post

শুরু হলো অ্যাপলের নিজস্ব প্রসেসরের যুগ

আহমেদ ইফতেখার

১৩ ডিসেম্বর ২০২০

বিশ্বের জনপ্রিয় প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাপল’ বহু প্রতীক্ষিত এম১ প্রসেসরচালিত কম্পিউটারের ঘোষণা দিলো। যদিও গত ১০ নভেম্বর ওই ঘোষণায় অ্যাপলপ্রেমীদের তৃষ্ণা পুরোপুরি মেটেনি। নিজস্ব প্রসেসরযুক্ত পুরো লাইনআপের ঘোষণা দেয়নি মার্কিন এই প্রযুক্তি জায়ান্ট, বরং আপাতত স্বল্প ক্ষমতার ম্যাকবুক এয়ারেই নতুন প্রসেসরের স্বাদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে ম্যাক ব্যবহারকারীদের। ম্যাকবুক এয়ার ক্রেতাদের জন্য অন্য কোনো সুযোগ রাখেনি অ্যাপল। ডিভাইসটি শুধু এম১ চিপ চালিত। এটির কোনো ইনটেল চিপ সংস্করণ পাবেন না তারা। ‘ওয়ান মোর থিং’ আয়োজনে নিজস্ব এম১ চিপ চালিত ম্যাকবুক এয়ার, ১৩ ইঞ্চি ম্যাকবুক প্রো দেখিয়েছে অ্যাপল। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটারগুলোকে এখনও নিজেদের নতুন চিপের আওতায় আনেনি প্রতিষ্ঠানটি। নিজেদের ১৬ ইঞ্চি ম্যাকবুক প্রো, আইম্যাক, আইম্যাক প্রো এবং ম্যাক প্রোতে এখনও ইনটেল চিপ ব্যবহার করছে তারা। ২০০৫ সাল পর্যন্ত অ্যাপল নিজস্ব ‘পাওয়ারপিসি’ প্রসেসর ব্যবহার করেছে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি তাদের কম্পিউটারে ইনটেল প্রসেসর ব্যবহার করতে শুরু করে। সে হিসেবে প্রায় দেড় দশক ধরে অ্যাপল ডিভাইসে রয়েছে ইনটেল চিপ। ক্রেতারা চাইলে ১৩ ইঞ্চি ম্যাকবুক ও ৫১২ গিগাবাইটের ম্যাক মিনির চিপ যাতে পাল্টে নিতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রেখেছে অ্যাপল। কিন্তু সে কাজটি করতে খরচ একটু বেশি পড়বে। এম১ চিপ চালিত ১৩ ইঞ্চি ম্যাকবুক প্রো পাঁচশ ডলার কমে, এবং মিনি দুইশ ডলার কমে কেনার সুযোগ পাবেন ক্রেতারা। কিন্তু ইনটেল চিপ চালিত সংস্করণ কিনলে সে সুযোগ থাকছে না ক্রেতাদের হতে। ইনটেল চিপ চালিত ১৩ ইঞ্চি ম্যাকবুক প্রো ও ২৫০ গিগাবাইট ম্যাক মিনি সংস্করণে অতিরিক্ত থান্ডারবোল্ট পোর্ট পাবেন ক্রেতারা। এটি বাদেও কিছু পার্থক্য চোখে পড়বে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটারগুলোকে নিজেদের নতুন চিপের আওতায় কবে নাগাদ আনবে, সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি অ্যাপল কর্তৃপক্ষ।

কেন অ্যাপল সরে আসছে ইনটেল চিপ থেকে আমরা ফিরে যাই ২০০৫ সালে। যেখান থেকে অ্যাপল কম্পিউটারের সঙ্গে ইনটেল প্রসেসরের ‘দাম্পত্য জীবন’ শুরু। অ্যাপল প্রতি বছর কয়েকটি নিয়মিত আয়োজন করে থাকে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়োজন হলো ডব্লিউডব্লিউডিসি বা ওয়ার্ল্ডওয়াইড ডেভেলপার্স কনফরেন্স। এই আয়োজনটিতে অ্যাপল সাধারণত সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশনের ঘোষণা দিয়ে থাকে। তবে, মাঝে মধ্যে হার্ডওয়্যারের ঘোষণাও যে এখান থেকে আসে না তা নয়। ২০০৫ সালের ডব্লিউডব্লিউডিসিতে সে সময়ের অ্যাপল সিইও স্টিভ জবস এমন একটি হার্ডওয়্যার ঘোষণা দেন যেটি সফটওয়্যারের বেলায় অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ছিল- অ্যাপল ভবিষ্যতের কম্পিউটারের জন্য নিজস্ব ‘পাওয়ারপিসি’ প্রসেসর থেকে ইনটেল প্রসেসরে চলে যাচ্ছে। দেড় দশক আগে সে সময় স্টিভ জবস ইনটেল প্রসেসরে চলে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণ দেখিয়েছিলেন, আজ সেই কারণটিই ইনটেল থেকে সরে আসার পেছনে কাজ করেছে। আসুন দেখে নেই সেটিসহ অন্য বিষয়গুলো-

পারফরম্যান্স পার ওয়াট একটি প্রসেসরের কার্যক্ষমতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ তবে তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ওই কার্যক্ষমতা কতো কম বিদ্যুৎ খরচে পাওয়া সম্ভব- এমনটাই বলেছিলেন স্টিভ জবস ২০০৫ সালে। ম্যাক কম্পিউটারে ইনটেল প্রসেসর ব্যবহারের পেছনে সে সময় সবচেয়ে বড় যুক্তি ছিল এটাই। স্টিভ জবসের ভাষায় এটা ‘নট ওনলি পারফরম্যান্স বাট পারফরম্যান্স পার ওয়াট’। সে সময়ে ওয়াট প্রতি কার্যক্ষমতার প্রশ্নে পাওয়ারপিসি প্রসেসরের তুলনায় ইনটেল এগিয়ে ছিল, ফলে অ্যাপল নিজের প্রসেসর বাদ দিয়ে ইনটেল প্রসেসরে চলে যায়। আমরা আপনাদের জন্য অসম্ভব ভালো পণ্যের আইডিয়া নিয়ে বসে আছি কিন্তু পাওয়ার পিসি প্রসেসরের কাঠামো ব্যবহার করে এগুলো বানানো সম্ভব নয়। সে সময় বলেছিলেন অ্যাপল সহপ্রতিষ্ঠাতা। আজ দেড় দশক পরে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ২০২০ সালে এসে অ্যাপল যে ধরনের, যে কার্যক্ষমতার কম্পিউটার তৈরির পরিকল্পনা করছে সেগুলি প্রচলিত ইনটেল প্রসেসর ব্যবহারে তৈরি সম্ভব নয় বলেই দাবি প্রতিষ্ঠানটির। ১০ নভেম্বরের আয়োজনেও সেই সুর মিললো অ্যাপলের উপস্থাপনায়। অ্যাপল বলছে প্রচলিত ইনটেল কোয়াড কোরের বদলে অ্যাপল অক্টাকোর প্রসেসর ব্যবহার করবে ম্যাক কম্পিউটারে যার কার্যক্ষমতা হবে ইনটেলের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিন গুণ! ২০১৩ সালেই যখন এআরএমভিত্তিক সিস্টেম-অন-এ-চিপ প্রসেসরে টাচ কন্ট্রোলার, ওয়্যারলেস মডেম একই চিপে আনা সম্ভব হয়েছে, তখনও ইনটেল চিপ ব্যবহার করলে ওইসব কাজের জন্য আলাদা প্রসেসরের দরকার পড়েছে। ফলে, মোবাইল ডিভাইসের আকার ছোট করে আনা বা প্রসেসরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যটারির আকারের প্রশ্নে পেছনে পড়ে যায় ইনটেল প্রসেসর। এদিকে যতো দিন যাচ্ছে ততোই মানুষের কাজের ধরন হয়ে উঠছে মোবাইল ডিভাইস নির্ভর। ফলে ব্যাটারি লাইফ এবং পণ্যের আকার ছোট রাখার সামর্থ্য হয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাপল বছরের পর বছর ধরে নিজেদের আইফোন এবং আইপ্যাডের জন্য সিস্টেম-অন-এ-চিপ প্রসেসর তৈরি করে আসছে যেটিকে অ্যাপল বলছে ‘এ সিরিজ’ চিপ। এতদিন ধরে এ সিরিজ চিপ তৈরির অভিজ্ঞতা অ্যাপল এখন কাজে লাগাচ্ছে এম সিরিজের পেছনে। অ্যাপল ইকোসিস্টেম এই প্রথমবারের মতো এআরএমনির্ভর এম সিরিজ প্রসেসরের কারণে আইফোন এবং আইপ্যাডের অ্যাপ এখন কোনোরকম আলাদা সংস্করণ তৈরি ছাড়াই সরাসরি ম্যাক কম্পিউটারে চালানো যাবে। এর মাধ্যমে অ্যাপল যে প্ল্যাটফর্ম ইকোসিস্টেমের জন্য অনেক আগে থেকেই পরিচিত, সেই চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর শেষ ধাপে সম্ভবত পৌঁছে গেল প্রতিষ্ঠানটি। আইফোন, আইপ্যাডের আইওএস এবং ম্যাক ওএস একই প্ল্যাটফর্মে চালানোর সক্ষমতা এখন পাচ্ছে অ্যাপল যেটি একাধিক ধরনের প্রসেসরে সম্ভব নয়। আইওএস ল্যাপটপ? এআরএম-নির্ভর প্রসেসর হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে আইওএস চালিত ল্যাপটপও বাজারে চলে আসা অসম্ভব নয়। প্রযুক্তি সম্মেলন ‘অল থিংস ডিজিটাল’ এর উদ্যোক্তা ওয়াল্ট মসবার্গ তো এ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেই বসেছেন অ্যাপলের নিজস্ব প্রসেসরে ফেরত যাওয়ার ঘোষণায়। লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির