post

সভ্যতা বিনির্মাণে ইসলামকেই বেছে নিতে হবে

রাজিফুল হাসান

০১ মার্চ ২০১৮
সভ্যতার ইংরেজি শব্দ হলো Civilization যা ল্যাটিন শব্দ Civic থেকে আগত, যার অর্থ ‘নগরে বসবাসরত কোন ব্যক্তি’। এর কারণ হলো, যখন কোন স্থানের মানুষ সভ্য হয়, তখন তারা কোন ছোট গোত্র বা যৌথ পরিবারের মত দলে নয় বরং নগরীর ন্যায় একটি বৃহৎ সুসংগঠিত আকারে দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। আর এই সুসংগঠিতভাবে বসবাসের ক্রমোন্নত স্তরই হলো সভ্যতা, ইংরেজিতে civilization। একটি সভ্যতার নিজস্ব আইন-কানুন, সংস্কৃতি, জীবনব্যবস্থা, এবং আত্মরক্ষার স্বাতন্ত্র্যিক পদ্ধতি থাকে। তা ছাড়াও থাকতে পারে কথা বলার জন্য একটি সাধারণ ভাষা এবং জ্ঞানার্জনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা। আর পৃথিবীর সভ্যতার বিশেষজ্ঞগণ, সভ্যতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এ কথাগুলোই বলেছেন বিভিন্নভাবে। অ্যাডামস, রবার্ট ম্যাককোরমিক, হ্যাভিল্যান্ড, উইলিয়াম, ফার্নান্দেজ অ্যারমেস্টো এবং স্টিফেন ভিককারস সভ্যতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, একটি সভ্যতা হলো কোনো জটিল সমাজব্যবস্থা যা নগরায়ণ, সামাজিক স্তরবিন্যাস, প্রতীকী যোগাযোগ প্রণালী (উদাহরণস্বরূপ: লিখনপদ্ধতি) উপলব্ধ স্বতন্ত্র পরিচয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণের মত গুণাবলি দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাদের মতানুসারে সভ্যতাকে আরও কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয় যেগুলোর ওপর সভ্যতা নির্ভরশীল। আর সেগুলো হলো কেন্দ্রীকরণ, আবাসন, শ্রমের বিশেষায়িতকরণ, আধিপত্য স্থাপন, স্থাপত্য শিল্প, কর বা খাজনা আরোপ, কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা, সাংস্কৃতিকভাবে সৃষ্ট উন্নয়ন আদর্শ এবং সম্প্রসারণের প্রবণতা। এ কথা সত্য যে, এ সকল বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছিলো অসংখ্য সভ্যতা। আবার এ সকল বৈশিষ্ট্যের উপযোগিতা আর যথার্থতার অভাবে ধ্বংসও হয়ে গেছে অসংখ্য সভ্যতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনেও এ কথা ঘোষণা করেছেন.... “ওয়ালি কুলি উম্মাতিন আজালুন ফা ইযাজাআ-আজারলুহুম লাইয়াসতাখিরুনা সাআতাও ওয়ালা ইয়াসতাকদিমুন।” (৭:৩৪) অর্থ: “প্রত্যেক জাতির জন্যই (তার উত্থান-পতনের) একটি সুনির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে। যখন তাদের সে মেয়াদ আসবে তখন তারা না এক মুহূর্ত পিছে যেতে পারবে, আর না এগিয়ে আসতে পারবে।” আর এই সুনির্দিষ্ট মেয়াদটুকু নির্ভর করে জাতি বা সভ্যতার কর্মকান্ডের ওপর। যদি সভ্যতার সামগ্রিক কার্যক্রম মানবতার জন্য উপযোগী তথা কল্যাণকর হয় তবে এই সভ্যতার স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে আর যদি অনুপযোগী তথা অকল্যাণকর হয় তবে ঐ সভ্যতা ক্রমাগতভাবে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে থাকে। উভয়টিই হচ্ছে আল্লাহর স্থায়ী নীতি। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার মাঝে অন্যতম ছিলো মিসরীয় সভ্যতা যাকে পৃথিবীর প্রথম সভ্যতা বলা হয়ে থাকে, যার মেয়াদকাল ছিলো প্রায় ৩ হাজার বছর (খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৫০-৩৩২ অব্দ), তবে ক্ষমতার উত্থান-পতন ঘটেছে অনেকবার। ছিলো রোমান সভ্যতা, যার মেয়াদকাল ছিলো ১০০০ বছর, সিন্ধু সভ্যতার মেয়াদ ছিলো ৭০০ বছর (খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০-১৯০০ অব্দ)। পারস্য সভ্যতার মেয়াদ ছিলো ৪০০ বছর (খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-২০০ অব্দ)। তা ছাড়াও ছিল ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা। এসকল সভ্যতার পরও পৃথিবীতে অনেক সভ্যতার বিনির্মাণ হয়েছিলো, আবার হয়েছে ধ্বংস। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেন, আমি পৃথিবীর সকল সভ্যতার ধ্বংসস্তূপকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তোমরা কেন ধ্বংস হলে? তারা শুধু একটাই জবাব দিয়েছিলো, injustice & injustice (অন্যায়/ অবিচার)। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত সভ্যতাগুলোর অনেক শক্তি সামর্থ্য থাকার পরও অন্যায়-অবিচারের কারণে ধ্বংস হয়ে যেতে হয়েছে। গ্রিক সভ্যতা অনুযায়ী তাদের দেবতারা দেবীদের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হতেন। এরই মাধ্যমে জন্ম নেয়া এক জারজ সন্তান ‘কিউপিড’ হলো তাদের প্রেম দেবতা। এ ছাড়া আফ্রোদিত, এথেন্স, থেমিসসহ তাদের সকল দেবীই উলঙ্গ থাকতেন বলে তাদের মূর্তিগুলো আভাস দেয়। দেব ‘ইদিপাস’ অবশ্য স্বয়ং নিজ মাতার প্রতি কামভাবে আসক্ত ছিলেন। শুধু এতটুকুতেই বোঝা যায় ঐ সভ্যতার নোংরামি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল। মিসরীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যের মাঝে অন্যতম ছিল যে রাজ পরিবারের বংশধরদের মাঝে যাতে ‘রাজকীয় রক্ত’ বিশুদ্ধতার মানদন্ড বজায় রেখে প্রবাহিত হতে পারে এ জন্য পিতা-কন্যা, মাতা-পুত্র, ভাই-বোনের মাঝে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলে পরবর্তী প্রজন্মকে ‘ডিজাইন’ করা হতো। আর রোমানদের বিশেষায়িত করতে গেলে যে বৈশিষ্ট্যটি বলতে হয়, তারা গবাদি পশুর ন্যায় মানুষ কেনাবেচা করত। এই দুর্ভাগা মানুষদের ‘গাডিয়েটর’ (প্রাচীন রোমের মল্লযোদ্ধা) নাম দিয়ে সিংহ বা বাঘের খাঁচায় ছেড়ে দিতো। গাডিয়েটররা জীবন বাঁচাতে হিংস্র পশুর সাথে ধস্তাধস্তি করে অবশেষে (পশুর) খাদ্যে পরিণত হতো। আর এগুলো দেখে উঁচুজাতের রোমানরা আনন্দ পেত। রোমান রাজ্যে সকল আইন ছিলো শুধু নিম্নবিত্ত আর প্রজাদের জন্য, উচ্চবিত্ত আর ধনিক শ্রেণীর জন্য কোন আইন নেই। তারা যা চায় তাই করতে পারে। বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বৃহত্তম অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো আরও একটি সভ্যতা। যাকে সমাজতান্ত্রিক সভ্যতা বলা হয়। যার উদ্দেশ্য ছিলো সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা, অর্থাৎ সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করা। এই সভ্যতা প্রতিষ্ঠার পর এর ধারক-বাহকরা তাদের রাজ্যকে ঘোষণা করেছিলো  golden heaven  বা সোনালি স্বর্গ হিসেবে। অর্থাৎ তাদের রাজ্যে স্বর্গীয় সুখ বিদ্যমান। তবে ইতিহাস সাক্ষী তথাকথিত স্বর্গীয় সুখ সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলো। অর্ধাহারে অনাহারে হাজারো মানুষ মারা গিয়েছিলো। বাধ্য হয়ে এই স্বর্গীয় সুখের রাজ্য ত্যাগ করে মানুষ পলায়ন করেছিলো অন্য রাজ্যে। আর মানুষ যাতে সীমানা পেরিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য বসানো হয়েছিলো পাহারা। বাঁচার জন্য পালাতে গিয়েও মারা পড়েছিল অসংখ্য মানুষ। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব সাধন এবং ১৯২১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে যে সোনালি স্বর্গ (সমাজতন্ত্র) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, সময়ের ব্যবধানে সমাজতন্ত্রকে ছেড়ে আবার পুঁজিবাদকেই পুনরায় গ্রহণ করে নিয়েছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। আজ পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে আমেরিকান সভ্যতা ও ইউরোপিয়ান সভ্যতা। দু’টি সভ্যতা আলাদা নামে প্রকাশ হলেও মূলমন্ত্র একই। রাজনীতিতে গণতন্ত্র, অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ, আর বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনাই এই সভ্যতার মূলভিত্তি। আর ধর্ম এখানে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, শুধু ব্যক্তিগতভাবেই এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। এই সভ্যতায় শ্রেণিবৈষম্য এই পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে ধনীরা আরও ধনী হতে থেকেছে আর দরিদ্ররা আরও দরিদ্র। নারীরা এখানে শুধু ভোগের পণ্য, তারা হারিয়েছে স্ত্রীর অধিকার আর মায়ের মর্যাদা। লোপ পেয়েছে সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার স্নেহ আর মা-বাবার প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা। আর তাই সন্তান জন্ম নিলে পাঠিয়ে দেয়া হয় বেবি কেয়ার সেন্টারে, আর মাতা-পিতা বৃদ্ধ হলে পাঠিয়ে দেয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মা-বাবার জন্য সময় এতই কম যে বছরে একদিন মা দিবস, বাবা দিবসের মাধ্যমে তাদের কথা স্মরণ করানোর চেষ্টা করা হয়। যৌন সম্ভোগকেই তারা জীবনের সব কিছু মনে করে নিয়েছে। আর তাই আমেরিকায় বিপরীত লিঙ্গের সাথে দৈহিক মিলনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইনে বৈধ করে নিয়েছে সমকামিতাকেও। অর্থাৎ একই লিঙ্গের দু’জনের মাঝে বিয়ে ও মিলনকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া আইনিভাবে বৈধতা না পেলেও এর ব্যাপক চর্চা রয়েছে ইউরোপের প্রায় সব কয়টি দেশেই। তবে এর মাধ্যমে এই সভ্যতা তার পতনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটিই গ্রহণ করেছে। কারণ সভ্যতা গড়ে ওঠে মানুষের সমন্বয়ে, যদি মানুষের ক্রমাগত বংশবৃদ্ধিই না হয়, তবে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ হবে কাদের নিয়ে? আর সমকামিতার মাধ্যমে মানবসন্তান বংশ বিস্তারে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া রুদ্ধ করেছে তারা। ইতিহাস সাক্ষী এই অপরাধের কারণেই গজবপ্রাপ্ত হয়েছিল হযরত লূত (আ)-এর জাতি। আজ পৃথিবীর নেতৃত্বদানকারী সভ্যতাগুলো যখন ধর্মবিমুখ, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে গ্রহণ করে নিয়েছে ধর্মহীনতা। তখন পৃথিবীর সভ্যতা বিশারদ ক্রিস্টানোফার ডারসন বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন-‘পৃথিবীর সভ্যতার আদি ভিত্তি হচ্ছে ধর্ম। ধর্মকে ভিত্তি করেই পৃথিবীর সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল।’ আর অং সান সু চির মতে, ‘পৃথিবীর সভ্যতা ধর্মের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে।’ আর লেখার শুরুতেই সভ্যতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, অনেকগুলো সুসংগঠিত জনসমষ্টির সমন্বয়েই গঠিত হয় সভ্যতা। যাদের নিজস্ব পরিচয়, আইন-কানুন, সংস্কৃতি এবং প্রতিরক্ষার পদ্ধতি থাকবে। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে এই সুসংগঠিত জনসমষ্টি গঠিত হতে হলে প্রথমেই গঠন হতে হয় একটি পরিবারের, আর অনেকগুলো পরিবার মিলে একটি গ্রাম/পাড়া/ মহল্লা/ওয়ার্ড গঠিত হয়। আবার অনেকগুলো ওয়ার্ড মিলে একটি থানা, আর অনেকগুলো থানার সমন্বয়ে একটি নগর গঠিত হয়। এভাবেই গঠিত হয় একটি নগর সভ্যতা অর্থাৎ নাগরিক সভ্যতা। আবার অনেকগুলো নগরের সমন্বয়ে কোন একটি বৃহত্তর সভ্যতা গড়ে ওঠে, যেমনটি হয়েছে বর্তমান আমেরিকায়। আবার যদি একইরকম কৃষ্টি-কালচার, নিয়ম-কানুন বিরাজমান থাকে অনেকগুলো দেশে, তবে এসকল দেশের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে একটি মহাদেশীয় সভ্যতা। যেমনটি হয়েছে বর্তমান ইউরোপিয়ান সভ্যতা। আর একটি মহাদেশ হওয়ার পরও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম কৃষ্টি-কালচার, নিয়ম-কানুন বিরাজমান থাকায় একটি মহাদেশীয় সভ্যতা হিসেবে প্রকাশ পেতে পারেনি এশিয়া মহাদেশ। তবে এই বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, সভ্যতা গঠনের প্রাথমিক একক হচ্ছে পরিবার। এমনকি সভ্যতা ক্রমবিকাশের একক বলাও চলে। কারণ পরিবারগুলোই মানবসভ্যতার প্রজনন কেন্দ্র। আর এই পরিবার গঠিত হয় একজন পুরুষ এবং একজন নারীর বৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে, যাকে বিয়ে (Marriage) বলা হয়। এই বিয়ের প্রক্রিয়া মানুষকে কে শিক্ষা দিয়েছে? উত্তরে বলতে হবে ‘ধর্ম’। কারণ ধর্মই একজন পুরুষ ও একজন নারীর মাঝে বৈধ সম্পর্ক জুড়ে দিয়েছে। পৃথিবীর সকল ধর্মে বিবাহের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। যদি ধর্ম এই কাজটি না করতো তবে পৃথিবীর মানবসভ্যতা গঠনতো দূরের কথা মানুষের অস্তিত্বই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেত। শুধু তাই নয়, ধর্মের মাধ্যমেই মানুষের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপিত হয়। সন্তান তার জন্মদাত্রীকে মা আর জন্মদাতাকে বাবা বলে ডাকে এবং তার জন্মদাতার পিতাকে দাদা আর মাতাকে দাদী বলে ডাকে। মা-বাবার সাথে যেভাবে আদবের সাথে কথা বলে, আচার-আচরণ করে ভাই-বোনের সাথে তা কিছুটা ভিন্ন। আবার বন্ধু/ক্লাসমেটের সাথে সম্পর্কের ধরনটা একেবারেই ভিন্ন। এই বিষয়গুলো মানুষকে ধর্মই শিক্ষা দিয়েছে। পৃথিবীর একটি রাষ্ট্রও কি এমন আছে যেখানে রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান একজন সংখ্যালঘু? উত্তরে বলতে হবে নেই। কোন রাষ্ট্র বা সরকার কেন পৃথিবীতে কয়টা উপজেলা আছে যার চেয়ারম্যান একজন সংখ্যালঘু অথবা কয়টা ইউনিয়ন/ওয়ার্ড আছে যেখানে চেয়ারম্যান/ মেম্বার একজন সংখ্যালঘু। হ্যাঁ কিছু হয়তো আছে, তবে তার শতকরা হার কি ১% হবে? না হবে না। বরং দেখা যায় যে দেশে যে ধর্মের অনুসারী বেশি সেই ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকেই একজন রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান হয়ে থাকেন, সেটা ঐ দেশে যেকোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চালু থাকুক না কেন। আমেরিকা খ্রিস্টান প্রধান দেশ, তাদের দেশের প্রেসিডেন্ট একজন খ্রিস্টান। চীন বৌদ্ধ প্রধান দেশ, চীনের প্রেসিডেন্ট একজন বৌদ্ধ। ইন্ডিয়া হিন্দুপ্রধান দেশ আর তাই ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী একজন হিন্দু। বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ এ দেশের প্রধানমন্ত্রীও একজন মুসলিম। এমনটাই হয়ে আসছে পৃথিবীতে। তা হলে এমনটি কেন হয়? নিঃসন্দেহে ‘ধর্মীয় শক্তির’ প্রভাবেই এমন হয়। তবে পৃথিবীর কোথাও এমনকি দেখা গেছে যে সংখ্যালঘুরা বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে? উত্তরে বলতে হবে না। বরং যেখানেই যারা সংখ্যালঘু সেখানে তারা একসাথে বসবাস করে। বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ আর খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু আর তাই হিন্দুদের সমন্বয়ে হিন্দুপাড়া, খ্রিস্টানদের সমন্বয়ে খ্রিস্টানপাড়া আর বৌদ্ধদের সমন্বয়ে বৌদ্ধপাড়া গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। তারা যেখানে যে কয়জন আছে একসাথে বসবাস করতে পছন্দ করে। আবার নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনে ঠিক একইভাবে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানেও একই চিত্র দেখা যায়। তাহলে কোন শক্তি তাদের একসাথে বসবাস করতে বাধ্য করছে? নিঃসন্দেহে ‘ধর্মীয় শক্তি’। একটু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে একজন মানুষের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি তার স্বধর্মেরই হয়ে থাকে, তার বিয়ে-শাদি, ব্যবসায়িক লেনদেন, মোয়ামেলাতসহ সামগ্রিক জীবনাচরণ ধর্মের বলয়েই আবর্তিত হয়। যদি পরিবার গঠন হয় ধর্মীয় নিয়মে, ব্যক্তি ও সমাজজীবন পরিচালিত হয় ধর্মীয় বলয়ে আর দেশের শাসক নির্বাচিত হয় ধর্মীয় প্রভাবে, তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে জীবনব্যবস্থা/ শাসনব্যবস্থা হিসেবে ধর্ম কেন নয়? আর ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিইবা কোথায়? ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার অন্যতম গুরু ‘ফিদেল ক্যাস্ট্রো’ জীবনের শেষ দিকে এসে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন ‘ধর্মের কাছেই ফিরে আসতে হবে’। ক্রিস্টানোফার ডারসনের মতে চারটি ধর্ম পৃথিবীর সভ্যতার আদি ভিত্তি কনফুসীয় ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম আর ইসলাম। আবার ওয়েবার তার সাথে আরো একটি ধর্ম যুক্ত করেছেন তা হলো বৌদ্ধ ধর্ম। কনফুসিয়াস ধর্মের অনুসারী পৃথিবীতে আজ আর নেই। সময়ের আবর্তনে এই ধর্ম তার উপযোগিতা/ গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এই ধর্ম আজ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত। হিন্দু ধর্ম একটি অতিপ্রাচীন সনাতন ধর্ম। মূলত দেব-দেবীর মূর্তি পূজাই এই ধর্মের উপাসনার মাধ্যম। তা ছাড়া দেব-দেবীদেরকে খুশি করার নামে তরুণ-তরুণীর অবাধ নৃত্য পরিবেশনা আর শিবলিঙ্গের পূজার নামে বেহায়াপনার বিস্তার এই ধর্মের প্রতি তরুণ অনুসারীদের আকৃষ্ট করার অন্যতম পন্থা। যার ফলে যৌন অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র ইন্ডিয়াতে। যৌন অপরাধের তালিকায় ৫ম স্থানে থাকা দেশটিতে National Crime Record Bureau (NCRB)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১০ সাল হতে প্রতি বছর ৭.৫% হারে যৌন অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে দেশটিতে, এই অপরাধীদের বেশির ভাগ ১৮-৩০ বছর বয়সের। ২০১৩ সালের রিপোর্টে দেখা যায় ইন্ডিয়ার শহরগুলোর মাঝে রাজধানী দিল্লিতে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হয় সবচেয়ে বেশি, সেখানে গড়ে দৈনিক ৪টি মামলা জমা হয় পুলিশের নিকট আর ঐ বছর হয়েছিল ১,৬৩৬টি। রাজ্যগুলোর মাঝে এই অপরাধের হার সবচেয়ে বেশি ছিল মাদিয়া প্রদেশে, প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১১টি মামলা ফাইল হতো আর ঐ বছর হয়েছিল ৪,৩৩৫টি। ২০১৩তে রাজস্তানে মামলা জমা হয়েছিল ৩,২৮৫টি, মহারাষ্ট্রে ৩,০৬৩টি আর উত্তর প্রদেশে ৩,০৫০টি। মামলার তথ্যের আলোকে প্রতিদিন গড়ে ৯৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ইন্ডিয়াতে। তবে মাদিহা ক্লার্ক এর মতে, ‘ইন্ডিয়ায় প্রায় ৫৪% ধর্ষণের ঘটনাই অপ্রকাশিত থেকে যায়’, আর মিহির শ্রীভাসতাবার মতে, এর পরিমাণ প্রায় ৯০%। আর তাই ইন্ডিয়ার সরকারের নিকট আজ ‘যৌন অপরাধ দমন’ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধর্মে শ্রেণিবৈষম্য এরকম পর্যায়ে যে এখানে ব্রাহ্মণ ব্যতীত ক্ষত্রিয়, শুদ্র এবং বৈশ্যদের জন্য তাদের ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করা পর্যন্ত মহাপাপ। আর একশ্রেণীর সাথে অন্য শ্রেণীর বৈবাহিক সম্পর্কতো অনেক দূরের কথা-স্পর্শ করাই পাপ হিসেবে গণ্য ছিল। আর এই শ্রেণিবৈষম্যের কারণেই কিন্তু যখন হযরত শাহজালাল, শাহপরাণ ভারতবর্ষে ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রচারে এসেছিলেন তখন নির্যাতিত-নিপীড়িত বৈষম্যের শিকার হিন্দুরা ইসলামের শান্তি ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করে আশ্রয় নিয়েছিল ইসলামের ছায়াতলে। বর্তমানে এই হিন্দুদের অবস্থা এরকম যে শিক্ষিতরা আর খুব বেশি ধর্ম-কর্ম পালন করে না। কেউ কেউ নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে আবার কেউ ধর্মান্তরিত হচ্ছে ইসলাম ধর্মে। সম্প্রতি কিছুদিন পূর্বে ইন্ডিয়ায় দলিত সম্প্রদায়ের হিন্দুরা তাদের স্বধর্ম ত্যাগ করে শান্তির ধর্ম হিসেবে ইসলামকেই গ্রহণ করে নিয়েছে। জন্মগত প্রক্রিয়া ব্যতীত ধর্মান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে এই ধর্মের অনুসারী বৃদ্ধি পায় না। হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র ইন্ডিয়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চাইতে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বৃদ্ধি হয় অনেক বেশি। আর তাই হিন্দু ধর্ম বিলুপ্তির আশঙ্কায় একজন হিন্দু ধর্মগুরু ঘোষণা দিয়েছেন ‘চারটি সন্তান জন্ম দিলে নগদ রুপি (ভারতীয় মুদ্রা) পুরস্কৃত করা হবে।’ খ্রিস্টান ধর্ম সংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের ধর্ম হলেও তার প্রকৃত অনুসারী সেই অনুসারে অনেক কম। ইউরোপ আমেরিকাতেই এই ধর্মের অনুসারী সবচেয়ে বেশি। তারা তাদের ধর্মকে নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করে নিয়েছে। এই ধর্ম তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। তাই দেখতে পাওয়া যায় ইউরোপ আমেরিকার বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাসের দিক থেকে নাস্তিক্যবাদকে গ্রহণ করে নিয়েছে। আর একটি অংশ আশ্রয় গ্রহণ করেছে ইসলামের ছায়াতলে। তাদের সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামো ভেঙে গেছে। কারণ যৌন সম্ভোগ তাদের মানসিকতাকে এতটাই বিকারগ্রস্ত করেছে যে পরিবার গঠনের চেয়ে উন্মুক্ত ভোগবিলাসকেই তারা গ্রহণ করে নিয়েছে। অথচ পরিবার গঠন না হলে গঠিত হবে না সমাজ, রাষ্ট্র আর সভ্যতা এবং বৃদ্ধি পেতে থাকবে যৌন অপরাধ ও সামাজিক অনাচার। ইতোমধ্যে এই দৃশ্য প্রতীয়মান হয়েছে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দেশগুলোতে। নিরীক্ষায় দেখা যায় সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ সংঘটিত হয় এরকম ১০টি দেশের তালিকার ৯টি-ই খ্রিষ্টানপ্রধান দেশ। তালিকায় প্রথম স্থানে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার ৪০% নারী তাদের জীবদ্দশায় ধর্ষণের শিকার হন। আর প্রতি বছর হিসেবে গড়ে ৫০০০০০টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে দেশটিতে। South Africas Tears Foundation এবং The Medical Research Council-এর তথ্যানুসারে “দক্ষিণ আফ্রিকার ১৮ বছরের কম বয়সের প্রায় ৫০% শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয় এবং দেশটিতে যারা যৌন হয়রানির শিকার হয় তাদের প্রতি ৯ জনে ১ জনের তথ্য প্রকাশিত হয় অবশিষ্ট সংখ্যা অপ্রকাশিত থেকে যায়।’ আর পুলিশের মতে এই অপ্রকাশিত ঘটনার পরিমাণ আরো বেশি। ২য় অবস্থানে থাকা সুইডেনে ১৯৭৫ সাল হতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নারী ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪৭২%। সে দেশের আইনজীবীদের মতে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের প্রতি ৩ জন তরুণীর মাঝে ১ জন ধর্ষণের শিকার হয়। জর্জ মাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তালিকায় ৩য় স্থানে থাকা আমেরিকায় প্রতি ৩ জনে ১ জন নারী তার জীবদ্দশায় ধর্ষণের শিকার হন, এর মাঝে ৭৯% নারীই ২৫ বছরের কম বয়সেই এই নির্যাতনের শিকার হন।RAINN (Rape, Abuse & Incert National Network) এর তথ্যানুযায়ী আমেরিকায় প্রতি ৯৮ সেকেন্ডে ১ জন যৌন হয়রানির শিকার হয়। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৮৮২ জন আর প্রতি বছর গড়ে ৩,২১,৭৯৫ জন। এর মাঝে ৬৮% ভিকটিমই ঘটনা পুলিশকে জানায় না আর ৯৮% ধর্ষকই একদিনের জন্যও জেলে যেতে হয় না। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ৪র্থ, ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৮ম, ৯ম এবং ১০ম স্থানে যথাক্রমে অবস্থান করছে ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জিম্বাবুয়ে এবং ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ড। তাদের সমাজের ৬০% মানুষ জারজ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। এই সভ্যতা তার পিতার পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে। এই সমস্যা অনুধাবন করতে পেরে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ বার্নার্ড-শ বলেছিলেন “আগামী ১০০ বছরের মাঝে সমগ্র ইউরোপকে বিশেষ করে ইংল্যান্ডকে তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য ইসলামকেই গ্রহণ করতে হবে।” এর বাস্তবতা আজ দেখা যাচ্ছে সমগ্র ইউরোপে সাথে আমেরিকাতেও। নিরীক্ষায় দেখা যায় ইউরোপ এবং আমেরিকায় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ধর্মের নাম হলো ইসলাম। এক জরিপে উঠে এসেছে ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এই ৫০ বছরে ইউরোপ এবং আমেরিকায় খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী বৃদ্ধি হয় ৬৫% আর ইসলাম ধর্ম বৃদ্ধি হয় ২৩৫%, যা খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের ভাবিয়ে তুলেছে। খ্রিষ্ট ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ‘জন পোপ বেনিটিক্স’ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “তোমরা ধার্মিক হও, বিবাহ করো, সন্তান ধারণ করো নইলে খ্রিস্ট ধর্ম অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।” আর তাই জন্মগত প্রক্রিয়ায় অনুসারী বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ইংল্যান্ডে সন্তান জন্ম নিলে ভাতা ও মাতৃত্বকালীন ছুটির পাশাপাশি আইন পাস করে দেয়া হয়েছে, পিতৃত্বকালীন ছুটিও। যত বেশি সন্তান জন্ম দিবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তত বেশি আর্থিক পুরস্কার এবং সম্মানের ঘোষণা দেয়া আছে ফিনল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেক দেশে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক ‘হ্যারি লি কুয়ান ই্উ’-এর একটি আফসোসের কারণ ছিল যে অনেক চেষ্ট-প্রচেষ্টা আর সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেও বৈবাহিক জীবন ও সন্তান গ্রহণের বিষয়ে তার দেশের নারীদের রাজি করাতে না পারা। আর গৌতম বৌদ্ধের মৌলিক শিক্ষা ‘সর্বজীবে দয়া করো’ লিখনিতে থাকলেও তার অনুসারীরা এর ব্যত্যয় ঘটিয়েছে সর্বত্রই। আমাদের পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধপ্রধান দেশ মিয়ানমারে কী ঘটেছে পৃথিবী তা প্রত্যক্ষ করেছে। সর্বজীব কেন সর্বশ্রেষ্ঠ যে জীব ‘মানুষ’ শুধু অন্য ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণে তাদের জীবন্ত হত্যা করা হচ্ছে। আর এই হত্যাযজ্ঞে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে বৌদ্ধ ধর্মগুরুগণ। জন্মগত প্রক্রিয়া ব্যতীত অন্য কোন প্রক্রিয়ায় হিন্দু ধর্মের ন্যায় বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীও বৃদ্ধি পায় না। আর অতিমাত্রায় ভোগবাদী জীবনব্যবস্থার কারণে এর (জন্মগত প্রক্রিয়ায় বৃদ্ধির হার) পারসেন্টেজও মাঝে মাঝে হয়ে যায় মাইনাস (-)। এই দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায় বৌদ্ধপ্রধান দেশ জাপানে, সেখানে নারীরা বিয়ের চাইতে মুক্ত ভাবে জীবনকে ভোগ করাকেই বেশি পছন্দ করে এবং সন্তান জন্ম দেয়া ও লালন-পালন করা তাদের নিকট অসহনীয় ব্যাপার। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বৌদ্ধপ্রধান দেশ হওয়া সত্যেও সে দেশের অল্প সংখ্যক মুসলমানদের ধর্মকর্ম পালন করাকে মেনে নিতে পারছে না চীন সরকার। ইসলামের বাস্তবিক সৌন্দর্য দেখে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আর তা প্রতিরোধ করতেই বিভিন্ন সময় মুসলমানদের ধর্ম পালনের ওপর আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা, যা ধর্ম বিদ্বেষের-ই বহিঃপ্রকাশ। উপরোল্লিখিত ধর্মগুলো তাদের স্ব-অবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। কারণ এসকল ধর্মের বিশ্বাস ও কর্ম পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে নিয়েছে ঐ ধর্মের অনুসারীরাই। এদিকে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মনোনীত পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম হলো ইসলাম। যে ধর্মের ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘যালিকাল কিতাবু লারাই বা ফিহি।’ (২:২) অর্থ : “এই সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই।” এ গ্রন্থের সংরক্ষণকারী আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন নিজেই ‘ইন্না নাহনু নাযযালনায্ যিকরা ওয়া ইন্না লাহুলা হাফিজুন।’ (১৫:৯) অর্থ: “আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ নাজিল করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” তাই এটি সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত অবিকৃত একটি গ্রন্থ। যার সত্যতা সম্পর্কে স্যার উইলিয়াম মূর, যিনি একজন কট্টর ইসলামবিরোধী এবং নিরীক্ষক ছিলেন, তিনি পবিত্র কোরআন সম্পর্কে লিখেন, “সৃষ্টিজগতে সম্ভবত দ্বিতীয় এমন কোন গ্রন্থ নেই, যার মূল অংশে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন সংঘটিত হয়নি।” এ গ্রন্থে মানবজাতি সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে “ওয়ানাযযালনা আলাইকাল কিতাবা তিবইয়ানাল্ লিকুলি শাইয়ুও ওয়াহুদাও ওয়া রাহমাতাও ওয়া বুশরালিল মুসলিমীন।” (১৬:৮৯) অর্থ: “আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি, যেটি এমন যে তা (জীবনব্যবস্থার) সকল বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা।” অর্থাৎ মানবজাতির সকল বিষয়ের বিস্তারিত সমাধান এই গ্রন্থে (কোরআনে) বর্ণনা করা হয়েছে, যার সত্যতা স্বীকার করেছেন ব্রিটিশ পন্ডিত নিকলসন। পবিত্র কোরআন সম্পর্কে তিনি বলেন, “Its a holy book. This holy book is a science book for scientist, a book of prosody for poets, a grammar book for grammarian, a lexicon for etymologist and encyclopaedia for law & legislation” আর এই ইসলাম ধর্মের বার্তাবাহক হযরত মোহাম্মদ (সা), যার সম্পর্কে বলা হয়েছে “ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাললিল আলামিন।” (২১:১০৭) অর্থ: “আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।” যাকে সমগ্র মানবতা শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মাইকেল এইচ হার্ট তার “দি হান্ড্রেড” গ্রন্থে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একশজন প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় মোহাম্মদ (সা)-কে রেখেছেন এক নম্বরে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “Mohammad is the saver of humanity” অর্থাৎ মোহাম্মদ (সা) মানবতার মুক্তির দূত। তিনি হচ্ছেন এরকম মানুষ যিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন, “আমি যা করি তোমরা (যতটুকু দেখতে পাও) তা অন্যের নিকট বলে দিও।” এতটুকু স্বচ্ছতার ঘোষণা পৃথিবীর কেউ দিতে পারেনি কোনদিন। ব্রিটিশ চিন্তানায়ক স্পেইনলার্জ বলেন, “কি আশ্চর্য তার (মোহাম্মদ সা:-এর) জীবন-ইতিহাস। শুধুমাত্র একজন মানুষের (মোহাম্মদ সা:-এর) জীবন যাচাই করার জন্য প্রায় সোয়া লক্ষ (এক লক্ষ পঁচিশ হাজার) মানুষের জীবন যাচাই করা হয়েছে, এমন ঘটনা মানব ইতিহাসে নেই।” আজ পৃথিবীর কোথাও শান্তি নেই। শান্তির খোঁজে সবাই অস্থির। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন “লাকাদ্ কানা লাকুম ফি রাসুলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাহ।” (৩৩:২১) অর্থ: “তোমাদের জন্য অবশ্যই আল্লাহর রাসূলের (জীবনের) মাঝে (অনুকরণযোগ্য) উত্তম আদর্শ রয়েছে।” আর পৃথিবীর জ্ঞানীগণ এ কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছেন। প্রফেসর মি. শান্তিরাম বলেছেন, “মোহাম্মদ (সা) বিশ্বজগতে সৎচরিত্রতা, ভালোবাসা এবং সাম্যের আলো ছড়িয়েছেন, দরিদ্রদের প্রতি অত্যাচারের চির নির্বাস ঘটিয়েছেন।” খ্রিষ্টান পাদরি রেভারেন্ড বসওয়ার্থ স্মিথ বলেন, “হযরত মোহাম্মদ (সা) একাধারে সিজারের ন্যায় শাসনতন্ত্রের শীর্ষভাগে এবং পোপের ন্যায় ধর্মমন্দিরের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর পোপের ন্যায় জাঁকজমক এবং সিজারের ন্যায় সেনাবাহিনী ছিল না। বেতনভোগী সেনা, দেহরক্ষী সৈনিক, রাজকীয় প্রাসাদ ও নির্ধারিত রাজস্ব ব্যতীত তিনি স্বর্গীয় অধিকার বলে রাজত্ব করেছেন। আমি বিশ্বাস করি, সুবিজ্ঞ দার্শনিক এবং প্রকৃত খ্রিষ্টানগণ একদিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পরমেশ্বরের প্রকৃত নবী বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন।” আজ সমগ্র পৃথিবীতে নারীরা অধিকারবঞ্চিত। অধিকারের নামে স্বাধীনভাবে অবাধ মেলামেশার সুযোগ দিয়ে করা হয়েছে ভোগের পণ্য। অথচ ইসলাম গর্তের মাঝে জীবন্ত পুঁতে ফেলা নারীদের উঠিয়ে দিয়েছিল নতুন জীবন এবং স্ত্রী, মা, মেয়ে ও বোনের সম্মান। ঘানার বিচারপতি মি. জাস্টিস ক্রেবাইটস বলেন, “হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জগতে নারী জাতির অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা কৃতিত্বপূর্ণ মহাপুরুষ। বহু শতাব্দীব্যাপী ইসলাম নারী জাতির অধিকার সংরক্ষণ করে আসছে, যেন তারা সমাজে সম্মানের সাথে বসবাস করতে পারে।” এডওয়ার্ড এ ফারমার বলেন, “বহু বিবাহব্যবস্থার মাধ্যমে হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যভিচার এবং উপপতœী পোষণের পরিবর্তে একটি সুন্দর ধর্মীয় ও আইনগত বিধান জারি করেছিলেন।” বিশিষ্ট কলামিস্ট রেভারেন্ড গ্রিওগোর রাসূল (সা)-এর সাফল্য সম্পর্কে বলেন, “মদ্যপান এবং পতিতাবৃত্তি বন্ধ করে তিনি একজন বিরাট সমাজ সংস্কারক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।” উপরোল্লিখিত ধর্মের অনুসারীদের ন্যায় ইসলাম ধর্মের কোন অনুসারীই এর মূল শিক্ষা থেকে পথভ্রষ্ট হয়নি বিষয়টি এমন নয়। বরং বিশ্বায়নের এই যুগে বস্তুবাদী জীবনব্যবস্থার অনেক কুফলই ভোগ করতে হচ্ছে মুসলিম জাতিকেও। তবে বিশ্বাসের মূল ভিত্তি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে ইলাহ ও হযরত মোহাম্মদ (সা)-কে আল্লাহর মনোনীত রাসূল হিসেবে মেনে নিতে কোন ভিন্নমত নেই মুসলিম জাতির। আর শৃঙ্খলিত জীবনের মূলভিত্তি হিসেবে ধর্ম নির্ধারিত বিয়ে ও পরিবার গঠনেই অভ্যস্ত তারা। তাই মুসলিম জাতি সভ্যতা বিনির্মাণের প্রাথমিক একক পরিবারকে যেমন সুরক্ষিত রেখেছে তেমনি ইসলামের অন্যতম মৌলিক শিক্ষা সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের মাধ্যমে সামাজিক জীবনকেও করেছে শক্তিশালী। এ বিষয়ে ঘানার বিচারপতি মি. জাস্টিস ক্রেবাইটস বলেন, “ইসলামের বিশেষ শিক্ষা ও নির্দেশ নারী পুরুষের কর্তব্যাবলির ব্যাখ্যা দিয়ে সমাজজীবনকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছে।” তাই আদর্শিকভাবে ব্যর্থ পৃথিবীর অন্য সকল মতাদর্শের বুদ্ধিজীবীগণ ইসলামের অগ্রযাত্রা রুখতে বেছে নিয়েছে বিকল্প পথ। আমেরিকান খ্রিষ্টান বুদ্ধিজীবী পি. কে হান্টিংটন লিখেছেন তার বিখ্যাত “ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন” বইটি। যেখানে তিনি বলেছেন “আগামী দিনে সভ্যতাগুলোর মাঝে যে দ্বন্দ্ব হবে তার একটি পক্ষ হবে ইসলাম আর অপর পক্ষ হবে অন্য সকল ধর্মগুলোর সমন্বয়ে।” আর এটি বুঝতে পেরে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ সিদ্ধান্ত নিলেন যে “আক্রান্ত হওয়ার আগেই আক্রমণ করতে হবে।” টুইন টাওয়ার নাটকের মাধ্যমে মুসলমানদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল মুসলিম রাষ্ট্র আফগানিস্তানকে। একই অভিযোগে শক্তিশালী মুসলিম দেশ ইরাক, লিবিয়া আর সিরিয়াকেও। তবে এই থিওরি ব্যর্থতায় পরিগণিত হতে যাচ্ছে। কারণ মুসলিম তরুণদের অগ্রণী ভূমিকায় শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাপী মুসলিম জাগরণ, সৃষ্টি হয়েছে নতুন রেনেসাঁ। ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে উঠছে পৃথিবীর সর্বত্রই। তাইতো টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দুই মাসের মাঝে নিউ ইয়র্কসহ আমেরিকায় ২০,০০০ মানুষ ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। আধুনিকতার ছলে মানববিধ্বংসী এই সভ্যতা শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে বিগত দু’টি বিশ্বযুদ্ধে হত্যা করেছে সাত কোটি পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ। অথচ অর্ধ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল ইসলাম কিন্তু এর কিয়দাংশ হত্যার দরকার পড়েনি। যেখানে ছিল না কোন সাদা-কালো, উঁচু-নীচু, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ আর ধর্মীয় বিদ্বেষ। ডব্লিউ এইচ টি গার্ডেনার তার ‘মিনস্ অব ইসলাম’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, “ইসলাম খ্রিষ্টবাদকে পরাজিত করে এবং এর বিশৃঙ্খলা অসামঞ্জস্যকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করে বিশ্বে একক ধর্ম হিসেবে ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার করেছে। আর এটাই একমাত্র ধর্ম যার মর্মবাণীর কাছে খ্রিষ্টবাদের বক্তব্য ম্লান হয়ে গেছে।” খ্রিষ্টান পাদরি রেভারেন্ড বসওয়ার্থ স্মিথ বলেন, “এটা অত্যন্ত স্পষ্ট ও সত্য ঘটনা যে, ইসলাম নব দীক্ষিত নিগ্রোদেরকে সাহস, মর্যাদা, আত্মনিভর্রশীলতা ও আত্মসম্মান দান করেছে যা খ্রিষ্টান ধর্মের মাধ্যমে কদাচিৎ সাধিত হয়েছে।” দেওয়ান বাহাদুর এস.পি.পি.সিং বলেন, “মুসলমান শাসনকর্তাদের আমলে খ্রিষ্টানদের গির্জাগুলি পূর্ণ নিরাপত্তা পেয়েছে। এই পবিত্র পয়গম্বরের সহনশীলতার উদাহরণ এই দেশে অলৌকিক ঘটনা বলে মনে হতে পারে।” আজ সমগ্র মানবতাকে মুক্তির জন্য ইসলামকেই বেছে নিতে হবে। কারণ মানুষের স্রষ্টা কর্তৃক মনোনীত ও গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা হলো ইসলাম। আল্লাহর ভাষায় ‘ইন্নাদ্দিনা ইনদাল্লাহিল ইসলাম।” (৩:১৯) অর্থ: “নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য জীবনব্যবস্থা একমাত্র ইসলাম।” “ওয়ামাই ইয়াবত্বাগি গাইরাল ইসলামি দ্বীনান ফালাই ইয়ুকবালা মিনহু ওয়াহুআ ফিল আখিরাতি মিনাল খাসিরিন।” (৩:৮৫) অর্থ: “যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন বিধান তালাশ করে, তবে তার কাছ থেকে কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং পরকালে সে চরম ব্যর্থ হবে।” আর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পন্ডিত জর্জ বার্নার্ড শ এর মতামতও তাই। তিনি বলেছেন, “চমকপ্রদ জীবনীশক্তির জন্য মোহাম্মদ (সা)-এর প্রচারিত ধর্ম আমার মনে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধার উদ্রেক করেছে। আমার মতে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা সকল যুগের সকল মানুষের ধর্ম অর্থাৎ বিশ্বজনীন ধর্ম রূপে গণ্য হতে পারে।” তিনি আরো বলেন, “অশান্ত এ পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে পৃথিবীর নেতৃত্ব মোহাম্মদ (সা)-এর হাতে তুলে দিতে হবে।” আজ হযরত মোহাম্মদ (সা) বেঁচে নেই তবে বেঁচে আছে তার আদর্শ। অর্থাৎ ইসলামকেই গ্রহণ করে নিতে হবে। লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির