা অথবা কোনো গৃহবধূর রূপসৌন্দর্য আলোচ্য বিষয় হয়ে পড়েছে এবং শ্রোতাগণ তা প্রাণ ভরে উপভোগ করছে। কোথাও যৌন সহবাসের কাহিনী বর্ণনা করা হচ্ছে এবং শ্রোতাদের মনে কামাগ্নি প্রজ্ব¡লিত হচ্ছে। কোথাও ভাঁড়ামি করা হচ্ছে অথবা বিদ্রƒপাত্মক কথা বলা হচ্ছে এবং চারিদিকে হাসি ঠাট্টার ঢল নেমেছে। কোথাও কারো প্রতি বিদ্রƒপ করা হচ্ছে এবং শ্রোতাগণ তা উপভোগ করছে। কোথাও কারো অসঙ্গত প্রশংসা করা হচ্ছে এবং হাততালি দিয়ে তা সমর্থন করা হচ্ছে। কোথাও কারো বিরুদ্ধে ঘৃণা, আক্রোশ, শত্রুতা প্রকাশ করে প্রতিশোধ গ্রহণের প্রেরণা সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং শ্রোতাদের মনে তার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে। এসব সমাবেশে কবিদের কথা শুনার জন্য ভয়ানক ভিড় জমে। এ ধরনের বড় বড় কবির পেছনে যারা লেগে থাকে, তাদের দেখে কেউ এ কথা মনে না করে পারে না যে, এরা নৈতিক বন্ধন থেকে মুক্ত, প্রবৃত্তির কামনা বাসনার স্রোতে প্রবাহিত। এরা সুখ সম্ভোগের পূজারি এবং পশুসদৃশ। তাদের মনে কখনো এ ধারণার ছোঁয়া লাগে না যে, দুনিয়ার মানুষের জন্য জীবনের কোনো মহান উদ্দেশ্য আছে না কি। এ উভয় দলের সুস্পষ্ট পার্থক্য যদি নজরে না পড়ে তাহলে সে অন্ধ। আর সব কিছু দেখার পর শুধু সত্যকে হেয় করার মানসে যদি বলে যে মুহাম্মদ (সা) এবং তাঁর সঙ্গী সাথীগণ কবি ও তাদের অনুচরদের মতোই, তাহলে বলতে হবে তারা মিথ্যা বলার জন্য সকল সীমালঙ্ঘন করেছে। “তোমরা কি দেখছ না যে, তারা (কবিগণ প্রত্যেক উপত্যকায় পথহারা হয়ে ঘুরছে?” (সূরা শুয়ারা : ২২৫)
অর্থাৎ কোনো একটি নির্দিষ্ট পথ নেই যে সম্পর্কে তারা চিন্তাভাবনা করে এবং যার জন্য তারা তাদের কাব্য-প্রতিভা নিয়োজিত করে। বরঞ্চ তাদের চিন্তা রাজ্যের ঘোড়া লাগামহীন ঘোড়ার মতো প্রত্যেক উপত্যকায় পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কামনা, বাসনা, স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের প্রত্যেক নতুন প্রবাহ তাদের মুখ থেকে এক নতুন বিষয়বস্তু বের করে আনে যে সম্পর্কে কোনো চিন্তা করতে এবং তা বর্ণনা করতে এ বিষয়ের প্রতি মোটেই লক্ষ্য রাখা হয় না যে, এ কথা সঠিক ও সত্য কি না। কখনো চিন্তার এক তরঙ্গ উঠলো তো বিজ্ঞতা ও সদুপদেশের কথা চললো। আবার কখনো দ্বিতীয় তরঙ্গ উঠলো তো এ একই মুখ থেকে চরম অশ্লীল ও জঘন্য কামনা লালসার মধু বর্ষণ হতে লাগলো। কারো প্রতি সন্তুষ্ট হলে তাকে আকাশে উঠানো হয় এবং কারো প্রতি ক্ষুণœ হলে তাকে পাতালপুরীতে পাঠানো হয়। এককজন কৃপণকে হাতেমের এবং একজন ভীরু কাপুরুষকে রুস্তম ও ইসকান্দারিয়ারের মর্যাদা দানেও তারা দ্বিধাবোধ করে না, যদি এতে তাদের কোনো স্বার্থ জড়িত থাকে। ঠিক এর বিপরীত কারো দ্বারা মনে ব্যথা পেলে, তার পবিত্র জীবনের ওপর কলঙ্ক আরোপ করতে, তার মান সম্ভ্রম বিনষ্ট করতে, এমনকি তার বংশের প্রতি উপহাস করতেও তারা লজ্জাবোধ করে না। খোদা পরস্তি ও খোদাদ্রোহিতা, বস্তুবাদ ও আধ্যাত্মিকতা, চারিত্রিক মহত্ত্ব ও চরিত্রহীনতা, পবিত্রতা ও নোংরামি, মলিনতা, গাম্ভীর্য এবং ছেলেমি, তোষামোদ ও বিদ্রƒপ সবকিছুই একই কবির কবিতার পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায়। কবিদের এসব সুপরিচিত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যে ব্যক্তি অবহিত ছিল, তার মস্তিষ্কে এ অবান্তর কথা কী করে প্রবেশ করতে পারতো যে, এ কুরআন উপস্থাপনকারীর ওপর কবি হওয়ার অপবাদ আরোপ করা হোক। অথচ তাঁর কথা ছিল একেবারে মাপাজোকা এবং সুস্পষ্ট। তাঁর পথ ছিল সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। তিনি সত্য ও সততা এবং কল্যাণের আহ্বান থেকে দূরে সরে গিয়ে একটি কথাও মুখ থেকে বের করেননি। কুরআনের অন্য এক স্থানে নবী (সা) সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তাঁর স্বাভাবিক প্রকৃতির সাথে কবিতা রচনার কোনো সামঞ্জস্যই ছিল না। “আমরা তাকে কবিতা শিক্ষা দিইনি। আর না এ তার করার কাজ।” (সূরা ইয়াসিন : ৬৯)
এ এমন এক সত্য যে যারাই নবী মুহাম্মদকে (সা) ব্যক্তিগতভাবে জানতো, তারা সকলেই জানতো। নির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে, কোনো কবিতাই পুরোপুরি হুজুরের (সা) মনে ছিল না। কথাবার্তায় কখনো কোনো কবির কোনো ভালো কবিতা তাঁর মুখ থেকে বের হলেও তা বেমানানভাবে পড়তেন অথবা তার মধ্যে শব্দের হেরফের হতো।
হযরত হাসান বাসরী (রহ) বলেন, একবার বক্তৃতা করতে গিয়ে হুজুর (সা) কবির কবিতা এভাবে আওড়ালেন। হযরত আবু বকর (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কবিতার শ্লোক আসলে এমন হবে।
একবার আব্বাস বিন মিরদাস সুলামিকে নবী (সা) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এ কবিতা লিখেছ?
তিনি বললেন, শেষ কথাটুকু অমন না হয়ে এমন হবে। নবী (সা) বললেন, উভয়ের অর্থ তো একই রকম।
হযরত আয়েশাকে (রা) জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নবী (সা) কখনো তাঁর ভাষণে কবিতা ব্যবহার করতেন কি না। তিনি বলেন, কবিতা অপেক্ষা অন্য কোনো জিনিসের প্রতি তাঁর ঘৃণা ছিল না। অবশ্যি কখনো কখনো বনি কায়েসের কবিতার দু-এক ছত্র পড়তেন। কিন্তু শেষটুকু আগে এবং আগেরটুকু শেষে পড়তেন। হযরত আবু বকর (রা) বলতেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ও রকম না এ রকম হবে।
নবী (সা) বলতেন, ভাই, আমিত কবি নই। আর কবিতা রচনা করা আমার কাজও নয়।
আরবের কাব্য সাহিত্য যেসব বিষয়ে পরিপূর্ণ ছিল তাহলো যৌন কামনা-বাসনা, প্রেম-প্রণয়, মদ্যপান, গোত্রীয় হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব-কলহ, অথবা গর্ব অহঙ্কার। ধার্মিকতা এবং কল্যাণের কথা তার মধ্যে খুব কমই পাওয়া যেত। তারপর মিথ্যা, অতিরঞ্জন, অপবাদ, বিদ্রƒপ, অসঙ্গত প্রশংসা আত্মম্ভরিতা, ঠাট্টা-বিদ্রƒপ এবং পৌত্তলিক পৌরাণিক কাহিনী এ কাব্য সাহিত্যের অঙ্গীভূত। এ জন্য নবী (সা) এ কাব্য সাহিত্য সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য করেন।
তোমাদের মধ্যে কারো পেট কবিতায় পূর্ণ হওয়া অপেক্ষা পুঁজে পূর্ণ হওয়া ভালো। তথাপি কোনো কবিতায় ভালো কথা থাকলে নবী (সা) তার প্রশংসা করতেন। তিনি বলতেন, কোনো কোনো কবিতা বিজ্ঞতাপূর্ণ হয়। উমাইয়া বিন আবিস সালতের কবিতা শুনে তিনি বলেন, তার কবিতা মুমেন কিন্তু তার মন কাফের।
একবার জনৈক সাহাবী শত খানেক উৎকৃষ্ট কবিতা নবীকে (সা) শুনিয়ে দেন এবং তিনি বলতে থাকেন, বাহ ভারি সুন্দর, আরও শোনাও। এবং তারা এমন কথা বলে যা করে না। (সূরা শুয়ারা : ২২৬)
এ ছিল কবিদের আর এক বৈশিষ্ট্য যা নবী (সা)-এর কর্মপদ্ধতির পরিপন্থী ছিল। যারা তাঁকে জানতো তাদের এটা জানা ছিল যে, তিনি যা বলেন তা করেন এবং যা করেন তাই বলেন। তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য এমন এক সুস্পষ্ট সত্য ছিল যা তাঁর পারিপার্শ্বিক সমাজের কেউ অস্বীকার করতে পারতো না। পক্ষান্তরে কবিদের সম্পর্কে কার এ কথা জানা ছিল না যে, তাদের বলা একরূপ এবং করা অন্যরূপ? দান দক্ষিণা সম্পর্কে এমন জোরালো বয়ান করবে যে মানুষ মনে করবে যে তার চেয়ে দরিয়া দিল আর কেউ হবে না কিন্তু কার্যকলাপ দেখলে দেখা যাবে যে ভয়ানক কৃপণ। বীরত্বের কথা বলবে কিন্তু স্বয়ং ভীরু কাপুরুষ। মুখাপেক্ষীহীনতা, তুষ্টি এবং আত্মমর্যাদার কথা বলবে কিন্তু স্বয়ং লোভ-লালসায় নীচতার সর্বনিম্নস্তরে পতিত হবে। অপরের সামান্য দুর্বলতা পাকড়াও করবে কিন্তু স্বয়ং চরম দুর্বলতায় লিপ্ত হবে।
বিরোধীদের অভিযোগে সামঞ্জস্যহীনতা এবং কুরআনের প্রতিবাদ
আগে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তার থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, মক্কার কাফেরগণ নবী (সা)-এর ওপর বিপরীতমুখী অভিযোগ আরোপ করতো এবং কোনো একটি অভিযোগও সুনির্দিষ্ট করে করতে পারেনি। কুরআন পাকে তাদের এ দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা মিথ্যা প্রমাণ করেছে।
“(অতএব) হে নবী! তুমি নসিহত করতে থাক। তোমার রবের অনুগ্রহে না তুমি গণক, আর না পাগল। লোকে কি বলে যে এ ব্যক্তি কবি যার সপক্ষে আমরা কালের বিবর্তনের অপেক্ষা করছি? তাদেরকে বল, আচ্ছা, অপেক্ষা কর। আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি। তাদের বিবেক কি তাদেরকে এ ধরনের কথা বলতে বলছে? অথবা প্রকৃতপক্ষে তারা বিদ্বেষের সীমা অতিক্রম করে গেছে?” (সূরা তুর : ২৯-৩২)
এ কয়েকটি বাক্য বিরোধীদের সকল প্রচারণার গোমর ফাঁক করে দিচ্ছে। যুক্তি প্রমাণের সার কথা এই যে, কুরাইশ সর্দার ও গোত্রপতিগণ বড় বিবেকবান হওয়ার দাবি করে। কিন্তু তাদের বিবেক কি এ কথা বলে যে, যে ব্যক্তি কবি নয় তাকে কবি বল? যাকে সমগ্র জাতি একজন বিজ্ঞ হিসেবে জানে, তাকে পাগল বল। ভাগ্য গণনার সাথে যে ব্যক্তির দূরতম সম্পর্কও নেই, তাকে অযথা গণক বল। বুদ্ধি বিবেকের ভিত্তিতেই তারা যদি কোনো নির্দেশ দান করে, ত কোনো এক নির্দেশ দেবে। কিন্তু পরস্পরবিরোধী অনেক নির্দেশ ত এক সাথে দিতে পারে না। এক ব্যক্তি একই সাথে কবি, পাগল এবং ভবিষ্যদ্বক্তা কেমন করে হতে পারে? পাগল হলে তো না গণক হতে পারে আর না কবি। গণক হলে কবি হতে পারে না। এবং কবি হলে গণক হতে পারে না। কারণ কবিতার ভাষা এবং তার বিষয়বস্তু পৃথক হয়ে থাকে এবং গণকের ভাষা ও তার বিষয়বস্তু পৃথক। একই কথাকে একই সময়ে কবিতাও বল এবং গণকের কথাও বলা এমন লোকের কাজ হতে পারে না যে কবিতা এবং গণকের কথার পার্থক্য জানে। অতএব এ পরিষ্কার কথা যে, নবী মুহাম্মদের (সা) বিরোধিতায় পরস্পরবিরোধী কথা কোনো বিবেকসম্মত কথা নয়। শুধু জিদ ও হঠকারিতার বশবর্তী হয়ে এসব বলা হচ্ছে। জাতির বড় বড় সর্দার ও দলপতিগণ বিদ্বেষবশত নিছক ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে বিবেকবান লোক যার প্রতি কোনো গুরুত্বই দেয় না। “(হে নবী)! দেখ কোন ধরনের কথা এরা তোমার বিরুদ্ধে বলছে? এরা পথভ্রষ্ট হয়েছে, তারা পথ পাচ্ছে না।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৪৮)
অর্থাৎ এরা তোমার সম্পর্কে কোনো একটি অভিমত প্রকাশ করে। বরঞ্চ একেবারে ভিন্ন ধরনের এবং পরস্পরবিরোধী কথা বলে। কখনো বলে যে তুমি স্বয়ং জাদুকর। কখনো বলে, তোমার প্রতি অন্য কেউ জাদু করেছে। কখনো বলে, তুমি কবি, কখনো বলে তুমি পাগল এবং কখনো বলে তুমি গণক। তাদের এ পরস্পরবিরোধী কথা স্বয়ং এ কথারই প্রমাণ যে, প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে তারা অজ্ঞ। নতুবা তারা এক এক দিন এক এক কথা বলার পরিবর্তে কোনো একটি সুস্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করতো। উপরন্তু এর থেকে এটাও বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, তারা কোনো একটি বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত নয়। একটা অভিযোগ করার পর নিজেরাই মনে করে যে, এটা ঠিক হলো না। তখন অন্য আর একটি অভিযোগ করে। তাও ঠিক হলো না মনে করে তৃতীয় এক অভিযোগ তৈরি এভাবে তাদের প্রত্যেক নতুন অভিযোগ পূর্বের অভিযোগ খণ্ডন করে। এতে বোঝা যায় যে সততার সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। নিছক শত্রুতাবশত একের পর আর একটি অভিযোগ আরোপ করছে। “এরা তো যখনই সত্য এদের কাছে এলো, একেবারে তা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিল। এ কারণেই এখন তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে আছে।” (সূরা কাফ : ৫)
এ সংক্ষিপ্ত বাক্যে এক বিরাট বিষয় বর্ণিত হয়েছে। এর মর্ম এই যে, এরা শুধু বিস্ময় প্রকাশ এবং ধারণাতীত বলে বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরঞ্চ যে সময় নবী মুহাম্মদ (সা) তাঁর সত্য দাওয়াত পেশ করলেন তক্ষুনি বিনাদ্বিধায় তাকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করলো। তার ফল এই হওয়ার ছিল এবং তাই হলো যে, তারা এ দাওয়াত এবং দাওয়াত উপস্থাপনকারী সম্পর্কে কোনো একটি অভিমতে স্থির থাকলো না। কখনো তাকে কবি বলে, কখনো পাগল, কখনো গণক। কখনো বলে, সে তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য এসব স্বয়ং রচনা করে এনেছে। কখনো এ অভিযোগ করে যে, তার পেছনে অন্য লোক আছে যারা এসব রচনা করে তাকে দেয়। এ ধরনে পরস্পরবিরোধী এ কথা প্রমাণ করে যে, তারা তাদের নীতি বা করণীয় সম্পর্কে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। এ দ্বিধাদ্বন্দ্বে তারা কখনোই পড়তো না যদি তাড়াহুড়া করে প্রথমেই নবীকে (সা) মিথ্যা মনে করে দ্বিধাহীন চিত্তে আগাম সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পূর্বে গুরুত্বসহকারে চিন্তা ভাবনা করে দেখতো যে এ দাওয়াত কোন ব্যক্তি পেশ করছে। কোন কথা বলছে এবং তার কী যুক্তি পেশ করছে। এ কথা ঠিক যে সে ব্যক্তি তাদের অপরিচিত ছিল না। কোথাও থেকে হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। সে তাদের আপন জাতিরই একজন। তাদের নিজস্ব পরীক্ষিত লোক। তার চরিত্র, আচার আচরণ ও যোগ্যতা তাদের অজানা ছিল না। এমন ব্যক্তির পক্ষ থেকে যখন কোনো কথা বলা হলো ত সঙ্গে সঙ্গেই তা গ্রহণ করা না হোক, কিন্তু এমনটিও হওয়া উচিত ছিল না যে শোনামাত্রই তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আর সে কথা যুক্তি প্রমাণহীনও ছিল না। তার জন্য সে রীতিমতো যুক্তিপ্রমাণও পেশ করছিল। তা শোনা উচিত ছিল এবং যাচাই করা উচিত ছিল যে, তা কতটা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এ আচরণ অবলম্বন করার পরিবর্তে যখন তারা জিদের বশবর্তী হয়ে প্রথমে তা মিথ্যা মনে করলো, তখন তার ফল এ হলো যে, প্রকৃত সত্যে উপনীত হওয়ার দরজা নিজেরাই নিজেদের জন্য বন্ধ করে দিল এবং চারদিকে পথহারা হয়ে ঘোরাফিরার বহু পথ খুলে দিল। এখন তারা তাদের প্রাথমিক ভুলের সপক্ষে দশটি পরস্পরবিরোধী কথা ত বলতে পারে। কিন্তু এ একটি কথা চিন্তা করতেও প্রস্তুত নয় যে, নবী সত্য হতে পারেন কি না এবং তিনি যে কথা পেশ করছেন তা সত্য হতে পারে কি না।
আপনার মন্তব্য লিখুন