post

র‍্যাগিং ও বুলিং ঘৃণ্যতম সামাজিক অবক্ষয়

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান

২৬ জানুয়ারি ২০২৩

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে নানা পথ ও মতের মানুষ। বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ মিলে একই সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাস করে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। দুনিয়াতে মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়া (আ)। তাঁদের থেকেই দুনিয়াতে মানুষ বিস্তার লাভ করেছে (সূরা নিসা : ১)। সে হিসাবে পৃথিবীর সকল মানুষ ভাই ভাই। আদর্শিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে মুসলমানরা ইবরাহিম (আ)-এর বংশধর (সূরা হজ্জ : ৭৮)। সুতরাং যেদিক দিয়েই বিবেচনা করা হোক না কেন পৃথিবীর সকল মানুষ পরস্পর ভাই ভাই। তাই মানুষ একে অপরকে কিংবা এক মুসলমান অপর মুসলমানকে কষ্ট দিতে পারে না। কারণ পরস্পরকে কষ্ট দেওয়ার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।


মানুষকে কষ্ট দেওয়ার মাধ্যম

মানুষকে প্রধানত কথা ও কাজের মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া হয়ে থাকে। কথার মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া বলতে গালি দেওয়া, গীবত-তোহমত, চোগলখুরী করা, খোঁটা দেওয়া, তুচ্ছ জ্ঞান করা ইত্যাদি বোঝায়। আর কাজের মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া বলতে জুলুম করা, ধোঁকা- প্রতারণা, রাস্তা বন্ধ করা, সম্পদ জবর দখল করা ও হত্যা করা ইত্যাদি বুঝায়।

র‌্যাগিং ও বুলিং বর্তমানে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার এক অপসংস্কৃতি। র‌্যাগিং শব্দের অর্থ নাকি ‘পরিচয়পর্ব’। কিন্তু বাস্তবে পরিচয়পর্বের নামে চলে মানসিক নির্যাতন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে পুরাতন শিক্ষার্থীদের একটা সখ্য গড়ে তোলার জন্য যে পরিচিতি প্রথা সেটাকে র‌্যাগিং বলে অভিহিত করা হয়। র‌্যাগিং-এর প্রথম শুরুটা হয়েছিল গ্রিক কালচারে; সপ্তম ও অষ্ঠম শতকে খেলার মাঠে টিম স্পিরিট নিয়ে আসার জন্য। কালের বিবর্তনে পশ্চিমা ইউনিভার্সিটিগুলোতে এটা ঢুকে যায় অষ্টদশ শতাব্দীতে বিশেষ করে ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে। ১৮২৮ থেকে ১৮৪৫ সালের দিকে আমেরিকার ইউনিভার্সিটিতে এর প্রচলন ঘটে বিভিন্ন ছাত্র সংস্থা পাই, আলফা, বিটা, গামা, কাপ্পা ও অন্যান্য ছাত্র সংস্থার উদ্ভবের মাধ্যমে। এগুলোতে সদস্যদের সাহসের পরিচয় নিতে র‌্যাগিং (পশ্চিমে এটাকে বলে হ্যাজিং) এর প্রচলন ঘটে। আমাদের উপমহাদেশে ইংরেজদের মাধ্যমে এই অপসংস্কৃতি অনুপ্রবেশ করে এবং এর বিবর্তিত রূপটা রয়ে যায়। বিশেষ করে র‌্যাগিং এর খারাপ প্রভাব সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বর্তমানে শ্রীলঙ্কাতে। যেসব দেশে র‌্যাগিং-এর উদ্ভব হয়েছে, তারা সময়ের সাথে সাথে ঠিকই এর প্রভাব মুক্ত হয়েছে আর আমাদের উপমহাদেশে আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে এমনটাই দেখা যায়, আমরা বাজে সংস্কৃতিটাকে লালন পালন করছি কিন্তু যাঁরা এর সূচনা করেছে তারা অনেক আগেই ছুড়ে ফেলেছে। আমাদেরও সময় এসেছে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার।

ভারত এবং বাংলাদেশে র‌্যাগিং প্রথার অন্তরালে অপরাধকর্ম চর্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনকে দিন। বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রসিকতার ছলে অমানবিক র‌্যাগিং প্রথা চলছে, যা এককথায় টর্চার সেলে নির্যাতনের মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ক্যাম্পাসে প্রথম পা রেখেই র‌্যাগিং নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নবীন শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, জাহাঙ্গীরনগর, শাহজালাল এবং ইসলামি বিশ্ববিদ্যলয়ে এ অবস্থা চরম নাজুক। এ নির্যাতনে পিছিয়ে নেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত সরকারি কলেজগুলোও।

র‌্যাগিংয়ের মাধ্যমে নবীন শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। যেমন কান ধরে ওঠবস করানো, রড দিয়ে পেটানো, পানিতে চুবানো, উঁচু ভবন থেকে লাফ দেওয়ানো, সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেওয়া, গাছে উঠানো, ভবনের কার্নিশ দিয়ে হাঁটানো, মুরগি হয়ে বসিয়ে রাখা, ব্যাঙ দৌড়ে বাধ্য করা, সিগারেট-গাঁজা-মদ্যপানে বাধ্য করা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করানো, সবার সম্মুখে নগ্ন করে নাচানো, যৌন অভিনয়ে বাধ্য করা, ছেলেমেয়ে হাত ধরা বা জোর করে আলিঙ্গন করতে বাধ্য করা, অপরিচিত মেয়ে অথবা ছেলেকে প্রকাশ্যে প্রেমের প্রস্তাব দিতে বাধ্য করা, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে যৌন হয়রানি করা, দিগম্বর করা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুম অথবা মাঠের মাপ নেওয়া, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মাপ নেওয়া, শীতের মধ্যে পানিতে নামিয়ে নির্যাতন করা, পুরোনো শিক্ষার্থীদের থুতু মাটিতে ফেলে নতুনদের তা চাটতে বলা, বড় ভাইদের পা ধরে সালাম করা, গালাগাল করা, নজরদারি করা, নিয়মিত খবরদারি করা ইত্যাদি।

র‌্যাগিং হচ্ছে একজন অনভিজ্ঞ ছাত্রকে ভিতু ও হীনমন্য করে তোলার অপপ্রয়াস। র‌্যাগিংয়ের মতো অমানবিক আচরণের কারণে অন্যের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞার সৃষ্টি হয়, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পরিবেশকে অনিরাপদ করে তোলে। র‌্যাগিংয়ের মতো অপদস্থ ও নির্যাতনমূলক আচরণে অনেক শিক্ষার্থী আতঙ্কে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে অনেকে আত্মহত্যারও চেষ্টা করে। তাছাড়া আজ যে শিক্ষার্থী র‌্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছে, সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আগামীতে এর চেয়ে বেশি মাত্রায় র‌্যাগিং করার পরিকল্পনা করবে এবং নতুন ছাত্রছাত্রীরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ওপর চড়াও হবে- এটাই স্বাভাবিক। ফলে এ অপসংস্কৃতি দিন দিন বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। 

সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, বুলিং হলো অপ্রত্যাশিত ও আক্রমণাত্মক আচরণ, যা সাধারণত স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আচরণের মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে ক্ষমতার অসামঞ্জস্য প্রকাশ পায়। এই আচরণের শিকার শিশু বা কিশোর থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের ব্যক্তিই হতে পারেন। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বা অফিসের সহকর্মীদের মধ্যেও এমন আচরণ দেখা যায়। এর অর্থ হচ্ছে, কাউকে শারীরিক বা মানসিকভাবে অপদস্থ করা। বুলিং মূলত সচেতন বা অবচেতনভাবে একধরনের আক্রমণাত্মক আচরণ, ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে অপমান, অপদস্থ বা হেয় করা। বুলিংকে মজা হিসেবে দেখার শিকড় আমাদের সমাজের গভীর পর্যন্ত।

কারো মতে, অপমান করা, আত্মসম্মানে আঘাত করা, কারও সামনে কাউকে হেয় করা, দোষারোপ করা, হুমকি দেওয়া, উত্ত্যক্ত করাকে বুলিং বলে। মৌখিক আতঙ্ক, শারীরিক আক্রমণসহ নানা ধরনের উত্ত্যক্তমূলক আচরণও বুলিং হিসেবে গণ্য হতে পারে। সাধারণত ‘বুলিং’ বলতে দু’জন ব্যক্তির মধ্যে তর্ক বা কথা-কাটাকাটির জের ধরে একজন ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে সবার সামনে দোষারোপ বা খারাপ ভাষায় আক্রমণ করাকে বোঝানো হয়। আবার একজনের ছবি বা ভিডিও বিকৃতি করে অনলাইনে তুলে ধরাও বুলিংয়ের মধ্যে পড়ে। এ ধরনের কাজকে সাইবার অপরাধ বলে গণ্য করা হয়।

বুলিং হলো অপ্রত্যাশিত ও আক্রমণাত্মক আচরণ, যা সাধারণত স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। পেক্সেলস ডটকম বুলিংয়ের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় স্পষ্ট করেছে।

- বুলিংয়ের শিকার ব্যক্তি বুলিংকে মেনে নিতে পারেন না।

- যিনি বুলিং করছেন এবং যিনি বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন, উভয়ই বুঝতে পারেন এ ধরনের পরিস্থিতিতে বুলিং করা ব্যক্তির ক্ষমতা বেশি।

- যিনি বুলিংয়ের শিকার হন, তিনি বারবারই হতে থাকেন।


র‌্যাগিং বন্ধে আদালতের লিগ্যাল নোটিশ

(১২ ডিসেম্বর) আদালত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিন মাসের মধ্যে অ্যান্টি রাগিং স্কোয়াড ও কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ একইসঙ্গে সরকারের ওপর এ নিয়ে একটি রুল জারি করে। রুলে র‌্যাগিংয়ের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের মর্যাদা রক্ষায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়।

এর আগে গত বছরের ৯ অক্টোবর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিং বন্ধে একটি লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় সংশ্লিষ্ট আইনজীবী রিট করেন। শুনানি শেষে আদালত তিন মাসের মধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অ্যান্টি র‌্যাগিং স্কোয়াড ও অ্যান্টি র‌্যাগিং কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। স্কোয়াড গঠন করা হবে র‌্যাগিং প্রতিরোধে আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। আর কমিটি গঠন করা হবে অভিযোগ নেওয়ার জন্য।


শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং-বুলিং প্রতিরোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা

দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং-বুলিং প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগে শিক্ষাসচিব সোলেমান খানের সভাপতিত্বে ‌‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং-বুলিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত নীতিমালা-২০২৩’ এর খসড়া চূড়ান্তকরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। 

নীতিমালায় কোনো শিক্ষার্থীকে ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতিকর বা বেদনাদায়ক এবং আক্রমণাত্মক ব্যবহার, ব্যঙ্গ করে নাম ধরে ডাকা, বদনাম করা, লাথি মারা, বিভিন্ন ধরনের কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করা বা উত্যক্ত করা, এমনকি অবহেলা বা এড়িয়ে চলে মানসিক চাপ দেওয়া র‍্যাগিং-বুলিংয়ের পর্যায়ে পড়ে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব মো. মিজানুর রহমান সই করা এ নীতিমালাটি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, র‍্যাগিং-বুলিং প্রতিরোধে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং-বুলিং প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং-বুলিং হয় কিনা তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং-বুলিং অপরাধ প্রতিরোধে অভিযোগ বক্স রাখার ব্যবস্থা করবেন এবং অভিযোগের গুরুত্ব অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। নিয়মিত সভায় মিলিত হয়ে এ সংক্রান্ত মনিটরিং কার্যক্রম পর্যালোচনা করবেন। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করবেন। এক্ষেত্রে র‍্যাগিং-বুলিংকারী শিক্ষক অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে পাঠাবেন। 

সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর বিদ্যমান বিধিবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থাগ্রহণের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করবে। বুলিং-র‌্যাগিংকারী শিক্ষার্থী হলে এর ধরন ও গুরুত্ব অনুযায়ী বিধিমালা অনুযায়ী সাময়িক বা স্থায়ী বহিষ্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং ঘটনার গুরুত্ব সাপেক্ষে প্রচলিত আইন অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করবে।

প্রতি ছয়মাস অন্তত একবার প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এ বিষয় থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ আয়োজন করবে।


র‍্যাগিং-বুলিং প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা

ইসলামের সঠিক শিক্ষার অভাবে ও নৈতিকতার পতনের কারণে র‌্যাগিং-বুলিংয়ের মতো অনৈসলামিক প্রথার ব্যাপকতা লাভ করেছে। ছোট ও নবীনের প্রতি আগ্রাসী ও নিষ্ঠুর আচরণ এবং প্রভুত্বের মনোভাব কোনোভাবেই ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। বড়র কাছে ছোটর প্রাপ্য স্নেহ ও ভালোবাসা। আর ছোটর কাছে বড়র প্রাপ্য শ্রদ্ধা ও মান্যতা। ইসলাম মানুষকে এ শিক্ষাই প্রদান করে। রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আমাদের ছোটকে স্নেহ করে না, আমাদের বড়কে শ্রদ্ধা করে না।’ (তিরমিজি-১৯১৯)। কাজেই মানবসমাজে ছোট-বড়র মাঝে স্নেহ-ভালোবাসা এবং ভক্তি-শ্রদ্ধার সম্পর্কই বাঞ্ছনীয়। নতুন কোনো জায়গায় বা প্রতিষ্ঠানে যারা আসে তারা সংকোচ, নিঃসঙ্গতা ও উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকে। এ অবস্থায় প্রয়োজন পুরোনোদের সহযোগিতাপূর্ণ দয়ার্দ্র আচরণ। এর পরিবর্তে ঠাট্টা-বিদ্রুপের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা নিঃসন্দেহে নির্দয়তা ও অমানবিকতা। এটা কোনো মুসলমানের কাজ নয়। ইসলামে মুসলমানের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে, তা হচ্ছে- ‘মুসলমান হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যার মুখ ও হাতের ক্ষতি থেকে অন্যান্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বুখারি-১০)। অন্য হাদিসে এরশাদ হয়েছে, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর না জুলুম করতে, না তাকে অসহায় অবস্থায় পরিত্যাগ করতে পারে এবং না তাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে পারে। কোনো লোকের নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছজ্ঞান করবে। প্রত্যেক মুসলমানের জীবন, ধনসম্পদ ও মানসম্মান প্রত্যেক মুসলমানের সম্মানের বস্তু। এর ওপর হস্তক্ষেপ করা হারাম।’ (মুসলিম-৬৭০৬)

মুসলমানকে কষ্ট দিতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অপরাধ না করা সত্ত্বেও যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সূরা আহযাব : ৫৮)

মুমিনকে কষ্ট দিতে নিষেধ করে রাসূল রাসূল সা. বলেন, ‘হে ঐ জামা‘আত! যারা মুখে ইসলাম কবুল করেছ, কিন্তু অন্তরে এখনো ঈমান মযবূত হয়নি। তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দিবে না, তাদের লজ্জা দিবে না এবং তাদের গোপন দোষ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবে না। কেননা যে লোক তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ অনুসন্ধানে নিয়োজিত হবে আল্লাহ তার গোপন দোষ প্রকাশ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তির দোষ আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন তাকে অপমান করে ছাড়বেন, সে তার উটের হাওদার ভিতরে অবস্থান করে থাকলেও।’ (তিরমিজি-২০৩২; মিশকাত-৫০৪৪)

বুলিংয়ের মতো ঘৃণ্য কাজ সাধারণত করা হয় হিংসা-বিদ্বেষ থেকে। অন্যের অগ্রগতিতে পরশ্রীকাতর হয়ে তাকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের কাজ করা হয়। এটি ইসলামের দৃষ্টিতে ঘৃণ্য কাজ। মহানবী সা. এ ধরনের কাজ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত, মহানবী সা. বলেন, ‘তোমরা অবশ্যই হিংসা পরিহার করবে, কারণ আগুন যেভাবে কাঠকে বা ঘাসকে খেয়ে ফেলে, তেমনি হিংসাও মানুষের নেক আমল খেয়ে ফেলে।’ (আবু দাউদ-৪৯০৩)

বুলিংয়ের একটি অস্ত্র হলো অন্যের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া। যেমন : অন্যের নামে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে চ্যাট করে চ্যাট হিস্ট্রির স্ক্রিনশটও বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে সে ব্যক্তিকে মানুষ বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করে। এর জেরে হয়তো তাকে একঘরে হয়ে যেতে হয়। এ ধরনের অপবাদের শিকার সাধারণত নারীরা হয়, ইসলামের দৃষ্টিতে কাউকে অপবাদ দেওয়া জঘন্য অপরাধ। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা সচ্চরিত্রা, সরলমনা-নির্মলচিত্ত, ঈমানদার নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা তো দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।’ (সূরা নূর : ২৩)

অনেকে আবার নিছক তিরষ্কার করার মাধ্যমে মজা করার উদ্দেশে বুলিংয়ের আশ্রয় নেয়, ইসলামের দৃষ্টিতে এটিও গুনাহের কাজ। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, কোনো সম্প্রদায় যেন অপর কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতই না নিকৃষ্ট! আর যারা তাওবা করে না, তারাই তো জালিম।’ (সূরা হুজরাত : ১১)

অনেকে ষড়যন্ত্র করতে বুলিং করে থাকে। পবিত্র কুরআন ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা মন্দকাজের চক্রান্ত করে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি আর ওদের ষড়যন্ত্র তো নস্যাৎ হবে।’ (সূরা ফাতির : ১০)

মানুষকে গালি দেওয়া হলে সে কষ্ট পায়। আর এটা কবীরা গোনাহ। পরকালে এর প্রতিকার হবে নেকী প্রদান বা গোনাহ বহনের মাধ্যমে। তাছাড়া কাউকে গালি দেওয়া গোনাহ। রাসূল সা. বলেন, 

‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসিকী এবং তার সাথে লড়াই করা কুফরী।’ (বুখারি-৪৮)

মুসলমানকে গালি দেওয়া নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত করার শামিল। রাসূল সা. বলেন, ‘মুসলমানকে গালি দেওয়া নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিপতিত করার ন্যায়।’ (ছহীহুত তারগীব-২৭৮০)

গীবত-তোহমতের মাধ্যমেও মানুষকে কষ্ট দেওয়া হয়। গীবত অর্থ দোষচর্চা, পরনিন্দা। আর তোহমত অর্থ মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা। এ দু’টিই পরিবারে ও সমাজে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য দায়ী।

গীবত বা দোষচর্চা থেকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আর একে অপরের পিছনে গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? বস্তুত: তোমরা সেটি অপছন্দ করে থাক।’ (সূরা হুজুরাত : ১২)


র‍্যাগিং-বুলিং প্রতিরোধে আমাদের করণীয় 

১. সমাজ থেকে র‌্যাগিং-বুলিং দূর করতে হলে নৈতিক শিক্ষার প্রচার-প্রসার ঘটাতে হবে। যাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় আছে, কুরআন-হাদিসের জ্ঞান আছে, তারা কখনো র‌্যাগিং-বুলিং করবে না। একমাত্র আল্লাহভীতিই পারে মানুষকে সব অপকর্ম থেকে বিরত রেখে আলোর পথ দেখাতে। তাই র‌্যাগিং-বুলিং বন্ধে যুবসমাজের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তারা যখন নৈতিক শিক্ষা পাবে, তখন সমাজে অপরাধ অনেকাংশেই কমে যাবে। 

২. যেকোনো পরিস্থিতিতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে। তাদের হতে হবে নিরপেক্ষ, নিয়মতান্ত্রিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধির অনুসারী। তাদের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে সিনেট, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল এবং ফ্যাকাল্টির মাধ্যমে। 

৩. সরকার, রাজনৈতিক দল, অভিভাবক এবং সামাজিক সংগঠনকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। 

৪. সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। নইলে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। শিক্ষকদের ছাত্রদের প্রশ্নে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ ও সহযোগী থাকতে হবে। ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক এবং আস্থা ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশের অপরিহার্য উপাদান। 

৫. শিক্ষকদের প্রকাশ্যে রাজনীতি এবং দলাদলি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনোক্রমেই ছাত্রদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। সকল ছাত্রই যেন তাদের অভিভাবক মনে করতে পারে। 

৬. শিক্ষকগণ পাঠদানকালে র‌্যাগিং-বুলিং এর কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করবেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির