বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশের পথপরিক্রমায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। একসময় বিনোদনসংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চার মূল বিষয় ছিল গীতিকবিতা। গীতিকবিতাকে ঘিরেই গীতিনাট্য, পুঁথি এবং গল্পের আসর বসতো গ্রামে-গঞ্জে। এ ছাড়াও বিভিন্ন মৌসুমকে ঘিরে নানা রকমের ক্রীড়াকৌতুকের প্রচলন ছিল। হিন্দুদের পূজাপার্বণকে ঘিরে যেমন আনন্দ আসর বসতো তেমনি মুসলমানদের ঈদ, রোজা এবং কুরবানিকে ঘিরেও উৎসবের আমেজ তৈরি হতো। শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে চলতো ইসলামের আলোচনা, যাকে ধর্মসভা বা ইসলামী জালসা নামে আখ্যা দেওয়া হতো। ফসলি আমেজকে সামনে রেখে জমে উঠতো বিভিন্ন ধরনের মেলা-পার্বণ। মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনা, বাসনকোসন ছাড়াও মিষ্টি-মিষ্টান্নের মহড়ৎ চলতো এসব মেলায়। এ ছাড়াও অঞ্চলভেদে আলকাপ, গম্ভীরা, গাজির গানসহ নানা ধরনের গানের আসরে মজে উঠতো মানুষের হৃদয়-মন। পরবর্তীতে লোকনাট্যসহ বিভিন্ন ধরনের সার্কাস ও যাত্রাপালাও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এসময় সাহিত্যের উৎকর্ষকতা সাধিত হলেও বিনোদন সংস্কৃতি তথা গান, নাটক, সিনেমা, যাত্রা, সার্কাস প্রভৃতি ততোটা সহজলভ্য ও সামাজিক স্বীকৃতির আওতায় আসেনি। শিল্পীসম্রাট আব্বাস উদ্দীন আহমদ, আবদুল আলীম, নীনা হামিদ প্রমুখের লোকগান ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে সেগুলোকে খুব বেশি গ্রহণ করা হতো না। তবে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাধ্যমে ইসলামী গানের সম্প্রসারণ ঘটলে ওয়াজ মাহফিলে ক্রমশ এসব গান গজল নামে ছড়িয়ে যায়। আলিম-উলামাশ্রেণিও ওয়াজের মধ্যে এসব গানের উদ্ধৃতি ব্যবহার করা শুরু করেন। ফলে বাদ্যবিহীন ইসলামী গানসমূহ গজল নামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
একসময় বিনোদন সংস্কৃতির মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল রেডিও। আমাদের বাংলায় ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রথম সংস্থা এটি। ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর পুরান ঢাকায় এর সম্প্রচার শুরু হয়ে পরবর্তীতে এটিকে ঢাকার শাহবাগে স্থানান্তর করা হয়। শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র অনন্য ভূমিকা পালন করে। বিনোদনের ক্ষেত্রেও এর অবদান কম ছিল না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান আজও আমাদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে তোলে। সাহিত্যবিকাশেও এ গণমাধ্যমটি বেশ জোরালো ভূমিকা পালন করে এসেছে। ‘রানারের ঝুলি’ নামের ছড়া কবিতা পাঠের আসর এক সময়ে বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের প্রধান প্রচারমাধ্যম হিসেবে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠানমালা বর্তমান সময়ে ততোটা বিস্তৃত না হলেও ‘রানারের ঝুলি’ অনুষ্ঠানটি আজো সাহিত্যপ্রেমীদের আন্দোলিত করে থাকে। ১৯৯৬ সাল থেকে রেডিও নামের বিনোদনমূলক গণমাধ্যমটিকে বাংলাদেশ বেতার নামে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বেতার ঢাকার ক, খ, গ চ্যানেলসহ সারাদেশে মোট ১২টি কেন্দ্রে ছড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে জাতীয় বেতার ভবনে এফ.এম রেডিও ছাড়াও বেসরকারিভাবে অনেক এফ.এম রেডিও এবং সারাদেশে প্রচুর পরিমাণে কমিউনিটি রেডিও চালু হয়েছে। এগুলোও গণমাধ্যম হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নানা রকমের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে থাকে। মোবাইল টেকনোলজির কারণে এখন আর বেতারযন্ত্র কাছে নিয়ে শোনার প্রয়োজন পড়ে না। মোবাইল কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ল্যাপটপ-কম্পিউটারেও রেডিও অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশ্বায়নের প্রভাব থাকলেও রেডিওর সম্প্রসারণও একেবারে কম হয়নি।
ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অন্যতম প্রধান বাহন টেলিভিশন। টেলিভিশন সম্প্রচার ব্যবস্থা ১৯৫০ সাল থেকে যাত্রা শুরু করলেও বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। তখন থেকে অগ্রাভিমুখী বিটিভির ভার্চুয়াল একাকিত্ব ছিল ১৯৯০ সালের শেষ পর্যন্ত। এরপর বিভিন্ন স্টেশন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চললেও তা সফল হয়নি। একুশে টেলিভিশন সফল যাত্রা শুরু করলেও তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই এটিএন বাংলা এবং ১৯৯৯ সালে চ্যানেল আই এর সফল যাত্রার পর থেকে বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে টেলিভিশনের সম্প্রচার ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। বর্তমানে বিটিভি ছাড়াও বেসরকারিভাবে দুই ডজনেরও বেশি চ্যানেল অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে যাচ্ছে। অন্য দিকে চ্যানেল ওয়ান, এসবি নিউজ, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশনসহ মোট ছয়টি টিভি চ্যানেল রাষ্ট্রীয় রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার একটি অবারিত ক্ষেত্র হচ্ছে টেলিভিশন। গণমাধ্যম হিসেবে খবরা-খবর প্রচারের পাশাপাশি সারাদিন বিনোদনমূলক নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। এর মধ্যে বিশেষত, নাটক, সিনেমা, সঙ্গীতসহ বিশেষ বিশেষ পর্বে সাহিত্যের আসরও করে থাকে। অন্যদিকে বিশিষ্ট লেখকদের জন্ম-মৃত্যু দিবসে সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। রমজান ও ঈদ ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় দিবসে ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার প্রয়াস এখন বেশ প্রশংসনীয়। বিশেষ করে সারা রমজান মাস জুড়ে প্রায় সবগুলো চ্যানেলে ইসলামী গানের রিয়ালিটি শো, ইসলামী সঙ্গীতের আসর, ইসলামী ভাবাদর্শে শিশুতোষ বিনোদন অনুষ্ঠান, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নোত্তরসহ নানামুখী ইসলামী আলোচনার উদ্যোগ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ঈদের কিছু অনুষ্ঠানেও ইসলামী সংস্কৃতির ছোঁয়া লক্ষ করা যায়। তবে ইসলামিক টিভি ও দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ হয়ে যাবার কারণে জনগণ এ ধরনের অনুষ্ঠান থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হচ্ছে।
‘অনলাইন টিভি’ বর্তমান সময়ে টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যকার সমাদৃত একটি নতুন আঙ্গিক। এটি এখন যুগের চাহিদা। দিন যত যাচ্ছে মানুষ ততো প্রযুক্তি নির্ভর হচ্ছে। তারা হাতের মুঠোয় সব কিছু রাখতে চায়। একদিকে তথ্য প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়ন, অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের উৎপাতে অতিষ্ঠ দর্শকদের নির্মল বিনোদন আর সর্বশেষ খবরা-খবর জানানোর প্রয়াস থেকেই শুরু হয় অনলাইন টেলিভিশন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বর্তমানে বেশ কিছু অনলাইন টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনলাইন টেলিভিশনের সব চেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে দর্শক নিজের সুবিধা মতো সময়ে একেবারে বিনামূল্যে নিজের পছন্দনীয় অনুষ্ঠানমালা দেখেতে পারেন। তা ছাড়া স্মার্ট ফোনের মাধ্যমেও এ ধরনের চ্যানেলের অনুষ্ঠানমালা সহজেই উপভোগ করা যায়। ফলে অনলাইন টেলিভিশনের অনুষ্ঠানমালা এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এসব অনলাইন টেলিভিশনগুলোও অন্যান্য টেলিভিশনের মতো সংবাদ, বিনোদন, টকশো, নাটক, বিজ্ঞানভিত্তিক অনুষ্ঠান, সমসাময়িক ঘটনাবলি নিয়ে অনুষ্ঠান, গান, আড্ডাসহ সাহিত্যের নানামুখী অনুষ্ঠানও প্রচার করে থাকে। অনলাইন টেলিভিশনের জনপ্রিয়তার কারণে দর্শক টানতে প্রচলিত সাটেলাইট চ্যানেলগুলোও ইতোমধ্যে অনলাইন ভার্সন চালু করেছে। এর মাধ্যমে বিনোদনসহ সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার বিষয়গুলো শুধু দোরগোড়ায় নয় বরং হাতের মুঠোয় এসে পড়েছে।
প্রেস মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশেও এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অনলাইন মিডিয়া। অনলাইন মাধ্যম মানেই অবাধ ও দ্রুতগামী তথ্য প্রবাহ করা। ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এ মাধ্যমটি তথ্যকে নিমিষেই ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বময়। এ অনলাইন মিডিয়ার অন্যতম প্রধান হচ্ছে সংবাদমাধ্যম। আর এটি আঁতুড়ঘর থেকেই একটি প্রযুক্তিনির্ভর গণমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। মুখে মুখে কিংবা হাতে লেখা কাগজে এর সূচনা মনে করা হলেও এর সফল যাত্রা শুরু হয়েছে মূলত মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর থেকেই। ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি শনিবার ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় জেমস আগাস্টাস হিকির সম্পাদনায় ‘বেঙ্গল গেজেট বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভাইজার’ নামে মুদ্রিত সংবাদপত্র। এরপর ১৮১৮ সালে মাসিক বাংলা পত্রিকা হিসেবে ‘দিগদর্শন’ প্রকাশিত হয় শ্রীরামপুর থেকে। কবি ঈশ্বরগুপ্তের সম্পাদনায় ১৮৩৯ সালের ১৪ জুন প্রকাশিত হয় প্রথম মুদ্রিত বাংলা দৈনিক ‘সংবাদ প্রভাকর’। অতঃপর ১৮৭৪ সালে পূর্ববাংলার রঙ্গপুর থেকে ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেই ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ পত্রিকার হাত ধরে আজ অসংখ্য পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে গেছে।
অনলাইন মিডিয়ার সংবাদ ও অন্যান্য বিষয়সমূহ প্রিন্ট মিডিয়া থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। প্রিন্ট মিডিয়ার দৈনিক সংবাদপত্রের মতোই অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধুলা, বিনোদন, পর্যটন, মফস্বল বিভাগসহ সব কিছুই থাকে। এমনকি এসবের জন্য আলাদা আলাদা পাতাও থাকে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মতো অনলাইন পত্রিকায় বিভিন্ন সংবাদ বা অনুষ্ঠানের ভিডিও আপলোড করার ব্যবস্থা থাকে। প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় একটি সংবাদ বা ফিচারের জন্য সীমাবদ্ধ স্পেস থাকে। কিন্তু অনলাইন সংবাদে অসীম স্পেস থাকায় ইচ্ছামত লেখা ও ছবি সেখানে সংযোজন করা যায়। আর পাঠকের পড়ার জন্য সংবাদপত্র বহন করে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। হাতের মুঠোর স্মার্টফোনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এ পত্রিকা পাঠ করা যায়। এ সহজলভ্যতার কারণে অনলাইন মিডিয়া এখন জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে উঠে এসেছে। ফলে বাংলাদেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন এলাকার আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকাও অনলাইন সংস্করণ চালু করেছে।
তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সহজলভ্য এ যোগাযোগ মাধ্যমসমূহ শুধুমাত্র একে অপরের মধ্যকার পরিচিতিই বৃদ্ধি করেনি বরং নানা অন্যায়ের প্রতিবাদ, নিন্দা, ক্ষোভ প্রকাশসহ মতামত প্রকাশের একটি উন্মুক্ত মাধ্যম হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত প্লাটফর্মগুলোতে প্রতিভাত হচ্ছে মানসিক বিবর্তন, মূল্যবোধের কড়চা, প্রতি মুহূর্তের বাংলাদেশ এবং সর্বোপরি বিশ্বপরিস্থিতির অপ্রকাশিত খবরাখবরসহ সার্বিক বিষয়সমূহ উপস্থাপিত হচ্ছে এ মিডিয়ায়। এ প্লাটফর্মগুলো যেমন আমাদের সম্পৃক্ত করছে তেমনি সংক্ষুব্ধও করছে অনেক সময়। তবে এ মাধ্যমসমূহের দ্বারা সুপ্তমেধা জাগরিত করার এক সূবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে, এ কথা অতি সহজেই বলা যায়। এর মাধ্যমে মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতার ব্যাপক আশঙ্কা থাকলেও মূল্যবোধ তৈরিতেও ভূমিকা পালনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা থেকে শুরু করে বাণিজ্যবসতিতেও দারুণ প্রভাব ফেলছে এ সব ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম।
ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের নানাদিকে নানাভাবে সুস্পষ্ট ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছে এ সোশ্যাল মিডিয়াগুলো। এ সব মিডিয়ার অন্যতম প্রধান হচ্ছে ব্লগ, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, মেসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটস্আপ প্রভৃতি। এ সবের পাইওনিয়ার হচ্ছে ব্লগ। এ ব্লগ থেকেই শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জয়যাত্রা। ব্যক্তি ব্লগ থেকে কমিউনিটি ব্লগ হয়ে তা আজ রূপান্তরিত হয়েছে স্ট্যাটাস, পোস্ট, কমেন্ট ইত্যাদি নামে মাইক্রো ব্লগে রূপ নিতে শুরু করেছে। অন্য দিকে ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে যাত্রা শুরু করে বিশ্বসামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে ফেসবুক। বন্ধু সংযোজন, বার্তা প্রেরণ, স্ট্যাটাসে নিজের মতামত পেশ এবং লাইক-কমেন্টের মাধ্যমে কোন বিনোদনমূলক কিংবা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি। টুইটার বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম। ২০০৬ সালের মার্চ মাসে যাত্রা শুরু করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে এ সোশ্যাল মিডিয়াটিও। তবে টুইটার ফেসবুকের মতো এখনো তৃণমূল পর্যায়কে ফ্রেমে বেঁধে নিতে সক্ষম হয়নি।
অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে তথ্য প্রযুক্তির মাঠে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে ইউটিউব। তথ্যসম্ভার থেকে শুরু করে সাহিত্য সংস্কৃতির বিশাল ভাণ্ডারকে রপ্ত করে রেখেছে এ সামাজিক মাধ্যমটি। এ যেন হাতের মুঠোয় সাগরের উপস্থিতি।
তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার লাভ করায় লেখালেখির মেজাজ ও লেখা প্রকাশের মাধ্যমে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ইতঃপূর্বে কবি-সাহিত্যিকগণের লেখা প্রকাশের জায়গা ছিল সীমিত। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা, হাতে গোনা কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত সাহিত্যের ছোট কাগজ, বিভিন্ন দিবসে প্রকাশিত সাময়িকী, বিভিন্ন দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিক-মাসিক পত্র পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা এগুলো ছিল লেখা প্রকাশের মাধ্যম। এসব স্থানে লেখা পাঠিয়ে তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতে হতো। সম্পাদক লেখা হাতে পেয়ে তা প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করে ছাপতেন। লেখা মানসম্মত না হলে কিংবা তাদের পত্রিকার সাথে খাপ খাওয়াতে না পারলে সে লেখা প্রকাশের মুখ দেখতো না। নতুন লেখকরা অনেকটা হতাশ হয়েই থাকতেন। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ দিনে অনেক কিছুর সাথে লেখালেখিতেও অনেক পরিবর্তন ও নতুনত্ব সংযোজিত হয়েছে। আগে লেখা তৈরি হতো কাগজে ড্রাফট করার মাধ্যমে। আর এখন তা তৈরি হচ্ছে সরাসরি ফিঙ্গার টিপে কী বোর্ডে লেখার মাধ্যমে কিংবা মোবাইলের বাটন টিপে কোনো ধরনের ড্রাফট ছাড়াই সরাসরি। লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। উপর্যুক্ত প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেই পোস্ট করার মধ্য দিয়ে লেখা প্রকাশ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সাহিত্য-আশ্রয়ী ওয়েবসাইট, ব্লগ, ফেসবুক প্রভৃতি এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। ফেসবুকে ইচ্ছেমতো নিজের লেখা যে কোনো সময়ে পোস্ট দেওয়া যায়। এছাড়া ফেসবুককে ঘিরে ইদানীং অসংখ্য পেজ ও গ্রুপ তৈরি হয়েছে সেখানে সৃজনশীল লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চাকে এগিয়ে নেবার জন্য তারা প্রত্যয়দীপ্ত। ফলে লেখা প্রকাশে আর কোনো বাধা-বিঘœ পরিবেশ থাকছে না।
তবে এ কথা স্বীকার্য যে, প্রিন্ট মিডিয়া এবং অনলাইন মাধ্যমে লেখা প্রকাশের বেশ পার্থক্য আছে। প্রিন্ট মিডিয়ায় লেখা প্রকাশের আগে সম্পাদকের হাতে তা প্রয়োজনীয় পরিমার্জন সাধিত হয়ে লেখাটি মানসম্পন্ন হয়ে ওঠে। কিন্তু অনলাইন মিডিয়া বিশেষত ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কডইন, ব্লগ কিংবা অধিকাংশ পেজ বা গ্রুপে কোন সম্পাদনার ফিল্টার নেই। যা লেখা হয় তাই পোস্ট হয়ে যায়। ফলে অনেক অপরিপক্ব কিংবা লেখাই হয় না এমন লেখা এখানে প্রকাশিত হয়ে সাহিত্য জগতে ভালো কিছুর চেয়ে অখাদ্য বা আবর্জনামূলক কিছু সৃষ্টি হয় যা দেখে মানুষের সাহিত্য সম্পর্কে বিরূপ ধারণার জন্ম হতে পারে।
তবে ইতিবাচক দিক হচ্ছে এখানকার পাঠকরাই হচ্ছেন সম্পাদক। যদিও অনেকেই অখাদ্য লেখাতেই ‘বাহ দারুণ, অসাম, অসাধারণ লেখা, মাথাই নষ্ট’ প্রভৃতি নানা রকম কমেন্ট করে লেখককে বিভ্রান্ত করে থাকেন তবুও এর মধ্যে অনেক সচেতন পাঠক পর্যবেক্ষণমূলক পাঠ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকেন। পাঠকদের মধ্যে যারা ভালো জানেন তাদের গঠনমূলক মন্তব্য ও সমালোচনা লেখার মান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। মূলত এ মিডিয়ায় লেখক-পাঠক, লেখক-লেখক, লেখক-সম্পাদক মতবিনিময়ের দ্বারা তাৎক্ষণিক গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে লেখাগুলোকে মানসম্মত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারেন। কাউকে হেয় প্রতিপন্ন না করে কিংবা অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মার্জিতভাবে সংশোধনমূলক পরামর্শ দিয়ে লেখার মান সমুন্নত করতে সহায়তা করার উত্তম সুযোগ রয়েছে এখানে। সেইসাথে অনলাইনে প্রকাশিত লেখাসমূহ যে কোন মুহূর্তে যে কোন জায়গা থেকে প্রয়োজন মতো সার্চ দিয়ে ডাউনলোড দিয়ে প্রিন্ট করেও অধ্যয়নের অবারিত এবং সহজলভ্য সুযোগ রয়েছে।
সংস্কৃতি চর্চার এক অনবদ্য অবারিত ক্ষেত্র ইউটিউব। নিজেদের মতো করে অডিও ভিজ্যুয়াল তৈরি করে তা ইউটিউবে পোস্ট করার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। সেই প্রক্রিয়ায় এখন অসংখ্য গান, নাটক, কথিকা, বক্তব্য, ওয়াজ, অভিনয়, কবিতা আবৃত্তিসহ নানা বিষয়ের অডিও-ভিজ্যুয়াল এখন বিশ্বের সব মানুষের হাতের মুঠোয় অবস্থান করছে। এমনকি অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবরা-খবর যা একপেশে মিডিয়ার কারণে চাপা পড়ে থাকছে কিংবা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে তার প্রকৃত ঘটনাটিও এখানে আপলোড করে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে সংস্কৃতিচর্চার মাঠ হিসেবে অনেক বড় একটি ক্ষেত্র। তবে এ কথাও সত্য যে, যে জিনিসের ইতিবাচক দিক যত বেশি তার নেতিবাচক দিক কোন অংশে কম নয়। এমতাবস্থায় ইতিবাচক বিষয়ের চর্চা বাড়ালে নেতিবাচক বিষয়গুলো এমনিতেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে- এটাই স্বাভাবিক।
পরিশেষে বলা যায়, সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জে হেরে গেলে জাহিলিয়াত বিজয়ী হবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ জাহিলিয়াত আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসছে আধুনিকতার মোড়কে, মানবধর্মের নতুন মাত্রার মানবিক সভ্যতার স্লেøাগান নিয়ে, তথ্য প্রযুক্তির পাখায় ভর করে। এখান থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়ে কাক্সিক্ষত স্বপ্নের বিপ্লবের দিকে পা বাড়াতে হলে জাহিলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার যোগ্যতাসম্পন্ন জনশক্তি গড়ে তোলার কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। আর এসব করার মোক্ষম সময় এখনই। কারণ প্রতি মুহূর্তে আসছে নতুন নতুন আবিষ্কার, আসছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জে মুসলমানদের নৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করার জন্য অসংখ্য অজগর সাপের আগমন ঘটছে। সুতরাং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং অনলাইন মিডিয়াকে কোনোভাবেই আর অবজ্ঞা নয়, বরং এটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সঠিকভাবে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধের অনিন্দ্য সুন্দর নান্দনিকতাকে ছড়িয়ে দিতে হবে; এ জন্য আমাদের যুবসমাজকেই দাঁড়িয়ে যেতে হবে কালের সাক্ষী হিসেবে।
লেখক : কবি ও গবেষক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও
সংস্কৃতি বিভাগ, রাবি
আপনার মন্তব্য লিখুন