post

সংবিধান সংশোধন জটিলতা এবং গণবিচ্ছিন্ন সরকার

০৮ মে ২০১১

আলফাজ আনাম

বাংলাদেশ এখন কোন সংবিধানের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে তা নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে তখন সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি এ নিয়ে নতুন এক রাজনৈতিক চাল দিতে চাইছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী এর আগে বলেছিলেন দেশে কার্যত এখন এক ধরনের সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ দেশ কোন সংবিধানের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে তা এখন স্পষ্ট নয়। সরকারি দলের নেতারা বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করলেও এখন দেশে প্রকৃতপক্ষে তিন ধরনের সংবিধানের অস্তিত্ব আমরা দেখছি। পঞ্চম সংশোধনী রায়ের মাধ্যমে আদালত সংবিধান সংশোধনের নির্দেশনা দিয়েছেন, অপর দিকে আইন মন্ত্রণালয় একটি খসড়া সংবিধান ছেপেছে যেখানে আদালতের রায়ের বাইরেও নানা ধরনের কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। এছাড়া আগের সংবিধানতো আছেই। কার্যকর সংবিধানের অস্তিত্ব নিয়ে এই প্রশ্নের মধ্যে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি বিরোধীদলীয় নেতাকে তার আইন বিশারদদের নিয়ে মতামত দেয়ার আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। অথচ আইন মন্ত্রণালয় থেকে ছাপানো খসড়া সংবিধানের কপি চেয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী চিঠি দিলেও তাকে খসড়া সংবিধানের কপি দেয়া হয়নি। এখন তাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে মতামত দেয়ার জন্য। এই চালবাজির মূল কারণটি হচ্ছে সংবিধান সংশোধন নিয়ে সরকার যে লেজে-গোবরে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে সেখানে বিরোধী দলকেও জড়ানো। প্রথম দিকে সরকারের মন্ত্রীরা বলেছিলেন ’৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়াই হবে সরকারের সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য। এখন সরকারি দলের নেতারা বলছেন, ’৭২ এর সংবিধানে আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। তা করা হলে দেশ ৪০ বছর পিছিয়ে যাবে। অথচ বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যখন এমন কথা বলা হয়েছিলো তখন তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান বলে সরকারের মন্ত্রীরা প্রচার চালিয়েছিলেন। ’৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয়েছিলো  সেক্যুলার সংবিধানের অধীনে এ রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। এখন সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সংবাদ সম্মেলন করে বলছেন সংবিধান সেক্যুলার হলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকবে এমনকি সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমও বহাল থাকবে। রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে এ ধরনের সেক্যুলার সংবিধান মনে হয় বিশ্বের দ্বিতীয় আর কোনো দেশে নেই। তাহলে কী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে ইসলামের চেতনাকেও সমুন্নত রাখতে চায়? প্রকৃতপক্ষে এর আড়ালে আওয়ামী লীগের ধর্ম নিয়ে রাজনীতির কৌশল কাজ করছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পরিবর্তন করলে ভোটের রাজনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তা উপলব্ধি করে এখন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংবিধানে সেক্যুলারিজম সংযোজনের নামে জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকারের শরিক বাম নেতারা আবার এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। এ পরিস্থিতিতে সংবিধান সংশোধনে সামনে আনা হয় নতুন ইস্যু। সেক্যুলার কিংবা ’৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেয়েও সংবিধান সংশোধন কমিটির কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে কেয়ারটেকার ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে সংশোধনী আনা। এই সংশোধনী আনার উৎসাহ রাজনৈতিক মহলে নানা সন্দেহের সৃষ্টি করছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে কেয়ারটেকার ব্যবস্থার পরিবর্তন বা সংস্কার বিষয়ে কোনো কথাই বলা হয়নি। অনেকে মনে করেন এ ব্যবস্থার সংস্কারের নামে আওয়ামী লীগ এমন কিছু উদ্যোগ নিতে চায় যাতে তাদের পছন্দের একটি সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা যায়। এসব প্রক্রিয়ায় তারা প্রধান বিরোধী দলকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলছে আবার সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত ধারাও সংযোজন করতে চাইছে। যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে মুছে ফেলা হবে। এখন সংবিধান সংশোধন নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে এক টেবিলে আলোচনা বিরোধী দলের জন্য রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। বিরোধী দল বিষয়টি উপলব্ধি করে বলেই এ ধরনের আলোচনায় যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। একই সাথে সংবিধান সংশোধন কমিটির বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। ফলে সংবিধান সংশোধনের নামে সংবিধানে যাই সংযোজন বিয়োজন করা হোক না কেন তা কোনোভাবেই দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। পরবর্তীতে তা পরিবর্তন হবে। আর এ কারণে বিরোধী দলকে কমিটিতে আমন্ত্রণ জানানোর এই কৌশল নেয়া হয়েছে। যাতে অন্তত এ কথা বলা যায় আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম কিন্তু বিরোধী দল আসেনি। দুই. সংবিধান সংশোধন নিয়ে সরকার নানা জটিলতার মধ্যে থাকলেও সরকারের নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডে কোনো পরিবর্তন হয়নি। দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন যে কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রূপ নিয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে তা ফুটে উঠেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট নিয়ে মন্তব্য করেছেন যে এ রিপোর্ট যথেষ্ট গবেষণালব্ধ নয়। অথচ এই রিপোর্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে সব তথ্য দেয়া হয়েছে তার সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে। ড. ইউনূসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ধরনের অর্বাচীন মন্তব্য সে দূরত্ব আরো বাড়িয়ে দেবে। ইতোমধ্যে পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে আইনের শাসন, আদালতের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক নিপীড়নের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ড. ইউনূসকে অপসারণ ও আদালতের রায়ের পর বাংলাদেশে ব্যক্তি আক্রোশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিভাবে চরিতার্থ করা হয় তা গোটা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। দেশে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত গুণী ব্যক্তিদের শুধু অপদস্থ করা হচ্ছে না বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে সরকার এখন হত্যা ও গুমের মতো নৃশংস নীতি গ্রহণ করেছে। বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে গুম করার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছেলেকে গুম করার অভিযোগ উঠেছে। তাকে এমন এক সময় গুম করা হয় যখন নারী উন্নয়ন নীতির ইসলাম পরিপন্থী ধারা বাদ দেয়ার দাবিতে আলেম সমাজের ডাকা হরতাল সফল হয়। আলেমসমাজের ডাকা হরতালের কর্মসূচিতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দু’জন মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সরকারের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের উদহারণ হিসাবে সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিভাত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের এসব কর্মকাণ্ড এক সময় ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলোর স্বৈরশাসকরা গ্রহণ করেছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের জন্য এ ধরনের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা সরকারের জনভিত্তিকে আরো দুর্বল করে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের জনপ্রিয়তায়ও যে ধস নেমেছে তা বোঝা কঠিন নয়। রাষ্ট্রপরিচালনায় সরকারে অদক্ষতা প্রকটভাবে ধরা পড়ছে। দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, বিনিয়োগ স্থবিরতা ও শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের কারণে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কার্যত বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও হতাহতের ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্মে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ফলে দেশের ভেতরে বাইরে দিশাহীন অবস্থা থেকে সরকার নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নিপীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না বরং জনপ্রিয়তা কমে যায়। সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ এখন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির