post

শহীদ আসগার আলী লিমন আমাদের প্রেরণা

আব্দুর রাকিব

০৫ এপ্রিল ২০২৩

এ ক ন জ রে

শহীদের নাম : আসগার আলী (লিমন)

পিতা : মো. লোকমান মিয়া 

মাতা : মোসা. আকলিমা বেগম 

ঠিকানা : উপর রাজারামপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

জন্মতারিখ : ৭ জুলাই ১৯৯৯ইং

শাহাদাত : ৪ এপ্রিল ২০১৩ 

ভাই-বোন : এক বোন ও এক ভাই, তিনি ছোট। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : হামিদুল্লাহ উচ্চবিদ্যালয়

শ্রেণি : ৭ম 

সাংগঠনিক মান : কর্মী 

শাহাদাত ক্রম : ১৬৮তম


“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।” (সূরা বাকারা : ১৫৪)। শহীদ আসগার আলী লিমন ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের অকুতোভয় একজন সৈনিক। ২০১৩ সালে তিনি ছিলেন মায়াজ-মুয়াজের ভূমিকায়। সারাদেশ যখন জালিম সরকারের জুলুম নির্যাতনে ছেয়ে গেছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো জেলায় ঘটছে গুম-খুনের ঘটনা। বিশ্ববরেণ্য আলেমসহ অসংখ্য ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জেলখানায় বন্দি রেখে চলছে নির্যাতনের স্টিমরোলার। থমথমে এই পরিবেশে শহীদের পুণ্যভূমি চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবিরত আন্দোলন চলছে তখন। জালিম শাসকের বিরুদ্ধে রাজপথে মিছিল ও প্রতিবাদসভা হচ্ছে প্রতিদিন। এই প্রতিবাদী মিছিলের অন্যতম রাহবার হয়ে আল্লাহর কাছে চলে গেলেন শহীদ লিমন। 


শাহাদাত কোনো বাধা মানে না 

তখন সারাদেশের জনগণ আলেম নির্যাতন ও সরকারের চতুর্মুখী জুলুমের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে। চলমান এইসব বিক্ষোভ মিছিলে নিয়মিত শামিল হতেন প্রবাসী বাবার একমাত্র ছেলে শহীদ আসগার আলী লিমন। তাঁর দেখাশুনা করার একমাত্র দায়িত্ব পালন করতেন মা আকলিমা বেগম। প্রতিদিন মানুষ যেভাবে গুম-খুন হচ্ছে, যদি তার সন্তানের কিছু হয়ে যায় তাহলে স্বামীর কাছে কি জবাব দিবে, এই ভাবনায় মা তার সন্তানকে মিছিলে যেতে বাধা দিত। কিন্তু কোনো বাধাই তাকে মিছিলে অংশগ্রহণ থেকে দূরে রাখতে পারতো না। এই জন্য শাহাদাতের দুই দিন আগে তার মা তাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে খাটের সাথে হাত বেঁধে রেখেছিলেন। তারপরও শহীদ লিমন তার হাতের বাঁধন খুলে মিছিলে গিয়েছিল।

শাহাদাতের দিন তার মা অস্থির মন নিয়ে তাকে বাড়ির ভিতর রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে চাবি নিজের কাছে রাখেন। কিন্তু শাহাদাতের বাসনা যে লিমনকে ব্যাকুল করে তোলে। সে চিন্তা করে যে কোনো মূল্যে মিছিলে অংশগ্রহণ করতে হবে। সেই জন্য তিনি সিঁড়ি ঘরে যান, দেখেন সেখানেও তালা দেওয়া। তার মাথায় চিন্তা আসে এই তালার চাবি মায়ের কাছে থাকে না, বাসায় কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়। তিনি খুঁজতে শুরু করেন, খুঁজতে খুঁজতে তিনি চালের ড্রামের ভিতর চাবি পেয়ে যান। সেই চাবি দিয়ে সিঁড়ির গেট খুলে ছাদে যান, সেখান থেকে আমের গাছ বেয়ে নিচে নেমে আসেন। তারপর মাকে বলে মা চললাম ইসলামী আন্দোলনের মিছিলে। মা শুধু অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে থাকলেন। কে জানতো এটাই তার শেষ চলে যাওয়া। 


শাহাদাতের ঘটনাক্রম 

দিনটি ছিল ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৩ রোজ বুধবার, প্রতিদিনের মতো সেই দিনের সকালটা মিষ্টি ছিল না, কারণ তৎকালীন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী মহানগর অফিস সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম মাসুম ভাইয়ের গুমের খবর আসে। মাসুম ভাইকে গুমের প্রতিবাদে অর্ধবেলা হরতাল আহ্বান করা হয়। সেই জন্য সকলেই ফজর নামাজ পড়েই রাস্তায় নামার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। চাঁপাইনবাবঞ্জ শহরের তিন জায়গায় মিছিল ও প্রতিবাদসভা করার সিদ্ধান্ত হয়। তার মধ্যে একটি জায়গা ছিল উপর রাজারামপুর মোড়, যে জায়গাটি শহীদ আসগার আলী লিমনের বাসার সামনে। সেই দিন দলমত নির্বিশেষে সবাই রাস্তায় নেমে আসে। আপামর জনতার সাথে আসগর আলী লিমনও সেই দিন মায়ের সকল বাধা উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে আসে। সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে সাথে নিয়ে হরতাল কর্মসূচি যখন সফলভাবে চলছিল ঠিক তখনই সকাল ১১টার দিকে রাজশাহী থেকে আসা র‌্যাবের গাড়ি তৌহিদী জনতার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমেই র‌্যাব জনতার উপর গুলি করা শুরু করে। সবাই যে যার মতো ইট-পাটকেল ছুড়ে গুলির মোকাবিলা করতে থাকে। তৌহিদী জনতার শক্ত প্রতিরোধে কিছু সময় পর র‌্যাব পিছু হটে এবং গাড়িতে করে চলে যায়। চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবি মিলে যৌথভাবে জনতার উপর হামলা চালায়। টিয়ারগ্যাস, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট এর সাথে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। তিন বাহিনীর যৌথ হামলার মোকাবিলা করে ময়দানে টিকে থাকে, অসংখ্য ভাই আহত হওয়ার খবর আসতে থাকে। এক পর্যায়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আসগার আলী (লিমন) গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আন্দোলোনের সাথীরা তার দ্রুত চিকিৎসার জন্য মেডিকেলে নেওয়ার জন্য চেষ্টা চালায়, কিন্তু সব জায়গায় পুলিশের তৎপরতা থাকায় সবাই চিন্তায় পড়ে যায়। তবুও মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তানকে মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা তো করতে হবে। তৎকালীন শহর সভাপতি শফিক এনায়েতুল্লাহ ভাইয়ের পরামর্শে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। হেলাল ভাই মোটরসাইকেল ড্রাইভ করে ও হাফিজুর ভাই লিমনকে কোলে নিয়ে মোটরসাইকেলে বসে ক্লিনিকের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। সোজা ক্লিনিকের অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন থাকায় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে দ্রুত রাজশাহী মেডিকেল নিয়ে যেতে বলে। অনেক কষ্ট করে অ্যাম্বুলেন্স-এর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স আসার পূর্বেই র‌্যাবের গাড়ি এসে হাজির হয়। র‌্যাব পুরো ক্লিনিক ঘিরে ফেলে। তারা তার চিকিৎসায় বাধা প্রদান করে। এক পর্যায়ে দীর্ঘসময় পর র‌্যাব চলে গেলে আসগার আলী লিমনকে নিয়ে যাওয়া হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে আমাদের কাঁদিয়ে আল্লাহ তার এই প্রিয় ছোট্ট বান্দাকে তাঁর সান্নিধ্যে নিয়ে নিয়েছেন। 


শহীদের গর্বিত পিতার অভিব্যক্তি     

শহীদ আসগার আলী লিমন ছিল আমার একমাত্র ছেলে সন্তান। সে যখন শহীদ হয় তখন আমি দেশের বাইরে ছিলাম। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে আমার বুকে যে ঝড় বইছে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের দেখলে সেই ঝড় যেন মন থেকে মুছে যায়। আমার ছেলে শহীদ হয়েছে এতে আমার কোনো দুঃখ নাই। আমার ছেলেকে নিয়ে আল্লাহ যদি এই দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এতেই আমার সন্তুষ্টি। আর যারা আমার ছেলেকে শহীদ করেছে এর বিচার আমি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম। তোমরা যারা এই আন্দোলনের পথ পেয়েছো, কখনো ধৈর্য হারা হইও না। দেখবে তোমাদের এই প্রচেষ্টার কারণে আল্লাহ তার দ্বীনকে বিজয়ী করবেন, ইনশাআল্লাহ।   


শহীদের মায়ের অভিব্যক্তি     

লিমন ছিল আমার দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে ছোট ছেলে। সে ছিল খুবই চঞ্চল। সে কখনই কোনো কাজ করব না বলত না। যখনই যে কাজ আমি দিতাম বা সংগঠনের কোনো কাজ থাকলে তাৎক্ষণিক করে নিত। তার বাবা দেশের বাইরে অবস্থান করার কারণে আমাকেই তার খোঁজখবর রাখতে হতো। এই জন্য আমি দেশের পরিস্থিতি দেখে মিছিলে যেতে বাধা দিতাম, সে কোনো বাধাই শুনতো না। তাকে বেঁধে রেখে বা দরজা বন্ধ করে দিয়েও থামাতে পারতাম না। যে কোনো মূল্যেই সে মিছিল মিটিংয়ে চলে যেত। সে শহীদ হয়েছে এতে আমার কোনো আফসোস নেই। এক ছেলের পরিবর্তে আমি শত শত ছেলে পেয়েছি। তোমরা আসলে আমি তোমাদের মাঝে আমার লিমনকে খুঁজে পাই। তার শাহাদাতের পর থেকেই আমরা ইসলামী আন্দোলন আরো বুঝতে শিখি। তার শাহাদাতই আমাকে ইসলামী আন্দোলন করতে অনুপ্রেরণা দেয়। আসগার আলী লিমন শহীদ হওয়ার পর থেকেই আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা চলছে। তোমরা আমার জন্য দোয়া করবে, আমি যেন ধৈর্য ধারণ করে থাকতে পারি। আর আল্লাহ যেন আমার আসগার আলী লিমনকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন। (আমিন)


তোমরা আল্লাহর রঙ ধারণ করো! আর কার রঙ তার চেয়ে ভালো? তোমরা তো তাঁরই ইবাদতকারী। (সূরা বাকারা : ১৩৮)। আল্লাহ তার দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য যুগে যুগে মর্দে মুজাহিদদের মধ্য থেকে প্রিয়ভাজনদের বেছে তার সান্নিধ্যে নিয়ে যান। বাংলাদেশের জমিনে ইসলামের পতাকাবাহী এই কাফেলার শহীদ আসগার আলী (লিমন) সহ অসংখ্য মুজাহিদ শাহাদাতের অমিয় শুধা পান করেছে। নাম না জানা অসংখ্য ছাত্র গুম অবস্থায় আছে। শত শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে হলেও একদিন এদেশে ইসলামের রাজ কায়েম হবে, ইনশাআল্লাহ। 


লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী ল কলেজ

আপনার মন্তব্য লিখুন

tamim

- 1 year ago

Mashallah

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির