শিক্ষায় ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি সময়ের দাবি
০২ আগস্ট ২০১১
জুমমন হোসেন
লিওটলস্টয়ের একটি গল্পে আছে, গ্রামের এক মূর্খ ধনী লোক শহর ভ্রমণে বেরিয়েছেন। পথিমধ্যে তিনি লক্ষ্য করলেন একটি বড় বিল্ডিং। কৌতূহল বশত সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন এটা কী? কর্তব্যরত কর্মকর্তা বললেন এটা বিশ্ববিদ্যালয়। পাল্টা প্রশ্ন, এখানে কী করা হয়? তিনি বললেন, এখানে ডিগ্রি দেয়া হয়। তার ডিগ্রি নেয়ার শখ হলো, তাই তিনি বললেন, আমাকে একটি দেয়া যাবে। তিনি বললেন, ১০০ ডলার লাগবে। তিনি ডিগ্রি নিয়ে ফেরার পথে চিন্তা করলেন তার ঘোড়ার জন্য একটি ডিগ্রি নেয়া দরকার। তাই তিনি গিয়ে বললেন, ভাই আমার ঘোড়াটার জন্য আরেকটি ডিগ্রি দেন । কর্মকর্তা বললেন, এখানে শুধু গাধাদের ডিগ্রি দেয়া হয় ঘোড়াদের নয়।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ডিগ্রি লাভ নয় বরং মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। যে শিক্ষার মধ্যে মূল্যবোধ বা নৈতিকতাবোধ সৃষ্টির সুযোগ নৈই তা কখনো সুশিা হতে পারে না । শিক্ষার ইংরেজি শব্দ 'education that means pack the information in draw the talents’ যার অর্থ হল অবগতি বা জ্ঞান প্রদান এবং জ্ঞেয় বিষয়ে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ।
মোতাহার হোসেন চৌধুরী তার ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে বলেছেন, মানুষের মধ্যে দু’টি সত্তা রয়েছে- পশুত্ব ও মনুষ্যত্ব। পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বের স্তরে পৌঁছার মাধ্যম হল শিক্ষা।
ইংরেজ কবি মিল্টন বলেছেন, ÔEducation is the harmonious development of body mind & soul’ অর্থাৎ দেহ মন ও আত্মার সুষম বিকাশই শিক্ষা।
মহাকবি ইকবাল বলেছেন, মানুষের খুদি বা রূহকে উন্নত করার প্রচেষ্টার নামই শিক্ষা।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেন, মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা।
সুতরাং মানুষকে সত্যিকারের মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা। সক্রেটিস বলেছেন, know thyself ‘নিজেকে জানো’। আরবিতে একটি প্রবাদ আছে ‘মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু যে নিজেকে জানলো সে তার রবকে চিনতে পারল।
ধর্মবিবর্জিত শিক্ষা বনাম নৈতিক শিক্ষা
ব্রিটিশদের দুইশত বছরের শাসনের সবচেয়ে বড় সাফল্য তাদের রেখে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থা। তারা বুঝতে পেরেছিল এ দেশ তারা চিরদিন শাসন করতে পারবে না । এ দেশের মানুষের ললাটে চিরকাল গোলামির জিঞ্জির এঁকে দেয়ার জন্য এবং তাদের চিন্তা চেতনাকে লালন ও বাস্তবায়নের জন্য তারা ১৯৩৭ সালে এক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করলেন। সেই শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তক ড. ম্যাকলে বলেন : এ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এমন এক জাতি তৈরি করবো যারা রক্তে মাংসে হবে ভারতীয় কিন্তু চিন্তা-চেতনায় হবে ইংরেজ। আমরা জাতি হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করলেও চিন্তার রাজ্যে আজও ইংরেজদের গোলামি করে যাচ্ছি। তাদের রেখে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘষা-মাজা দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছি অথচ শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এ দেশে তাদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটেনি এ শিক্ষাব্যবস্থায়।
নৈতিকতাবর্জিত শিক্ষা কখনো জাতিকে ভাল মানুষ উপহার দিতে পারে না। আজকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যবোধ সৃষ্টির উপাদান থাকত তাহলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্বিয়ন হতো না, শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীধর্ষণের মত ঘটনা দেশবাসী অবলোকন করতে হতো না।
পাশ্চাত্য অনুসরণে ধর্মহীন শিক্ষা মানুষকে চরম বস্তুবাদী বানাচ্ছে। প্রযুক্তি মানুষকে দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ, ভালোবাসা। মঙ্গল গ্রহের সাথে যোগাযোগ রয়েছে কিন্তু পাশের প্রতিবেশীর খবর রাখি না। ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল আইস অ্যান্ড জাস্টিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট এক রিপোর্টে বলা হয় : যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৮ সেকেন্ডে একজন নারী নির্যাতিত হয় এবং প্রতি ৩ মিনিটে একজন ধর্ষিতা হয়। ধর্মবিবর্জিত শিক্ষা আজকের আমেরিকার সমাজে কী পরিমাণ নৈতিক হাহাকার সৃষ্টি করেছে তা আমেরিকার এককালের টিভি বিশ্লেষক জিমি সোয়াগোটের মন্তব্য থেকে বুঝতে পারি : আমেরিকা, বিধাতা অবশ্যই তোমার বিচার করবেন, আর যদি তিনি তোমার বিচার না করেন, তাহলে নৈতিক অপরাধ এবং লালসা চরিতার্থ করার অপরাধে সডোম, ঘোমরার জনপদের (আদ, সামুদ ও লুত সম্প্রদায়) অধিবাসীদের কেন ধ্বংস করলেন; সে জন্য স্বয়ং বিধাতাকেই মা চাইতে হবে।
সুতরাং আজকে নৈতিক শিার জন্য ধর্মের বিকল্প নেই। প্রখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক Stanly Hall বলেন : If you teach your children three R (Reading, Writing, & Arithmetic) leave the fourth R (Religion) you will get the fifth R (Rascality).
পৃথিবীর সকল ধর্ম মানুষের কল্যাণের কথা বলে, নৈতিকতার কথা বলে। রাসূল (সা)-কে মানবজাতির শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। গৌতম বুদ্ধ অষ্টমার্গের কথা বলেছেন, যীশু খ্রিষ্ট মানুষকে ভালবাসতে বলেছেন। সুতরাং আমরা যদি ধর্ম শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার সাথে সমন্বয় করতে পারি তাহলে সত্যিকারের আদর্শ মানুষ বানানো সম্ভব।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মন্তব্য লিখুন