শহীদ খলিল অনন্য গুণের অধিকারী
মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন
০৫ জুলাই ২০১৫
২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট শহীদ খলিলের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার পথ। আওয়ামী পুলিশ সেদিন প্রকাশ্যে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে প্রিয় খলিল ভাইকে হত্যা করেছে। ঘটনাটি হলো আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস থাকার কারণে জালিম এ সরকার আদালতের ঘাড়ের ওপর বন্দুক রেখে গণমানুষের সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে। এ রায়ে সারা দেশে ইসলামপ্রিয় মানুষ মর্মাহত হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। এক দিকে চলছিল রমজান মাস, অন্য দিকে ৯ আগস্ট ২০১৩ ছিল ঈদুল ফিতর। তাই সব কিছু বিবেচনা করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ১৩ ও ১৪ আগস্ট হরতাল ঘোষণা করে। শান্তিপূর্ণভাবে দেশের তৌহিদী জনতা তাদের প্রতিবাদ জানানোর মাধ্যমে হরতাল পালন করে।
১৪ আগস্ট সকাল ৭টায় ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ হরতালের সমর্থনে তৎকালীন শাখা সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি মিছিল দনিয়া এ কে স্কুলের সামনে থেকে শুরু করলে শান্তিপূর্ণ এ মিছিলে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বিতর্কিত যাত্রাবাড়ী থানার অতি উৎসাহী পুলিশ অফিসার অবনি শঙ্কর কর ও প্রদীপ কুমার দ্বীপের নেতৃত্বে মিছিলকারী ভাইদের ওপর গুলিবর্ষণ করলে খলিলুর রহমান মল্লিক ভাইসহ বেশ কয়েকজন ভাই গুলিবিদ্ধ হন। মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় খলিলুর রহমান মল্লিক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলিবিদ্ধ খলিলুর রহমানের ওপর পুলিশ গাড়িচাপা দিলে আমাদের প্রিয় খলিলুর রহমান মল্লিক শাহাদত বরণ করেন।
পরবর্তীতে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে। লাশ নিয়ে চলে ইতিহাসের ন্যক্কারজনক রাজনীতি। শত চেষ্টা করেও ঢাকায় অনুমতি পাওয়া যায়নি জানাজার। শেষবারের মতো তাদের প্রিয় সাথীকে একটিবারের জন্য দেখতে পারেনি শহীদের শোকাহত সাথীরা। গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানার করমজা মল্লিক পাড়ায় জড়ো হয় হাজার হাজার তৌহিদী জনতা। দলমত নির্বিশেষে হাজারো গ্রামবাসীর অংশগ্রহণে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।
শহীদ খলিল অনন্য গুণের অধিকারী ছিলেন। শহীদ খলিলুর রহমান মল্লিক দাওয়াতি কাজে ছিলেন খুবই পেরেশান। এতো পেরেশান ছিলেন যে, তার ওপরের ক্লাসের ছাত্রদের দাওয়াত দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত করে নিতেন। তাই প্রায়ই কেন্দ্র ঘোষিত দাওয়াতি দশক কিংবা দাওয়াতি পক্ষে বেশ কয়েকবার সর্বোচ্চ সংখ্যক সমর্থক বৃদ্ধি করে পুরস্কৃৃত হয়েছেন। খলিল ভাইয়ের চিন্তাভাবনা ছিল সুদূরপ্রসারী ও উন্নত। তিনি এলাকার নিরীহ ছাত্রদের মাঝে শিক্ষার আলো ও দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর লক্ষ্যে নিজ প্রচেষ্টায় ও নিজ অর্থায়নে সপ্তম শ্রেণীতে থাকতেই বাড়ির পাশে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুলের পরিচালক তিনি নিজেই ছিলেন। নিজের খরচের টাকা থেকে শিক্ষকদের বেতন দেন। প্রয়োজনে টাকা পয়সা ধারও করতেন।
সর্বদা হস্যোজ্জ্বল ও মায়াবী চেহারার অধিকারী ছিলেন খলিল। স্বাস্থ্যগত দিক থেকে খুব সমৃদ্ধ ছিল না কিন্তু মানসিক দৃঢ়তা ছিলো অত্যন্ত মজবুত। সদালাপী ও সাদাসিধে জীবনাচারে অভ্যস্ত খলিলকে আমি কখনো বিলাসপূর্ণ, জৌলুস জীবন যাপন করতে দেখিনি। সাদা পোশাক ছিল তার নিয়মিত পরিচ্ছদের অংশ। অর্থনৈতিক ভাবে তেমন দুর্বল ছিল না, কিন্তু ব্যয়ে অতিরঞ্জন আমার চোখে পড়েনি।
মানুষকে আপন করে নেয়ার অস্বাভাবিক যোগ্যতাপূর্ণ ব্যক্তি আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। দ্বীনি ভাইকে হৃদয় দিয়ে সহযোগিতা করা ছিল তার প্রকৃতিগত গুণ। খলিল তার হৃদয়াবেগ মিশ্রিত ব্যবহার দিয়ে শুধু আন্দোলনের ভাইদের নয় বরং শিক্ষকমন্ডলী, সুধীমন্ডলী, বাবা-মা ও এলাকাবাসীর মন জয় করে নিয়েছিলেন খুবই সহজে। তার বিচক্ষণতার জন্যে যে কেউ তার ভালোবাসার সাগরে খুব সহজে হারিয়ে যেত।
খলিল ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার এলাকাবাসীর বক্তব্য থেকে এর বাস্তব রূপ অনুধাবন করা গেছে খুব সহজেই। লেনদেন ছিল খুবই স্বচ্ছ, নিজে না খেয়ে অপর ভাইয়ের সহযোগিতা করা ছিল খলিল ভাইয়ের সহজাত।
শহীদের সাথী হিসেবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন জান্নাতে আমাদের একসাথে থাকার সুযোগ করে দেন। আমিন।
একনজরে শহীদ খলিলুর রহমান মল্লিক
নাম : খলিলুর রহমান মল্লিক
পিতা : আব্দুল বাতেন মল্লিক
মাতা : জমেলা বেগম
জন্ম : ১ জানুয়ারি ১৯৯৬, পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার করমজা মল্লিক পাড়া গ্রামে
ভাইবোন : ৪ ভাই ১ বোন, সবার মধ্যে দ্বিতীয়
লেখাপড়া : ফাজিল প্রথম বর্ষ, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা ও অনার্স প্রথম বর্ষ ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
সাংগঠনিক মান : সদস্য
সর্বশেষ দায়িত্ব : শ্যামপুর থানার অফিস সম্পাদক ও ৮৮ নম্বর উত্তর ওয়ার্ডের সভাপতি
শাহাদতের তারিখ : ১৪ আগস্ট ২০১৩ সকাল ৭টায়
শাহাদতের স্থান : যাত্রাবাড়ীর দনিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় (পুলিশের গুলিতে)
শখ : সর্বদা অন্যের উপকার করা ও সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ
প্রিয় মানুষ : মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:
লেখক : শহীদ খলিলের তৎকালীন থানা সভাপতি, পরিকল্পনা ও উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ
আপনার মন্তব্য লিখুন