post

সিটি করপোরেশন নির্বাচন রেড সিগন্যাল

১২ জুলাই ২০১৩

আলফাজ আনাম চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের শুরুতে দোদুল্যমানতা ছিল। বিরোধী জোট অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনের আমেজ লক্ষ করা গেছে। সিটি করপোরেশন এলাকায় উন্নয়ন বা প্রার্থীর যোগ্যতা ভোটারদের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল না, বরং জাতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকার ব্যাপারে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্টত সরকারের প্রতি অনাস্থা ফুটে উঠেছে। নির্বাচনের এই ফলাফল শুধু জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না, আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এই ফলাফলের পর ক্ষমতাসীন দলে যেমন হতাশা এসেছে, অপর দিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হবেন। চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতির প্রভাব বিশেষ করে  ক্ষমতাসীন দলের রাষ্ট্র পরিচালনার নানামুখী ব্যর্থতা, দুর্নীতি এবং ইসলামপন্থীদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতন বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে ক্র্যাকডাউনের ঘটনা সাধারণ ভোটারদের এই নির্বাচনে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অণুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। রাজনীতিতে ধর্মীয় কার্ড হিসেবে এর যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলাম প্রশ্ন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। হেফাজতের নেতাকর্মীরা কোথাও সরবে আবার কোথাও নীরবে ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে শাহবাগের আন্দোলন ক্ষমতাসীন দলের ভোটের রাজনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। ব্লগার রাজীবকে দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ ও তার বাসায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সমবেদনা সাধারণ মানুষকে দারুণভাবে আহত করেছে। হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে কত মানুষ মারা গেছে তার সঠিক তথ্য আড়াল করার কারণে এ নিয়েও অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ভোটারেরা বিষয়টিকে আলেম হত্যা হিসেবে দেখছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী ও দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা এলাকায় ইসলামপন্থীদের ওপর পুলিশের নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের মেয়রপ্রার্থীরা এ দু’টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটে পরাজিত হয়েছেন। এর মধ্যে খুলনায় ৬০ হাজার ৬৭১ ভোটে এবং রাজশাহীতে ৪৮ হাজার ৩৮০ ভোটে। এসব এলাকার ভোটারেরা বুলেটের জবাব ব্যালটের মাধ্যমে দিয়েছেন। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা কম হওয়ার পরও সেখানে ৩৫ হাজার ১৫৭ ভোটের ব্যবধানে বিরোধী জোটের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। কম ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন বরিশালের মেয়রপ্রার্থী; তার পরও ভোটের ব্যবধান ছিল ১৬ হাজার ৯৮০। বিএনপি দাবি করেছে, নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা করা না হলে এই নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের সাথে পরাজিত প্রার্থীদের ভোটের ব্যবধান হতো অনেক বেশি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শুধু মেয়র নন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। ১১৮টি সাধারণ ওয়ার্ডের ৬৫টিতে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপি সমর্থিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরেরা। ২৮টিতে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ আর জামায়াতে ইসলামী বিজয়ী হয়েছে ছয়টিতে। বাকিগুলোতে স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। আরো আশ্চর্যজনক দিক হলো ক্ষমতাসীন দলের মেয়রপ্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী এলাকাতেই পরাজিত হয়েছেন। এ থেকে প্রমাণ হয় ভোটারেরা প্রার্থী দেখে নয়, রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে তাদের ভোট দিয়েছেন। জাতীয় রাজনীতিতে এই নির্বাচন যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে তা আগেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলেছিলেন। ফলাফলের এই বিপর্যয়ের পর ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে যে নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল তার প্রমাণ। অপর দিকে বিরোধী জোটের নেতারা বলেছেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি সাধারণ মানুষ তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। এর আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে চট্টগ্রাম ও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হন। কিন্তু এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে আওয়ামী লীগ সরে আসেনি। ফলে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার ফয়সালা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রশাসনের কম-বেশি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ছিল না তা বলা যাবে না। বিশেষ করে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত মেয়রপ্রার্থীর পক্ষে প্রশাসনযন্ত্র প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ করার পরও নির্বাচন কমিশন কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এমনকি বরিশালে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। কালো টাকার ছড়াছড়িও কম ছিল না। রাজশাহী ও সিলেটে বেশ কিছু বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বাসায় অভিযান চালানোর ঘটনাও ঘটেছে। অর্থাৎ নির্বাচনে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব যথেষ্ট কার্যকর ছিল, কিন্তু ব্যাপক ভোটার উপস্থিতির কারণে ব্যবধান বেশি হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতাগুলো ঢাকা পড়ে গেছে। জাতীয় নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি করতে পারে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের যোগ্যতা বা দুর্বলতা যা-ই থাকুক না কেন সরকারের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ দারুণভাবে অসন্তুষ্ট। ফলে ভোট দানের প্রথম সুযোগেই তারা এর সদ্ব্যবহার করেছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই দেশে এক ধরনের নীরব ভোট বিপ্লবের সূচনা হলো। অপর দিকে বিরোধী দল নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ মেটাতে সক্ষম হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী হতে কেন্দ্রীয়পর্যায় থেকে মনিটরিং করা হয়েছে। সুশৃঙ্খল প্রচারণার চেষ্টা ছিল। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বিরোধী দল এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকারের ব্যর্থতার দিকগুলোর পাশাপাশি নিপীড়ন-নির্যাতনের দিকগুলো সামনে আনবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় ইস্যুর বিভিন্ন বিষয়ে প্রচারণার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ছিল। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে পুলিশি তৎপরতা ছিল, কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে প্রশাসনের এ ধরনের পক্ষপাতমূলক আচরণ করা সম্ভব হবে না। আর তা করা হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এই ফলাফল যে ক্ষমতাসীন দলের বিপর্যয়ের আগাম সঙ্কেত, তা বোঝা খুব কঠিন নয়। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নির্বাচনের দিনই এই মন্তব্য করেছেন। ক্ষমতাসীন দল এই পরিস্থিতি কতটা অনুধাবন করতে পারছে, তার ওপর নির্ভর করবে আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র। সিটি নির্বাচনের পরাজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধী দল যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না ছাড়ে তাহলে নির্বাচনই হবে না। তার এই বক্তব্য ইতোমধ্যে নতুন করে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। তাহলে কি জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে রাখা হবে। কিভাবে? নাকি দেশে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে যাতে অগণতান্ত্রিক কোনো পক্ষ ক্ষমতা গ্রহণ করে? বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে প্রধানমন্ত্রী অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় আনার আন্দোলন বলে উল্লেখ করেছেন। এখন তিনি বলছেন নির্বাচন হবে না। তার এই বক্তব্য গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে এখন অনিশ্চিত করে তুলছে। তবে এ কথা সত্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর সরকারের ওপর দেশী-বিদেশী বন্ধুদের চাপ বাড়বে। অজনপ্রিয় সরকারকে বিদেশীরা বেশি দিন সমর্থন দেয় না। এমনকি তিস্তাচুক্তি নিয়ে ভারত আরেক দফা পিছিয়ে গেছে। যা সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ আরো বাড়তে থাকবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামপন্থীদের দমনের শর্ত কতটা কাজ দেবে তা নিশ্চিত নয়। কারণ ইসলামপন্থী দলগুলো সহিংসতা নয়, নির্বাচনমুখী রাজনীতির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে জুলুম-নির্যাতনের জবাব দিতে চাইছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এই ফলাফলের পর সরকার যদি নিপীড়ন ও নির্যাতনের পথ পরিহার করে বিরোধী দলের সাথে সংলাপের পথে ফিরে আসে, তাহলে হয়তো বড় ধরনের সঙ্ঘাত এড়ানো যাবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করেছে, আদর্শবিচ্যুত বামপন্থীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উগ্র-ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রচারণা ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড সরকারের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সরকারের নীতির পরিবর্তন না হলে জাতীয় নির্বাচনে এই বিপর্যয় ক্ষমতাসীন দলের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির