post

সভ্যতার দুষ্টক্ষত

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

২৬ মে ২০২২

যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়; বরং আলোচনার টেবিলেই দ্বি-রাষ্ট্রিক বা আন্তর্জাতিক সকল সমস্যার সমাধান হওয়াই কাক্সিক্ষত। কিন্তু সে পথে অগ্রসর না হয়ে রাশিয়া ও প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়েছে। শক্তির দিক থেকে অসম হলেও এই যুদ্ধ কিন্তু একতরফা হয়নি বরং সামরিক শক্তিকে পিছিয়ে থাকা ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধই গড়ে তুলেছে। দেশটির সেনাবাহিনী ও সাধারণ জনতা রাশিয়াকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়নি। কিন্তু সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে বিজয়ী হওয়া বা বেশি দিন লড়াইয়ে টিকে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই বরং এক অনিবার্য পরিণতিতে তাদেরকে পরাজয় বরণ করতে হবে। যদিও যুদ্ধে রাশিয়া কাক্সিক্ষত সুবিধা করতে পারেনি।
মূলত, যুদ্ধকে মানবসভ্যতার দুষ্টক্ষত হিসাবে চিহ্নিত করা অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ, এতে কোন ভাবেই শান্তি ফিরে আসে না বরং জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ক্ষেত্রবিশেষে তা সভ্যতার জন্যও হুমকি হয়ে দেখা দেয়। বস্তুত, যুদ্ধ হলো দেশ, সরকার, সমাজ বা আধাসামরিক বাহিনী যেমন ভাড়াটে, চরমপন্থী এবং মিলিশিয়াদের মধ্যে একটি তীব্র সশস্ত্র সংঘাত। অন্যদিকে, যুদ্ধবিগ্রহ বলতে যুদ্ধের ধরনগুলোর সাধারণ ক্রিয়াকলাপ, বৈশিষ্ট্য বা সাধারণভাবে যুদ্ধেরই ক্রিয়াকলাপ ও বৈশিষ্ট্যগুলোকে বোঝায়। যুদ্ধবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন থাকলেও তা কখনো আইন বা নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। তাই কোন যুদ্ধই সামরিক লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সঙ্গত কারণেই সকল যুদ্ধেই প্রচুর বেসামরিক লোকের হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকে। তাই যুদ্ধ মানেই নিধনযজ্ঞ বা ধ্বংসযজ্ঞ। যেমনটি আমরা চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে প্রত্যক্ষ করছি। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ইতোমধ্যেই উভয় পক্ষের বিপুল সংখ্যক সৈন্যের প্রাণহানি ঘটেছে। ইউক্রেনের অনেক সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনকি রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে রেহাই পায়নি শিশু ও মাতৃসদনও।
এই ভূমণ্ডলকে সৃষ্টি করা হয়েছে সৃষ্টিকুলের অনুকূল ও বসবাসের উপযোগী করে। শুধু জীবের জীবন ধারণ নয় বরং জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে যা প্রয়োজন তার সব কিছুই আছে এই নশ্বর পৃথিবীতে। এই সৃষ্টিনিচয়কে যে সর্বাঙ্গ সুন্দর, সাবলীল ও অতিশয় সমৃদ্ধ করে সৃষ্টি করা হয়েছে তা সার্থকভাবেই ফুটে উঠেছে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন-ধান্যে পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ কবিতাংশে, যা সমঝদার কাব্যপ্রেমিকদের মনে এক নির্মোহ আবেদন সৃষ্টি করে।
মূলত পৃথিবী নামক এই গ্রহ ছাড়া মহাবিশ্বের আর কোন স্থান জীবের জীবন ধারণের জন্য উপযোগী নয়। বিজ্ঞান ও প্রয্ুিক্তর অভাবনীয় উন্নতির পরও মানুষ এমন কোন স্থানের এখনও সন্ধান পায়নি যেখানে জীবের অস্তিত্ব রয়েছে। এলিয়েন নিয়ে খুচরো কিছু কথা থাকলেও তা এখন পর্যন্ত আন্দাজ-অনুমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। মানুষ চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করেছে বেশ আগেই। কিন্তু চাঁদে জীবের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। মঙ্গলগ্রহেও প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে ইতিবাচক কোনো খবর নেই।
বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন যে, চাঁদ ও মঙ্গল একেবারেই প্রাণহীন। কিন্তু সম্প্রতি নির্জীব চন্দ্রপৃষ্ঠকে সজীব করে সেখানে মনুষ্য বসতি গড়তে মহাশূন্য বিজ্ঞানীরা প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মঙ্গলগ্রহ নিয়েও ভাবা হচ্ছে বেশ সক্রিয়ভাবেই। সাম্প্রতিক বছগুলোতে চীনের মহাকাশ সংস্থা দাবি করেছে, চাঁদের বুকে তাদের পাঠানো যানে একটি পাত্রে বোনা তুলোর বীজ থেকে চারা গজিয়েছে। চাঁদে তিন ধরনের উদ্ভিদের বীজ পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’। সেখানে বীজগুলো থেকে চারা গজানোর চেষ্টা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
আগামী এক দশকের মধ্যেই মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠানোর তোড়জোড়ও চলছে। নাসার গবেষকরা হিসাব করে দেখেছেন, মঙ্গলগ্রহের প্রতিকূল পরিবেশ ও সেখানে তৈরি করা অবকাঠামো বিবেচনায় নিলেও মাত্র ৬৮ দিন পর থেকেই ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে পড়তে হবে মানুষকে। এজন্য গুনতে হবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। কিন্তু তার স্থায়িত্ব হতে পারে মাত্র দু’মাসের কিছু বেশি। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) গবেষকেরা মঙ্গলগ্রহে মানুষের বসবাসের সম্ভাবনার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইউএসএ) আশাবাদ ব্যক্ত করছে ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে মানববসতি স্থাপন করার।
অনুসন্ধিৎসা ও নতুন কিছু করার ইচ্ছা মানুষের চিরন্তন। সে অনুসন্ধিৎসা থেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যও এসেছে। সে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালেই মানুষ চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, আগামী ২০২৪ সালে তারা মঙ্গলগ্রহে অবতরণ করতে সক্ষম হবেন। এমনকি পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ ও মঙ্গলগ্রহকে মনুষ্য বসতির জন্য উপযোগী করার চেষ্টাও করছেন তারা। কিন্তু নির্জীব চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহকে সজীব করার জন্য মানুষ যতটা তৎপর কিন্তু সুজলা ও সফলা বসুন্ধরার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে তারা ততটাই উদাসীন। এমন অভিযোগ আত্মসচেতন মানুষের।
বিজ্ঞানীরা চন্দ্র ও মঙ্গল পৃষ্ঠকে জীবন ধারণের উপযোগী করার চেষ্টায় অঢেল অর্থও ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু পৃথিবী নামক এই গ্রহটি যে ক্রমেই পরিবেশ বিপর্যয় ও সংঘাতের মুখোমুখি হয়ে ক্রমেই মনুষ্য বসতির অনুপযোগী হয়ে উঠছে তা নিয়ে সেভাবে ভাবা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতার কারণেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (Global Warming) ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব রীতিমতো উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মনুষ্যসৃষ্ট দূষণকারী বস্তুর নিঃসরণ; বিশেষত সালফেট কণা শৈত্যয়ন ক্রিয়া সৃষ্টি করছে। যা পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য ও জীব বৈচিত্র্যের জন্য শুধু ক্ষতিকরই নয় বরং উদ্বেগজনকও।
যদিও তা প্রকৃতির স্বাভাবিক জলবায়ু চক্রের কারণেও হতে পারে। কিন্তু, মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বিশেষত জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত দহন এবং বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে প্রাকৃতিক গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া তীব্রতর হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীতে পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে, এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে পৃথিবী তার ভারসাম্য হারাবে এবং জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গ্রিন হাউজ ইফেক্ট বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নই যে শুধু পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ও সভ্যতার জন্য হুমকি এমন নয় বরং বিশ্বরাজনীতিতে সংঘাত ও শক্তির প্রতিযোগিতাও বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব পরাশক্তিগুলো এখন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় বেশ পুলকবোধ করে। যুদ্ধ বা সমর বলতে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষগুলোর মধ্যে সুসংগঠিত এবং কখনও কখনও দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংঘর্ষকে বোঝানো হয়। চারিত্রিক দিক দিয়ে এটি প্রচণ্ড সহিংস এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। তাই একটি শান্তির বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যেখানে নিরস্ত্রীকরণ প্রয়োজন সেখানে বৈশ্বিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধের ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে বৈ কমছে না। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিশ্বে সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি হচ্ছে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র। উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর আরও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতিরক্ষা বাজেটে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে।
সুইডেনভিত্তিক স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দিয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড মিলিটারি এক্সপেন্ডিচার রিপোর্ট’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অব্যাহত দরপতন ও রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকার পরও সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে দেশটি বিশ্বে তৃতীয় স্থান দখল করেছে। সামরিক ব্যয়ে সবার ওপরে যুক্তরাষ্ট্র এবং এরপর চীন।
২০১৬ সালে বিশ্বে সামরিক খাতে আগের বছরের তুলনায় শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বেশি খরচ হয়েছে, যা বৈশ্বিক জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৬ সালে রাশিয়া সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। মস্কোর সামরিক ব্যয় ৬ হাজার ৯২০ কোটি মার্কিন ডলার।
বিশ্বের শীর্ষ সামরিক শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর প্রতিরক্ষা খাতে তাদের ব্যয় ১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়াচ্ছে। যার সর্বশেষ পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার। এশীয় দেশ চীন সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রতিরক্ষা খাতে দেশটি ২৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার খরচ করছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ইউরোপীয় দেশগুলো গত বছর সামরিক ব্যয় অনেক বাড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। ন্যাটোভুক্ত অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস, ফ্রান্স ও এস্তোনিয়ার সামরিক ব্যয় গত বছর আরও বেশি বাড়ানো হয়েছে। আর ভারত নিজেদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়েছে। দেশটি সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। নয়াদিল্লির সামরিক ব্যয় ৭ হাজার ৫৯০ কোটি ডলার।
সামরিক সংঘাত বা যুদ্ধের ফল যে কখনো ভালো হয় না, অতীতে ফিরে তাকালেই তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায়। যুদ্ধ শুধু মানুষের প্রাণহানিই ঘটায় না বরং মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করে। একই সাথে ব্যয় হয় প্রভূত অর্থের। যা শান্তির কাজে ব্যবহার হলে সভ্যতা আরও অনেক বিকশিত হওয়া সম্ভব ছিল। বিষয়টি আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করার জন্য অতীতের কিছু যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি রোমন্থন করা যেতে পারে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ : ১৯১৪-১৯১৮ সালে এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে ১ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে ৬ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ নিহত হন। ইউরোপকেন্দ্রিক এই যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন প্রায় ৭ কোটি সেনা। এদের মধ্যে প্রায় এক কোটির মৃত্যু হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ : এ যুদ্ধ ১৯৩৯-১৯৪৫ সালে হয়েছে। এতে ৭ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছেন। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড দখল করেন। এর দুদিন পরেই ফ্রান্স এবং ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ধীরে ধীরে তা বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেয়।
তাইপিং বিদ্রোহ : ১৮৫১-১৮৬৪ সালে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ২ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। এটি চীনের সবচেয়ে বড় গৃহযুদ্ধ।
মোঙ্গল শাসনকাল : ১২০৭-১৪৭২ সালে সংঘটিত এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৩ কোটি থেকে ৬ কোটি।
লুসান রেবেলিয়ন : ১৭৫৫-১৭৬৩ সালে সংঘটিত এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লক্ষ থেকে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ। চীনে ট্যাঙ্গ এবং ইয়ান রাজবংশের মধ্যে সিংহাসন দখলের এই লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় দুই কোটি মানুষের।
কুইঙ্গ সা¤্রাজ্যের পতন : এ যুদ্ধ ১৬১৬-১৬৬২ সংঘটিত হয়েছিলো। এতে মৃতের সংখ্যা ২ কোটি ৫০ লক্ষ। চীনের সর্বশেষ রাজবংশ হল কুইঙ্গ। মিঙ্গদের আক্রমণে এই রাজবংশের পতন হয়।
তৈমুর লং : ১৩৬৯-১৪০৫ সালে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। এতে মৃতের সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে ২ কোটি।
দুনগান অভ্যুত্থান : ১৮৬২-১৮৭৭ সালে সংঘটিত এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ২০ লক্ষ। চীনে দুনগান জাতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল কুইঙ্গ রাজবংশের বিরুদ্ধে।
রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ : ১৯১৭-১৯২১ সালে সংঘটিত যুদ্ধে ৫০ লক্ষ থেকে ৯০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। বলশেভিক পার্টির অভ্যুত্থান এবং ক্ষমতা দখলের সেই গৃহযুদ্ধে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষের।
নাপোলিওনিক যুদ্ধ : ১৮০৩-১৮১৫ সালে সংঘটিত হওয়া এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৩৫ থেকে ৭০ লক্ষ। এক সঙ্গে একাধিক দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল সেই সময়ে। প্রায় বারো বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে চলা সেই যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের।
অতীতের কোনো যুদ্ধই সভ্যতার জন্য সুখস্মৃতি বয়ে আনেনি বরং সকল ক্ষেত্রে এক ভয়ঙ্কর চিত্রই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু হামলায় শুধুমাত্র হিরোশিমাতে প্রায় ১৪০,০০০ লোক নিহত হন। নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ লোক মারা যান এবং পরবর্তীতে এই দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪,০০০ জন।
অতীতে যুদ্ধ নিয়ে এমন দুঃসহ স্মৃতির পরও বৈশ্বিক রাজনীতিতে যুদ্ধোন্মাদনা বন্ধ হয়নি। রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল, দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনা, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ এই সবকিছুই বলে দেয় যে আগামী দিনে সশস্ত্র সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পাবে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে প্রত্যেক দেশকে তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো যে দেশগুলো ইতোমধ্যেই সামরিক শক্তিমত্তায় বলিষ্ঠ অবস্থানে পৌঁছেছে, তাদের মাঝেও এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য এখন বিশ্বের সবচেয়ে সঙ্কটময় অঞ্চলের একটি। সিরীয় যুদ্ধ এই সঙ্কটকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এই যুদ্ধের কারণে সংশ্লিষ্ট সব দেশকেই তাদের সামরিক ব্যয় বাড়াতে বাধ্য করেছে। অর্থনীতিবিদ ন্যান তিয়ানের মতে, ‘আমাদের তথ্যমতে শুধুমাত্র ২০১৬ সালে সিরিয়া যুদ্ধে ৪৬৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে রাশিয়া।’ প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৫ সালে মোট বাজেটের ১৩ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করেছে সৌদি আরব। ২০১৬ সালে এই ব্যয় ছিল ৯ শতাংশ।
ইউরোপেও সামরিক ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলো ২০১৬ সালে আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিরক্ষা গবেষক সিমন উইজম্যানের দেয়া তথ্য মতে, রাশিয়া ২৭ শতাংশ ব্যয় বাড়ানোর পর ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোও অনেকটা একই কাজ করেছে।
আধুনিক বিজ্ঞান মানব সভ্যতাকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সকল ক্ষেত্রেই মানবকল্যাণে ব্যবহার করা হয়নি বরং অনেক অনেক ক্ষেত্রে তার অপব্যবহার মানবসভ্যতাকে মহাসঙ্কটের মধ্যেই ফেলে দিয়েছে। চাঁদ ও মঙ্গলগ্রহে প্রাণের স্ফুরণ ঘটানোর পরিকল্পনা নিঃসন্দেহ ইতিবাচক। কিন্তু পৃথিবীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে সবার আগে। বন্ধ করতে হবে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাও। অন্যথায় সভ্যতা সঙ্কটমুক্ত হবে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির