post

শহীদি সম্মেলনে যোগ দিলেন আব্দুল্লাহ আল মঞ্জু

৩০ এপ্রিল ২০১২
এইচ এম জোবায়ের “শহীদেরা আমাদের গৌরব শহীদেরা আমাদের গৌরব শহীদেরা আমাদের বিপ্লবী শপথের ফাগুনের ফুলে রাঙ্গা সৌরভ”। গত ১৩ এপ্রিল ’১২ রোজ শুক্রবার  আব্দুল্লাহ আল মঞ্জু ভাই শাহাদাত বরণ করেন। যা মূলত হক ও বাতিলের চিরস্থায়ী নিয়মেরই প্রতিফলন। আর শাহাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ বাছাই করে নেন কারা ঈমানের দাবিতে সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী। প্রেক্ষাপট ও ঘটনার সারসংক্ষেপ : বিগত ১৩, ১৪ জানুয়ারি ’১২ তারিখে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার পান্টী ঈদগাহ ময়দানে সামাজিক সংগঠন ‘আন নুর’-এর উদ্যোগে একটি তাফসীর মাহফিলের আয়োজন করা হয়। কিন্তু‘ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বাধার মুখে প্রশাসন তা স্থগিত ঘোষণা করে। এই মাহফিলকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে ২টি মামলা করে। প্রথম মামলার আসামি ১৯ জন এবং দ্বিতীয় মামলার আসামি করা হয় ১১ জনকে। ফলে সকল আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পরও তাফসীর মাহফিল আর আলোর মুখ দেখেনি। এখানে বলে রাখা দরকার যে ইউনিয়নে ঘটনাটি ঘটে সেই পান্টী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএনপি সমর্থিত, আর যে ওয়ার্ডে ঘটনাটি ঘটে সেই ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পুরুষ ও মহিলা মেম্বার দু’জনই জামায়াত সমর্থিত। আর বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদ হুসেন জাফর হলেন কুমারখালী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এত বড় ক্ষমতাশীল ব্যক্তি হওয়ার পরও পান্টী তথা কুমারখালীতে দিন দিন জামায়াত-শিবিরের উত্থানকে তিনি ভালো চোখে দেখেননি। এ জন্য তিনি এবং তার বাহিনী মওকা খুঁজছিলেন জামায়াত-শিবিরকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য। গত ৯ এপ্রিল ‘আন নূর’ উদ্যোগে একটি কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এতে একটি প্রশ্ন ছিল ‘কততম তাফসীর মাহফিল বন্ধ করে দেয়া হয়’? মূলত এই প্রশ্ন দেখে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বলেন যে এর মাধ্যমে তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা কুইজ প্রতিযোগিতা ও প্রশ্নপত্র বিলি বন্ধ করার কথা বলেন। তারা বলেন, কুইজ প্রতিযোগিতায় এই প্রশ্ন দিয়ে জামায়াত-শিবির তাফসীর মাহফিল বন্ধ করাটাকে একটা দলিল হিসেবে রেখে দিতে চাচ্ছে। তারা কূটকৌশলে মেতে ওঠে। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা গোপন মিটিং করে ও সংগঠিত হয়। ১২ এপ্রিল তারিখে ‘আন নূর’-এর সভাপতি ও জেলা ছাত্রশিবিরের দফতর সম্পাদক বনি আমিনের ছোট ভাই নাজমুল, বড় ভাই শিবলী নোমান ও বাবা আব্দুল মা’বুদের ওপর আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন ও আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে ১৫-২০ জন অতর্কিত হামলা চালায়। এবং শিবলী নোমান (জামায়াত সমর্থিত মহিলা মেম্বার নূর বানুর স্বামী)-কে ধরে নিয়ে যায়। এতে এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার সমস্ত মানুষ স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক গ্রুপে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের চিহ্নিত ব্যক্তিরা, অন্য দিকে জামায়াত-বিএনপিসহ এলাকাবাসী। শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। পুলিশের ভূমিকা উপস্থিত সবাইকে বিস্মিত করে। আমাদের বেশ কিছু আহত হওয়ার পরও পুলিশ উল্টো আমাদের ভাইদের সাময়িকভাবে আটকে রাখে ও পরবর্তী যে কোন ঘটনার জন্য আমাদের দায়ী করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। ইতঃপূর্বে, অন্যায়ভাবে তাফসীর মাহফিল বন্ধ এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে উত্তেজিত হয়ে আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপ আবুল হুসেন, হাছেন ও মোহসিন (যারা জন্মগত আওয়ামী লীগ) -এর নেতৃত্বে জামায়াতে যোগ দেয়ার কথা ঘোষণা করে। এতে আ’লীগের অপর গ্রুপ আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং জামায়াত-শিবিরের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার ফন্দি আঁটে। ১৩ এপ্রিল সকালে ফজরের নামাজের পর মিনারুল নামে একজন বিএনপি কর্মী পান্টী বাজারে যাওয়ার পথে রুহুল আমীন ও আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন অতর্কিত হামলা করে ও মাথা ফাটিয়ে দেয়। পরে তারা জামায়াত কর্মী ইউসুফ আলীকে আহত ও রক্তাক্ত করে। পুলিশের সহায়তায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা ব্যাপক আক্রমণ চালায়। জামায়াত-বিএনপিও আত্মরক্ষামূলক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সকাল থেকেই শুরু হয় দফায় দফায় সংঘর্ষ। একটি গ্রুপ শিবিরকর্মী আব্দুল্লাহ আল মঞ্জুর ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে তার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। মঞ্জু ভাই ফজরের নামাজ মসজিদে পড়ে, কুরআন পাঠ করে বিশ্রাম নেন। ঐ সময় দাঁত ব্রাশ করতে করতে বাড়ির বাইরে আসেন। পেছন হতে কয়েক হাত দূর থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে  ধারালো ফালা নিক্ষেপ করা হয়। ফালাটি পেছন থেকে তাঁর ডান কাঁধের একটু নিচ দিয়ে ঢুকে ডান বুকের একটু ওপর দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ফালা নিক্ষেপকারী হলো আওয়ামী লীগ কর্মী বাদশাহর ছেলে ফারুক ও রুবেল। মঞ্জু ভাই নিজ হাতে টান দিয়ে সেটা খুলে ফেলেন এবং তাৎক্ষণিক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। জবাই করা প্রাণীর মতো রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হতে থাকে। তখন সময় আনুমানিক সকাল সাড়ে ৮টা। ৪৫ মিনিটের মধ্যে মাইক্রোযোগে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে আনা হয়। আনার পর সাড়ে ৯টার দিকে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অর্থাৎ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তিনি রাস্তায়ই শাহাদাত বরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। শহর সভাপতি মুজাহিদ ভাই ও জেলা সভাপতি ইসরাঈল ভাইয়ের তদারকিতে শহীদের লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে তার নিজ গ্রামে পাঠানো হয়। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য : শহীদের কফিন বাড়িতে পৌঁছার সাথে সাথে এক অবর্ণনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। আগে থেকেই শহীদের লাশ দেখার জন্য হাজারো জনতার বাঁধভাঙা ঢল নামে একমাত্র পুত্রসন্তানকে হারিয়ে বাবা-মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। শরীরের রক্ত পানি করে তিল তিল করে বড় করা সন্তানের লাশ আজ চোখের সামনে। এটা কিভাবে বিশ্বাস করা যায়! অকাল মৃত্যু বলে যদিও কিছু নাই। মৃত্যুর জন্য নির্ধারিত সময় ঠিক করা আছে। কেউ তার আগে বা পরে মরবে না। (আল ইমরান- ১৪৫)। গর্ভধারিণী মায়ের আহাজারিতে খোদার আরশ কেঁপে উঠছিল। শহীদের সাথীরা বাকরুদ্ধ। ষাটোর্ধ্ব এক মুরুব্বি বলছিলেন, ‘‘আজ সকালে মঞ্জু আমার সাথে ফজরের নামাজ মসজিদে জামায়াতে আদায় করেছে আর জোহরের নামাজের আগেই সে লাশ হয়ে আমাদের সামনে এসেছে, এটা কিভাবে মেনে নেয়া যায়! পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি মাসুম ছেলেকে যারা খুন করলো আল্লাহ তুমি তাদের বিচার করো।’’ শাহাদাত ও তাৎক্ষণিক কর্মসূচি মুহতারাম কেন্দ্রীয় সভাপতি শুরু থেকেই ‘টাইম টু টাইম’ খবর রাখছিলেন ও নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। ঘটনাক্রমে আমি সেই দিনই নিয়মিত সফরের জন্য ঢাকা থেকে রাতের গাড়িতে সকাল ৬টায় কুষ্টিয়া পৌঁছাই। সকাল ৯টায় ইবিতে এসএসসি ও দাখিল ফলপ্রার্থী টিসিতে আলোচনা রেখে মোটরসাইকেলযোগে চুয়াডাঙ্গা রওনা হই। চুয়াডাঙ্গাতে ১২টায় কর্মী টিসিতে আলোচনা। ১২টা ৯ মিনিটে কেন্দ্রীয় বায়তুলমাল সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ভাই প্রথমে ফোন করে শাহাদাতের খবর জানান। তিনি জানতে পারেন কেন্দ্রীয় সহকারী বায়তুলমাল সম্পাদক চপল ভাইয়ের কাছ থেকে। চপল ভাইয়ের বাড়ি কুমারখালীর পান্টীতে। এর কিছুক্ষণ পরেই ফোন করেন সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি স্থানীয় ও জেলা জামায়াত-শিবিরের কাছ থেকে সার্বিক খোঁজ-খবর নিয়ে মঞ্জু ভাইয়ের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সভাপতিকে জানাতে বলেন। আমি জেলা ও থানা জামায়াত-শিবিরের ভাইদের কাছ থেকে সার্বিক খবরাদি নিয়ে বাদ জুম’আ মুহতারাম  কেন্দ্রীয় সভাপতিকে জানালে তিনি  ঢাকায় অবস্থানরত সেক্রেটারিয়েট ভাইদের নিয়ে বসে ৪টার দিকে শাহাদাতের ঘোষণা দেন। এর আগেই আমাকে চুয়াডাঙ্গার টিসি ও অন্যান্য কার্যক্রম রেখে কুষ্টিয়ায় রওনা দেয়ার নির্দেশ দেন। আমি কুষ্টিয়া পৌঁছে জামায়াত পৌর অফিসে গিয়ে দেখি সেখানে আগে থেকেই জামায়াত ও শিবিরের নেতৃবৃন্দ বসে আছেন। অন্যদিকে পান্টীতে মাইকিং করে বাদ মাগরিব জানাজার ঘোষণা দেয়া হয়। আমি জানাজা আরো দুই ঘণ্টা পেছানোর পরামর্শ দিলে জেলা আমীর ‘ডিউ টাইমে’ পড়ার ব্যাপারেই মত দেন। ফলে আমাদের হাতে সময় একদমই কমে যায়। আমি আর ইবি সভাপতি মনোয়ার ভাই সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিই। অল্প সময়ের নোটিশে ৩৫ জনের মত ‘প্রিন্ট’ ও ‘ইলেকট্রনিক’ মিডিয়ার সাংবাদিক উপস্থিত হন। সাংবাদিকদের সাথে সাথে পুলিশও আসে। পুলিশ ও ডিবি সংবাদ সম্মেলনের জন্য নির্ধারিত স্থান জেলা জামায়াতের ইয়াতিমখানার অফিস ঘিরে ফেলে এবং ৮ জন জামায়াত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আমরা সংবাদ সম্মেলন করতে না পেরে সাংবাদিকদেরকে লিখিত বক্তব্য সরবরাহ করি। জেলা সভাপতি ইসরাঈল হুসেন ভাইয়ের সাথে ইবি সভাপতিসহ পান্টীতে জানাজা ধরতে ‘মোটর বাইকে’ রওনা দেই। জানাজা ও কাফন-দাফন : সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর আমরা পন্টী হাই স্কুল মাঠে জানাজা নামাজে স্থানে পোঁছাই। সন্ধ্যা হয়েছে প্রায় ১ ঘণ্টা। এই অন্ধকার ভেদ করে হাজারো জনতা জানাজায় হাজির হয়েছেন। অবিশ্বাস্য, লোকে লোকারণ্য শহীদেরই স্মৃতিবিজড়িত স্কুল মাঠ। যে মাঠে তিনি খেলতেন আজ সে মাঠেই তার জানাজার নামাজ! জেলা আমীর ও প্রাক্তন এমপি আব্দুল ওয়াহিদ বক্তৃতা করছিলেন। তার পর শহীদের গর্বিত পিতা, তারপর আমি বক্তব্য রাখলাম। আসলে বাগানের মালিক (আল্লাহ) তো বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ও সুগন্ধি ফুলটিই নিজের জন্য বাছাই করে থাকেন। পরদিন কুমারখালী থানায় অর্ধদিবস হরতালের ঘোষণা করা হলো। নিজ হাতে লাশ কবরে নামিয়ে, মাটি দিয়ে ‘গাফুরুর রাহিম’ রবকে বললাম, “হে মজলুমের ফরিয়াদ শ্রবণকারী আল্লাহ, আজ ফজরের নামাজ পর্যন্ত এই ভাইয়ের প্রতি তাঁর বাবা-মা, এলাকাবাসী ও সংগঠনের ভাইগণ খুশি ছিলেন তুমিও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও”। লেখক : কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির