শিক্ষা একটি চলমান পক্রিয়া। শিক্ষার মাধ্যমে জাতির উন্নতি, সভ্যতা ও সমাজ তার মূল্যবোধ প্রজন্মের পর প্রজন্মে বিকশিত হয়। সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষার ধারণা, বিষয়বস্তু, শিক্ষা কারিকুলাম, শিক্ষাদান পদ্ধতি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। প্রাচীনকাল থেকে ক্রমাগত প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বহু উত্তরণ ঘটেছে। মানব সভ্যতা পূর্বে যেমন ছিল, বর্তমানে তেমন নেই। মানব সভ্যতার অন্যতম একটি নিয়ম হলো ক্রমবিকাশ। এই ক্রমবিকাশের মূলে রয়েছে শিক্ষা। সভ্যতার শুরুতে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার রূপ যেমন ছিল তা পর্যায়ক্রমে বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান আধুনিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানব সভ্যতার বিবর্তনের মূলে যেমন শিক্ষার ভূমিকা রয়েছে, তেমনই শিক্ষার বিবর্তনেও মানুষের ভূমিকা রয়েছে।
মানুষ নিজের প্রয়োজনেই শিক্ষা গ্রহণ করে এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটায়। আর উত্তম শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থাই মানুষকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। যুগে যুগে শিক্ষাবিদগণ পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত প্রয়োজন, সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা, জাতীয় উন্নয়ন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনা করে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করেন। এই প্রবন্ধে পাঠক প্রাচীন ভারত থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানতে পারবেন। চলুন, ছুটে চলা যাক বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে।
শিক্ষার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে ইতিহাসের বাধাবিপত্তির পথ বেয়ে বহু পিছনে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। নিম্নোক্ত শিক্ষার ইতিহাসকে চার আমলে ভাগ করে আলোচনা করা হলো :
১) প্রাক-মুসলিম এবং মুসলিম আমলের ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা।
২) ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা।
৩) পাকিস্তান আমলের শিক্ষাব্যবস্থা।
৪) বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা।
১) প্রাক-মুসলিম এবং মুসলিম আমলের ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা :
প্রাক-ইসলামি যুগেই চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মুসলিম আরবদের বসতি গড়ে উঠেছিল। ড. আব্দুল করীম তাঁর ‘চট্টগ্রামের ইতিকথা’ গ্রন্থে বলেন, খ্রিষ্টীয় অষ্টম/নবম শতাব্দীতে সিলেট ও চট্টগ্রামের সাথে আরবীয় মুসলমান ধর্মপ্রচারক ও বণিকদের যোগাযোগ ছিল। আরব ধর্মপ্রচারক ও বণিকরা সিলেট, চট্টগ্রামে স্বাধীন রাজ্য গঠন না করলেও আরবদের আসা-যাওয়ার কারণে সিলেট ও চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার ও মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এমনকি মুসলিম ভূস্বামীগণ নিজেদের খরচে প্রতিবেশী দরিদ্র ছাত্রদের সুশিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য শিক্ষক নিযুক্ত করতেন। তারা শিক্ষার্থীদের কুরআন, হাদীস ছাড়াও ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। ধনাঢ্য মুসলিমগণ সরাসরি অথবা দান, ওয়াকফ বা ট্রাস্টের মাধ্যমে ইসলাম শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখতেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে নিজেদের ধর্মীয় ও নৈতিক মান উন্নয়ন করা। তারা ওহির জ্ঞান ও জাগতিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করতেন। ফলে এ শিক্ষার মাধ্যমে ঘরে ঘরে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আদর্শ মানুষ তৈরি হয়। এ ছাড়াও মুসলমান সন্তানদের ওহির জ্ঞান ও জাগতিক শিক্ষা তাদের বৈঠকখানা, বাংলো, খানকার দরগা, বাড়ির আঙিনা ইত্যাদি জায়গায় চালু হয়েছিল। ফলে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে তখন তাদের ঘরে ঘরে মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আদর্শ ও আলোকিত মানুষ তৈরি হতো।
প্রাক-মুসলিম এবং মুসলিম আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা বলতে ভারতের প্রাথমিক শিক্ষার ইতিহাসকেই বুঝিয়ে থাকে। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং ধন-সম্পদের দিক থেকে ভারতবর্ষ ছিল বিত্তশালী। ফলে দ্রাবিড়, আর্য, মঙ্গোলিয়া, তুর্কি, পাঠান, মুঘল, ইংরেজ প্রভৃতি জাতি ভারতে আগমন, বসবাস ও শাসন করেছে যুগ যুগ ধরে।
আনুমানিক ২০০০ বছরেরও পূর্বে প্রাচীন ভারতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে। প্রাচীন ভারতের এই শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। তাই ধর্মের ভিত্তিতে প্রাচীন ভারতের এই শিক্ষাব্যবস্থাকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা : (১) বৈদিক শিক্ষা, (২) বোৗদ্ধ শিক্ষা এবং (৩) মুসলিম শিক্ষা।
প্রাচীন ভারতের এই তিন শ্রেণির শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে এখানে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো :
প্রাচীন ভারতে বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থা : বেদ হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। বেদ শব্দের অর্থ জ্ঞান। বৈদিক চিন্তাধারা ও দার্শনিক মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষাব্যবস্থা ‘ব্রাহ্মণ্য’ শিক্ষা নামে অভিহিত। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় বর্ণ বৈষম্য ছিল প্রকট। ফলে এ শিক্ষা সর্বজনীন না হয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। এ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ শিক্ষার্থীরা ঢোল ও পাঠশালার উচ্চতর জ্ঞান লাভের সুযোগ পেত। ক্ষত্রিয় শিক্ষার্থীরা রাজগৌরব বা যুদ্ধবিদ্যা লাভ করত। অন্যান্য শিক্ষার্থীরা কৃষি ও ব্যবসায় শিক্ষা লাভ করত।
প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা : গৌতম বুদ্ধের অহিংসনীতির ভিত্তিতে বৌদ্ধ শিক্ষার আবির্ভাব ঘটে। নির্বাণ লাভ বৌদ্ধধর্মের শেষ লক্ষ্য। অষ্টমা বা অষ্টপন্থায় নির্বাণ লাভ ছিল বৌদ্ধ শিক্ষার মূল কথা। সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ বিশ্বাস, সৎ উপার্জন, সৎ ধ্যান, সৎ প্রচেষ্টা ও সৎ স্মৃতি হচ্ছে অষ্টমার উপাদান। শিক্ষার মাধ্যমে অষ্টমা চর্চা এবং তা ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দুঃখময় পৃথিবী থেকে নির্বাণ ছিল বৌদ্ধ শিক্ষার লক্ষ্য। শিশুর ছয় বছর থেকে শিক্ষা শুরু হতো এবং চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত চলত। গণতন্ত্র ছিল বৌদ্ধ শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং শিক্ষার দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
প্রাচীন ভারতে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা : মুসলমানরা প্রথমে বৈঠকখানায়, বাংলোয়, বাড়ির আঙিনায় ও মক্তবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করাতেন। অতঃপর মুসলিম শাসনামলে প্রাথমিক শিক্ষা ছিল মসজিদ কেন্দ্রিক। মসজিদগুলোকে মক্তব হিসেবে ব্যবহার করা হতো। চার বছর বয়সে শিক্ষার্থীকে আনুষ্ঠানিকভাবে কালেমা পাঠের মাধ্যমে মক্তবে ভর্তি হতে হতো। নামাজে পাঠের জন্য মক্তবে প্রয়োজনীয় সূরা-কেরাত শিক্ষা দেওয়া হতো এবং মূল পাঠ শুরু হতো ৭ বছর বয়সে। মুসলিম শিশুগণ মক্তবে কুরআন, আরবি ও ইসলাম শিক্ষা অর্জন করত। এর পাশাপাশি পড়ালেখা ও সাধারণ হিসাবনিকাশও শিক্ষা দেওয়া হতো। মসজিদের ইমামগণ মক্তবে শিক্ষকতার কাজ করতেন।
বাংলার প্রথম সুলতান ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ছিলেন অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী। তিনি দিল্লীর সম্রাট কুতুবউদ্দীন আইবেকের অনুকরণে দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, মাদরাসা, দরগাহ ও কলেজে কুরআন-হাদিস শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেন। বিশেষ করে মুসলিম সুলতানগণ নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষাবিস্তারে অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। শিক্ষা প্রসারে তাঁরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। মুসলিম শাসকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম জমিদার, মুসলিম ধনাঢ্য ব্যক্তিগণসহ মুসলিম প্রধানগণ নিজ নিজ এলাকায় মক্তব, মাদরাসা, কলেজ এবং দরগাহ কায়েম করতেন। ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রভূত ধনসম্পদ ও জমি দান করতেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে মুসলমান শিক্ষার্থীদেরকে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ মানুষ তৈরি করতেন।
২) ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা :
মুসলমানদের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ার পর মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে শিক্ষাবিস্তারে যেসব উদ্যোগ নিয়েছিল, তা সব ছিল তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য অর্থাৎ এ দেশবাসীকে কেরানি ও তাদের অনুসারী গোলাম তৈরি করার জন্য কুরআনিক শিক্ষাকে ধ্বংস করা হয়েছিল।
১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর মুসলামানদের শিক্ষাদীক্ষা’তো দূরের কথা; সত্য কথা বলতে কি, ইংরেজ শাসনের শুরুর পর একশত বছর যাবৎ মুসলমান জাতির অস্তিত্বই ছিল প্রকৃতপক্ষে বিপন্ন। যেখানে তাদের শুধু বেঁচে থাকার প্রশ্ন, সেখানে তারা সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষার চিন্তা করবে কী করে? ইংরেজদের আগমনের পর তৎকালীন ভারতে গোটা মুসলিম জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উলিয়াম হান্টার বলেন, “ভারতবর্ষের ঘটনাবলির সাথে আমি বিশেষভাবে পরিচিত। ফলে আমি যতদূর জানি, তাতে ইংরেজ আমলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারতবর্ষের মুসলমান অধিবাসীগণ।”
বাংলাদেশের শিক্ষানীতির ইতিহাস প্রসঙ্গে এ নিবন্ধে ব্রিটিশ আমলের ১১টি শিক্ষানীতি, শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ওহির শিক্ষা এবং নৈতিক ও ইসলামি মূল্যবোধকে ধ্বংস করা।
নিম্নোক্ত ব্রিটিশ আমলের ১১টি শিক্ষা কমিশন বা শিক্ষানীতি উল্লেখ করা হলো :
১) ১৭৯২ সালের চার্লস গ্র্যানেন্টর শিক্ষাবিষয়ক সুপারিশমালা।
২) ১৮৩৫ সালের লর্ড মেকলের শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদন : লর্ড মেকলে ছিল ব্রিটিশ আইনসভার সদস্য। তিনি শিক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন এবং ১৮৩৫ সালের মার্চ মাসে সেটিকে আইনে পরিণত করেন।
৩) ১৮৪৪ সালের উইলিয়াম অ্যাডামসের শিক্ষাবিষয়ক জরিপ কমিটি গঠন করা হয়।
৪) ১৮৫৪ সালের ২১ জুলাই চালর্স উডের উডস ডেসপ্যাচ-এর শিক্ষা কমিশন।
৫) ১৮৮২ সালের উইলিয়াম হান্টারের শিক্ষা কমিশন : উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে ১৮৩২ সালে শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় এবং ১৮৮৩ সালে কমিশন প্রাথমিক স্তরে পাশ্চাত্য শিক্ষার সুপারিশ পেশ করে।
৬) ১৮৯৮ সালের লর্ড কার্জনের নামে শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। ১৯০১ সালে তিনি শিমলা সম্মেলনের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কারের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
৭) ১৯০৪ সালের ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন শিক্ষা কমিশন।
৮) ১৯১৭ সালে স্যাডলার শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়।
৯) ১৯২৯ সালের হার্টিস শিক্ষা কমিশন ঘোষণা করা হয় এবং এই কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার ওপর জোর দেয়।
১০) ১৯৩৪ সালের সাফ্রু শিক্ষা কমিশন এবং
১১) ১৯৪৪ সালের জন সার্জেন্ট শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় এবং এই কমিটি শিক্ষানীতির রিপোর্ট পেশ করে।
বৃহত্তর ভারতে ব্রিটিশ শাসকগণ কর্তৃক গঠিত এই ১১টি শিক্ষা কমিশন তৈরির মূল উদ্দ্যেশ ছিল ৪টি :
i) ব্রিটিশ শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে ইংরেজদের গোলাম বানানো।
ii) ভারতবর্ষের মানুষকে সভ্যতায়, নম্রতায় ইংরেজদের ন্যায় নৈতিকতা ও চরিত্রহীন মানুষে পরিণত করা।
iii) ওহির শিক্ষা তথা ইসলামি শিক্ষা ও কুরআনের শিক্ষাকে ধ্বংস করা।
iv) আধুনকি ও মাদরাসা শিক্ষা দুই ভাগে মুসলমানদের শিক্ষাকে বিভক্ত করা হয়।
তাদের সকল উদ্দেশ্যই ভারতবর্ষে বাস্তাবায়িত হয়েছিল। তাইতো লর্ড মেকলের শিক্ষাব্যবস্থাই বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে স্থায়ীভাবে চালু হয় এবং আজও উক্ত শিক্ষাব্যবস্থার আলোকেই ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিক্ষা নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং সেগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হতে থাকে; যদিও মেকলের শিক্ষানীতিকে এ অঞ্চলের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশ শাসনামলে তাদের রচিত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ধীরে ধীরে ইসলামি শিক্ষা ও স্থানীয় পর্যায়ের শিক্ষাকে ধ্বংস করা হয়। তারা মুসলিম শিক্ষাকে গুরুত্বহীন করে এ অঞ্চলে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে প্রধান করে তুলেছিল। ভারতবাসীও ধীরে ধীরে এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কারণ, সমাজ রাজনীতি ও অর্থনীতির যে কাঠামো গড়ে উঠেছিল সে সময়ে, সেগুলোর সঙ্গে শিক্ষা কাঠামোকে সেক্যুলারভাবে তৈরি করা হয়েছে। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে গেলেও পাকিস্তান আমলে ব্রিটিশদের তৈরি করা নৈতিক ও ইসলামী মূল্যবোধ বিনাশকারী শিক্ষানীতির অনুকরণেই শিক্ষাব্যবস্থা চলতে থাকে। এটি মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক।
৩) পাকিস্তান আমলে শিক্ষাব্যবস্থা :
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয় : ভারত ও পাকিস্তান।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ আমলের শিক্ষানীতির ইতিহাস মূলত পূর্ববঙ্গসহ ভারতবর্ষে ইসলামি শিক্ষাকে ধ্বংসের ইতিহাস। ব্রিটিশের পর বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক শিক্ষার মাধ্যমে শোষণ করতে চাওয়ার ইতিহাস। ব্রিটিশ আমলের ১১টি ছোটো-বড়ো শিক্ষা কমিশন বা শিক্ষানীতি মানুষকে যতটুকু না সরাসরি ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী করেছিল; ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর পাকিস্তান আমলের ছয়টি শিক্ষা কমিশনের কার্যক্রম মানুষকে আরও বেশি ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী করে তুলেছিল। অর্থাৎ এই শিক্ষানীতি মানুষকে তার চেয়েও বহুগুণে বিদ্রোহী করে তোলে। শিক্ষার মাধ্যমে কীভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখার পরিকল্পনা করা যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হতে পারে পাকিস্তান আমলের শিক্ষানীতিগুলো।
নিম্নোক্ত পাকিস্তান আমলে গঠিত ৬টি শিক্ষা কমিশনের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি উল্লেখ করা হলো :
১) ১৯৫২ সালে মওলানা আকরম খাঁর শিক্ষা পূর্ণগঠন কমিটি : উপনিবেশিক শিক্ষা থেকে বেরিয়ে একদমই নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক মওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁকে প্রধান করে ‘পূর্ববঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা পূনর্গঠন কমিটি’ গঠিত হয়। সার্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশসহ বেশ কতগুলো সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
২) ১৯৫৭ সালের আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন : ১৯৫৭ সালে গঠিত আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ প্রদান করা হয়। আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করেন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। উক্ত সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি।
৩) ১৯৫৮ সালের এস. এম শরিফ খান শিক্ষা কমিশন : পশ্চিম পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষা সচিব এস. এম শরীফকে সভাপতি এবং আরও দশ জন শিক্ষাবিদকে সদস্য করে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় শিক্ষাবিষয়ক কমিশন গঠন করে। শরীফ কমিশন পাকিস্তানি মতবাদ ও জাতীয়তাবাদ এবং মানবসম্পদ উন্নয়নকে সামনে রেখে বেশ চমৎকার কিছু সুপারিশ রেখেছিল। কিন্তু সেখানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঠিক প্রতিফলন ছিল না। তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠীর উদাসীনতা ও অবহেলায় সুপারিশসমূহের বেশিরভাগই বাস্তবায়িত হয়নি।
৪) ১৯৬৩ সালের ইসলামিক ইউনিয়ন (ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসাইন) শিক্ষা কমিশন ঘোষণা করা হয়।
৫) ১৯৬৬ সালের বিচারপতি হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন এবং
৬) ১৯৬৯ সালের এয়ার মার্শাল নূর খান শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে গঠিত ৬টি শিক্ষা কমিশনের সুপারিশমালা পাকিস্তান শাসন আমলে বাস্তবায়ন করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তারপর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়।
৪) বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা :
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে নতুন আঙ্গিকে তৈরি করার জন্য যে সাতটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় তা সংক্ষেপে নি¤েœ আলোচনা করা হলো।
ও. প্রফেসর ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন : স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে এ কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সালে তাদের প্রতিবেদন পেশ করলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
i. কাজী জাফর আহম্মেদ শিক্ষা কমিশন ১৯৭৭ : তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমদকে প্রধান করে ১৯৭৭ সালে পুনরায় একটি শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি কুদরত-ই-খুদা কমিশনের শিক্ষা প্রতিবেদনের আলোকে সেসময়ের উপযোগী করে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলেন। এই শিক্ষা কমিশনের সুপারিশও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
ii. ড. মজিদ খান শিক্ষা কমিশন ১৯৮২ : ১৯৮২ সালে গঠিত মজিদ খান শিক্ষা কমিশন ১৯৮৩ সালে প্রতিবেদন পেশ করে। কিন্তু এর কোনো সুপারিশই জনগণের প্রতিবাদে বাস্তবায়ন হতে পারেনি। কারণ, এতে জনগণের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করতে পারেনি; উলটো বৈষম্য সৃষ্টির নানা উপাদান ছিল।
iii. মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশন ১৯৮৮ : রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে ১৯৮৮ সালে মফিজ উদ্দিন আহমদের শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।
iv. ড. প্রফেসর শামসুল হক শিক্ষা কমিশন : দীর্ঘদিন পর ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক এম শামসুল হককে প্রধান করে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি করা হয়, তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি (খসড়া) তৈরি করা হয় এবং ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো সংসদে গৃহীত হয়। উক্ত শিক্ষানীতিও বাস্তবায়িত হয়নি।
v. প্রফেসর ড. এম এ বারী শিক্ষা কমিশন : অতঃপর ২০০২ সালে প্রফেসর ড. এম এ বারীর নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু সেই শিক্ষানীতিও বাস্তবায়ন হয়নি।
vi. ২০০৩ সালে অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞাকে প্রধান করে নতুন আরেকটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় এবং এই কমিশনের সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি।
vii. সর্বশেষ ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। ২০১০ সালে উক্ত কমিটি প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি হিসেবে গৃহীত হয়। এই শিক্ষানীতি ১৯৭৪ সালের কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ও শিক্ষানীতির ভিত্তিতে তৈরি।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক শিক্ষাক্রম :
সরকারের চাওয়া অনুসারে কমিটি যে প্রতিবেদনটি তৎকালীন সরকারের কাছে পেশ করে, সেটি কিছুটা সংশোধিত হয়ে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে শিক্ষানীতি হিসেবে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিই বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষানীতি, যা ১৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে কার্যকর হয়ে আসছে।
কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের মূলনীতি ছিল ধর্ম তথা ওহির শিক্ষাকে অবহেলা করা। ২০১০ সালের শিক্ষা কমিশন মূলত কৌশলে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে ধীরে ধীরে ম্লান করার দিকে এগোচ্ছে। এ শিক্ষানীতির বেশকিছু সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও ২০১০ সালে গৃহীত শিক্ষানীতির কৌশলগুলো সরকার ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করছে। তবে শিক্ষা কমিশনের অধিকাংশ ভালো কৌশলে বাস্তবায়ন করা হয়নি, কেন করা হয়নি তার কারণ আমাদের বোধগম্য নয়। শিক্ষানীতি গৃহীত হওয়ার পর ২০১১ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ও মনিটরিং-এর জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এসব কমিটির অধীনে অনেকগুলো উপকমিটি গঠন করা হলেও কেন শেষ পর্যন্ত সেগুলো ১০০% কার্যকর হলো না, তাও রহস্যপূর্ণ। ২০১৮ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও বহু বাস্তবসম্মত সুপারিশ ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
তা ছাড়া ২০১০ সালের শিক্ষানীতি ব্রিটিশ আমলের মেকলে শিক্ষানীতি ও ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের আদলে প্রণয়ন করা হয়েছে। শিক্ষাবিদগণ মনে করে, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক চরিত্রের অধিকারী মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ ও আলোকিত মানুষ তৈরির কোনো সম্ভবনা নেই।
তাই সরকারের উচিত নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে অবিলম্বে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তা চালু করা। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাস ঐতিহ্য বিষয় ইতোমধ্যে সমালোচিত হয়েছে এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সাম্প্রতিক শিক্ষাক্রমে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে শুরু থেকে অনেক বিতর্ক চলছে :
নতুন শিক্ষা কারিকুলামে পাঠ্যপুস্তকের অনেক বিষয় নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছে। শিশু-কিশোরদের পাঠ্যবইয়ে এমন সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা তাদের পাঠ-উপযোগী নয়। শিশু-কিশোরদের পাঠ্য বইয়ে লজ্জাহীন নানা বিষয় যুক্ত করায় অনেক অভিভাবকও রীতিমতো ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। শিশুসাহিত্যের পরিবর্তে যুক্ত করা হয়েছে সমাজবিরোধী, চরিত্র বিধ্বংসী, ধর্মবিরোধী দর্শন। পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মগজে প্রবেশ করানো হচ্ছে ধর্মহীনতা। বিজ্ঞজনেরা মনে করে, বর্তমান শিক্ষক্রম শুধু ইসলাম ধর্মই নয়; অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কেও শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ ধারণা তৈরি করছে। এসবের কিছু বাস্তব উদাহরণ নিম্নোক্ত পেশ করা হলো :
উদাহরণ-১ : সাম্প্রতিক শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে লজ্জাহীনতা ও গর্ভপাতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে :
নতুন শিক্ষাক্রমে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন অধ্যায় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাঠ্যবইয়ে কিছু বিষয় এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেগুলো বিতর্কই শুধু নয়; বরং ভিনদেশি অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের হীন প্রচেষ্টারই নামান্তর। বিশেষ করে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিকও বটে। পাঠ্যবই খুললে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে যেসব বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে, তা শিশু-কিশোরদের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। ৬ষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে বয়ঃসন্ধিকালের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা কোনো মতেই পাঠ-উপযোগী নয়।
৬ষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে মেয়েদের মাসিক এবং ছেলেদের বীর্যপাত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ফলে ছেলেমেয়েদের লজ্জাবোধ ভেঙে যাচ্ছে। সপ্তম শ্রেণির বইয়েও অনুরূপ লজ্জাজনক বিষয়ে আরও খোলামেলা আলোচনা করে ছেলেমেয়েদের ব্যাপকভাবে ফ্রি-মিক্সিং প্রমোট করা হয়েছে। ৭ম শ্রেণির ছেলেমেয়েদের মধ্যে কিশোর বয়সে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ থাকাটা প্রকৃতিগতভাবেই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বিষয়টিকে পাঠ্যপুস্তকে ও ক্লাসরুমে আলোচনার মাধ্যমে মূলত ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশাকে বৈধ, স্বাভাবিক এবং নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে লজ্জাহীনতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।
৮ম শ্রেণির উক্ত বইয়ে আরও বেশি নির্লজ্জ ও খোলামেলাভাবে বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের মাসিক ও ছেলেদের বীর্যপাত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ৮ম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের একটি গল্পে সাথী নামে একটি মেয়ে তার মাসিকের ঘটনা ক্লাসরুমে গিয়ে গল্পের ছলে ছেলেমেয়েদের সাথে আলোচনা করছে। একই বইয়ে সঞ্চয় ও আমেনার একটি গল্পে ইন্টারনেট ও গুগল ব্যবহারের মাধ্যমে উক্ত বিষয়গুলো কীভাবে বিস্তারিত জানা যায় তা আরও বেশি খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি থাকে। তাই ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য লেখা বইয়ের বর্ণনা হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, এই বইয়ে যেভাবে শারীরিক পরিবর্তন, মেয়েদের মাসিক ও ছেলেদের বীর্যপাত নিয়ে অনুসন্ধান করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, তাতে আমাদের নৈতিক ও সৎ চরিত্রসম্পন্ন প্রজন্ম ধ্বংসের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের সমাজে অবৈধ গর্ভপাতের যে পরিসংখ্যান তা হয়তো আগামীতে অনেক বেড়ে যাবে।
উদাহরণ- ২ : সাম্প্রতিক শিক্ষাক্রমে শিক্ষার আড়ালে শিক্ষার্থীদের বাল্যপ্রেমে উৎসাহিত করা হচ্ছে :
ক্লাস সিক্স, সেভেন বা এইটের ছেলেমেয়ে- যাদের বয়স ১০ বছর থেকে ১৩ বছর, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের নামে এভাবে অবাধ মেলামেশার ফলে বাল্যপ্রেম মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। এই কারণে আমেরিকাতে এই বয়সি (১০ থেকে ১৩ বছর) ৩৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরী অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়। আর বয়স ১৫ বছর হওয়ার পর এই হার ৫০ শতাংশ হয়ে যায়। এর প্রধানতম কারণ বা মূল চালিকাশক্তিই হলো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ এবং যৌনতা বুঝতে পারা। ফলে যা ঘটার তাই ঘটে। কিশোরী গর্ভধারণের হার হাজারে ৪৩ জন এবং গর্ভপাতের হারও ঐসব দেশে অনেক উচ্চ। আবার পরিণত বয়সের আগেই এই অসময়ে রোমান্টিক সম্পর্ক পরবর্তীতে উগ্র আচরণ অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট মারাত্মকভাবে ধ্বসের কারণ হয়। আবার ঘন ঘন সঙ্গী পরিবর্তন, সম্পর্ক গড়তে সমস্যা, সংসার জীবনে অসুখী হওয়া ইত্যাদির জন্যও দায়ী এই কাঁচা বয়সের প্রেমের সম্পর্ক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মতো মুসলিমপ্রধান দেশে এবং আমাদের মুসলিম সমাজ সন্তানদের এই ধরনের পরিণতি কোনোভাবেই মেনে নেবে না। অর্থাৎ এই ধরনের যৌনশিক্ষা কুফল ছাড়া আমাদের সমাজে বিন্দুমাত্র সুফল বয়ে আনবে না। আমাদের পরিবারের আদরের সন্তানরা যদি স্কুলে পড়তে এসে অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট খারাপ করে এবং সেই জায়গায় উলটো সন্তানরা প্রেম-ভালোবাসা কিংবা ডেটিং করে বেড়ায়, তাহলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে আর নিরাপদ বোধ করবেন না।
বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, সেক্সচুয়াল এডুকেশনের জন্য পাঠ্যপুস্তুক নয়; বরং পরিবারই যথেষ্ট। ছেলেমেয়েদের এসব বিষয়ে সচেতন করার দায়িত্ব স্কুল বা সরকারের নয়; এটা পরিবারের দায়িত্ব। যুগ যুগ ধরে পরিবারের লোকেরাই এই দায়িত্ব পালন করে আসছে।
উদাহরণ-৩ : সাম্প্রতিক শিক্ষাক্রমে মা-বাবাসহ গুরুজনদের শাসন ও শৃঙ্খলা মানতে শিক্ষার্থীরা অবাধ্য হবে :
মাধ্যমিক থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন কারিকুলামের পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন অধ্যায়ের গল্প ও ছবিতে আমাদের চিরাচরিত পারিবারিক শাসনকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যদিও আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক দিক বিবেচনায় সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের অনুশাসন, শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতার অন্যতম জায়গা। কিন্তু সাম্প্রতিক পাঠ্যপুস্তকের বর্ণনায় বাবা-মায়ের এই অনুশাসনকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ৬ষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের কয়েকটি অধ্যায় পড়লে দেখা যাবে শিক্ষার্থীদের পার্সোনাল স্পেসের নামে পারিবারিক অনুশাসনকে মন্দ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কী পড়ছে বা মোবাইলে কী দেখছে এগুলো যদি বাবা-মা মনিটরিং করেন, এটাকে বলা হচ্ছে বাবা-মায়ের অনাধিকার চর্চা। মনে হচ্ছে পশ্চিমা সমাজের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে মুসলিম ও বাঙালি সমাজে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নৈতিকতাবোধ, মানবিক গুণাবলি ও উন্নত চরিত্রকে ধ্বংসের আয়োজন করা হয়েছে নতুন শিক্ষাব্যবস্থায়। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল আনুগত্যসম্পন্ন ও আদর্শিক মানের। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিশুদেরকে অতীতে পড়ানো হতো :
“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজন,
আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।
এখানে শিশুদেরকে আদর্শ ও আনুগত্যের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। অথচ এ ধরনের শিক্ষাকে অপসারিত করে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বাবা-মাসহ গুরুজনদের শাসন না মানার জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা হয়েছে।
উদাহরণ- ৪ : ‘শরিফ থেকে শরিফা’ গল্পের মাধ্যমে সমকামিতাকে উৎসাহিত করে পরিবার প্রথাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে :
গত ৭-৮ বছরে বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডারবাদের প্রসারে ব্যাপক কার্যক্রম করা হয়েছে। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ট্রান্সজেন্ডার মতবাদের পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। মিডিয়ায় ট্রান্সজেন্ডারদের তুলে ধরা হচ্ছে ইতিবাচকভাবে। সামাজিকভাবে ট্রান্সজেন্ডারবাদকে বৈধতা দেওয়ার জন্য চলমান নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডারবাদ ও বিকৃত যৌনতার স্বাভাবিকীকরণ। বর্তমানে এ কাজটি চলছে দুটি ধারায়। একটি হলো সরাসরি ট্রান্সজেন্ডারবাদের শিক্ষা, অন্যটি হলো যৌন শিক্ষার নামে অবাধ বিকৃত যৌনতার প্রচার ও প্রসার। নতুন কারিকুলামে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৩৯ ও ৪০ পৃষ্ঠার “শরিফ থেকে শরিফা” গল্পটি নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
শরিফার গল্পে বলা হয়েছে- “ছোটোবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময় বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে।” এই মন্তব্যটি কোনো হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের নয় এবং তা হতেই পারে না। কারণ, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের দৈহিক পরিবর্তনের ওপরে ভিত্তি করে ছেলে অথবা মেয়ে নির্ধারিত হয়। দেখতে ছেলের মতো কিন্তু তার দৈহিক গঠন মেয়ের মতো হলে তারা নিজেকে মেয়ে বলে মনে করে। আর দেহের গঠন ছেলেদের মতো কিন্তু দেখতে মেয়ের মতো হলে সে নিজেকে ছেলে হিসেবে বহিঃপ্রকাশ করতে পারে। কিন্তু প্রকাশিত গল্পে বলা হয়েছে, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। এই মনে মনে শব্দ দুটি প্রশ্নবিদ্ধ, যা কিনা ট্রান্সজেন্ডার বা লিঙ্গ পরিবর্তনকারীদের সদিচ্ছা ও মনমানসিকতা এবং আচরণের বহিঃপ্রকাশ। কথাগুলো সরাসরি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমদানি করা ট্রান্সজেন্ডারবাদ এবং জেন্ডার আইডেন্টিটি মতবাদের বক্তব্য। আত্মপরিচয় এবং যৌনতা নিয়ে বিকৃতিকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করে নিতে শেখানো হচ্ছে আামদের শিশু-কিশোরদের। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে এখন শোনা যাচ্ছে পাঠ্যবইয়ের শরিফ থেকে শরিফা গল্পটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে এই বিষয়ে গঠিত কমিটি।
তা ছাড়া বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ মুসলিম সন্তানরা ৫ বছর থেকে ৮/৯ বছর বয়েসে পবিত্র কুরআন শিক্ষাসহ ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা না রাখায় কুরআন শিক্ষা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। একটি জাতির চরিত্র, দেশপ্রেম, নৈতিকতাবোধ কেমন হবে তা নির্ভর করে সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। যে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা যত উন্নত, সে জাতি তত উন্নত। একটি আদর্শ জাতি গঠন হয় আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আদর্শ মানে উন্নত করা তো দূরের কথা; বরং নৈতিক চরিত্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্র চলছে। আগামী প্রজন্মকে নৈতিকতাহীন, বিকৃত মস্তিষ্ক, পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট মানসিকতায় গড়ে তোলার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এর প্রমাণ সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘শরিফ থেকে শরিফা’ ট্রান্সজেন্ডার বা সমকামিতা গল্প।
উদাহরণ-৫ : বর্তমান শিক্ষাক্রমে ছেলেমেয়েদের নাচ ও সংগীত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে :
নাচ ও সংগীত দেব-দেবীদের প্রার্থনা মনে করা হয়। নতুন এ শিক্ষাকারিকুলামে ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিল্প সংস্কৃতি বইয়ের ৩৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, সংগীত, নাচ আর অভিনয় পরস্পরের আত্মার আত্মীয়। তাই সংগীতের তাল লয় এবং নৃত্যের নানা কৌশল শেখানো হচ্ছে। তাদের সনাতন ধর্মে সংগীত ও নৃত্যকে মনে করা হয় দেব-দেবীর প্রার্থনা। ছেলেমেয়ে একসাথে নাচ-গান অভিনয় করানো ইসলামি মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। অথচ এই নৃত্য শিক্ষাকে সকল শিক্ষার্থীর জন্যই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদি কেউ মুসলিম মূল্যবোধকে তোয়াক্কা না করে, তাহলে তিনি তার নিজ দায়িত্বে নাচ-গান ও অভিনয় সন্তানকে শেখাবেন। কিন্তু গণহারে শিক্ষার্থীদের এসব বিষয় শিখতে বাধ্য করার অধিকার কারও আছে বলে আমরা মনে করি না।
উদাহরণ-৬ : ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান শাসকদের ভিনদেশি বলা হয়েছে :
৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ে ইসলাম ধর্ম বহিরাগত ধর্ম এবং মুসলমান শাসকদের বানানো হয়েছে ভিনদেশি দখলদার, ভিনদেশি শাসক বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ ইতিহাসবিদদের মতে, মুসলিম শাসকরা কখনোই বহিরাগত ছিল না। আর্যরা যেমন বাহির থেকে এ দেশে এসেছে, শতশত বছর এই দেশে বসবাস করে দেশীয় নাগরিক হয়ে গেছেন, ঠিক তেমনি এই প্রক্রিয়ায় মুসলমানরাও এই দেশের নাগরিক। তাদেরকে বহিরাগত বলাটা ইতিহাসের জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। মুসলিম শাসক কর্তৃক মুসলমানদের বহিরাগত বলা একটা সাম্প্রদায়িক বক্তব্য।
উদাহরণ-৭ : ২য় শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণির বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে আদর্শ ও অনুকরণীয় গল্প ও কবিতা এবং শিক্ষণীয় গল্প ও কবিতা :
দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সকল বিষয়ের বইয়ের মধ্যে অত্যন্ত সুকৌশলে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, আদর্শ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অন্যদিকে পৌত্তলিকতা, অশ্লীলতা ও ইসলামবিরোধী ভিনদেশি কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরা হয়েছে। ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে চরম ইসলামবিরোধী, বিতর্কিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রত্যাখ্যাত ‘বিবর্তনবাদ’ সংযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি এ বইয়ে অসংখ্য কল্পিত দেব-দেবীর নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবি প্রকাশের মাধ্যমে পৌত্তলিকতা ও অশ্লীলতা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। বইটিতে উপমহাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন অর্জন, বিতর্কিত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলে ধরলেও মুসলিমদের ত্যাগী ও ঐতিহাসিক ভূমিকাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে; এমনকি বাদ দেওয়া হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বর্তমান মাধ্যমিক শিক্ষায় নৈতিকতাসম্পন্ন কবিতা, প্রবন্ধসহ যে শিক্ষামূলক গল্পগুলো বাদ দিয়েছে তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :
১) দ্বিতীয় শ্রেণি : ‘সবাই মিলে করি কাজ’ শিরোনামে মুসলমানদের শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত বাদ দেওয়া হয়েছে।
২) তৃতীয় শ্রেণি : ‘খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)’ শিরোনামে একটি সংক্ষিপ্ত জীবন চরিতও বাদ দেওয়া হয়েছে।
৩) চতুর্থ শ্রেণি : খলিফা হযরত ওমর (রা.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত।।
৪) পঞ্চম শ্রেণি : ‘বিদায় হজ্জ’ নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত বাদ দিয়ে সংযুক্ত করেছে ‘বই’ নামের একটি কবিতা, যা কুরআনবিরোধী।
৫) পঞ্চম শ্রেণি : বাদ দেওয়া হয়েছে কাজী কাদের নেওয়াজের লিখিত ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ নামক কবিতা- যাতে শিক্ষকের প্রতি বাদশাহ আলমগীরের মহত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। এ কবিতায় শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে আদব কেমন হওয়া উচিত তা বর্ণনা করা হয়েছিল।
৬) পঞ্চম শ্রেণি : বাদ দেওয়া হয়েছে ‘শহীদ তিতুমীর’ নামক একটি জীবন চরিত। এ প্রবন্ধটিতে শহীদ তিতুমীরের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘটনা উল্লেখ ছিল।
৭) ষষ্ঠ শ্রেণি : ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখিত ‘সততার পুরস্কার’ নামক ধর্মীয় শিক্ষণীয় ঘটনাটিও বাদ দেওয়া হয়েছে।
৮) ষষ্ঠ শ্রেণি : বাদ দেওয়া হয়েছে মুসলিম দেশ ভ্রমণ কাহিনি- ‘নীলনদ আর পিরামিডের দেশ’ নামক গল্পটি।
৯) ষষ্ঠ শ্রেণি : মুসলিম সাহিত্যিক কায়কোবাদের লেখা ‘প্রার্থনা’ নামক কবিতাটি। এতে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করার তাগিদ দেওয়া হয়েছিল।
১০) সপ্তম শ্রেণি : বাদ দেওয়া হয়েছে ‘মরু ভাস্কর’ নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত।
১১) অষ্টম শ্রেণি : বাদ দেওয়া হয়েছে ‘বাবরের মহত্ব’ নামক কবিতাটি।
১২) নবম ও দশম শ্রেণি : বাদ দেওয়া হয়েছে মধ্যযুগের বাংলা কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’ নামক ধর্মভিত্তিক কবিতাটি।
১৩) নবম ও দশম শ্রেণি: বাদ দেওয়া হয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি আলাওল-এর ধর্মভিত্তিক কবিতা ‘হামদ’, মুসলিম কবি আব্দুল হাকিমের লেখা ‘বঙ্গবাণী’, কবি গোলাম মোস্তফার লেখা ‘জীবন বিনিময়’, কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘উমর ফারুক’ নামক কবিতাগুলো।
বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, ওপরে উল্লেখিত বাদ দেওয়া গল্প ও কবিতাগুলো অবিলম্বে পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন।
সরকার যদি নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে কবিতা ও প্রবন্ধ এবং ইসলাম শিক্ষা বিষয়টিকে সকল স্তরে বাধ্যতামূলক করে, তাহলে দেশের সকল অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা তাদের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পাবে। ফলে বাংলাদেশে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষার ফল সকল ধর্মের মানুষ ভোগ করতে পারবে। শিক্ষার্থীরা নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ আলোকিত মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে বলে আমরা মনে করি। তাই সরকারকে নার্সারি থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষাসহ সকল ধর্মের মানুষের জন্য নৈতিকতার শিক্ষা আরও ভালোভাবে চালু করতে হবে।
সাম্প্রতিক শিক্ষাক্রম : জাতীর প্রত্যাশা পূরণে আমাদের দায়িত্ব :
নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনার পর সাধারণ জনগণ, অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীসহ সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি করার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।
১। আদর্শ ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করা।
২। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার নতুন শিক্ষাক্রমসহ সামগ্রিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি খুঁজে বের করা। বিশেষ করে নতুন শিক্ষাক্রমে বাদ দেওয়া ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাগুলো পুনরায় বহাল রাখার চেষ্টা করা।
৩। ২০২৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষাক্রম বিষয়ে বিস্তারিত জানা ও গবেষণার জন্য ২০২৪ সালের নভেম্বর/ডিসেম্বর মাসে দিনব্যাপি ওয়ার্কশপের আয়োজন করা।
৪। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি-এর ওয়েবসাইট থেকে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে শিক্ষাক্রম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করা।
৫। শিক্ষাক্রম বিষয়ে সাবেক শিক্ষাবিদগণ ও বর্তমান অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের মতামত গ্রহণ করা।
৬। শিক্ষাক্রম বিষয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিম্নের কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন :
i) সেমিনার, সিম্পোজিয়াম আয়োজন করা।
ii) আলেম-ওলামা, সমমনা রাজনৈতিক দল, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও শিক্ষার্থী নেতৃবৃন্দদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করা।
iii) অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা।
iv) লিফলেট ও প্রচারপত্র তেরি করে ব্যাপক প্রচার ও বিতরণের ব্যবস্থা করা।
v) ট্রান্সজেন্ডারসহ সকল নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী শিক্ষার বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সকল প্রচার মিডিয়ায় লেখালেখি করে সেগুলো প্রচারের ব্যবস্থা করা।
vi) জনগণ, ছাত্রসহ ঐক্যবদ্ধভাবে সাধারণ প্ল্যাটফরম থেকে-ক) মানববন্ধন, খ) বিক্ষোভ মিছিল, গ) সমাবেশ, ঘ) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্বারকলিপি প্রদান ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও এবং ঙ) প্রেসক্লাব কেন্দ্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করা।
vii) টেলিভিশন/রেডিও/সংবাদপত্র/ম্যাগাজিন/বই পুস্তকে আদর্শ ভিত্তিক ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা চালু করা।
viii) আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা : শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মাধ্যমে।
পরিশেষে বলতে চাই- নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিবর্জিত শিক্ষাক্রমে অবশ্যই শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং জাতি নিজ আদর্শ হারিয়ে আদর্শহীন জাতিতে পরিণত হবে। আর এটাই ইসলাম বিরোধী ও সেক্যুলার গোষ্ঠীর একান্ত চাওয়া; যাতে শিক্ষার্থীগণ নৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়। এরূপ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নৈতিক চরিত্র ও মানবতা বিবর্জিত শিক্ষার্থী ছাড়া আদর্শ আলোকিত সৎ চরিত্রবান মানুষ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। তাই জাতিকে আলোর দিশা দেখানোর জন্য প্রয়োজন নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে রচিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন।
ইসলাম ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় সবাইকে একসাথে আওয়াজ তুলতে হবে। ইসলাম বিরাধী শিক্ষানীতি বাতিল করে ইসলাম শিক্ষাসহ সকল ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষা প্রাক-প্রাথমিক থেকে সকল স্তরে বাধ্যতামূলক করার জন্য বাস্তবসম্মত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মন্তব্য লিখুন