post

সংগঠন জনশক্তির মানোন্নয়নে দায়িত্বশীলের ভূমিকা

আব্দুল্লাহ আল নোমান

১০ জুন ২০২৪

ভুমিকা

আল্লাহ তায়ালা বলেন, اِ۟لَّذِیْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَ الْحَیٰوةَ لِیَبْلُوَكُمْ اَیُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلًا١ؕ وَ هُوَ الْعَزِیْزُ الْغَفُوْرُۙ

কাজের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কে উত্তম তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল। (আল-মুলক, আয়াত : ২)

অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা মানুষের মৃত্যুর নির্ধারিত সময় দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। এই সময়টুকুতে মানুষ ইচ্ছে করলে তার নফসের গোলামি করে সময় শেষ করে দিতে পারে, আবার মহান রবের বিধানকে সামনে রেখে তার দুনিয়ার নির্ধারিত সফর শেষ করতে পারে। তবে এই দুই শ্রেণীর ব্যক্তির ব্যাপারেই আল্লাহ তায়ালা বলেন,  

فَاَلْهَمَهَا فُجُوْرَهَا وَ تَقْوٰىهَا۪ۙ

মানুষের মধ্যে আমি সীমালঙ্ঘন ও তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য দিয়ে দিয়েছি। (আশ-শামস, আয়াত : ৮)

قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰىهَا۪ۙ

নিঃসন্দেহে সফল হয়ে গেছে সেই ব্যক্তি, যে নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে। (আশ-শামস, আয়াত : ৯)

وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰىهَاؕ

এবং যে তাকে দাবিয়ে দিয়েছে সে ব্যর্থ হয়েছে। (আশ-শামস, আয়াত : ১০)

অতএব মানুষ যদি তার নিজেকে পরিশুদ্ধতার দিকে নিয়ে যেতে চায়, তবে তাকে তার নফসের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হবে। আর যারাই সংগ্রাম করবে তারাই নিজেদেরকে মানোন্নয়নের দিকে নিয়ে যাবে। যেহেতু ইসলাম এসেছে মানুষকে মহান রবের বিধান অনুযায়ী গড়ে তোলার জন্য, সেহেতু ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের প্রধান কাজই হচ্ছে নিজেদেরকে প্রতিনিয়ত মানোন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসা। ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল নিজেকে যেমন মানোন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসবে ঠিক তেমনি তার জনশক্তিদেরকেও মানোন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসবে। 

মানোন্নয়ন

মানোন্নয়ন বলতে আমরা সহজ সরল ভাষায় যা বুঝি সেটা হলো, মানের যে উন্নতি সাধন করা হয় তাই মানোন্নয়ন বা মানের যে উর্ধ্বক্রম তাকেই মানোন্নয়ন বলে। আত্মগঠনের পর কাজ হচ্ছে ক্রমান্বয়ে মানের উন্নতি সাধন করা।

শরিয়তের পরিভাষায় বলা যায়, একজন ঈমানদার তার ঈমানকে সমৃদ্ব করার জন্য নিয়মিত যে চেষ্টা বা প্রচেষ্টা চালায় তাকে মানোন্নয়ন বলে ।

মানোন্নয়ন করা প্রয়োজন কেন?

একজন দায়িত্বশীল তার জনশক্তিকে মানোন্নয়ন করার আগে তাকে মানোন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করাবে। আর প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করাতে হবে কুরআন ও হাদিস থেকে । নিম্নোক্ত কিছু বিষয় সামনে রাখা যেতে পারে-

১. ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য

দায়িত্বশীল তার জনশক্তিকে উপলব্দি করাবে যে, ঈমানের বলয়টা প্রতিনিয়ত বৃদ্বির জন্য চেষ্টা অব্যাহত না রাখলে শয়তান আমাদের চতুর্দিক থেকে হামলা করে আমাদের পথভ্রষ্ট করে ফেলবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

ثُمَّ لَاٰتِیَنَّهُمْ مِّنْۢ بَیْنِ اَیْدِیْهِمْ وَ مِنْ خَلْفِهِمْ وَ عَنْ اَیْمَانِهِمْ وَ عَنْ شَمَآئِلِهِمْ١ؕ وَ لَا تَجِدُ اَكْثَرَهُمْ شٰكِرِیْنَ

সামনে-পেছনে, ডানে-বায়ে, সবদিক থেকে এদেরকে ঘিরে ধরব এবং এদের অধিকাংশকে তুমি শোকর গুজার পাবে না। (আল-আরাফ, আয়াত : ১৭)

হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ঐ ব্যক্তির জন্য ধ্বংস যার আজকের দিনটি গতকালের চেয়ে উত্তম হলো না।

২. ভালো কাজে প্রতিযোগিতার জন্য

দায়িত্বশীল তার জনশক্তি মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে ভালো কাজের প্রতিযোগিতার জন্য উৎসাহ দেবে এবং ভালো কাজের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য মহান রব যে জাযাহ রেখেছেন সে বিষয়ে তাকে উপলব্দি করাতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَ سَارِعُوْۤا اِلٰى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمٰوٰتُ وَ الْاَرْضُ١ۙ اُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِیْنَ

দৌঁড়ে চলো তোমাদের রবের ক্ষমার পথে এবং সেই পথে যা পৃথিবী ও আকাশের সমান প্রশস্ত জান্নাতের দিকে চলে গেছে, যা এমন সব আল্লাহভীরু লোকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। (আলে-ইমরান, আয়াত : ১৩৩)

 یُسٰرِعُوْنَ فِی الْخَیْرٰتِ وَ یَدْعُوْنَنَا رَغَبًا وَّ رَهَبًا١ؕ وَ كَانُوْا لَنَا خٰشِعِیْنَ

তারা সৎকাজে আপ্রাণ চেষ্টা করত, আমাকে ডাকত আশা ও ভীতিসহ এবং আমার সামনে ছিল অবনত হয়ে। (আল-আম্বিয়া, আয়াত : ৯০)

৩. আল্লাহ তায়ালার বাছাইকৃত বান্দার হক আদায় করার জন্য

জনশক্তির চিন্তা-চেতনায় অবশ্যই এই বিষয়টা জাগ্রত করে দিতে হবে যে, আমরা হচ্ছি আল্লাহর বাছাইকৃত বান্দা। আল্লাহতো তার দ্বীনের খেলাফতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার জন্য আমাদের বাছাই করে তার দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে বাছাইকৃত বান্দা হওয়ার নিয়ামতের হক যথাযথভাবে আদায় করা। সেটা কেবল সম্ভব নিজের মানোন্নয়ন করার মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَ جَاهِدُوْا فِی اللّٰهِ حَقَّ جِهَادِهٖ١ؕ هُوَ اجْتَبٰىكُمْ وَ مَا جَعَلَ عَلَیْكُمْ فِی الدِّیْنِ مِنْ حَرَجٍ١ؕ 

আল্লাহর পথে জিহাদ করো যেমন জিহাদ করলে তার হক আদায় হয়। তিনি নিজের কাজের জন্য তোমাদেরকে বাছাই করে নিয়েছেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। (আল-হাজ্জ, আয়াত : ৭৮)

৪. আল্লাহর নিকট ক্ষমার আশায়

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের প্রতিটি মূহুর্ত আল্লাহর ক্ষমার দিকে দৌঁড়াতে হয় তা দায়িত্বশীল হিসেবে জনশক্তিকে বোঝানোর মাধ্যমে তার মানোন্নয়নের প্রতি উৎসাহ ও প্রেরণা তৈরি করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

سَابِقُوْۤا اِلٰى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ جَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَآءِ وَ الْاَرْضِ١ۙ اُعِدَّتْ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِاللّٰهِ وَ رُسُلِهٖ١ؕ ذٰلِكَ فَضْلُ اللّٰهِ یُؤْتِیْهِ مَنْ یَّشَآءُ١ؕ وَ اللّٰهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِیْمِ

দৌঁড়াও এবং একে অপরের চেয়ে অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করো তোমার রবের মাগফিরাতের দিকে এবং সে জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের মতো। তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে সে লোকদের জন্য যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি ঈমান এনেছে। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ। যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল। (আল-হাদীদ, আয়াত : ২১)

অতএব জনশক্তি যখন তার নিজের মধ্যে মানোন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব উপলব্দি করবে তখন স্বেচ্ছায় তিনি নিজেকে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন করতে মানোন্নয়নের দিকে নিয়ে যাবে।

মানোন্নয়নের জন্য ৩টি দিক প্রয়োজন

জনশক্তিকে মানোন্নয়ন করার জন্য ৩টি দিককেই দায়িত্বশীলের সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে-

১. জ্ঞানগত দিক

সে যা করতে চাচ্ছে তার ব্যাপারে স্বচ্ছ জ্ঞান রাখতে হবে। সে যা করতে চাচ্ছে তা কুরআন-হাদিস অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় কি না! তাই জনশক্তির মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রথমত তাকে জ্ঞানগত দিকে নজর দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা যেমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবুয়তের দায়িত্ব দেওয়ার আগে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। 

اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِیْ خَلَقَۚ

পড়ো (হে নবী), তোমার রবের নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন।

خَلَقَ الْاِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍۚ

জমাট বাঁধা রক্তের দলা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।

اِقْرَاْ وَ رَبُّكَ الْاَكْرَمُۙ

পড়ো এবং তোমার রব বড় মেহেরবান।

الَّذِیْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِۙ

যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন।

عَلَّمَ الْاِنْسَانَ مَا لَمْ یَعْلَمْؕ

মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জানত না। (আল-আলাক্ব, আয়াত : ১-৫)

২. আমলগত দিক

জনশক্তি জ্ঞানগতভাবে যা অর্জন করছে তা আমলে পরিণত করার জন্য উদ্বুদ্ব করতে হবে। কেননা জানার পর মানার ক্ষেত্রে বৈপরিত্য তৈরি হলে তার জন্য ভয়ংকর পরিণাম অপেক্ষা করছে, তা তাকে বোঝাতে হবে। যেমনটি হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লা বলেন,

عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ ‏"‏ 

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, পাঁচটি বিষয়ে জবাব না দেওয়া পর্যন্ত কোনো মানব সন্তানের পা এক কদমও সামনে অগ্রসর হতে দেওয়া হবে না।

ক. জীবন কীভাবে শেষ করেছে?

খ. যৌবন কীভাবে বিদায় করেছে? 

গ. ধনসম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছে? 

ঘ. কোন পথে সেটা ব্যয় করেছে? 

ঙ. অর্জিত জ্ঞানের কতটুকু আমল করেছে? (সহীহ তিরমিযি)

উপরোক্ত হাদিসের আলোকে ৫ম যে প্রশ্ন করা হবে তা হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের আলোকে সে কতটুকু আমল করেছে তার জবাবদিহি করতে হবে। কাজেই জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে আমলে অভ্যস্থ হতে হবে।

৩. ময়দানগত দিক

জনশক্তিকে জ্ঞান ও আমলের সমন্বয় করিয়ে মানোন্নয়নের জন্য ৩য় যে দিকে নজর দেওয়াতে হবে তা হচ্ছে তার ময়দানগত দিক। সে শুধু আমল বা জ্ঞানের বুৎপত্তি অর্জন করলেই হবে না ,আল্লাহর এই জমিনে আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য ময়াদানে কাজ করে যেতে হবে। প্রতিষ্ঠিত তাগুতি শক্তিকে সকল পর্যায়ে পরাভূত করে দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠাই ছিল সকল নবী-রাসূলের প্রধান কাজ । অতএব এই বৃহৎ কাজের আঞ্জাম দেওয়ার জন্য আমাদের ময়দানে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

هُوَ الَّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰى وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَى الدِّیْنِ كُلِّهٖ وَ لَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ۠

তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত এবং দ্বীনে হক দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ দ্বীনকে অন্য সকল দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন, চাই তা মুশরিকদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন। (আস-সফ, আয়াত : ৯)

কুরআনের মানোন্নয়নের ক্রম

যারা ঈমানের মধ্যে দাখিল হয় তাদের মানোন্নয়নের ৪টি পর্যায় কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। জনশক্তিকে এই মানগুলোর বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান দিতে না পারলে লক্ষ্যপানে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। হয়তো সময়ের পরিক্রমায় সে এই পথ থেকে তার অজান্তেই বিচ্যুতি ঘটাবে। 

১. ঈমান

সর্বপ্রথম ঈমান সম্পর্কেই আলোচনা করা যাক। কারণ, এটা ইসলামী জিন্দেগীর প্রাথমিক ভিত্তিপ্রস্তর। তাওহীদ, রিসালাত আল্লাহর একত্ববাদ ও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে রাসূলরূপে স্বীকার করে নেওয়াই এক ব্যক্তির ইসলামের পরিসীমায় অনুপ্রবেশ লাভের জন্য যথেষ্ট। তখন তার সাথে ঠিক একজন মুসলমানেরই ন্যায় আচরণ করা আবশ্যক যখন এরূপ আচরণ ও ব্যবহার পাবার তার অধিকারও হয়। কিন্তু সাধারণ স্বীকারোক্তি এমনি আইনগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট হলেও ইসলামী জিন্দেগীর সমগ্র ‘ত্রিতল বিশিষ্ট উচ্চ প্রাসাদের’ ভিত্তিপ্রস্তর হওয়ার জন্যও কি এটা যথেষ্ট হতে পারে? সাধারণ লোকেরা এরূপই ধারণা করে। আর এজন্য যেখানেই এই স্বীকারোক্তিটুকু পাওয়া যায়, সেখানেই বাস্তবিকভাবে ইসলাম, তাকওয়া ও ইহসানের উচ্চতলসমূহ তৈরি করার কাজ শুরু করে দেওয়া হয়। ফলে সাধারণত এটা হাওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদেরই (?) অনুরূপ ক্ষণভঙ্গুর ও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। বস্তুত একটি পরিপূর্ণ ইসলামী জিন্দেগী গঠনের জন্য সুবিস্তারিত সম্প্রসারিত, ব্যাপক গভীর ও সুদৃঢ় ঈমান একান্তই অপরিহার্য। ঈমানের বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা হতে জীবনের কোনো একটি দিক বা বিভাগও যদি বাইরে পড়ে থাকে, তবে ইসলামী জিন্দেগীর সেই দিকটিই পুণর্গঠন লাভ হতে বঞ্চিত থেকে যাবে এবং তার গভীরতায় যতটুকু অভাবই থাকবে, ইসলামী জিন্দিগীর প্রাসাদ সেখানেই দুর্বল ও শিথিল হয়ে থাকবে, এ কথায় কোনোই সন্দেহ নেই।

উদাহরণ স্বরূপ “আল্লাহর প্রতি ঈমানের’’ উল্লেখ করা যেতে পারে। বস্তুত আল্লাহর প্রতি ঈমান দ্বীন ইসলামের প্রাথমিক ভিত্তিপ্রস্তর। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যাবে যে, আল্লাহকে স্বীকার করার উক্তিটুকু সাদাসিধে পর্যায় অতিক্রম করে বিস্তারিত ও সম্প্রসারিত ক্ষেত্রে প্রবেশ করার পর এর বিভিন্ন রূপ দেখতে পাওয়া যায়। কোথাও “আল্লাহর প্রতি ঈমান” একথা বলে শেষ করা যায় যে, আল্লাহ বর্তমান আছেন। সন্দেহ নেই পৃথিবীর তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি এক ও অদ্বিতীয়, এটাও সত্য কথা। কোথাও আরও একটু অগ্রসর হয়ে আল্লাহকে মাবুদ স্বীকার করা হয় এবং তার উপাসনা করার প্রয়োজনীয়তাও মেনে নেওয়া হয়। কোথাও আল্লাহর গুণ এবং তাঁর অধিকার ও ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত ও ব্যাপক ধারণাও শুধু এতটুকু হয় যে, আলিমুল গায়েব, সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা, প্রার্থনা শ্রবণকারী, অভাব ও প্রয়োজন পূরণকারী তিনি এবং ইবাদাতের সকল খুঁটিনাটি রূপ একমাত্র তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট করা বাঞ্ছনীয়। এখানে কেউ তার শরীক নেই। আর “ধর্মীয় ব্যাপারসমূহে” চূড়ান্ত দলীল হিসেবে আল্লাহর কিতাবকেও স্বীকার করা হয়। কিন্তু এরূপ বিভিন্ন ধারণা বিশ্বাসের পরিণামে যে একই ধরণের জীবনব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না, তা সুস্পষ্ট কথা। বরং যে ধারণা যতখানি সীমাবদ্ধ, কর্মজীবনে ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে ইসলামী বৈশিষ্ট্য অনিবার্যরূপে ততখানি সংকীর্ণ হওয়াই দেখা দেবে এমনকি যেখানে সাধারণ ধর্মীয় ধারণা অনুযায়ী “আল্লাহর প্রতি ঈমান” অপেক্ষাকৃতভাবে অতীব ব্যাপক ও সম্প্রসারিত হবে, সেখানেও ইসলামী জিন্দেগীর বাস্তবরূপ এই হবে যে, একদিকে আল্লাহর দুশমনদের সাথে বন্ধুত্ব রক্ষা করা হবে এবং অন্যদিকে আল্লাহর “আনুগত্য’’ করার কাজও সেই সংগেই সম্পন্ন করা হবে কিংবা ইসলামী নেজাম ও কাফেরি নেজাম মিলিয়ে একটি জগাখিচুড়ি তৈরি করা হবে।

এভাবে “আল্লাহর প্রতি ঈমান’’ এর গভীরতার মাপকাঠিও বিভিন্ন। কেউ আল্লাহকে স্বীকার করা সত্ত্বেও সাধারণ জিনিসকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয় না। কেউ আল্লাহর কোনো কোনো জিনিস অপরাপর জিনিস অপেক্ষা ‘অধিক প্রিয়’ বলে মনে করে। আবার অনেক জিনিসকে আল্লাহর অপেক্ষাও প্রিয়তর হিসেবে গ্রহণ করে; কেউ নিজের জান-মাল পর্যন্ত আল্লাহর জন্য কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু নিজের মনের ঝোঁক-প্রবণতা, নিজের মতবাদ ও চিন্তাধারা কিংবা নিজের খ্যাতি ও প্রসিদ্ধিকে বিন্দুমাত্র ব্যাহত করতে প্রস্তুত হয় না। ঠিক এই হার অনুসারেই ইসলামী জিন্দেগীর স্থায়িত্ব ও ভঙ্গুরতা নির্ধারিত হয়ে থাকে। আর যেখানেই ঈমানের বুনিয়াদ দুর্বল থেকে যায়, ঠিক সেখানেই মানুষের ইসলামী নৈতিকতা নির্মমভাবে প্রতারিত হয়।

২. ইসলাম 

ঈমানের উপোরক্ত ভিত্তিসমূহ যখন বাস্তবিকই পরিপূর্ণ ও দৃঢ়রূপে স্থাপিত হয়। তখনই তার ওপর ইসলামের দ্বিতীয় অধ্যায় রচনা করার কাজ শুরু হয়। বস্তুত ইসলাম হচ্ছে ঈমানেরই বাস্তব অভিব্যক্তি ঈমানেরই কর্মরূপ। ঈমান ও ইসলামের পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক বীজ ও বৃক্ষের পারস্পরিক সম্পর্কের অনুরূপ। বীজের মধ্যে যা কিছু যেভাবে বর্তমান থাকে, তাই বৃক্ষের রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এমনকি, বৃক্ষের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে বীজের মধ্যে কি ছিল, আর কি ছিল না, তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়। বীজ না হওয়া সত্ত্বেও বৃক্ষের অস্তিত্ব যেমন কেউ ধারণা করতে পারে না, অনুরূপভাবে এটাও ধারণা করা যায় না যে, জমি বন্ধ্যা ও অনুর্বর নয় এমন জমিতে বীজ বপন করলে বৃক্ষ অংকুরিত হবে না। প্রকৃতপক্ষে ঈমান ও ইসলামের অবস্থা ঠিক এরূপ। যেখানে বস্তুতই ঈমানের অস্তিত্ব থাকবে, সেখানে ব্যক্তির বাস্তব জীবনে, কর্মজীবনে, নৈতিকতায়, গতিবিধিতে, রুচি ও মানসিক ঝোঁক-প্রবণতায় স্বভাব-প্রকৃতিতে, দুঃখ-কষ্ট ও পরিশ্রম স্বীকারের দিকে ও পথে, সময়, শক্তি এবং যোগ্যতার বিনিয়োগ জীবনের প্রতিটি দিকে ও বিভাগে, প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপারেই এর বাস্তব অভিব্যক্তি ও বহিঃপ্রকাশ হবেই হবে। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ حَقَّ تُقٰتِهٖ وَ لَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَ اَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো। মুসলিম থাকা অবস্থায় ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়। (আলে-ইমরান, আয়াত : ১০২)

৩. তাকওয়া

فَاتَّقُوا اللّٰهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَ اسْمَعُوْا وَ اَطِیْعُوْا وَ اَنْفِقُوْا خَیْرًا لِّاَنْفُسِكُمْ١ؕ وَ مَنْ یُّوْقَ شُحَّ نَفْسِهٖ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ

তাই যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো। শোন, আনুগত্য করো এবং নিজেদের সম্পদ ব্যয় করো। এটা তোমাদের জন্যই ভালো। যে মনের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকল সেই সফলতা লাভ করবে। (আত-তাগাবুন, আয়াত : ১৬)

তাকওয়া সম্পর্কে আলোচনা শুরু করার পূর্বে ‘তাকওয়া’ কাকে বলে তা জেনে নেওয়া আবশ্যক। তাকওয়া কোনো বাহ্যিক ধরণ-ধারণ এবং বিশেষ কোনো সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের নাম নয়। তাকওয়া মূলত মানব মনের সেই অবস্থাকেই বলা হয় যা আল্লাহর গভীর ভীতি ও প্রবল দায়িত্বানুভূতির দরুণ সৃষ্টি হয় এবং জীবনের প্রত্যেকটি দিকে স্বতস্ফূর্তভাবে আত্মপ্রকাশ করে। মানুষের মনে আল্লাহর ভয় হবে, নিজে আল্লাহর দাসানুদাস এই চেতনা জাগ্রত থাকবে, আল্লাহর সামনে নিজের দায়িত্ব ও জবাবদিহি করার কথা স্মরণ থাকবে এবং এই একটি পরীক্ষাগার, আল্লাহ জীবনের একটি নির্দিষ্ট আয়ু দান করে এখানে পাঠিয়েছেন, এই খেয়াল তীব্রভাবে বর্তমান থাকবে। পরকালে ভবিষ্যতের ফয়সালা এই দৃষ্টিতে হবে যে, এই নির্দিষ্ট অবসরকালের মধ্যে এই পরীক্ষাগারে নিজের শক্তি, সামর্থ্য ও যোগ্যতা কীভাবে প্রয়োগ করেছে, আল্লাহর ইচ্ছানুক্রমে যেসব দ্রব্যসামগ্রী লাভ করতে পেরেছে, তার ব্যবহার কীভাবে করেছে এবং আল্লাহর নিজস্ব বিধান অনুযায়ী জীবনকে বিভিন্ন দিক দিয়ে যেসব মানুষের সাথে বিজড়িত করেছে, তাদের সাথে কিরূপ কাজ-কর্ম ও লেন-দেন করা হয়েছে একথাটিও মনের মধ্যে জাগরুক থাকবে।

বস্তুত এরূপ অনুভূতি ও চেতনা যার মধ্যে তীব্রভাবে বর্তমান থাকবে, তার হৃদয় মন জাগ্রত হবে, তার ইসলামী চেতনা তেজস্বী হবে, আল্লাহর মর্জির বিপরীত প্রত্যেকটি বস্তুই তার মনে খটকার সৃষ্টি করবে, আল্লাহর মনোনীত প্রত্যেকটি জিনিসই তার রুচিতে অসহ্য হয়ে উঠবে, তখন সে নিজেই করতে শুরু করবে। তখন সুস্পষ্টরূপে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করা দূরের কথা সংশয়পূর্ণ কোনো কাজেও লিপ্ত হতে সে নিজে ইতস্তত করবে। তার অন্তর্নিহিত কর্তব্যজ্ঞানই তাকে আল্লাহর সকল নির্দেশ পূর্ণ আনুগত্যের সাথে পালন করতে বাধ্য করবে। যেখানেই আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমালংঘন হওয়ার আশংকা হবে, সেখানেই তার অন্তর্নিহিত আল্লাহভীতি তার পদযুগলে প্রবল কম্পন সৃষ্টি করবে, চলৎশক্তি রহিত করে দেবে। আল্লাহর হক ও মানুষের হক রক্ষা করা স্বতস্ফূর্ত রূপেই তার স্বভাবে পরিণত হবে। কোথাও সত্যের বিপরীত কোনো কথা বা কাজ তার দ্বারা না হয়ে পড়ে সেই ভয়ে তার মন সতত কম্পমান থাকবে। এরূপ অবস্থা বিশেষ কোনো ধরণে কিংবা বিশেষ কোনো পরিধির মধ্যে পরিলক্ষিত হবে না, ব্যক্তির সমগ্র চিন্তা-পদ্ধতি এবং এবং তার সমগ্র জীবনের কর্মধারাই এর বাস্তব অভিব্যক্তি হবে। এর অনিবার্য প্রভাবে এমন এক সুসংবদ্ধ সহজ, ঋজু এবং একই ভাবধারা বিশিষ্ট ও পরম সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রকৃতি গঠিত হবে, যাতে সকল দিক দিয়েই একই প্রকারের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা ফুটে উঠবে। পক্ষান্তরে কেবল বাহ্যিক আকার-আকৃতি ও কয়েকটি নির্দিষ্ট পথের অনুসরণ এবং নিজেকে কৃত্রিমভাবে কোনো পরিমাপযোগ্য ছাঁচে ঢেলে নেওয়াকেই যেখানে তাকওয়া বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, সেখানে শিখিয়ে দেওয়া কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ ধরণ ও পদ্ধতিতে ‘তাকওয়া’ পালন হতে দেখা যাবে, কিন্তু সেই সঙ্গে জীবনের অন্যান্য দিকে ও বিভাগে এমনসব চরিত্র, চিন্তা-পদ্ধতি ও কর্মনীতি পরিলক্ষিত হবে, যা ‘তাকওয়া’ তো দূরের কথা ঈমানের প্রাথমিক স্তরের সাথেও এর কোনো সামঞ্জস্য হবে না।

৪. ইহসান

‘ইহসান’ হচ্ছে, ইসলামী জীবন প্রাসাদের সর্বোচ্চ মঞ্জিল, সর্বোচ্চ পর্যায়। মুলতঃ ‘ইহসান’ বলা হয় আল্লাহ তাঁর রসূল এবং তাঁর ইসলামের সাথে মনের এমন গভীরতম ভালবাসা ও আত্মহারা প্রেম পাগল ভাবধারাকে, যা একজন মুসলমানকে ‘ফানা ফিল ইসলাম’ বা ‘ইসলামের জন্য আত্মোৎসর্গীকৃত প্রাণ’ করে দেবে। তাকওয়ার মূল কথা হচ্ছে আল্লাহর ভয়, যা আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ হতে দূরে সরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। আর ইহসানের মূলকথা হচ্ছে আল্লাহর প্রেম, আল্লাহর ভালবাসা। এটা মানুষকে আল্লাহর সন্তোষ লাভ করার জন্য সক্রিয় করে তোলে। এ দু’টি জিনিসের পারস্পরিক পাথর্ক্য একটি উদাহরণ হতে বুঝা যায়। সরকারি চাকুরীজীবিদের মধ্যে এমন কিছু সংখ্যক লোক থাকে, যারা নিজ নিজ নির্দিষ্ট দায়িত্ব, কর্তব্য অনুভূতি ও আগ্রহ উৎসাহের সাথে যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়। সমগ্র নিয়ম-কানুন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করে তারা চলে এবং সরকারের দৃষ্টিতে আপত্তিকর কোনো কাজই তারা কখনো করে না। এ ছাড়া আর এক ধরনের লোক থাকে, যারা ঐকান্তিক নিষ্ঠা, আন্তরিক ব্যগ্রতা ও তিতিক্ষা এবং আত্মোৎসর্গপূর্ণ ভাবধারার সাথেই সরকারের কল্যাণ কামনা করে। তাদের ওপর যেসব কাজ ও দায়িত্ব অর্পিত হয়, তারা কেবল তাই সম্পন্ন করে না, যেসব কাজে রাষ্ট্রের কল্যাণ ও উন্নতি হতে পারে আন্তরিকতার সাথে সেইসব কাজও তারা আঞ্জাম দেবার জন্য যত্নবান হয় এবং এজন্য তারা আসল কর্তব্য ও দায়িত্ব অপেক্ষা অনেক বেশি কাজ করে থাকে। রাষ্ট্রের ক্ষতিকর কোনো ঘটনা ঘটে বসলেই তারা নিজেদের জানমাল ও সন্তান সবকিছুই উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত হয়। কোথাও আইন-শৃঙ্খলা লঙ্ঘিত হতে দেখলে তাদের মনে প্রচ- আঘাত লাগে। কোথাও রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিদ্রোহ ঘোষণার লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হলে তা অস্থির হয়ে পড়ে এবং তা দমন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। নিজে সচেতনভাবে রাষ্ট্রের ক্ষতি করা তো দূরের কথা তার স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগতে দেওয়া তাদের পক্ষে সহ্যাতীত হয়ে পড়ে এবং সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি দূর করার ব্যাপারে সাধ্যানুসারে চেষ্টার বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না। পৃথিবীর সর্বত্র একমাত্র তাদের রাষ্ট্রের জয়জয়কার হোক এবং সর্বত্রই এরই বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়ে পত পত করতে থাকুক এটাই হয় এই শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের মনের বাসনা। এই দু’য়ের মধ্যে প্রথমোক্ত কর্মচারীগণ হয় রাষ্ট্রের ‘মুত্তাকি’ আর শেষোক্ত কর্মচারীগণ হয় ‘মুহসিন’ উন্নতি এবং উচ্চপদ মুত্তাকীরাও লাভ করে থাকে, বরং যোগ্যতম কর্মচারীদের তালিকায় তাদেরই নাম বিশেষভাবে লিখিত থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘মুহসিনদের’ জন্য সরকারের নিকট যে সম্মান ও মযার্দা হয়ে থাকে, তাতে অন্য কারোই অংশ থাকতে পারে না। ইসলামে ‘মুত্তাকী’ ও ‘মুহসীনদের’ পারস্পরিক পার্থক্য উক্ত উদাহরণ হতে সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যায়। ইসলামে মুত্তাকীদেরও যথেষ্ট সম্মান রয়েছে। তারাও শ্রদ্ধাভাজন সন্দেহ নেই কিন্তু ইসলামের আসল শক্তি হচ্ছে মুহসিনগণ। আর পৃথিবীতে ইসলামের মূল উদ্দেশ্য একমাত্র ‘মুহসিনদের’ দ্বারাই সুস্পন্ন হতে পারে।

আল্লাহ তায়ালা মুহসিনদের সম্পর্কে বলেন,

بَلٰى١ۗ مَنْ اَسْلَمَ وَجْهَهٗ لِلّٰهِ وَ هُوَ مُحْسِنٌ فَلَهٗۤ اَجْرُهٗ عِنْدَ رَبِّهٖ١۪ وَ لَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَ لَا هُمْ یَحْزَنُوْنَ۠

(আসলে তোমাদের বা অন্য কারোর কোন বিশেষত্ব নেই।) সত্য বলতে কি যে ব্যক্তিই নিজের সত্ত্বাকে আল্লাহর আনুগত্যে সোপর্দ করবে এবং কার্যত সৎপথে চলবে, তার জন্য তার রবের কাছে আছে এর প্রতিদান। আর এই ধরনের লোকদের জন্য কোন ভয় বা মর্মবেদনার অবকাশ নেই। (আল-বাক্বারাহ, আয়াত : ১১২)

ছাত্রশিবিরের মানোন্নয়নের ক্রম

ইমলামী ছাত্রশিবির তার জনশক্তিদেরকে উপরোক্ত কুরআনের ৪টি পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে ৪টি মানদ- ঠিক করেছেন-

১. সমর্থক

যে সকল ছাত্র আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়ন করার জন্য নিজেকে এই কাফেলায় শামিল করতে চায়, তাকে জেনে বুঝে সমর্থন করতে হবে। যিনি সমর্থক হলেন তাকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন সাধিত করার জন্য প্রাথমিকভাবে ৪টি কাজ করতে হবে-

-নিয়মিত কুরআন ও হাদীস বুঝে চেষ্টা করা।

-নিয়মিত দাওয়াতি কাজ করা।

-নিয়মিত ইসলামী সাহিত্য পড়া।

-নিয়মিত ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখা ।

একজন দায়িত্বশীল সমর্থককে উপরিউক্ত ৪টি কাজের পাশাপাশি নির্ধারিত সিলেবাস অনুসরণ করে জ্ঞান অর্জন, আমল ও ময়দানগত দিক উন্নত করানোর প্রচেষ্ঠা চালাবে। 

২. কর্মী

যখন একজন সমর্থক জ্ঞান, আমল ও ময়দানগত দিকে কিছুটা সমৃদ্ধি অর্জন করে এবং নির্ধারিত সিলেবাস আয়ত্ত্ব করে, দায়িত্বশীল তার সমগ্রিক দিক বিবেচনা করে দ্বীনের পথে তখন অগ্রসর করানোর জন্য তাকে কর্মী ঘোষণা করেত পারে। কর্মীর হিসেবে তাকে ৮টি কাজ করতে হয় এবং নির্ধারিত সিলেবাস অধ্যয়ন করাতে হবে।

- নিয়মিত কুরআন ও হাদীস বুঝে পড়ার চেষ্টা করা।

-নিয়মিত দাওয়াতী কাজ করা।

- নিয়মিত ইসলামী সাহিত্য পড়া।

- ইসলামের প্রাথমিক দাবিসমূহ মেনে চলার চেষ্টা করা।

- নিয়মিত বায়তুলমালে এয়ানত দেওয়া।

- নিয়মিত ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখা।

- কর্মী সভা, সাধারণ সভা প্রভৃতি অনুষ্ঠানসমূহে যোগদান করা।

- সংগঠন কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।

৩. সাথী

একজন কর্মী তার ৮টি কাজ ও নির্ধারিত সিলেবাস পরিপূর্ণ আয়ত্ত্ব করার পর দায়িত্বশীল সামগ্রিকভাবে তাকে দ্বীনের পথে আরো অগ্রগামী করার জন্য ছাত্রশিবিরের সংবিধানের সুনির্দিষ্ট পন্থায় তাকে সাথী শপথের আওতায় নিয়ে আসবেন।

সাথী হওয়ার শর্তসমূহ :

- সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে ঐক্যমত পোষণ করা।

- সংগঠনের কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির সাথে সচেতনভাবে একমত হওয়া।

- ইসলামের প্রাথমিক দায়িত্বসমূহ পালন করা।

- সংগঠনের সামগ্রিক তৎপরতায় পূর্ণভাবে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া।

৪. সদস্য

একজন সাথী তার শর্তসমূহ পূরণ করত নির্ধারিত সিলেবাস আয়ত্ত্ব করে সংগঠনের সর্বোচ্চ শপথ গ্রহণ করার জন্য চেষ্ঠা চালাবেন। জ্ঞানগত, আমলগত ও ময়দানগত দিকের সমৃদ্ধতা অর্জন ও সর্বোচ্চটুকু বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতা তৈরি হলে ছাত্রশিবিরের সংবিধানের নির্ধারিত পন্থায় সদস্য শপথের আওতায় নিয়ে আসা হয়। 

শর্তসমূহ নিম্নরূপ

- সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করা।

- সংগঠনের কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির সাথে পূর্ণ ঐক্যমত পোষণ করা এবং তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা।

- সংবিধান মেনে চলা।

- ফরয ও ওয়াজিবসমূহ যথাযথভাবে পালন করা।

- কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা।

- শিবিরের লক্ষ্য ও কর্মসূচির বিপরীত কোনো সংস্থার সাথে সম্পর্ক না রাখা।

ছাত্রশিবির তার জনশক্তিদেরকে ‘‘মুহসিন’’ পর্যায়ে উপনীত করার জন্য বৈজ্ঞানিক এই পন্থাকে সামনে রাখার চেষ্টা করে। দায়িত্বশীল তার জনশক্তিকে পরম মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে সংগঠনের নির্ধারিত পন্থায় মানোন্নয়ন করালে আশা করা যায় মুহসিন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু দায়িত্বশীল যদি সাধারণ ছাত্রের মন-মগজে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন পরিপূর্ণভাবে না বুঝাতে পারে বা সংগঠনের নির্ধারিত ফর্মুলা যথাযথভাবে না মেনে জনশক্তিকে মানোন্নয়নের জন্য অগ্রসর করে তবে তার অবস্থা হবে ঐ ঈমানদারের মতো যিনি তার মনে ঈমানের পরিপূর্ণ বীজ বপন করতে পারেনি। ঈমানদার তার মনে পরিপূর্ণ ঈমানের বীজ বপন না করার কারণে ইসলাম, তাকওয়া ও ইহসান পর্যায়ে পৌঁছানো তার জন্য যেমন খোলস মাত্র ঠিক ইকামাতে দ্বীনের সমর্থকের অবস্থা তেমন হবে যিনি কর্মী, সাথী ও সদস্য হবেন বটে সেটা হবে কেবল খোলস মাত্র। প্লাস্টিকের তৈরী ফুলে যেমন সাজ-সজ্জাকে সুসজ্জিত করে বটে কিন্তু তার থেকে কোনো ঘ্রাণ ছড়ায় না ঠিক তেমনি যথযথ প্রক্রিয়ায় মানোন্নয়ন না হলে সংখ্যাধিক্যতায় সংগঠন সুসজ্জিত হবে বটে কিন্তু আন্দোলনের মৌলিক উদ্দেশ্য হাসিল হবে না বা মাকসুদে মঞ্জিলে পৌঁছা আদৌ সম্ভব হবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাহাবীদেরকে চিন্তায়-চেতনায়, ধ্যানে-জ্ঞানে, আমলে-আখলাকে, মাঠে ময়দানে সর্বদিকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন বিধায় মাকসুদে মঞ্জিলে পৌঁছা সহজতর হয়েছে। অতএব আমাদের সেই পথ এবং আদর্শকে ধারণ করেই আমাদের জনশক্তিদের মানোন্নয়ন করাতে হবে। তাই জনশক্তিদের মানোন্নয়নে দায়িত্বশীলের ভুমিকা অনস্বীকার্য। আরবীতে একটি প্রবাদ বাক্য দিয়েই শেষ করছি-।الناس على دين ملوكهم “জনগণ নেতৃবৃন্দেরই আদর্শানুসারী হয়ে থাকে।”

মহান রব আমাদেরকে কুরআন ও হাদিসের আলোকে সংগঠনের নির্ধারিত পন্থায় মানোন্নয়নের কার্যক্রম যথাযথভাবে আঞ্জাম দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।।

লেখক : কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির