post

শিশুদের ডিজিটাল আসক্তি এবং উত্তরণের উপায়

শেখ মুহাম্মদ এনামুল কবির

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

একটি শিশু শুধু শিশু নয় সে পরিবারের, সমাজের সর্বোপরি দেশের সম্পদ। এই রাষ্ট্রীয় সম্পদকে রক্ষা করা আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। আজকের শিশুরাই আগামীর বাংলাদেশ। তাই তাদের যেভাবে গড়ে তুলবেন বাংলাদেশও ঠিক সেভাবে চলবে। কবির ভাষায় বলতে হয় ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সকল শিশুর অন্তরে। তার মানে হলো প্রতিটি শিশু একদিন পিতা বা মাতা হবে। শৈশবে সে যেভাবে পরিবার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে বড়ো হয়ে সে যখন পিতা বা মাতা হবে তখন সেই শিক্ষাই সে তার সন্তানদের দিবে। শিশুরা বড়োদের অনুকরণ করতে বেশি পছন্দ করে। আপনি যা করবেন সে তাই করবে। এজন্যই শিশুর সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা এবং নৈতিকভাবে শক্তিশালী করার দায়িত্ব পরিবারের। একজন শিশুর নীতি নৈতিকতা, আচার ব্যবহার কি রকম হবে তা তার পরিবারের শিক্ষার উপর নির্ভর করে। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পরিবারের দেওয়া শিক্ষাই একজন শিশু সারা জীবন লালন করে। এর পর যদিও সে অনেক বড়ো প্রতিষ্ঠানে বড়ো ডিগ্রি অর্জন করলেও পরিবারের দেওয়া শিক্ষা কখনও সে ভুলতে পারে না। যাই হোক আলোচনা ভিন্ন দিকে না নিয়ে মূল বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। ডিজিটাল আগ্রাসনের এই শিশুরাই আজ বড়ো ভিক্টিম। নিত্য নতুন ডিজিটাল গেম, ভিডিও গেমস, স্মার্টফোনের গেমস, কম্পিউটার গেমস সহ নানা ধরনের আকর্ষণীয় ডিজিটাল ডিভাইস ও অনলাইন কেন্দ্রিক গেমসগুলো শিশুদের কাছে খুবই লোভনীয়। 

এখনকার জেনারেশন খুবই ফাস্ট। আপনি বা আমি মোবাইল ফোন হাতে কবে পেয়েছি? চোখ বন্ধ করে একটু চিন্তা করুন তো। আমি প্রথম মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু করি যখন আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আমাদের আগের প্রজন্ম যারা তারাতো কেউ মধ্য বয়সে কেউ বৃদ্ধ বয়সে মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অনেকেই জন্মের আগে থেকেই মায়ের পেট থেকেই এই স্মার্টফোনের সংস্পর্শে আসছে। সেটা কিভাবে জানতে চান? ধরুন আপনার সন্তান দুনিয়া আসার সুখবর পেলেন মানে আপনার স্ত্রী গর্ভবতী। আপনার স্ত্রী যে স্মার্টফোন ব্যবহার করে তার প্রভাব তার অনাগত সন্তানের উপর পড়ে কারণ গর্ভবতী মায়ের প্রতিটা অ্যাক্টিভিটিজ গর্ভের সন্তানের উপর প্রভাব ফেলে। তো যে সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থা থেকেই এই স্মার্টফোনের সাথে পরিচিত সে তো ফাস্ট হবেই। আপনি দেখবেন মোবাইলের অনেক ফাংশন আপনি ভালো করে জানেন না কিন্তু একটি তিন বছরের শিশু আপনার থেকে অনেক অ্যাডভান্স অনেক কিছু সে জানে আপনার মোবাইলটি হাতে নিয়ে ফটাফট গেমসে ঢুকছে বা ইউটিউবে ঢুকে কার্টুন দেখছে যা দেখে আপনি পুরোপুরি বিস্মিত হন চোখ কপালে তোলেন। কয়েক বছর আগে ২০১৩ সালের দিকে যখন আমি প্রথম অ্যানড্রয়েড সেট ব্যবহার শুরু করেছি তখন আমার এক মামাতো ভাই তার বয়স মাত্র তিন বছর হবে সে আমার মোবাইলটি হাতে নিয়ে প্লে স্টোরে ঢুকে ওর পছন্দ মতো গেমস ডাউনলোড দিয়ে গেমস খেলছিলো। আমার মোবাইলে সাধারণত কোনো ধরনের গেমস থাকে না। আমি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় খেয়াল করা হয়নি মামাতো ভাই কী করছে হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম সে মোবাইলে গেমস খেলছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম সে গেমস পেলো কোথায়? প্লে স্টোর সে বলতে পারে না আমাকে প্লে স্টোরে ঢুকে দেখালো যে সেখান থেকে ডাউন লোড দিয়েছে!! চিন্তা করুন কোনটা প্লে স্টোর কিভাবে ডাউনলোড করতে হয় তা তার এই বয়সেই রপ্ত হয়ে গেছে! আর আমাদের অনেকেই আছে ডাউনলোড তো দূরে থাক প্লে স্টোর যে কি তাই বুঝি না। আমার ঐ মামাতো ভাইয়ের সাথে আপনাদের আশপাশের বা আপনার বাচ্চাদের মিলিয়ে দেখেন, দেখবেন ওর চেয়েও ফাস্ট প্রজন্ম হয়েছে এখনকার শিশুরা। একটা কথা মনে রাখতে হবে শিশুরা যা একবার দেখে তা সে সহজে মনে রাখতে পারে। আমরা শিশুদের এই প্রযুক্তিতে ফাস্ট হওয়ার বিষয়টি খুব ইনজয় করলেও সঠিক সময়ে সঠিকভাবে তাদেরকে দিকনির্দেশনা না দিলে আপনার ভবিষ্যৎ কর্ণধার এই শিশুটিই হতে পারে মারাত্মকভাবে ডিজিটাল আসক্ত একজন শিশু এবং আপনার আশা আকাক্সক্ষার এবং স্বপ্নের শিশু হতে পারে আপনার মনোকষ্টের কারণ।

আজকাল শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ উদ্বিগ্ন কারণ তাদেরকে যে সমস্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতে হয় তাদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হচ্ছে ডিজিটাল আসক্ত শিশু! কারণ মোবাইল, স্মার্টফোনসহ আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি শিশুদের আসক্তি দিন দিন বাড়ছে। অনেক অভিভাবক ইচ্ছা করেই স্মার্টনেসের নামে তাদের নাবালক সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন আপডেট ডিজিটাল প্রযুক্তি। আর এই আপডেট ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রতি তীব্র আকর্ষণ শিশু-কিশোরদের জন্য আত্মঘাতী হচ্ছে তা অনেকেই ভেবে দেখছেন না। অথচ গবেষকরা বলছেন, শৈশবে প্রযুক্তির অধিক ব্যবহার মানুষের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে ব্যাঘাত ঘটতে পারে শিশুদের সুস্থ মানসিক বিকাশে। আপনাদের বা আমার গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই নিজে যদি একটু চোখ কান খোলা রেখে আপনার আমার আশপাশে ভালো করে দেখেন তাহলে অসংখ্য শিশু কিশোর পেয়ে যাবেন যারা ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত এবং তাদের পিতা-মাতা তাদের এই আসক্তি থেকে মুক্ত করার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে আসক্তি এতো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে মা বাবা বাধ্য হয়ে তাদেরকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছেন। 

শিশুদের প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি মানসিক বিকাশে মারাত্মকভাবে প্রভাব বিস্তার করে এমনকি স্মৃতিশক্তি পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি টিভি চ্যানেল একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছে শিশুদের প্রযুক্তির আসক্তির উপর। সে রিপোর্টে বলা হয়েছে ইদানীং অনেক শিশু দেরিতে কথা বলছে তার মানে যে সময়ে তার কথা বলার কথা তা সে সময় বলতে পারছে না ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আকর্ষণের কারণে। আর একটু পরিষ্কার করলে বলে বলতে হয় যখন একটি শিশুর বেড়ে ওঠার কথা খুবই স্বাভাবিকভাবে এবং তার আশপাশের পরিবেশ প্রতিবেশ দেখে দেখে তার নিজস্ব আপন ভুবন তৈরি করে নেওয়ার কথা। এর পর একটু একটু আ আ করবে মা ডাকবে মামা বাবা ইত্যাদি শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হওয়ার কথা কিন্তু তাকে যদি ডিজিটাল ডিভাইসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ঐ ডিভাইসের রঙিন আলোক রশ্মি তাকে বেশি আকৃষ্ট করে এবং তার আশপাশের পরিবেশ প্রতিবেশ সম্পর্কে তার ধারণা হওয়ার চেয়ে ওটাকেই তার আপন এবং সাথী মনে হতে থাকে। যেহেতু ঐ ডিভাইস থেকে শুধু নির্দিষ্ট কিছু প্রোগ্রাম শিশুকে ব্যস্ত রাখে এবং সেখানে তাকে শেখানোর কোনো প্রক্রিয়া না থাকায় শিশু তার স্বাভাবিক পরিবেশ প্রতিবেশের মাঝে যাদের সাথে বা যে শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হওয়ার কথা তার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে সে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন তার স্বাভাবিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে অনেক বেগ পেতে হয় তাই অনেক শিশুর কথা বলতে দেরি হয়। তা ছাড়া অনেক শিশু স্বাভাবিক পরিবেশের সাথে খাপখাওয়াতে না পারার কারণে অটিস্টিক হয়ে যায়। শিশু মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়ে গর্ভবতী মায়ের ডিজিটাল ডিভাইস ও প্রযুক্তির প্রতি আসক্তিও সন্তানের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। 

গবেষণায় বলা হয়, গ্যাজেট ও ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর ডিভাইসগুলো ব্যবহার করার কারণে শিশুরা খুব তাড়াতাড়ি যৌনতা, সন্ত্রাস ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পায়। ফলে অনেক শিশু খুব আগ্রাসী স্বভাবের হয়। কিছু শিশু বড়ো হয়ে ভালো-মন্দ না বুঝে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েও যায়। গবেষকরা আরো বলছেন, ডিজিটাল উপকরণ আসার আগে বাচ্চারা লেখাপড়া খেলাধুলা করে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খুব দ্রুতই উন্নতি করতে পারতো। কিন্তু বেশ কয়েক বছর থেকে স্মার্টফোন, ট্যাব বা এ জাতীয় অন্য ডিভাইসে অভ্যস্ত হওয়া শিশুর লেখাপড়ায় উন্নতি খুব ধীরগতিতে হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন শতকরা ৯০ ভাগ সামর্থ্যবান শিশুর বাবা-মা-ই আজকাল কম বয়সী সন্তানের হাতে মোবাইল বা অন্য গ্যাজেট তুলে দেন। শতকরা ৯৫ ভাগ শিশুর বাবা-মা তারপর আর খবরই নেন না তাদের সন্তান রাতে কখন ঘুমায়। বাবা-মায়ের অজান্তেই বা অবহেলায় আপনি যেটা বলেন বলতে পারেন বা অতি আদরের বহিঃপ্রকাশ ফল সে যেটাই হোক শিশুর জন্য ডেকে নিয়ে আসছে অনিদ্রাজনিত অসুখ। আর এ অসুখ খুবই মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠাতে। আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে আগে শিশুরা সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে যেতো এখন রাত বারোটা বেজে যায় তারপরও শিশুদের চোখে ঘুম আসে না!

সম্প্রতি ‘দ্য অ্যামেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স ও ক্যানাডিয়ান সোসাইটি অব পেডিয়াট্রিক্সের বিজ্ঞানীরা কোন বয়সের শিশুকে কতটুকু প্রযুক্তির সংস্পর্শে নেয়া উচিত, সে সম্পর্কে পরিষ্কার একটি ধারণা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, দুই বছরের আগে শিশুদের সব গ্যাজেট থেকে দূরে রাখাই উচিত মানে কোনোভাবে তাদের ডিজিটাল ডিভাইসের সাথে পরিচিত করানো যাবে না। ওই বয়সে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, আইপ্যাড বা টেলিভিশনে অভ্যস্ত হলে শিশু স্বভাবে অস্থির হয়, অনেক ক্ষেত্রে কানে কম শুনতেও পারে। বিজ্ঞানীদের মতে, দুই বছরের পর তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের অল্প অল্প করে  শুধু ধারণা দেওয়ার জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে তবে কোনো অবস্থাতে তাদের হাতে কোনো ডিজিটাল ডিভাইস তুলে দেওয়া যাবে না। ছয়  থেকে ১২ বছর বয়সীরা দিনে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট ডিজিটাল ডিভাইস বা টিভির সংস্পর্শে গেলে ক্ষতি এড়াতে পারবে। তবে এসবে অত্যধিক অভ্যস্ত হলে অনেক শিশু অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর নানা রকমের ক্ষতিকর প্রভাব জীবনের ওপরও পড়ে। ডায়াবেটিক কিংবা হৃদরোগেরও ঝুঁকি বেড়ে যায় শিশুদের। ১৩ থেকে ১৮ বছরের শিশুদের প্রতিদিন সর্বোচ্চ এক ঘন্টা এ জিনিসগুলোর কাছে গেলে সম্ভাব্য ক্ষতি কম হবে আর মোটে না গেলে তো কোনো ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনাই থাকলো না। শিশুদের বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস বেশি ব্যবহার করার ফলে খুব কম বয়সেই অনেকে মানসিক অবসাদে ভুগতে পারে।

বর্তমানে শিশুদের উপযোগী করে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ তৈরি হচ্ছে। এসব অ্যাপস ব্যবহার করে শিশুরা সহজেই বিভিন্ন ডিভাইস পরিচালনায় পারঙ্গম হয়ে উঠার পাশাপাশি পড়ালেখা বাদ দিয়ে ঐ সমস্ত অ্যাপসে বেশি আসক্ত হয়ে পড়ছে। শিশুদের ডিভাইস ব্যবহার করতে দেওয়ার মাধ্যমে ব্যস্ত রাখার একটি ক্রমবর্ধমান প্রবণতা আজকাল বাবা-মায়েদের মধ্যে বেশ লক্ষ্য করা যায়। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে পরিচালনা করতে বিভিন্ন অডিও-ভিজ্যুয়াল ব্যবহার করছে। কিন্তু এই অডিও ভিজ্যুয়াল বাবা মায়েদের সাময়িক স্বস্তি দিলেও এর ফলে শিশুদের উপর দীর্ঘমেয়াদে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

করপোরেট যুগে বাবা মা দু’জনে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকেন। সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না অফিসের কাজে এতই ব্যস্ততা থাকে অফিসে বসে নির্দিষ্ট কাজ শেষ করতে না পেরে অনেক সময় অফিসের ফাইল বাসা পর্যন্ত নিয়ে আসতে হয়। এভাবে বাবা মা সারাদিন শেষে যখন বাসায় ফেরে সন্তানদের স্বাভাবিক দাবি থাকে তারা তাদের সাথে সময় দেবে। আবার অনেক সন্তান বায়না ধরে তার সাথে সময় কাটানোর কিন্তু কর্পোরেট যুগের অনেক বাবা মা নামের দাস-দাসীদের তখনও একটু সময় হয় না সন্তানদেরকে দেওয়ার জন্য। উল্টো কোন পার্শ প্রতিক্রিয়ার চিন্তা না করে সন্তানকে শান্ত বা ব্যস্ত রাখতে অনেক বাবা-মাই সন্তানের হাতে অ্যান্ড্রয়েড সেট বা স্মার্টফোনের কোনো ফাংশন চালু করে দিয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে যান। এভাবে শিশুদেরকে নিজ মা বাবাই ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছেন ডিজিটাল আসক্তির দিকে। আর একবার যখন এক-দুই বছর বয়স থেকেই গড়ে ওঠে এধরনের আসক্তি তা পরবর্তী সময়ে লাগাম টেনে ধরা যায় না। দিন যত যায় শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা বাড়ানো শিশুরা ক্রমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনেক মাধ্যমে তারা এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ে যে, ভয়াবহ অ্যালকোহোলের আসক্তির মতো ভয়াল এক মরণ নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে। রাত জেগে অনলাইনে পড়ে থেকে স্বাভাবিক ঘুমের বারোটা বাজাচ্ছে। এতে করে তার মনমানসিকতা খিটখিটে থাকে সমসময়। পড়া লেখায় তেমন ভালো করতে পারে না অথচ মা বাবার কতো স্বপ্ন তাকে ঘিরে! 

শিশুদের এই ডিজিটাল আসক্তি নিয়ে সম্প্রতি উত্তরা মাইলস্টোন কলেজের অধ্যক্ষ সহিদুল ইসলাম জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দেন। তিনি বলেন, শিশুর ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির সময়টুকুতে এই শহুরে জীবনযাত্রা এবং প্রযুক্তির আগ্রাসন একটি প্রাণঘাতী ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তির যে সুবিধার কথা বলা হচ্ছে তা কেবল প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের বেলায় কিছুটা উপকারভোগী হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিকৃত যৌনদৃশ্য দেখে সাধারণ জীবনে তারাও অনেকটা বেশামাল হয়ে পড়ে।

তিনি আরো বলেন, একটি স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার চেয়ে বরং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত রাখার জন্য তাদের হাতে ফোন তুলে না দিয়ে বরং এর পরিবর্তে তাদের উচিত সন্তানদের দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচিতে অংশ নিতে উৎসাহিত করা। 

আমি এই বইয়ের শুরুর দিকে উল্লেখ করেছি যে, বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ১ লাখ ৭৫ হাজার শিশু নতুন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। তার মানে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন শিশু প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট জগতে প্রবেশ করছে। অনলাইন জগতে এতো বিপুল সংখ্যক শিশুদের প্রবেশাধিকার যদি কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া হয় তাহলে এরাই হতে পারে সাইক্রাইমের শিকার বা শিকারি। তাই প্রত্যেকটি শিশুকে এই সাইবার ক্রাইম থেকে বিরত রাখা এবং এর ভিকটিম হওয়ার হাত থেকে তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব প্রতিটি মা বাবার পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের।

ডিজিটাল আসক্তির ফলে শিশুর কী কী ক্ষতি হয়?

এতক্ষণের আলোচনা থেকে আমাদের কাছে পরিষ্কার একটি ধারণা হয়েছে যে ডিজিটাল আসক্তি আমাদের শিশু, কিশোর কিশোরীদের কী ভয়াবহ শারীরিক মানসিক এবং সর্বোপরি তার বেড়ে ওঠায় কত মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। একনজরে আমরা দেখে নেই কী কী ক্ষতি হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের।

- শিশুর অধিক আসক্তির ফলে অনিদ্রার দেখা দেবে। নিয়মিত ঘুম না হলে শরীরের উপর এর প্রভাব পড়ে।

- নিয়মিত ঘুম না হলে শিশু নিয়মিত খেতেও চাইবে না। নিয়মিত না খেলে শরীর ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে যাবে।

- সময়মতো খাদ্য না খেলে শরীর অপুষ্টিতে ভুগবে এবং অপুষ্টিজনিত রোগের ভুগতে পারে।

- একটানা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ফলে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হতে পারে।

- অনেকক্ষণ একই জায়গায় বসে এ সমস্ত ডিভাইসে মগ্ন থাকলে স্থুলতা তথা শিশু অতিরিক্ত মোটা হয়ে যেতে পারে। 

- অল্প বয়সেই ঘাড়ে, পিঠে এবং কোমরে ব্যথা হতে পারে।

- একবার আসক্ত হয়ে গেলে শিশু প্রচণ্ড জেদি হবে এবং ক্রমান্বয়ে অসামাজিক হয়ে পড়বে।

- কোনো অবস্থাতে সে পড়ালেখায় মন বসাতে পারবে না।

- অতি বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা, হতাশা এবং তীব্র মানসিক চাপের মতো মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে।

- শিশুদের অতিমাত্রার আসক্তি বাইপোলার ডিজঅর্ডার মুডের মতো গেমিং ডিজঅর্ডার মুড হওয়ার প্রবণতা প্রবল হতে পারে।

- বিভিন্ন অ্যাপস, ইন্টারনেট এবং গেমসের বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে আচরণ পরিবর্তিত হতে পারে। আচরণে আগ্রাসী ভাব দেখা দিবে অল্পতে রেগে যাবে।

- শিশু মারাত্মকভাবে আইসোলেটেড হবে অর্থাৎ সামাজিকতা বা অন্যের সাথে বিশেষ করে বয়স্কদের সাথে সে কোনোভাবে খাপ খাওয়াতে পারবে না।

উপরের বিষয়গুলো ছাড়াও আরও নানা ধরনের পাশর্^প্রতিক্রিয়া একজন আসক্ত শিশু বা কিশোরের মধ্যে হতে পারে। আমি বিভিন্ন সাময়িকী এবং পত্রিকার পাশাপাশি কিছু বাস্তব চিত্র থেকে উপরের পয়েন্টগুলো তুলে ধরেছি।

শিশুদের ডিজিটাল আসক্তি থেকে বাঁচাতে

আমাদের করণীয় কী?

উপরে এতক্ষণ আমরা শিশুদের ডিজিটাল আসক্তিতে জড়িয়ে পড়া, এর ক্ষতিকর দিকগুলো কী কী হতে পারে এবং কিভাবে তারা ডিজিটাল মায়াজালে আটকে যায় তা বলার চেষ্টা করেছি। এখন আমরা শিশুরা যদি একবার এই ভয়াবহ আসক্তিতে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে তখন অভিভাবক বা গার্ডিয়ান হিসেবে আমাদের কী কী করণীয় হতে পারে বা কোন ধরনের পদক্ষেপ নিলে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারবো ডিজিটাল মায়াজাল থেকে।

এক. কোনো অবস্থাতে শিশুর হাতে মোবাইল তুলে দেওয়া যাবে না

অনেক মা-বাবা শিশুকে শান্ত করতে তাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেন। এটি কোন অবস্থাতে করা যাবে না। শিশুরা জন্মের পর থেকেই ডিজিটাল ডিভাইস সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে শুনে বা ধারণা নিয়ে মাতৃগর্ভ থেকে দুনিয়াতে আসে না। এই শিশুদের কে শিখিয়ে দেয় যে এটার নাম মোবাইল ওটার নাম টিভি ওটার নাম স্মার্টফোন? আমরাইতো এ সমস্ত ডিভাইসগুলোর সাথে তাকে পরিচিত করে তুলি তাই না? তাই যখন আপনি আপনার শিশুকে এ সমস্ত ডিভাইসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন আপনাকে অবশ্যই সচেতনতার সাথে বিষয়টিকে সামলাতে হবে। আমরা অনেকেই অতি অল্প বয়সে শিশুর কানের কাছে মোবাইল নিয়ে তাদের বলতে বলি “হ্যালো বলো হ্যালো বলো” তারা খুব আনন্দের সাথে তা বলার চেষ্টা করে এবং আমরা তা উপভোগ করি। আর এভাবেই সে ফোনের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে এরপর বাবা মা তার সামনে ফোন নিয়ে যেভাবে কথা বলে সেও মাঝে মাঝে ওভাবে কানের কাছে নিয়ে দেখবেন আধো আধো বোল দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে। এমন মনকাড়া দৃশ্য দেখে আমাদের মনে এক চিলতে আনন্দঘন অনুভূতি খেলে যায় আমরা উল্লসিত হই। আমরা দেদার তাদের সামনে ফেসবুকিং করছি, ইউটিউব দেখছি ফোনে কথা বলছি। শিশুরা যেহেতু অনুকরণপ্রিয় তাই তারা দেখে দেখে আমাদের অনুকরণ করছে। এজন্য আমাদের প্রত্যেকের সচেতনতার সাথে ডিজিটাল ইকুইপমেন্ট বা গেজেট ব্যবহার করতে হবে। দীর্ঘ সময় ফোনে কথা বলতে হলে শিশুদের থেকে দূরে সরে কথা বলার চেষ্টা করা এবং এমনভাবে মোবাইলফোন ব্যবহার করা উচিত যাতে করে কোনো অবস্থাতেই শিশুর আপনার মোবাইলের প্রতি বিন্দু পরিমাণ কৌতূহল তৈরি না হয়। আপনি কখনো শিশুকে কান্নাকাটি করলে কান্না থামানোর জন্য মোবাইল হাতে তুলে দিবেন না। আমাদের অনেকেই নিচের এই ভুলটি করে থাকি। 

রাফসান একটি ফুটফুটে শিশু দারুণ চঞ্চল। সারাদিন তার চঞ্চলতায় পুরো বাড়ি মুখরিত থাকে। রাফসানের একটুখানি খুশির ঝলকে বাড়ির সবাই খুশি। তাই মা-বাবা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে রাফসান কী করলে খুশি হবে তা করার জন্য। কোনো অবস্থাতেই সে যাতে মনে কষ্ট না পায় সেদিকে তার মা-বাবাসহ বাড়ির প্রত্যেকের নজর। বাড়িতে খেলনার কোনো অভাব নেই। আর আট দশটা শিশুর মতো রাফসানের খাবার খেতে প্রচুর আপত্তি। তার এই আপত্তিতে চিন্তার ভাঁজ পড়ে বাড়ির সবার। তবে তার বাবা মার একটু বেশিই চিন্তা হয় বিষয়টি নিয়ে। তাকে খাওয়ানোর জন্য তার বাবা-মা অস্থির হয়ে পড়ে। অনেক প্রচেষ্টার পর রাফসানকে যখন খাওয়ানো যাচ্ছেই না তখন মা মোবাইলে কার্টুন চালিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করে রাফসান খায় কি না তা দেখার জন্য। এবার ছেলে কার্টুন দেখছে আর তালে তালে কয়েক লোকমা খাচ্ছে। মা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যাক অবশেষে ছেলেকে খাওয়ানোর উপায় সে পেয়ে গেছে!! এখন প্রতিনিয়ত মা কার্টুন ছেড়ে দিয়ে রাফসানকে মনের সুখে খাওয়ান আর হিসাব কষেন যাক বাবা, এভাবে রাফসানকে খাওয়াতে তার আগের চেয়ে অনেক সময় কম লাগছে এবং সে কিছু সময়ও বাঁচিয়ে অন্য কাজে মনোযোগ দিতে পারছে! কী ভাবছেন আপনারা রাফসানের মা খুব বুদ্ধিমতীর মতো কাজটি করছে তাই না? আসলে কি তাই? কিছুদিন পর রাফসানের মা খেয়াল করে দেখে যে তার রাফসান খাওয়ার সময় বাদেও নিজে নিজে কার্টুন চালিয়ে দেখছে। আগের মতো প্রাণ উচ্ছলতা নেই সারাক্ষণ শুধু মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে তাকিয়ে কার্টুন দেখছে আর একা একা হাসছে। তার কাছ থেকে মোবাইলটা প্রয়োজনে কারো সাথে কথা বলার জন্য নিয়ে নিলেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে!! এমনকি রাফসান অপরিচিত কাউকে দেখলে প্রচুর চিৎকার করছে। রাফসান আগে যে আধো বোলে তার মা বাবাকে ডাকতো তাও ডাকছে না। চিন্তায় তার মা বাবা দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসকের নিকট নেওয়ার পর চিকিৎসক প্রথমে কোন সমস্যা শনাক্ত করতে পারেনি। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় স্পিচ অ্যান্ড থেরাপি সেন্টারে সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যা বলা হয় তা শোনার জন্য রাফসানের বাবা মা কখনো প্রস্তুত ছিলো না। অতিরিক্ত মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রাফসানের স্ক্রিন আসক্তি তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয় তার মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা দিয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘অটিজম স্পেকটার্ম ডিজঅর্ডার’। আর এ কারণে রাফসান যে আধো আধো বোলে তার বাবা মাকে ডাকতো এখন তা আর ডাকছে না! এটি কোন গল্প নয় বাস্তব একটি ঘটনা। পিতা-মাতার একটু সচেতনতার অভাবে প্রাণবন্ত রাফসান আজ অটিজমের পথে। হয়তো সঠিক চিকিৎসায় সে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। রাফসানের বাবা মা শিক্ষিত বলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু যারা শিক্ষিত না তারা তাদের ক্ষেত্রে এর বিপরীত ঘটনাও ঘটছে। এ রকম হাজারো রাফসান আজ আমাদেরই ভুলের কারণে ডিজিটাল আসক্তিতে নিমজ্জিত হয়ে জীবন বিপন্ন করছে।

দুই. অবসর সময়ে শিশুকে সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখুন

অবসর সময়ে শিশুদের বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখতে মা বাবাকে ভূমিকা রাখতে হবে। নবী-রাসূলদের জীবনী, সাহাবাদের জীবনীসহ বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান অর্জনের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা, শারীরিক ফিটনেসের জন্য খেলাধুলা করতে উৎসাহ দিন। ফুলের বাগান করা সেগুলো পরিচর্যা করা শিখাতো পারেন। সাঁতার কাটা, বাইসাইকেল চালানো শেখাতে পারেন। বিভিন্ন দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরতে নিয়ে যান। মানে আপনাকে একজন দক্ষ শিক্ষকের মতো আপনার সন্তানকে খুব সতর্কতার সাথে তাকে গাইড করতে হবে। তাকে আস্তে আস্তে কুরআন তিলাওয়াত শেখান। কুরআনের প্রতি তার আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য কী কী করা যায় তা আপনি করুন। ছোট ছোট সূরাগুলো মুখস্থ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। নিত্যপ্রয়োজনীয় ছোট ছোট দোয়া ও মাসয়ালা মাসায়েলগুলো শেখান। অবসর সময়ে আপনি তাকে মুখস্থ সূরার, দোয়া এবং মাসয়ালা মাসায়েলের মৌখিক পরীক্ষা নিন। মুখস্থ করার প্রক্রিয়াটা যেন আনন্দদায়ক হয় আপনার শিশু যেন পড়া মুখস্থ করতে নিজ  থেকে আগ্রহ পায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। প্রয়োজনে তাকে উৎসাহিত করতে গিফটের ব্যবস্থা রাখুন। তার চিন্তার জগতে কিছু চিন্তার খোরাক পায় এমন কিছু তার সাথে করুন। বুদ্ধি ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কিছু গাণিতিক ধাঁধা খেলুন। বড়োদের সম্মান করতে ও ছোটদের আদর সোহাগ এবং সমবয়সীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে মোটিভেশন চালান। অন্যধর্মের প্রতি এবং অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শিখান। মোট কথা একজন পরিশীলিত মানুষ হিসেবে তাকে গড়ে তোলার বীজটি আপনাকেই বপন করতে হবে। শিশুদের মন একে বারে কাদামাটির মতো আপনি এ বয়সে যা শিখাবেন সে তা সারাজীবন মনে রাখবে।

তিন. শিশুকে প্রচুর সময় দিন

এখনকার বেশির ভাগ মা-বাবা চাকরিজীবী বা কর্মজীবী। চাকরি বা কর্মের ব্যস্ততার কারণে মা বাবারা সন্তানকে সময় দিতে না পেরে তাদের হাতে মোবাইল বা ডিজিটাল গেজেট তুলে দেন সময় কাটানোর জন্য। আগেই বলেছি মা-বাবা শিশুকে শান্ত করার জন্য বা তাদের সময় বাঁচানোর জন্য যখনই এই ডিভাইসগুলো শিশুর হাতে তুলে দিবেন তখনই তারা তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিলেন। আস্তে আস্তে তারা স্ক্রিন আসক্ত হয়ে পড়ে একটা সময় এই শিশু যখন একটু বড়ো হয় তখন তারা আর বাবা মায়ের কথা শুনতে চায় না। মনে রাখবেন আপনার দরদমাখা একটু আলতো হাতের স্পর্শ শিশুকে অনেক সজীব এবং প্রাণবন্ত করে তোলে। আপনার মুখের আব্বু শোনা বা আম্মু শোনা ডাক তার ধমনিতে শিহরণ জাগায়। আর আপনি যদি তাকে গুরুত্ব দিয়ে একটু সময় তাকে দেন তাহলে তার হৃদয়টা প্রসারিত হয়। শিশুরা ছোট থাকতেই অনেক বুদ্ধিমান ও সার্প ব্রেনের হয়। আপনি তাকে কতটুকু ভালোবাসছেন কতটুকু তাকে মূল্যায়ন করছেন সে সবকিছুই বুঝতে পারে। আমাদের কাছে মনে হতে পারে ওরা খুবই ছোট ওদের এখনও বোঝার সময় হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আপনি যখন আপনার শিশুকে সময় দিবেন এবং তাকে বুঝতে চেষ্টা করবেন দেখবেন আপনার শিশু সন্তানটি কতটা প্রাণবন্ত থাকে। আপনার সন্তানের সাথে আপনি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন। সে যেন নির্ভয়ে আপনার কাছে তার সকল জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পায় এবং আপনি তার সকল প্রশ্নের বুদ্ধিবৃত্তিক তথ্যবহুল তার উপযোগী করে উত্তর দিন। এমন যেন না হয় যে আপনার শিশু আপনার কোনো আচরণে মনে করে যে আপনি আপনার সন্তানকে উপেক্ষা করছেন। এ রকমটি হলে কী ধরনের সর্বনাশ আপনি বয়ে নিয়ে আসছেন তা নিজেও জানেন না। এ প্রসঙ্গে একটি ছোট নাটিকার কথা মনে পড়ে গেলো। যে নাটিকাটি আপনারা ফেসবুক বা ইউটিউবে সবাই দেখেছেন। একটি ছোট মেয়েকে তার স্কুলের শিক্ষিকা জিজ্ঞেস করলেন সে বড়ো হয়ে কী হতে চায়? তার উত্তর ছিলো যে সে বড়ো হয়ে স্মার্টফোন হতে চায়। তার এ উত্তরে অন্য শিশুরা হাসাহাসি করলেও ঐ শিক্ষিকা বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার কাছে জানতে চাইলেন কেন সে স্মার্টফোন হতে চায়? উত্তরে ছোট্ট শিশু মেয়েটি যা জানালো তা শোনার জন্য ঐ শিক্ষিকা কোন মতেই প্রস্তুত ছিলেন না। শিশু মেয়েটি তার শিক্ষিকাকে জানায় যে, তার মা-বাবা দুজনেই স্মার্টফোন নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকে, অফিসে গেলে স্মার্টফোন নিয়ে যায় আবার বাসায় এসেও স্মার্টফোন হাতে থাকে। তাকে একটুও আদর করে না, স্মার্টফোনে ঠিকমতো চার্জ দেয় কিন্তু তাকে ঠিকমতো খাবার দিতেই ভুলে যায় তার মা! এমনকি তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে না থেকে স্মার্টফোন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে! সে কোলে উঠার জন্য কান্না করলে তাকে দূরে ঠেলে দেয় কিন্তু স্মার্টফোনের রিংটোন বাজলে দৌড়ে যেয়ে তা রিসিভ করে! আর এ সব কারণে সে স্মার্টফোন হতে চায়। স্মার্টফোন হলে তার মা বাবা তাকে স্মার্টফোনকে যেভাবে ভালোবাসে তাকেও সে রকম ভালো বাসবে! এ প্রশ্নের উত্তর শুনে শিক্ষিকা প্রচণ্ড আহত হন। যদিও একটি নাটিকা কিন্তু ঐ নাটিকার মাধ্যমে আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বাবা-মায়ের সন্তানকে অবহেলার কারণে এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে যারা স্মার্টফোন বা অন্য কিছু হতে চান। আপনি যদি আপনার সন্তানকে স্মার্টফোনের আসক্তিতে হোক বা চাকরি বা কর্মজীবনের ব্যস্ততায় হোক সময় না দেন ঠিক ঐ নাটিকার শিশুর মতো আপনার সন্তান হৃদয়ের ভিতর হাহাকার নিয়ে বেড়ে উঠবে।

চার. শিশুকে মনিটরিংয়ের আওতায় রাখুন

আপনার সন্তানকে আপনি নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখুন। বর্তমানে অনলাইন ক্লাসসহ নানা কারণে আপনার সন্তানকে ডিজিটাল ডিভাইস এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ কাজে যখন শিশুদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার শেষে তার কাছ থেকে তা নিয়ে নিন। আপনার সন্তান মোবাইলে কোন কোন অ্যাপস বেশি ব্যবহার করছে এবং তার প্রতি বিশেষ মনোযোগ তা খেয়াল রাখুন। প্রয়োজনে ঐ অ্যাপস মোবাইল থেকে ডিলিট দিয়ে দিন। এতে আপনার সন্তান ঐ বিশেষ অ্যাপস না পেয়ে ধীরে ধীরে মোবাইলের প্রতি আকর্ষণ হারাবে। পড়ার সময়, খেলার সময়, ঘুমানোর সময় সন্তানের হাতে মোবাইল তুলে দিবেন না। একটু বড়ো যারা তাদেরও আপনার তীক্ষœ নজরদারির মধ্যে রাখুন। তারা  কোথায় যায় কার সাথে ওঠা বসা করে তা পর্যবেক্ষণ করুন।

পাঁচ. পারিবারিক সময়ে মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ করুন

আজকাল প্রায় প্রত্যেক বাসায় গেলে দেখা যায় প্রত্যেকে তার রুমে তার হাতের স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত আছে। বাসায় কোনো মেহমান গেলে তার কাছে মনে হয় সে যেন কোনো এক অজানা অচেনা পরিবারে এসেছে। যেখানে আগে আমরা ছোট সময়ে বাসায় মেহমান আসলে বাসার ছোটরা গোল হয়ে তার পাশে বসে থাকতাম। নতুন নতুন গল্প শুনতাম পুরো বাড়িতে শিশু-কিশোরদের মাঝে একটা উৎসব উৎসব আমেজ বিরাজ করতো। আমাদের মা-বাবারাও মেহমান থাকাকালীন সময়ে মেহমানের সাথে সময় দিতে উৎসাহ জোগাতো তার আদর আপ্যায়নের জন্য শিশুরাই বেশি ভূমিকা পালন করতো। আর এখন তা অতীত স্মৃতি ছাড়া কিছুই না। মানুষ আজকাল ডিজিটালাইজেশনের ফলে এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে যে বাসায় কে আসলো আর কে গেল তা নিয়ে শিশুদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। এমনকি তাদের অনেকেই বোঝে না কিভাবে মেহমানদের সাথে ব্যবহার করতে হবে। কিভাবে হবে যেখানে বড়োদেরই অবস্থা অত্যন্ত করুণ সেখানে শিশুরাতো তাদেরই অনুসরণ করছে। আমরা প্রায় সময় নিজেরাই মোবাইল একটা কানে ধরে কথা বলতে বলতে বাসায় ঢুকি। আর বাসায় ঢুকে দেখি স্ত্রী সন্তানেরা যে যার মতো করে তাদের স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত আছে! এমন পরিস্থিতি যদি আমি নিজেই তৈরি করে রাখি তাহলে অন্যরাও উৎসাহিত হবে ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তাই আমাদের প্রতিটি পরিবারে পারিবারিক সময় নির্ধারণ করা খুবই জরুরি। অর্থাৎ বাসার সবাই যখন বাসায় থাকবে তারা অতীব প্রয়োজনীয় ছাড়া কোনো ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবে না। তাই পারিবারিক সময়ে সব ধরনের ডিভাইস ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। প্রতিদিন বাসার সবাই মিলে পারিবারিক বৈঠক করা যেতে পারে। যে বৈঠকে বাড়ির কর্তাব্যক্তি প্রত্যেকের সারাদিনের কাজের পর্যালোচনা করবে যারা ভালো কাজ করবে বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে তাদেরকে পুরস্কার দিয়ে অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে। আর কোনো ধরনের দোষ ত্রুটি করলে সুন্দরভাবে তাকে সংশোধন করবে। বাড়ির বড়োরা ছোটদের সময় দিবে। তাদেরকে তাদের পারিবারিক ইতিহাস ঐতিহ্য শেখাবে। মোট কথা পারিবারিক বৈঠক এবং বাসার পরিবেশটা এমন আকর্ষণীয় বন্ধুত্বপূর্ণ করতে হবে যাতে শিশুরা মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করা থেকে পরিবারের এ সময়টা এবং পারিবারিক বৈঠকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে।

ছয়. সবার জন্য ডিভাইস ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিন

যেহেতু আমরা ডিজিটাল সময়ে বাস করি তাই বিভিন্ন প্রয়োজনে ডিজিটাল ডিভাইস করা থেকে একেবারেই আমরা নিজেদের বিরত রাখতে পারবো না। আমাদের সন্তানরাও পারবে না এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা যেটা পারবো তাহলো সন্তানদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করার সময়সীমার নিয়ন্ত্রণ করতে। শিশুদের ক্ষেত্রে কে কতটুকু সময় মোবাইল ফোন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইউটিউব ব্যবহার করতে পারবে তার সময় বেঁধে দেওয়া খুবই জরুরি। শুধু সময় বেঁধে দিলে হবে না তা কার্যকর হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করুন।

সাত. শিশুদের খেলাধুলার প্রতি উৎসাহিত করুন

শিশুরা ডিজিটাল আগ্রাসনের ফলে খেলাধুলা ভুলতে বসেছে। ডিজিটাল আগ্রাসনের পাশাপাশি শহর এলাকায় পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকায় বাধ্য হয়ে অনেক শিশু-কিশোররা মোবাইল, কম্পিউটার ল্যাপটপে ভিডিও গেমসের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। সবকিছু মাথায় রেখে আপনার শিশুকে কিভাবে আউটডোর অ্যাক্টিভিটিজের সাথে সম্পৃক্ত করা যায় তা নিয়ে আপনার এখনই ভাবা উচিত। কারণ খেলাধুলা শিশুদের সুস্থ শারীরিক গঠন ও বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আপনার বাসার পাশে কোনো খেলার মাঠ না থাকলে শিশুদের স্কুলে বা যেখানে আছে সেখানে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। প্রতিদিন কষ্ট হলে একদিন পর একদিন যান তার পরও যান। এতে আপনার অনেক লাভ কারণ আপনার শিশু সুস্থতার সাথে সঠিক শারীরিক গঠন নিয়ে বেড়ে উঠবে। দীর্ঘক্ষণ ঘরে বসে মোবাইলে বা কম্পিউটারে  ভিডিও গেমস খেলে স্থূল হওয়া থেকে বেঁচে যাবে এবং হার্ট ভালো থাকবে আপনার সন্তানের।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির