post

শহীদ মুরসিদের কফিন বয়ে চলতে আপনি কি প্রস্তুত? । মোঃ সিরাজুল ইসলাম

১১ জুলাই ২০১৯

শহীদ মুরসি রহিমাহুল্লাহ চলে গেছেন। এর আগে শহীদ মতিউর রহমান নিজামী, শহীদ গোলাম আযম, শহীদ হাসান আল বান্না, শহীদ সাইয়্যেদ কুতুব রহিমাহুল্লাহ আলাইহিমসহ অগনিত প্রিয় নেতৃবৃন্দ শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে মা’বুদের দরবারে হাজির হয়েছেন। শহীদ হয়েছেন- মানে সাক্ষ্য হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে অটল, অবিচলতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। পিছপা হননি; বিচলিত হননি। এখন তাদের সেই সাক্ষ্য বহন করার দায়িত্ব তাদের রেখে যাওয়া সাথীদের। অর্থাৎ আপনার, আমার, আমাদের। আপনি কি প্রস্তুত? হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। আপনি কি প্রস্তুত, তাদের কফিন বহন করে নেয়ার জন্য? পারবেন তাদের রেখে যাওয়া আন্দোলনকে সাফল্যের পানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে? কাঙ্ক্ষিত মানে নিজেকে গড়তে; সাথীদের গড়তে? এ শহীদদের চোখের দিকে কখনও তাকিয়েছেন? দেখেছেন গভীর দৃষ্টিতে? কী দীপ্তি ছিল! কী অসম্ভব দৃঢ়তা আর আশাবাদের প্রতিচ্ছবি ছিল তাদের চাহনীতে! পরখ করেছেন কখনও? সে আশাবাদী দৃষ্টি এবার আপনাকে বহন করতে হবে। তাঁদের সাথীদেরকে প্রস্তুত করতে হবে কাঙ্ক্ষিত সে সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী গড়ার তরে। যেমন পৃথিবী গড়া আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন। যে সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী গড়ার দায়িত্ব দিয়ে তিনি মানুষকে খলিফা বানিয়েছেন; তাঁর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব কাঁধে তুলে দিয়েছেন। সে প্রতিনিধিত্বের পথে সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা বা ইবাদত ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ তথা ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের পথে শহীদেরা অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়ে গেছেন এই কার্যক্রমকে। এবার আপনার, আমার, আমাদের পালা। ইসলামী আন্দোলনের পথে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা), হযরত ইউসুফ (আ)। অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছেন দ্বীনের পতাকাবাহী বহু ইমাম, মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ, মুজাহিদসহ দ্বীনের দায়ীরা। তারা জালিমের জুলুম ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র সত্য ও ন্যায়ের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায় হাসিমুখে সয়ে গেছেন নানা অপবাদ। প্রয়োজনে জীবনের শেষ রক্তবিন্দুটুকু জমিনে ঢেলে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। শুধুমাত্র আদর্শগত বিরোধের কারণে তারা জালিমের জুলুম ও পাশবিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। জালিমের কারাগারে বন্দীজীবন কাটিয়েছেন ইমাম আবু হানিফা, সংগ্রামী বীর ইমাম ইবনে তাইমিয়া। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল , ইমাম মালেক, উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলন ও সংগ্রামের অগ্রপথিক-মুজাদ্দেদে আলফেসানী, সৈয়দ নেসার আলী তিতুমীর, শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী, মধ্যপ্রাচ্যের ইখওয়ানুল মুসলিমুনের শায়েখ কুতুব শহীদ , শহীদ হাসান আল বান্না, ওমর তিলমেসানী, জয়নব-আল-গাজ্জালী ও আব্দুল কাদের আওদা রহমাতুল্লাহ আলাইহিম। এখনো চীনের ঝিংঝিয়াংয়ে, আলজেরিয়ায় সত্য পথের হাজার হাজার পথিককে জেলের অন্তরালে প্রতিনিয়ত অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে। মিশরের নাসের সরকার একটি বানোয়াট অপবাদে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইসলামী সংগঠন ‘ইখওয়ানুল মুসলেমিন’ দলটিকে বেয়াইনী ঘোষনা দিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা শুরু করে। নেতাদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুব (র) ও ছিলেন। গ্রেফতার করার পর তাঁকে বিভিন্ন জেলে রাখা হত। নির্যাতনের কারণে তাঁর শরীরে সবসময় জ্বর থাকত। হাতে-পায়ে ডান্ডা বেড়ি আর শিকল পড়ানো হয়। শুধু তাই নয়, এক জেল থেকে অপর জেলে স্থানান্তর করার সময় তাকে হেঁটে যেতে বাধ্য করা হয়! পথে বারবার বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে যেতেন তিনি। হুশ ফিরে এলে তিনি বলতেন, “আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ...! জেলে ঢোকানোর সাথে সাথে সাইয়েদ কুতুব (র)কে মারপিট শুরু করে দিতো দুই-তিন জন মিলে। দুই, তিন, চার ঘন্টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে এই নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতো তাঁর উপর। তারপর একটি প্রশিক্ষিত কুকুরকে লেলিয়ে দিয়ে আহত ক্লান্ত দেহটিকে জেলের আঙ্গিনায় টেনে নিয়ে বেড়ানো হতো। কুতুব (র)এর এসব নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা ছিলনা, কিন্তু ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে তিনি সহ্য করে যেতেন এবং এসময় তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হতো- ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ! শহীদ মুরসিদের কফিন বয়ে চলতে আপনি কি প্রস্তুত? । মোঃ সিরাজুল ইসলামএক বছর কারাভোগের পর জামাল উদ্দিন নাসের সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে ক্ষমার আবেদন করলে তাঁকে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। এই মুজাহিদ নাসের সরকারের প্রস্তাবে যে জবাব দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে চিরদিন। তিনি বলেছিলেন, “আমি এ প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি যে, মজলুমকে জালিমের নিকট ক্ষমার আবেদন জানাতে বলা হচ্ছে। আল্লাহর কসম! যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে, তবু আমি এরূপ শব্দ উচ্চারণ করতে রাজি নই। আমি আল্লাহর দরবারে এমন অবস্থায় হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর প্রতি এবং তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট।” পরবর্তীকালে তাঁকে যতবার ক্ষমা প্রার্থনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ততবারই তিনি একই কথা বলেছেন, “যদি আমাকে যথার্থই অপরাধের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাহলে আমি এতে সন্তুষ্ট আছি। আর যদি বাতিল শক্তি আমাকে অন্যায়ভাবে বন্দি করে থাকে, তাহলে আমি কিছুতেই বাতিলের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করব না।” আজ দেশে দেশে ইসলামী আন্দোলনের শত্রুরা সাইয়েদ কুতুবের উত্তরসুরিদের অন্যায়ভাবে খুন করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। পবিত্র কুরআনে এই সমস্ত জালিমদের জন্য স্পষ্ট ঘোষণা- “যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন ঈমানদারকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, সে চিরকাল সেখানেই থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য কঠোর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।” (সূরা নিসা: ৯৩) উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (র)কেও জেলে কয়েক বছর কাটাতে হয়েছে। ফাঁসির পোশাক পরিধান করার পর যাকে সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি বলেছিলেন, “মৃত্যুর ফায়সালা জমিনে নয় আসমানে হয়। আপনারা মনে রাখবেন যে আমি কোন অপরাধ করনি। আমি তাদের কাছে কিছুতেই প্রাণ ভিক্ষা চাইব না। এমন কি আমার পক্ষ থেকে অন্য কেউ যেন প্রাণ ভিক্ষা না চায়; না আমার মা, না আমার ভাই, না আমার স্ত্রী-পুত্র পরিজন। জামায়াতের লোকদের কাছে আমার এই নিবেদন।” সেই ধারাবাহিকতায় কারারুদ্ধ হয়েছিলেন ভাষা সৈনিক বর্ষীয়ান জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, বুদ্ধিজীবী ও চৌকস নেতৃত্বের অধিকারী মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লাসহ শত শত ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মী। যাদেরকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রহিংসার মাধ্যমে হত্যা করে আওয়ামী সরকার। কারারুদ্ধ কুরআনের পাখি বিশ্ব নন্দিত মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ড. মুরসির ভাগ্য বরণ করতে হবে কিনা জানিনা। ক্ষমতার লোভে ও কায়েমী স্বার্থ হাসিলের জন্য শাসকগোষ্ঠী যুগে যুগে জুলুম ও নির্যাতনের মাধ্যমে এসব সত্যের পথে চলা পথিকদের পথচলাকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। আমরা বাতিলের ষড়যন্ত্রের বিপরীতে আল্লাহ রব্বুল আলামিনকে আমাদের অভিভাবক মেনে পথ চলি। আমাদেরকে শহীদদের কফিন কাঁধে নিয়ে বাকিটা পথ পাড়ি দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর দেখানো পথ ধরে চূড়ান্ত সাফল্যের পথে আমাদের হেটে চলতে হবে, দৌঁড়াতে হবে। আমরা থামব না; বাতিলের রক্তচক্ষুকে মাড়িয়ে আমরা পথ চলব অটল অবিচলভাবে ইনশাআল্লাহ। শাহাদাতের তামান্নায় হবে আমাদের পথচলা; হয় বিজয় দেখে যাব, নতুবা বিজয়ের পথে সাথীদের কাঁধে দায়িত্ব রেখে মা’বুদের দরবারে হবে আমাদের স্থান। আমাদের কফিন আবার বহন করে এগিয়ে যাবেন সাথীরা। তবুও এ সংগ্রাম থামবে না ইনশাআল্লাহ। এ পথে আল্লাহই আমাদের সহায়। ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে আমাদের হৃদয়তন্ত্রী আলোড়িত হবে, আমরা হব সাহসী; আমরা হব উজ্জীবিত আর বাতিল শক্তি হবে শঙ্কিত; হতবিহ্বল, ইনশাআল্লাহ। লেখক: সম্পাদক, প্রেরণা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির