মানুষকে আল্লাহ মর্যাদাসম্পন্ন জীবনের অধিকারী বানিয়েছেন। এই মর্যাদা ও অনুগ্রহ মানুষ হিসাবে প্রত্যেক মানুষ পেয়েছে; তাতে সে মুমিন হোক অথবা কাফের। কেননা, এ মর্যাদা অন্য সৃষ্টিকুল, জীবজন্তু, জড়পদার্থ ও উদ্ভিদ ইত্যাদির তুলনায়। আর এ মর্যাদা বিভিন্ন দিক দিয়ে। যে আকার-আকৃতি, এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ শারীরিক গঠন ও ধরন মহান আল্লাহ মানুষকে দান করেছেন, তা অন্য কোন সৃষ্টি পায়নি। যে জ্ঞান মানুষকে দেওয়া হয়েছে, যার দ্বারা তারা নিজেদের আরাম ও আয়েশের জন্য অসংখ্য জিনিস আবিষ্কার করেছে, জীবজন্তু ইত্যাদি তা থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়া এই জ্ঞান দ্বারা তারা ঠিক-বেঠিক, উপকারী-অপকারী এবং ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম। এই জ্ঞান দ্বারা তারা আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টিকুল থেকে উপকৃত হয় এবং তাদেরকে নিজেদের বশে রাখে। এই জ্ঞান ও মেধারই মাধ্যমে তারা এমন অট্টালিকা নির্মাণ করে, এমন পোশাক আবিষ্কার করে এবং এমন সব জিনিস বানায় যা তাদেরকে গ্রীষ্মের তাপ, শীতের ঠাণ্ডা এবং মৌসুমের অন্যান্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। অনুরূপ বিশ্বজাহানের সমস্ত জিনিসকে মহান আল্লাহ মানুষের সেবায় লাগিয়ে রেখেছেন। চাঁদ, সূর্য, হাওয়া, পানি এবং অন্যান্য অসংখ্য জিনিস রয়েছে যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হচ্ছে। (তাফসিরে আহসানুল বায়ান)। আল্লাহ তায়ালা আদমসন্তানকে বিভিন্ন দিক দিয়ে এমন সব বৈশিষ্ট্য দান করেছেন, যেগুলো অন্যান্য সৃষ্টজীবের মধ্যে নেই। যেমন: সুশ্রী চেহারা, সুষম দেহ, সুষম প্রকৃতি এবং অঙ্গসৌষ্ঠব। (ইবনে কাসীর)। “আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৭০)। আল্লাহ আরো বলেন : “অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে।” (সূরা তীন : ৪) মানুষের জীবনে নানা দিক ও বিভাগ রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত তার বিস্তৃতি। তন্মধ্যে সামাজিক জীবন অন্যতম। মানুষের গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিচয় হলো মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ বলতে আমরা কী বুঝি? সমাজবিজ্ঞানীরা নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। পরিচয় তুলে ধরেছেন। সমাজবিজ্ঞানী গিডিংস বলেন, ‘সমাজ বলতে আমরা সেই জনসাধারণকে বুঝি যারা সংঘবদ্ধভাবে কোনো সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিলিত হয়েছে। অধ্যাপক আর. এম ম্যাকাইভার তার সমাজ নামক গ্রন্থে সমাজের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের সামাজিক সম্পর্কে জটিল জালই সমাজ।’ সমাজবিজ্ঞানী কিম্বল ইয়ং এর মতে, ‘সমাজ হলো সামাজিক সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিবর্গের সাধারণ পরিচিত।’ ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজব্যবস্থার ভিত্তি কী? এ বিষয়ে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ)-এর অভিমত: ‘দুনিয়ার সমস্ত মানুষ একই বংশোদ্ভূত’ এ মতের উপরই ইসলামী সমাজব্যবস্থার বুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম এক জোড়া মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তারপর সেই জোড়া হতে সকল মানুষের জন্ম হয়েছে। প্রথম দিক দিয়ে একজোড়া মানুষের সন্তানগণ দীর্ঘকাল পর্যন্ত একই দল ও একই সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলো; তাদের ভাষাও ছিলো এক। কোন প্রকার বিরোধ-বৈষম্য তাদের মধ্যে ছিলো না। কিন্তু তাদের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পেতে লাগলো ততই তারা পৃথিবীর নানাদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো এবং এ বিস্তৃতির ফলে তারা অতি স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন বংশ, জাতি ও গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়লো। তাদের ভাষা ভিন্ন হয়ে গেলো, পোশাক-পরিচ্ছদের দিক দিয়ে অনেক বৈষম্য ও বৈচিত্র্য দেখা দিলো। দৈনন্দিন জীবন যাপনের রীতিনীতিও আলাদা হয়ে গেলো এবং বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন আবহাওয়ায় তাদের রং, রূপ ও আকার-আকৃতি পর্যন্ত বদলে গেলো। এসব পার্থক্য একেবারেই স্বাভাবিক, বাস্তব দুনিয়ায়ই এটা বর্তমান। কাজেই ইসলামও এসবকে ঠিক একটা বাস্তব ঘটনা হিসেবেই গ্রহণ করেছে। ইসলাম এসবকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেবার পক্ষপাতী নয়, বরং এসবের দ্বারা মানবসমাজে পারস্পরিক পরিচয় লাভ করা যায় বলে ইসলাম এগুলোকে স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু পার্থক্য বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে মানবসমাজে বর্ণ, বংশ, ভাষা, জাতীয়তা ও স্বাদেশিকতার যে হিংসা-বিদ্বেষ উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, ইসলাম তা কিছুতেই সমর্থন করতে পারে না, এর দৃষ্টিতে এটা সম্পূর্ণরূপেই ভুল। মানুষ এবং মানুষের মধ্যে শুধু জন্মের ভিত্তিতে উচ্চ-নীচ, আশরাফ-আতরাফ এবং আপন পরের যে পার্থক্য করা হয়েছে, ইসলামের দৃষ্টিতে তা একেবারেই জাহিলিয়াত একেবারেই মূর্খতাব্যঞ্জক। ইসলাম সমস্ত দুনিয়ার মানুষকে সম্বোধন করে বলে যে, তোমরা সকলেই এক মাতা ও এক পিতার সন্তান, তোমরা পরস্পর ভাই ভাই এবং মানুষ হওয়ার দিক দিয়ে তোমরা সকলেই সমান। (ইসলামের জীবন পদ্ধতি)। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, ভালো-মন্দ, সঠিক-ভুল সম্পর্কে সমাজের মানুষের যে ধারণা, তা হলো মূল্যবোধ। সামাজিক মূল্যবোধ ও অবক্ষয়ের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবদুস শহীদ নাসিম। সামাজিক মূল্যবোধ: যে বিষয়গুলো কোনো সমাজকে সুস্থ, সুন্দর ও সম্প্রীতিভিত্তিক মূল্যবান সোনালি সমাজে রূপান্তরিত করে, সে বিষয়গুলোর সক্রিয় চেতনাবোধকেই সামাজিক মূল্যবোধ বলা হয়। সর্বজন স্বীকৃত যেসব ভালো, উত্তম, সুন্দর, চমৎকার, শালীন, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও কল্যাণকর বিষয় কোনো সমাজকে কল্যাণময় সোনালি সমাজে পরিণত করে, সেগুলোর চর্চা ও সংরক্ষণের সক্রিয় চেতনাবোধকে সামাজিক মূল্যবোধ বলা হয়। সেই মূল্যবোধগুলোই হয়ে থাকে সেই সমাজের অলঙ্কার ও মণিমুক্তা। মণিমুক্তাসম সেই মূল্যবোধগুলোর কয়েকটি হলো: ১. মানবতাবোধ ও মানবিকতা। ২. দয়ামায়া, ¯েœহ, ভালোবাসা। ৩. হিতকামনা, পরোপকার, মানবকল্যাণ। ৪. পারস্পরিক শ্রদ্ধবোধ ও সম্মান প্রদর্শন। ৫. জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানচর্চার প্রবল আকাক্সক্ষা। ৬. সাহসিকতা ও বীরত্ব। ৭. কর্মোদ্দীপনা, কর্মকৌশল, কর্মদক্ষতা। ৮. শালীনতাবোধ ও শালীনতাচর্চা। ৯. ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায্যতাবোধ ও সুবিচার। ১০. সুস্থ ও সুষ্ঠু পারিবারিক বন্ধন। ১১. নীতিবোধ ও নৈতিকতার চর্চা। আর সামাজিক অবক্ষয়: সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা না থাকা, কিংবা সামাজিক মূল্যবোধের ধস নামা, কিংবা বিলুপ্তি ঘটাকে ‘সামাজিক অবক্ষয়’ বলা হয়। সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষা দিয়েছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা.। তাঁর ব্যক্তিগত আদর্শের অল্প কিছু দিক তুলে ধরছি, যা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয়। বর্তমান সমাজে এর চর্চা অব্যাহত রাখলে সামাজিক মূল্যবোধ টিকে থাকবে এবং সর্বত্র সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি পরিবেশ তৈরি হবে; ইনশাআল্লাহ। চারিত্রিক দিক থেকে অধঃপতিত মানুষগুলোকে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক মাধুর্য ও আদর্শ দিয়ে নৈতিকতার উচ্চ শিখরে আরোহণের ব্যবস্থা করে দিলেন। আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা: আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের উপর রয়েছেন। (সূরা কালাম : ৪)। হযরত আলী রা. বলেন: মহৎ চরিত্র বলে কুরআনের শিষ্টাচার বুঝানো হয়েছে। (কুরতুবী)। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন: মহৎ চরিত্রের অর্থ মহৎ দ্বীন। কেননা আল্লাহর কাছে ইসলাম অধিক প্রিয় কোনো দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা নেই। তিনি নিজেই বলেন: নিশ্চয়ই ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন। (সূরা আলে-ইমরান : ১৯)। আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা আলে ইমরান : ৮৫)। আল্লাহর রাসূলের সা. নৈতিক চরিত্রের সুন্দর পরিচয় তুলে ধরেছেন হযরত আয়েশা রা.। তিনি বলেছেন, কুরআনই হলো তাঁর চরিত্র। (মুসনাদে আহমদ-৬/৯১)। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, আমি দশটি বছর রাসূলুল্লাহ সা.-এর খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। আমার কোনো কাজ সম্পর্কে তিনি কখনো উহ! শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। আমার কোনো কাজ দেখে কখনো বলেননি, তুমি এ কাজ করলে কেন? কিংবা কোনো কাজ না করলে কখনো বলেননি, তুমি এ কাজ করলে না কেন? (বুখারি-৬০৩৮; মুসলিম-২৩০৯)। রাসূলুল্লাহ সা. নিজেই বলেছেন: আমি উত্তম চরিত্রকে পরিপূর্ণতা দেয়ার জন্যই প্রেরিত হয়েছি। (মুসনাদে আহমদ-২/৩৮১)। জাহেলি যুগে লোকেরা মিথ্যা কথায় অভ্যস্ত ছিলো। কথাবার্তায় মিথ্যা থেকে দূরে থাকতে পারতো না। মিথ্যা কথা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কিংবা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে অপরাধবোধ তাদের অন্তরে লালিত হতো না। বিশ্বনবী সা. নিজেকে সত্যবাদী হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। জীবনে একটি বারের জন্যও তিনি মিথ্যার আশ্রয় নেননি। তাইতো আরবের মানুষেরা তাঁকে আস-সাদিক উপাধিতে ভূষিত করেছিলো। আল্লাহ তায়ালা বলেন: হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। (সূরা তাওবা : ১১৯)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন: নিশ্চয়ই সত্য ভালো কাজের পথ দেখায় আর ভালো কাজ জান্নাতের পথ দেখায়। আর মানুষ সত্য কথা বলতে অভ্যস্ত হলে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে (তার নাম) লিপিবদ্ধ হয়। নিশ্চয়ই অসত্য পাপের পথ দেখায় আর পাপ জাহান্নামের পথ দেখায়। কোনো ব্যক্তি মিথ্যায় রত থাকলে পরিশেষে আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী হিসেবেই (তার নাম) লিপিবদ্ধ করা হয়। (বুখারি-৬০৯৩)। আল্লাহর রাসূল সা.-এর উদার চিত্ত, বিরুদ্ধবাদীদের হৃদয় ও মন জয় করার সুযোগ তৈরি করে দিতো। তায়েফে রক্তাক্ত হয়েছেন। তবুও তাদের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষ লালন করেননি। আল্লাহর কাছে তাদের জন্য হেদায়াতের দোয়া করেছেন। মক্কার কাফির মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবায়ে কেরামদের কতো কষ্ট দিয়েছিলো। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি তাদের উদ্দেশে ক্ষমার ঘোষণা জানিয়ে দিলেন। তিনি বিরোধিতা করা সত্ত্বেও অমুসলিমদের জন্য বদদোয়া না করে কল্যাণ ও হেদায়াতের জন্য দোয়া করতেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, একদা আবু তোফায়েল ও তার সঙ্গীরা এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, (ইয়েমেনের) দাউস গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং কুফরি করেছে। আপনি তাদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করুন। উপস্থিত লোকরা বলতে লাগল- দাউসের লোকেরা ধ্বংস হয়ে গেছে। দাউস ধ্বংস হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ সা. বদদোয়া না করে তাদের জন্য দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি দাউস গোত্রের লোকদের হেদায়াত দিন এবং তাদের (আমার কাছে) এনে দিন। (বুখারি)। আল্লাহর রাসূল সা. খুব সাদামাটা জীবনের অধিকারী ছিলেন। তাঁর আদর্শের অনন্য দিক ছিলো, তিনি বিনয়ী ছিলেন। যা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। হযরত আবু মাসউদ রা. বলেন, এক লোক রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে কথা বলতে এলো। তখন ভয়ে সে কাঁপছিলো। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, শান্ত হও। আমি কোনো রাজা-বাদশা নই। আমি একজন সাধারণ নারীর সন্তান। (ইবনে মাজাহ-৩৩১২)। হযরত আয়েশা রা.-কে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, রাসূলুল্লাহ সা. ঘরে কী করতেন? তিনি উত্তরে বললেন- তিনি পরিবারের কাজে সহযোগিতা করতেন। (বুখারি-৬৭৬)। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ কী? এ ব্যাপারে সমাজ বিশ্লেষক ও গবেষকদের মতামতের আলোকে বলা যায় যে, মৌলিক কিছু কারণে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে আমাদের সমাজ। ১. দারিদ্র্য ২. বেকারত্ব ৩. মাদকাসক্তি ৩. পারিবারিক দুর্বলতা ৪. অসৎসঙ্গ ৫. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং ৬. ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদি। দারিদ্র্য বলতে বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য অধীনস্থ সম্পদ বা আয়ের অপর্যাপ্ততাকে বোঝায়। আমাদের দেশে এই সমস্যা কমছে না। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতিতে তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬-এর চূড়ান্ত রিপোর্টে (মে ২০১৯) দাঁড়িয়েছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশে। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, করোনার প্রভাবে দারিদ্র্যের হার ও মাত্রা দুটোই বেড়েছে। এতে মানুষ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন, ঋণ নিয়েছেন এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন। করোনা মহামারীর প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। দারিদ্র্য দূরীকরণে শ্রমের মর্যাদা উপলব্ধি, পরিশ্রমী হওয়া ও রিযিক তালাশের প্রচেষ্টা জোরদার রাখা জরুরি। ‘তিনিই তোমাদের জন্য ভূমিকে বশ করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তার কাঁধে চলাফেরা করো ও তাঁর রিজিক খাও। তাঁরই কাছে তোমাদেরকে পুনর্জীবিত হয়ে যেতে হবে।’ (সূরা মুলক : ১৫)। যাকাত ও সাদাকাহ দারিদ্র্য দূরীকরণের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবী!) তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন। আর আপনি তাদের জন্য দোয়া করুন। আপনার দোয়া তো তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা তওবা : ১০৩)। বেকারত্ব একটি সামাজিক ব্যাধি অথবা সঙ্কট। ইংরেজি আনএমপ্লয়মেন্ট শব্দটি থেকে বেকারত্ব শব্দটি এসেছে। একজন মানুষ যখন তার পেশা হিসেবে কাজ খুঁজে পায় না তখন যে পরিস্থিতি হয় তাকে বেকারত্ব বলে। (উইকিপিডিয়া)। বেকারত্ব দূরীকরণে ইসলামের সুন্দর নীতি অবলম্বন করলে দ্রুত সমাধান সম্ভব, ইনশাআল্লাহ। চেষ্টা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা, পরিশ্রম করা এবং উদ্যোগী থাকা অনস্বীকার্য। আল্লাহর ঘোষণা: নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে। (সূরা রা’দ : ১১)। সূরা জুমআর ১০ নম্বর আয়াতে কারিমায় আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন: অতঃপর সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করো ও আল্লাহকে খুব বেশি স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও। চলার পথে কষ্ট আসবে। প্রতিবন্ধকতা থাকবে। তবুও এগিয়ে যেতে হবে। হতাশ হওয়া যাবে না। আল্লাহ তায়ালার বাণী: সুতরাং কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে। অবশ্যই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে। (সূরা ইনশিরাহ : ৫-৬)। হাদিসে এসেছে: নিশ্চয়ই বিপদের সাথে মুক্তি আছে, আর নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে আছে স্বস্তি। (মুসনাদে আহমদ-১/৩০৭)। আয়াতদ্বয়ের তাফসিরে হাসান বসরী ও কাতাদাহ বলেন, এক কষ্ট দুই স্বস্তির ওপর প্রবল হতে পারে না। (ফাতহুল কাদির, তাবারি)। মাদক মানে যা সেবন করলে নেশা হয় এমন। মত্ততা বা নেশা সৃষ্টি করে এমন জিনিস। আর মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে ব্যক্তির এই অবস্থাকে বলে মাদকাসক্তি। ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি)-এর মন্তব্য: মাদক গ্রহণের ফলে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া গেলেও এই ক্ষণস্থায়ী স্বস্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর ফাঁদ। ফাঁদে একবার জড়ালে স্বাস্থ্যহানি ঘটে, সৃজনীশক্তি শেষ হয়ে যায়। ‘স্বাস্থ্যহানি’ বলতে কেবল দৈহিক স্বাস্থ্যের কথা বলা হচ্ছে না। দেহের পাশাপাশি বিশৃঙ্খল ও বিধ্বস্ত হয়ে যায় মনের স্বাস্থ্য, পুড়ে যায় আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক চিত্রে নেমে আসে দুর্যোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপ থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে ১৮ বছরের ওপরে শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষ মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৫ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। অথচ এই সকল তরুণ ও যুবকরাই নানা ধরনের মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। না বুঝেই অনেক তরুণ বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, মাদক সেবনের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৮০ লাখ মানুষ এবং বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ ২৬ হাজার মানুষ মারা যায়। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তবে এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৭০ লাখের মত মাদকাসক্ত আছে। এর মধ্যে ৭৪ শতাংশ হলো ছেলে আর ২৬ শতাংশ মেয়ে। মাদকাসক্তির দিকে ধাবিত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো: মস্তিষ্কে এক বিশেষ ধরনের প্রোটিনের পরিমাণ কম থাকা এবং মলিকিউলার মেকানিজমের ফলে মাদকাসক্তি দেখা যায়। মাদকাসক্তির বড় কারণ হলো- মাদকের সহজলভ্যতা, মাদকের প্রতি তরুণ প্রজন্মের কৌতূহল ও নিছক মজা করার প্রবণতা, মাদকের কুফল সম্পর্কে প্রকৃত ধারণার অভাব, মাদক বিষয়ে ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে বন্ধুদের চাপ, পারিপার্শ্বিক কারণ, ব্যর্থতা। এমনকি মাদক নিয়ে স্মার্ট হওয়ার প্রবণতাও অনেককে ঠেলে দেয় মাদকের জগতে। মাদক ও মাদকাসক্তদের নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশে রয়েছে কঠোর আইন। তবুও থামছে না অপরাধীদের অশুভ পথচলা। এর সমাধানে প্রয়োজন- নৈতিক চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের লালন। হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণয় করার শর (আযলাম) তো কেবল ঘৃণার বস্তু, শয়তানের কাজ। অতএব তোমরা সেগুলো বর্জন করো। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। শয়তান তো চায় মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে ও সালাতে বাধা দিতে। তবে কি তোমরা বিরত হবে না? (সূরা মায়িদাহ : ৯০-৯১)। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যা-ই বিবেকশূন্য করে তা-ই মদ। আর সমস্ত মাদকতাই হারাম। যে ব্যক্তি কোনো মাদক সেবন করলো, চল্লিশ প্রভাত পর্যন্ত তার সালাত অসম্পূর্ণ থাকবে। তারপর যদি সে তওবা করে, তবে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন। এভাবে চতুর্থবার পর্যন্ত। যদি চতুর্থবার পুনরায় তা করে, তখন আল্লাহর উপর হক হয়ে দাঁড়ায় তাকে ত্বিনাতুল খাবাল থেকে পান করানো। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! ত্বিনাতুল খাবাল কী? তিনি বললেন, জাহান্নামবাসীদের পুঁজ। যে কেউ কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্ককে মদ খাওয়াবে, যে হারাম হালাল সম্পর্কে জানে না, আল্লাহর হক হয়ে যাবে যে, তাকে ত্বিনাতুল খাবাল পান করানো। (মুসলিম-২০০২; আবু দাউদ-৩৬৮০)। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, অনুগ্রহের খোঁটাদানকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য এবং মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি; জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (নাসায়ী-৫৬৭২)। সর্বপ্রকার অপকর্ম এবং অশ্লীলতার জন্মদাতা হচ্ছে মদ। (ইবনে মাজাহ-৩৩৭১)। মদ ও ঈমান একত্রিত হতে পারে না। (নাসায়ী-৮/৩১৭)। হযরত আনাস রা: বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সা. মদের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন দশ শ্রেণীর ব্যক্তির ওপর লানত করেছেন। ১. যে লোক নির্যাস বের করে ২. প্রস্তুতকারক ৩. পানকারী ৪. যে পান করায় ৫. আমদানিকারক ৬. যার জন্য আমদানি করা হয় ৭. বিক্রেতা ৮. ক্রেতা ৯. সরবরাহকারী এবং ১০. এর লভ্যাংশ ভোগকারী। (ইবনে মাজাহ-৩৩৮০)। পরিবার হলো সন্তানকে গড়ে তোলার প্রাথমিক ঠিকানা। আদর্শ শিখাবার মূল মানযিল। পিতা-মাতার কাছ থেকেই সন্তান শিখবে। অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানেই সে নিজেকে গড়ে তুলবে। তাই প্রতিটি পরিবারে থাকা চাই সঠিক পথনির্দেশনা। সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর অগ্নি হতে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম-হৃদয়, কঠোর-স্বভাব ফিরিশতাগণ, যারা আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয়, তাই করে। (সূরা তাহরিম : ৬)। তাফসিরে আহসানুল বায়ানের বর্ণনা: এতে মু’মিনদের পালনীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আর তা হলো, নিজেদেরকে সংস্কার ও সংশোধন করার সাথে সাথে পরিবারের লোকদেরকেও সংস্কার ও সংশোধন করতে হবে এবং তাদেরকে ইসলামী শিক্ষা ও তরবিয়ত দেয়ার প্রতি যত্নবান হতে হবে। যাতে তারা জাহান্নামের জ্বালানি হওয়া থেকে বেঁচে যায়। আর এই কারণেই রাসূল সা. বলেছেন, ‘শিশুরা যখন সাত বছর বয়সে পৌঁছে যাবে, তখন তাদেরকে নামায পড়ার আদেশ দাও। আর দশ বছর বয়সে পৌঁছে যাওয়ার পর (তারা নামাযের ব্যাপারে উদাসীন হলে) তাদেরকে (শিক্ষামূলক) প্রহার কর।’ (সুনানে আবু দাউদ, সুনানে তিরমিজি সালাত অধ্যায়)। ফকিহগণ বলেন, এইভাবে তাদেরকে রোযা রাখারও আদেশ দিতে হবে এবং অন্যান্য শরিয়তি বিধি-বিধানের অনুসরণ করার শিক্ষা তাদেরকে দিতে হবে। যাতে সাবালক হওয়ার সাথে সাথে তাদের মধ্যে সত্য দ্বীন মানার অনুভূতি সৃষ্টি হয়ে যায়। (ইবনে কাসীর)। সামাজিক অবক্ষয় রোধে সৎসঙ্গ খুবই জরুরি। ছোটবেলাতেই বাচ্চারা যেন এ সবক পায় এবং নিজেরা ভালোভাবে বুঝার মতো জ্ঞান হওয়ার পর অসৎসঙ্গ ত্যাগে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, ইনশাআল্লাহ। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের সা. নির্দেশনা, ইতঃপূর্বে রাসূলুল্লাহ সা.-এর চারিত্রিক গুণাবলির বর্ণনায় চলে এসেছে। অপসংস্কৃতির মরণছোবল থেকে জাতিকে রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে সজাগ ও সচেতন রাখতে হবে। সুস্থ ও মননশীল সংস্কৃতি বিকাশে প্রতিশ্রুতিশীল থাকতে হবে। ইসলামী সংস্কৃতি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য ধারণ করলো সে তাদেরই দলভুক্ত হলো। (সুনানে আবু দাউদ-৪০৩১)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত অন্য হাদিসে রাসূল সা. বলেন, তিন প্রকারের লোক আল্লাহর কাছে সর্বাধিক ঘৃণিত, ১. হারাম শরিফের পবিত্রতা বিনষ্টকারী, ২. ইসলামে বিজাতীয় রীতি-নীতির (সংস্কৃতির) প্রচলনকারী, ৩. কোন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যার প্রচেষ্টাকারী। (বুখারি) সর্বোপরি ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। ইসলামের সৌন্দর্য লালন, প্রচার ও প্রসার জরুরি। কুরআন, হাদিস-সুন্নাহর যথাযথ জ্ঞানার্জন, পরিপূর্ণ আমল ও ব্যাপক দাওয়াত; সামাজিক অবক্ষয় রোধ ও মূল্যবোধ রক্ষায় অপরিহার্য।
লেখক : সহকারী মহাসচিব, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরিন
আপনার মন্তব্য লিখুন