post

শহীদ গোলাম ফারুক : একটি ইতিহাস এম. এ. আহাদ

০১ জুলাই ২০২০

আল্লাহর এই জমিনে সকল প্রকার জুলুম নির্যাতনের মূলোচ্ছেদ করে আল কুরআন ও আল হাদিসের আলোকে এক সোনালি সমাজ গড়ার দীপ্ত প্রত্যয় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। আমাদের লক্ষ্য মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কুরআন প্রচারের মধ্যে দিয়ে পথহারা ছাত্র-জনতাকে সঠিক পথের দিশা দেওয়া। আমাদের স্বপ্ন ছিল একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়বার। আমরা এমন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখি যে সমাজের মধ্যে থাকবে না কোন অশান্তি; থাকবে না কোন দুঃখ দুর্দশা। যে সমাজে থাকবে না কোনো বৈষম্য থাকবে না কোনো অন্যায় অবিচার। বরং সেই সমাজের মধ্যে থাকবে শান্তি, সুখ, সমৃদ্ধি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সৌহার্দ্য ও নিরাপত্তা। যে সমাজে ইসলাম অনুসারে পরিচালনা ব্যবস্থা এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েম থাকবে। এ সোনালি সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিপালকের সুমহান বাণী ছাত্রসমাজের মাঝে পৌঁছিয়ে দিতে অসংখ্য বার বাতিলের হাজারো বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমাদের অসংখ্য ভাইকে হাত, পা, চোখ হারাতে হয়েছে এবং জেল, জুলুম, অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে অনেক জনশক্তিকে। গুমও হয়েছেন অনেক ভাই। শহীদ হয়েছেন ২৩৪ জন ভাই। এদের মধ্যে ৪১তম শহীদ আমাদের গোলাম ফারুক ভাই। এসকল ভাই কি আসলেই মৃত্যুবরণ করেছেন? আল্লাহ বলেছেন-“আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তোমরা তাদেরকে মৃত বলো না এসব লোক প্রকৃতপক্ষে জীবিত, কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।” (সূরা বাকারা : ১১৪) বাল্যকাল ও পড়াশুনা বাল্যকাল থেকেই শহীদ গোলাম ফারুক ছিলেন সৎ, সাহসী ও পরোপকারী। ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। প্রাথমিক ও এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাস করেছেন নিজগ্রামের সেন্ট আলফ্রেড উচ্চবিদ্যালয় থেকে। তৎকালীন সময়ের স্টার মার্কস (৭২৫ মার্ক) পেয়েছেন এবং বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে যথারীতি স্টার মার্কস (৭৪৫ মার্কস) পেয়ে কৃতিত্বের সাথে পাস করেন ১৯৮৯ সালে। এইচএসসি.পরীক্ষার পরেই তিনি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমান রাজধানী শহর ঢাকায়। পারিবারিকভাবে আর্থিক সঙ্কট থাকায় টিউশনি করে নিজের পড়াশোনাসহ অন্যান্য খরচ জোগান দেন। শহীদ গোলাম ফারুকের ইচ্ছা শহীদ গোলাম ফারুক ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল বড় ডাক্তার হবেন। নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং দেশের অসহায় দরিদ্রের ফ্রি চিকিৎসা করবেন। ভর্তি পরীক্ষায় তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল উভয় জায়গায়ই চান্স পান। তবে ছোট বেলার সেই লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপদানের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি না হয়ে ভর্তি হন বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে। ইসলামী আন্দোলন ও শহীদ গোলাম ফারুক মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর পরই তিনি ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় হন। পড়াশুনার পাশাপাশি দ্বীনি আন্দোলনের কাজকে প্রধান কাজ মনে করেন। পথহারা ছাত্র-যুবকের দ্বারে দ্বারে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করে একটি সোনালি সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন। তার শাহাদাতের কথা স্মরণ করে তৎকালীন মহানগরীর সভাপতি ও বর্তমান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বরিশাল জেলা পূর্ব শাখার মুহতারাম আমির অধ্যাপক আব্দুল জব্বার ভাই বলেন- ‘শহীদ গোলাম ফারুক ভাই ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের জন্য এক নিবেদিতপ্রাণ। ইসলামী আন্দোলনের কাজকে তিনি অন্য সকল কাজ থেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন এবং আন্তরিকতার সাথে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের আঞ্জাম দিতেন। বাতিলের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মেডিক্যালের সাধারণ ছাত্র এবং ব্যাচমেটদের মাঝে দাওয়াতি কাজ করতেন। ইসলামের জন্য তার এ কর্মতৎপরতা দেখে বাতিলশক্তি তথা আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তা সহ্য করতে না পেরে বেছে নেয় তাকে হত্যার পথ। আর আমরা হারালাম সদা হাস্যোজ্জ্বল, দ্বীনের জন্য পাগলপারা এক তাজা প্রাণ। কিন্তু বাতিলরা জানতো না এক গোলাম ফারুককে শহীদ করে ইসলামী আন্দোলনের কাজকে স্তব্ধ করা যায় না বরং শহীদের রক্তে এ ময়দান আরও উর্বর হয়। আর এটাই ইসলামী