শততম শহীদ জোবায়ের আমাদের প্রেরণা
০৯ এপ্রিল ২০১৪
জাহিদ হাসান
শুনতে পাচ্ছ কি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা, শুনতে পাচ্ছ কি বাংলার লক্ষ কোটি যুবকেরা, শুনতে পাচ্ছ কি শহীদের সাথীরা, শুনতে পাচ্ছ কি তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে কেন জীবন দিতে হলো এক মেধাবী ছাত্রকে? আমি শিবিরের শততম শহীদ জোবায়ের ভাইয়ের কথা বলছি। তাকে দেখিনি কোনদিন তবুও তিনি আমার আপন।
তার ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ হয়নি কোনদিন তবু তিনি আমার ভালোবাসার অবলম্বন। তার সাথে কাটেনি কোন প্রহর তারপরও তিনি আমার স্মৃতির মণিকোঠায় সদা বিদ্যমান। একত্রে দ্বীনের কাজ করিনি কোনদিন তবুও তিনি আমার উৎসাহদানকারী। শহীদি মিছিলে তার সাথে স্লোগান দিইনি কোনদিন তবুও তিনি আমার অনুপ্রেরণা। যার শাহাদাতের সংবাদ শুনে ব্যাকুল হয়েছিল আমার হৃদয়, থেমেছিল ভাষা, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল দুই ফোঁটা অশ্রæ।
সেদিন যা ঘটেছিল : ১৫ মে ১৯৯৯ সাল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ছোট্ট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা দুপুরের নীরবতা ভেঙে আক্রমণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বিশ্রামরত শিবিরকর্মীদের ওপর। আক্রমণের পরও তাদের পশুত্ব নিবৃত্ত হয়নি, তারা খুঁজতে থাকে নেতৃবৃন্দকে। আর সেই সময় ক্লাস থেকে হলে একা একা ফিরছিলেন শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অফিস সম্পাদক জোবায়ের ভাই। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত ব্যাংকের কাছ থেকে তুলে নিয়ে যায় প্রিয় ভাই জোবায়েরকে। এই অপরহণ করার ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টরকে জানানো হলেও তারা প্রশাসনের চেয়ারে বসে ছাত্রলীগের কর্মীর ভূমিকা পালন করেন। শহীদের সাথীরা সারা ক্যাম্পাস খুঁজেও পেল না জোবায়েরের চাঁদমাখা মুখ। সময় দ্রæত বয়ে চলছে, দায়িত্বশীলদের হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে, চোখের জল ফেলে দোয়া করছে শহীদের সাথীরা। অতঃপর মাগরিবের আজান, আর ফরেস্ট্রি ছাত্রাবাসের পেছনে একটি গুলির শব্দ। কিছুক্ষণ পর সংবাদ এলো জোবায়ের ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শুরু হলো বাঁধভাঙা কান্না আর শহীদি কাফেলার শহীদদের তালিকায় লেখা হলো একটি নাম ১০০।
শিক্ষাজীবন :
“ছোট থাকব না মোরা চিরদিন
বড় হব নিশ্চয় একদিন।”
বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল শহীদ জোবায়ের ভাইয়ের। আর সেই স্বপ্নের ভিত গড়ে দিলেন জোবায়ের ভাইয়ের মা। তিনি তার আদরের সান্তানদেরকে বলতেন, “তোমরা একটি করে বই পড়বে আর তার বিনিময়ে আমি তোমাদের দশটি করে টাকা দেবো।” মায়ের উদ্দেশ্য ছিল সন্তানেরা টাকার আশায় বেশি করে বই পড়বে আর তার ফলে তাদের জ্ঞানের রাজ্য বিকশিত হবে। সত্যিই জ্ঞানী হয়েছিল শহীদ জোবায়ের। তার শিক্ষাজীবনের দিকে তাকালেই তার সত্যতা পাওয়া যায়। নিজ গ্রামে চৌবাড়িয়া চকদই প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে সব শ্রেণীতে প্রথম হন তিনি। প্রাইমারি ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তিলাভ এবং আনেহলা স্কুলের শিক্ষক মহোদয়গণ তার সুচরিত্র, সত্যবাদিতা, ন্যায়নীতিপরায়ণতা ও মেধাবী ছাত্র হিসেবে তাকে একটি রৌপ্য পদক দিয়ে ভূষিত করেন। এসএসসি এবং এইচএসসিতে লেটার মার্কসসহ ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন।
তাকওয়া : শহীদ জোবায়ের শিশুকাল থেকেই ছিলেন সহজ সরল। আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ছিল অকৃত্রিম বিশ্বাস ও ভালোবাসা। কয়েক বছর আগে জোবায়ের ভাইয়ের বাবার সাথে আমার কথা হয়েছিল। তিনি জোবায়ের ভাই সম্পর্কে বলছিলেন এভাবে, “শৈশবকাল থেকেই একটা সুন্দর অভ্যাস ছিল তার। আমাকে নামাজ পড়তে দেখলেই আমার ডান পাশে দাঁড়িয়ে যেত। আমি একদিন বারান্দায় চৌকির ওপর নামাজ পড়ছি এমন সময় জোবায়ের আমার ডান পাশে দাঁড়াল। আমি যেই জমিনে সিজদায় গিয়েছি, জোবায়েরও আমার সাথে সিজদা দিলো কিন্তু ওর কপালটা চৌকির ওপর না ঠেকার কারণে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল। আমি নামাজ ছেড়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম। কিছুক্ষণ পর জোবায়ের বলল, বাবা! নামাজ শেষ হয়েছে? না, বলে আমি আবার নামাজে দাঁড়ালাম জোবায়েরও আমার সাথে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে বললাম, বাবা জোবায়ের! ব্যথা পেয়েছ? জোবায়ের হাসি দিয়ে বলল, নামাজ পড়তে কি মানুষ ব্যথা পায়?
রমজানের চাঁদ উঠেছে পশ্চিম আকাশে। রমজানের চাঁদ দেখেই যেন ঈদের আনন্দ পাচ্ছে শিশুরা। আমার জোবায়ের দৌড়ে এলো তার মায়ের কাছে। বয়স তখন ৪ বছর। বলল, মা আমি রোজা রাখব। ওর মা কোন উত্তর দিলেন না। আমরা সেহরি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ জোবায়ের উঠে বসে বলল, মা তোমরা ভাত খেয়েছ? আমি বললাম, হ্যাঁ, খেয়েছি। জোবায়ের মন খারাপ করে শুয়ে পড়ল। সকালে তার মা তাকে খাবার দিলে সে খেল না। ওর মা খাওয়ানোর জন্য ওকে ছয়বার গোসল করালো। তবু জোবায়ের খেল না, রোজাও ভাঙলো না।
আমার জোবায়ের কখনো টেলিভিশন দেখতো না। তবে সংবাদ শুনতো। আমরা ঘরের ভেতর সবাই টেলিভিশনে সংবাদ শুনতাম। আর আমার জোবায়ের ঘরের পাটখড়ির বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে খবর শুনত। আমি বলতাম জোবায়ের তুমি সংবাদ দেখ না কেন? সে বলত, বাবা যে মেয়েটি সংবাদ পড়ে তাকে দেখলে আমার চোখের পর্দা নষ্ট হতে পারে। এই হলো আমার জোবায়ের, আমার গর্ব, আমার অহঙ্কার, আমার বিশ্বাস আমার ভালোবাসা। আজ আমাদের গর্বিত পিতা মাস্টার রহমতুল্লাহ আমাদের মাঝে নেই। তিনি গত ১১ অক্টোবর ২০১১ তারিখে বার্ধক্যজনিত কারণে মিরপুরের একটি হাসপাতালে মারা যান। মৃত্যুর সংবাদ শুনে সেখানে ছুটে যান সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মু. মুজিবুর রহমান মন্জু, সাবেক শিক্ষা সম্পাদক আহসান হাবিব ইমরোজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতিবৃন্দসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার সময় মুজিবুর রহমান মন্জু ভাই বলছিলেন, আমি জীবনে অনেক শহীদ ও শহীদের পরিবারের সাথে মিশেছি তবে শহীদ জোবায়েরকে অনেক তাকওয়াবান ও তার পরিবারটিকে আমার কাছে আন্তরিক ও আপন মনে হয়। ঢাকাতে জানাজা নামাজ শেষে তৎকালীন সহকারী অফিস সম্পাদক খ: রুহুল আমিন ও কেন্দ্রীয় কলেজকার্যক্রম সম্পাদক বুলবুল ভাইসহ কফিন নিয়ে টাঙ্গাইলে আসি এবং চৌবাড়িয়ায় শহীদ জোবায়ের ভাইয়ের কবরের পাশে দাফন সম্পন্ন করা হয়। আল্লাহ আমাদের পিতাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন। আমিন।
শাহাদাতের তামান্না : “মরতেই হবে যখন, শহীদি মরণ দিও আমাকে”Ñ এই গানটি জোবায়ের ভাই কখনো গেয়েছিলেন কি না আমি জানি না তবে শুনেছেন অবশ্যই। এই গান যেমন প্রেরণা দেয় শাহাদাতের তেমনি রাসূলের হাদিসও প্রেরণা দেয় আমাদের। হয়তো শহীদ জোবায়ের এই হাদিসটি জানতেন, “রাসূল (সা) বলেছেন, আল্লাহর নিকট শহীদদের জন্য ছয়টি পুরস্কার রয়েছে। সেগুলি হলো : ১. প্রথম রক্তবিন্দু ঝরতেই তাকে মাফ করা হয় ২. তাকে কবরের আজাব থেকে রেহাই দেয়া হয় ৩. সে ভয়ানক আতঙ্ক থেকে নিরাপদ থাকে ৪. তাকে সম্মানের টুপি পরিয়ে দেয়া হবে ৫. তাকে উপহারস্বরূপ আনত-নয়না হুর প্রদান করা হবে ৬. তাকে সত্তরজন আত্মীয়স্বজনের জন্য সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হবে। (তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ)
একদিন ফজরের নামাজের ইমামতি করছেন ছেলে জোবায়ের আর মুক্তাদি হিসেবে আছেন পিতা মাস্টার রহমতুল্লাহ। নামাজ শেষে মুনাজাতরত অবস্থায় কাতরকণ্ঠে জোবায়ের ভাই বলছেন, হে আল্লাহ! আমাকে তুমি শাহাদাতের মৃত্যু দিও। মুক্তাদি হিসেবে কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই বৃদ্ধ পিতা বললেন, আমিন। পিতার আমিন বলার চল্লিশ দিন পর ছেলের শহীদি কফিন উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন বৃদ্ধ পিতা।
জোবায়ের ভাইয়ের আব্বা বলেন, “যে দিন জোবায়ের বাড়ি থেকে শেষবারের মতো যায় তখন আমি বলেছিলাম, জোবায়ের! বাংলাদেশের দূর-দূরান্ত থেকে শিবিরের ছেলেরা এসে লেখাপড়া করে, অনেক সময় ছাত্রলীগের শয়তানরা তোমাদের মেরে ফেলে। ঐ সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত ছেলের পিতা-মাতা কিভাবে খবর পান। সে বলল, বাবা আল্লাহ পাকের রহমতে শিবিরের ভাইয়েরা সমস্ত ব্যবস্থা করে থাকেন। এ পর্যন্ত ৯৯ জন দ্বীনি ভাই শহীদ হয়েছেন। ওর কথা শেষ না হতেই আমি বললাম তুমি কি একশজন পূরণ করতে চাও? এই কথা বলার সাথে সাথে আমার অন্তর কেঁপে উঠল, আমি জোবায়েরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ও মিষ্টি সুরে বলল “আাল্লাহ পাক দয়া করে কবুল করলে।”
সংগঠনের প্রতি শহীদ পরিবারের চাওয়া : শততম শহীদের মা আজ বৃদ্ধ, চলতে গিয়ে কোমরে আঘাত পেয়েছেন। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মেয়ে হুসনে আরার বাসায় থেকে শুধু নামাজ পড়েন আর আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। তিনি বলেছেন, জোবায়ের আমার ত্রিশ বছরের সাধনায় সৎ, সাহসী, উদ্যমী, পরোপকারী ও ভালোবাসার হৃদয়ের অধিকারী একজন প্রকৃত মানুষ হয়েছিল। আজ ৩৭ বছরের টগবগে যুবকের নাম হচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির। এই সংগঠনের নেতাকর্মীরা কি পেরেছে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে? তারা কি পেরেছে শহীদ জোবায়েরের মতো তাকওয়ার অধিকারী হতে? যদি না পারে তবে আমাদের পাওয়া অনেক বাকি। শহীদ জোবায়েরের মতো লক্ষ লক্ষ সন্তানের প্রতি তাকিয়ে আছেন বৃদ্ধ মা কখন তারা এই বাংলার সবুজ জমিনে প্রতিটি গ্রামে নারায়ে তাকবির ¯েøাগান দিবে। তার জিজ্ঞাসাÑ আর কত রক্ত দিলে এদেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হত্যার রাজনীতি বন্ধ হবে, মা হারাবেন না তার সন্তানকে, ভাই তার বোনকে, নিরপরাধ মানুষগুলো জেলখানা থেকে মুক্তি পাবে, সেদিন কবে আসবে? নাকি এই স্বপ্ন দেখে দেখেই শহীদ জোবায়ের ভাইয়ের মাতাও ঘুমিয়ে যাবেন চৌবাড়িয়ার কবরস্থানে যেখানে ঘুমিয়ে আছেন শিবিরের শততম শহীদ জোবায়ের হোসেন।
লেখক : সাবেক জেলা সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
টাঙ্গাইল জেলা শাখা
আপনার মন্তব্য লিখুন