কত ভুল বুঝাবুঝি হয়। কোনো কোনো সময় ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান এমনকি মা -বাবা পর্যন্ত সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে! অনেক সময় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার মতো বিন্দু পরিমাণ পাথেয় থাকে না কাছে। কোনোভাবেই আমরা বোঝাতে পারি না সত্যটা। মানুষের সাথে চলতে গিয়ে কিংবা ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় লেনদেন নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। ঘাড়ে চেপে বসতে পারে অসহ্য অপবাদ। কত খারাপ কথা, কত মিথ্যে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে যেতে পারে মুখে মুখে। অনেকে এইরকম পরিস্থিতিতে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আসলেই কি সেটা সমাধান! অপবাদের গ্লানি থেকে অপরাধের মাধ্যমে মুক্তি চাওয়ার মতো বোকামি আর কি হতে পারে। যাতে দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই নষ্ট হয়। ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা করবে, তাকে আগুনে দগ্ধ করা হবে ; এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। (সূরা নিসা : ২৯-৩০)
আমরা হজরত ইউসুফ (আ)-এর কথা সবাই জানি। মিসরের বাদশাহের স্ত্রী জুলেখার অনৈতিক আবদারে সাড়া না দিয়ে খোদাভীতির ঐতিহাসিক নাজরানা পেশ করেও মিথ্যে অপবাদে জেলে গেলেন। মহিলা বলল, এ হচ্ছে সে ব্যক্তি, যার জন্য তোমরা আমাকে ভর্ৎসনা করেছিলে। আমি ওরই মন জয় করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে। আর আমি যা আদেশ দেই, সে যদি তা না করে, তবে অবশ্যই সে কারাগারে প্রেরিত হবে এবং লাঞ্ছিত হবে। (সূরা ইউসুফ : ৩২)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ কুদরতে মরিয়ম (্আ)-এর স্বামী ছাড়াই গর্ভধারণের অলৌকিক বিষয়টিতে যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল সেটাও প্রথমদিকে মানুষকে বোঝানোর ক্ষমতা ছিলনা তাঁর।
‘অতঃপর তাকে কোলে নিয়ে আপন সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হলো। তারা বলল, ‘হে মরিয়ম! নিশ্চয় তুমি অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ করে বসেছ।’ (সূরা মারিয়ম : ২৭)
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা.-এর চরিত্রে কালেমা লেপনের চেষ্টা করেছিলেন মুনাফিকরা। দুর্বল ঈমানের অধিকারী মুসলমানরা পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েছিলেন সেই অপপ্রচারে। যুগ যুগ ধরে আল আমিন তথা সত্যবাদী বলে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা.কেও পড়তে হয়েছে সততার প্রশ্নে! সময়ের ব্যবধানে সত্য উন্মোচিত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এই সত্যটা প্রকাশ পাওয়ার আগের সময়টা প্রত্যেকর ক্ষেত্রে ছিল অনেক কঠিন ও নির্দয়। পৃথিবীর প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা যেন তাকিয়ে ছিল ঘৃণাভরা চোখে। এইরকম নাজুক পরিস্থিতিতেও নিজেই নিজের কাছে সৎ থাকলে সব কিছুকে থোড়াই কেয়ার করে জীবন উপভোগ করা যায়। অন্যদিকে চারিত্রিক দৃঢ়তার ব্যাপারে বাইরে যতই স্বীকৃতি থাকুক না কেন, যতই বাহবা থাকুক পরিচ্ছন্ন চলাফেরার; নিজের কাছে নিজের সততার ব্যাপারে শক্ত সম্মতি পাওয়া না গেলে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে জীবন। বিবেকের দংশনে ক্ষতবিক্ষত হয় হৃদয়। অনুতাপের অনলে পুড়ে ছারখার হতে থাকে অন্তর। মনের আকাশে জমতে থাকে হতাশার ঘন কালোমেঘ। শত স্বীকৃতি, শত উপভোগের উপকরণও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। নিজেই নিজের কাছে সৎ থাকতে কঠোর সাধনার প্রয়োজন। দরকার আত্মসমালোচনা চর্চার। নিজ ভুলের স্বীকৃতি দানের মানসিকতা এ গুণ অর্জনের পথকে সুগম করে। নিজেই নিজের চরিত্রকে ব্যবচ্ছেদ করার উদারতা যার আছে তার পক্ষেই সৎ থাকা সহজ হয়। যেহেতু প্রযুক্তির এই যুগে পাপাচারের সকল পথ উন্মুক্ত। অপরাধের সকল উপকরণ সহজলভ্য। এই অবস্থায় আখেরাতের চিন্তা ব্যতীত অসৎ পথে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। পরকালের শাস্তির ভয় ছাড়া কোনো বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা করে না মানুষের লোভাতুর নফস। আল্লাহর ভয় মনে জাগ্রত থাকলেই কেবল সৎ থাকা যায়। প্রকাশ্যে গোপনে কোথাও ঘটেনা এতোটুকু পদস্খলন। মানুষ হিসেবে কিছু ভুল হয়ে গেলেও অনুতপ্ততা ও তওবায় সততার পথেই আবার ফিরে আসে। নিজেকে সৎ ভাবার এবং প্রকাশ্যে দাবি করার নামই প্রকৃত সততা নয়। বরং অপ্রয়োজনে দাবি করা অনেকক্ষেত্রেই অযথা অহমিকা। এবং এই দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পূর্ণ মিথ্যে না হলেও লোকদেখানো কিছু পথ ও পন্থার আশ্রয় নিতেই হয়। তাতে নিজের সততার স্বীকৃতি লাভ করা গেলেও সত্যিকার অর্থে নিজেই নিজের কাছে সৎ থাকার স্বাদ অধরাই থেকে যায়। ফেতনার এ যুগে কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আগেই নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী না হয়ে সতর্ক হওয়া দরকার। কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পরেই তো কেবল অনুভব করা সম্ভব আমি আসলেই সৎ থাকতে পারলাম কিনা। কারও আমানতের খেয়ানত হয়ে যায় কিনা এই পেরেশানি থাকা প্রকৃত আমানতদারের বৈশিষ্ট্য। যে নিজেকে আমানতদার হিসেবে প্রচার করতে উৎসাহী তার পক্ষে কতদিন সৎ থাকা সম্ভব আল্লাহ পাকই ভালো জানেন! কারণ আল্লাহর নবী হয়েও ইউসুফ (আ)-এর বক্তব্য ছিল, ‘আমি আমার ব্যক্তিসত্তাকেও নির্দোষ মনে করিনা, নিশ্চয় প্রবৃত্তি মন্দের দিকেই প্ররোচিত করে, অবশ্য আমার রব যার প্রতি দয়া করেন তার কথা আলাদা, নিঃসন্দেহে আমার রব ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ (সূরা ইউসুফ : ৫৩)
নিজের প্রতি অতিবিশ্বাসের বীজ থেকেই অসতর্কতার অঙ্কুরোদগম ঘটে আর অসতর্কতা থেকেই জন্মলাভ করে অসততা। সততার কথা বলাটা যত সহজ সৎ থাকাটা মোটেও তত সহজ নয়! রাসূল সা. সৎ ব্যবসায়ীদের শহীদদের সাথে থাকার কথা ঘোষণা এমনি এমনি দিয়ে দেননি। শহীদরাতো খোদার রাহে নিজেদের সর্বোচ্চটুকু বিলিয়ে দেন নির্দ্বিধায়। তাজা খুনে রক্তাক্ত হয় জমিন। সেখানে মুনাফা অর্জনের উপায় ব্যবসার তুলনা কিভাবে হতে পারে! পণ্য সম্পর্কে মিথ্যে না বললে ভয় থাকে বড় ধরনের লোকসানের। ওজনে কম দেয়া বা অভিনব কৌশলে ভেজাল মিশ্রণের লোভ সামলানো প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায় চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। হালাল হারাম বাছ বিচার করে বাজারে টিকে থাকাটা একজন ব্যবসায়ীর জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কিন্তু একজন ব্যবসায়ী সৎ না হলে একজনের জন্য অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এজন্যই হয়তো রাসূল সা. সৎ ব্যবসায়ীদের এমন মর্যাদার কথা বলেছেন। আখিরাতে সততার পুরস্কার তো পাওয়া যাবেই, দুনিয়াতেও আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সৎ ব্যক্তিদের কল্পনাতীতভাবে সম্মানিত করে থাকেন। হজরত ইউসুফ (আ) সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর একেবারে মিসরের মন্ত্রী বনে গেলেন। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা.-এর চারিত্রিক পবিত্রতা সরাসরি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ঘোষণার মাধ্যমে তাঁর মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পেল। হজরত মরিয়মের শিশু সন্তানটির জবান দিয়ে মায়ের পরিচ্ছন্নতার কথা উচ্চারিত হওয়ার মাধ্যমে শুধু অপবাদ থেকেই মুক্তি মিলল না বরং সম্মানের একেবারে চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছলেন। আর রাসূল সা.-এর মর্যাদার কথা তো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ নিজেই নিজের কাছে সৎ থাকলে অপপ্রচারকারীরা যতই সম্মানহানি ঘটাতে চাক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে রূপান্তরিত করেন সম্মানে। সততার একটা অদম্য শক্তি আছে। যে শক্তি কখনো কোথাও, কারও কাছে হার মানে না! শত ঝড় ঝাপটায়ও অনড়, অটল থাকার রসদ জোগায়। এ শক্তি অর্জনে যারা যত বেশি অগ্রগণ্য তারা তত বেশি সম্মানিত, তাদের জীবন তত উপভোগ্য। লেখক : প্রাবন্ধিক
আপনার মন্তব্য লিখুন