আন্দোলনের মূল শক্তি। যেমনটা আল্লাহ বলেছেন, “এরা তাদের মুখের ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। আর আল্লাহর এটাই ফায়সালা যে, কাফিররা যতই অপছন্দ করুক, তিনি তার নূরকে পূর্ণরূপে প্রকাশ করবেনই।” (সূরা সফ : ৮) ছেলে সম্পর্কে মায়ের মন্তব্য ¯েœহ আর সবচেয়ে ভালোবাসার প্রিয় ধন গোলাম ফারুকের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তার জন্মদাতা মা বারবারই মূর্ছা যান আর বলেন, পরিবারের ৫ সন্তানের মধ্যে গোলাম ফারুকই ছিল আমাদের আশা ভরসার প্রতীক। তাকে ঘিরেই আমরা স্বপ্ন দেখতাম। পরিবারে অন্যান্যদের সবার মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে মেধাবী। আমাদের স্বপ্ন ছিল শহীদ গোলাম ফারুক বড় ডাক্তার হয়ে পরিবারের ও গ্রামের মানুষের সেবা করবে। আল্লাহর অশেষ রহমতে মেডিক্যালে চান্স পেয়ে ভর্তিও হয়েছিল। তবে আল্লাহ আমাদের আশা পূরণ করেননি। বুকটা খালি করে আল্লাহ সন্তানকে নিয়ে গেলেন। সে অনেক ধার্মিক ছিল। ছোটবেলা থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, তাফসির পড়তো, সত্য কথা বলতো এবং সবার সাথে মিলে মিশে থাকতো। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ১৭ জুলাই ১৯৯১ সাল। প্রতিদিনের মতোই নতুন আভা নিয়ে সূর্য তার দীপ্তি ছড়িয়ে আঁধারকে আলোকিত করে বয়ে আনে এক শুভ সকাল। নতুন প্রথমবর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে। কলেজ ক্যাম্পাস নবীনদের পদচারণায় মুখরিত। আর ২য় বর্ষের ছাত্র গোলাম ফারুক তার সহপাঠীদের নিয়ে ব্যস্ত অ্যানাটমির ডিসেকশন হলে। শরীর ব্যবচ্ছেদ করে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য ছাত্রছাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছে মৃতদেহের চারপাশে। তখন কে জানত আজই ফারুকের সাথে তাদের শেষ ক্লাস। গুপ্ত ঘাতকদের হায়েনার মরণ ছোবল তাকে কুরে কুরে নিঃশেষ করে নিয়ে যাবে মৃত্যুর হিম শীতল কুঠুরিতে? শুধু ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধেই আওয়ামী লীগের ছাত্র নামধারী গুণ্ডা কর্মী ফরিদ (ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের কর্মী) একটি খাতার পৃষ্ঠায় বাজে মন্তব্য লিখে চুইংগামের মাধ্যমে সাঁটিয়ে দেয় গোলাম ফারুকের অ্যাপ্রনের পেছনে। গোলাম ফারুক তা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করতেই তার ওপর হামলে পড়ে ফরিদ, শিশির, পাভেলসহ ব্যাচের ছাত্রলীগ কর্মীরা। এ যেনো সেই সুযোগ যার জন্য এতো অপেক্ষা, এতো পরিকল্পনা! আক্রমণের ধরন দেখেই মনে হয়েছিল এ সবই ছিলো পূর্বপরিকল্পিত। একের পর এক কিল, ঘুষি পড়তে থাকে গোলাম ফারুকের ওপর। গোলাম ফারুকের সাহায্যে ছুটে আসেন শিক্ষকসহ সহপাঠীরা। কিন্তু হঠাৎ তাদের একজন বসার টুল ছুড়ে মারে গোলাম ফারুকের মাথায়। ফিনকি দিয়ে তাজা রক্ত ঝরতে থাকে তার মাথা দিয়ে। সাথে সাথেই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে গোলাম ফারুক ভাই। কী নির্মম আর নির্দয়ভাবে আক্রমণ করা হয় প্রিয় ভাইটিকে। একবারও তাদের বিবেক বাধা দিল না একবারও অন্তর কেঁপে উঠল না? এ যেন জাহেলিয়াতের বর্বরতাকেও হার মানায়। কী অপরাধ ছিল গোলাম ফারুকের? শুধু কি সত্য প্রচার করা আর মানুষকে সৎ পথ দেখানো এ ছাড়া আর কিছুই নয়। অতঃপর আহত গোলাম ফারুককে ভর্তি করা হয় শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজের স্টুডেন্ট ক্যাবিনে। প্রচণ্ড পরিমাণে রক্তপাত হচ্ছিল। দ্রুত সময়ের মধ্যে আন্দোলনের ভাইয়েরা ও সহপাঠীরা আট ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে প্রিয় গোলাম ফারুককে দেয়ার জন্য। সবাই ভেবেছিলেন গোলাম ফারুক বেঁচে উঠবেন, আবার ফিরে আসবেন সহপাঠীদের মাঝে, পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে যাবেন ইসলামী আন্দোলনের অসমাপ্ত কাজ। মহান আল্লাহর দরবারে এটাই ছিলো সবার প্রার্থনা। কিন্তু মহান আল্লাহ গোলাম ফারুককে তাঁর দ্বীনের জন্য আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছিলেন। ১৯ তারিখ বিকেল থেকে অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে প্রচণ্ড পরিমাণে শ্বাসকষ্ট ও খিঁচুনি শুরু হয়। ২০ তারিখ রাত তিনটার দিকে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে শাহাদতকে কবুল করে নেন শহীদ এ কে এম গোলাম ফারুক। আচ্ছা শহীদের কি তখন কষ্ট হচ্ছিল? মহান আল্লাহতো শহীদদের মৃত্যুর সময় চোখের সামনে জান্নাতকে তুলে ধরেন। নাকি হাসি ফুটে উঠেছিল শহীদের মুখে? হয়তো শহীদ হাসতে হাসতে তাঁর রবের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন, হয়তো কেউ খেয়াল করেনি। আর এখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন জান্নাতের পাখি হয়ে। “ছিঁড়ে যাক পাল ভেঙে যাক হাল আসুক তমসা ঘোর সপ্ত-সিন্ধু পাড়ি দিয়ে তবু আনতেই হবে নতুন ভোর”। লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির