post

সম্ভাবনাময় অর্থনীতিতে কালো মেঘ

১০ জানুয়ারি ২০১৫

মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ

Economicsসরকার ও বিরোধী দলের পরপস্পর বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে নানামুখী সঙ্কটে থাকা অর্থনীতির কী হবে, তা নিয়ে শঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। এমনিতেই রফতানি ও রেমিট্যান্সে ভর করে চলা অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। এদিকে রেমিট্যান্স ছাড়া কমে গেছে আমদানি, রফতানি, বিনিয়োগ, সঞ্চয় ও রাজস্ব আয়। এমনকি সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতির কারণে দাতা সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় করছে না। ফলে থেমে গেছে দেশের উন্নয়ন কর্মসূচি। অন্য দিকে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে এই উত্তাপ দিন যতই এগিয়ে যাবে ততই বাড়বে। কেননা বছরের শুরু থেকেই টানা আন্দোলনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট রাজপথ দখলে রাখতে চাইছে এবং সামনের দিনগুলোতেও আরো কঠিন কর্মসূচির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের রাজনীতি এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে অর্থনীতিও। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের কী করে কত দিনে সমাধান হবে, সে সম্বন্ধে বিবদমান দুই পক্ষের নেতৃত্ব যারা দিচ্ছেন, তাদেরও কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। সরকারের সৃষ্ট সঙ্কটের কারণে দেশের অর্থনীতিকে যে কত বড় মূল্য দিতে হতে পারে, সে সম্বন্ধে সরকারকে তেমন ভাবনা-চিন্তা আছে বলেও দেখা যাচ্ছে না। এর আগের ২০১৩ ও ২০১৪ সালের শুরুর দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনগুলো ঘিরেও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল এবং তাতে অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ ছাড়া ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়, তাতে টানা হরতালের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর দুই মাস কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। এ জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তা কাটিয়ে উঠতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছিল। তবে নানা কারণে এবারের রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতি আরও অনেক ব্যাপক ও গভীর হওয়ার আশঙ্কা আছে। অতীতের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার যেমন বড় হয়েছে, তেমনি বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ততাও অনেক বেয়েছে এবং পশ্চাৎ শিল্পের বিকাশের ফলে অর্থনীতির আন্তঃখাত নির্ভরশীলতাও বেড়েছে। এর ফলে পণ্য উৎপাদন, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও জাহাজীকরণ এসব কিছু নিরবচ্ছিন্নভাবে সচল রাখা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এর কোথাও বিঘœ ঘটলে একাধিক খাতের ক্ষতির বোঝা পুঞ্জীভূত হয়ে অর্থনীতির ওপর বড় আঘাত আসতে পারে। এবারে রাজনৈতিক বিরোধের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো যে এটা ঢাকাকেন্দ্রিক না হয়ে ছোট ছোট শহরে ও গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদনের উপকরণ সরবরাহ ও উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ দুটোই বিঘিœত হচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতি বাজারব্যবস্থার প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দিয়ে তেমন নিয়ন্ত্রিত হয় না, বরং এর ভিত্তি হলো সামাজিক অনুশাসন ও ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে ব্যক্তিগত আস্থার সম্পর্ক। অর্থনীতির ভাষায় এটা হলো এক ধরনের সামাজিক মূলধন, যা গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়া সহিংস রাজনৈতিক বিরোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটা খুব দৃশ্যমান না হলেও গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে এর নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। এবারের রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে রয়েছে নানা দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে ইতোমধ্যেই দুর্বল হয়ে যাওয়া একটি আর্থিক খাত। অর্থনীতির মন্দাভাবের কারণে এমনিতেই ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার কিছুটা অবনতি ঘটেছিল। এর ওপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর হল-মার্ক জাতীয় জালিয়াতির ঘটনার প্রভাব বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ওপরও এসে পড়েছে। এ অবস্থায় শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে একদিকে ঋণখেলাপি বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের চলতি মূলধনের সরবরাহেও টান পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুই পক্ষই। এমনকি দু-একটি ব্যাংকের দেউলিয়া হয়ে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাও মূলধন হারিয়ে পথে বসতে পারেন। চলমান সহিংস রাজনৈতিক বিরোধের ফলে তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ও দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্ন। লক্ষণীয় হরতাল-অবরোধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই কিন্তু সম্ভাব্য রাজনৈতিক বিরোধের আশঙ্কার কারণে বিশ্বঅর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত সূচকগুলোর অবনতি শুরু হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের হিসাব থেকে দেখা যায়, বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহার, বিদেশি বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স প্রবাহ সবই নিম্নমুখী। রফতানির প্রবৃদ্ধিও কমে যাচ্ছে। দেশের তৈরি পোশাকশিল্প এমনিতেই বিশ্বজুড়ে ভাবমূর্তির সঙ্কটে আছে, তার ওপর আছে শ্রমিক অসন্তোষ। যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের বাজারে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার জন্য শর্ত বেঁধে দিয়েছে। আরো আশঙ্কার বিষয়, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও আমাদের পোশাক রফতানির শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিলের বিষয় বিবেচনা করছে। সন্দেহ নেই, রাজনৈতিক বিরোধ চলতে থাকলে পোশাকশিল্পের সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। চলতি (২০১৪-১৫) অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। অর্থবছরের ৭ মাস পরও এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আশা করা যাচ্ছে না। অর্থনীতির সূচক থেকে বুঝা যাচ্ছে প্রবৃদ্ধির হার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক নিচে থাকতে পারে। এর বড় কারণ হলো, বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়া। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য গত বছরের তুলনায় অন্তত ৭৫ হাজার কোটি টাকার বাড়তি বিনিয়োগ লাগবে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত নিজেও বিনিয়োগ মন্দা নিয়ে আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। নানামুখী সঙ্কটের কারণে বিনিয়োগ লাভজনক বিবেচিত না হওয়ায় শিল্প উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আসতে চাইছেন না। তার ওপর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তীব্র হয়ে উঠায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। শিল্পোদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে উত্তপ্ত রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে আস্থার সঙ্কট রয়েছে। মূলত এ কারণেই নতুন করে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না উদ্যোক্তারা। সেই সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের অপ্রতুলতা, নতুন সংযোগ পেতে পদে পদে ভোগান্তি ও সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়টি ব্যবসায়ীদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। অবকাঠামোর দুর্বলতা এসব কারণেও বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে তারা মনে করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ব্যাংকিং খাতে অলস টাকার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিপুল পরিমাণ এ টাকা বিনিয়োগে আসছে না। এর মধ্যে ২৫ হাজার কোটি টাকা কোনো কাজে আসছে না। ফলে অনেক ব্যাংকেই লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে। বিশেষ করে নতুন এবং ছোট ব্যাংকগুলো। আমানত নেয়ার অর্থ বিনিয়োগে না এলে ব্যাংকের আয় কমে যাবে। কিন্তু আমানতকারীদের সুদের টাকা তো ঠিকই পরিশোধ করতে হবে। ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে একধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির