post

সুইস ব্যাংকে অর্থপাচার ও আমাদের ভবিষ্যৎ

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

২৪ জুলাই ২০১৭
মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। চোখের সামনেই হয়েছে অনেক উত্থান-পতন। শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বিবর্তন ঘটেছে সামাজিক অবকাঠামোতেও। জনগণের কল্যাণ ও ভাগ্য পরিবর্তেনের কথা বলে বরাবরই ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে। চড়াই-উতরাইও তো আর কম হয়নি। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে একশ্রেণির সুযোগসন্ধানীর। তারা জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করে নিয়েছেন। আর বরাবরই আশাহত হয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। এ প্রসঙ্গে আমার ইংরেজি স্যারের কথা বারবারই মনে পড়ে। মরহুম ময়েজ উদ্দীন। তিনি ক্লাসে প্রায়শই খেদোক্তি করে বলতেন, ‘অনেক বড় বড় স্বপ্ন ছিল আমার। এ জন্য লেখাপড়াসহ চেষ্টা-চরিত্র কম করিনি। ছুটেছি এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তরে। কিন্তু ‘ইঁদুর কপালে’র শিকে আর ছেঁড়েনি। আমি যে ময়েজ ছিলাম সে ময়েজই রয়ে গেছি। ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে রাজ কপালেদের। কিন্তু সে কপালটা আমারই হওয়ার কথা ছিল’। তার খেদোক্তির সাথে সৈয়দ মজতুবা আলীর ‘পন্ডিত মশাই’ গল্পের ২৫ টাকা বেতনধারী পন্ডিত মশাইয়ের খেদোক্তির অনেকটা মিল রয়েছে। যা তাদের আত্মঅবমাননা বলা ছাড়া কোনো উপায় আছে? আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অনেক কিছুই করেছে। প্রতারিত ও প্ররোচিতও কম হয়নি। বারবার আশায় বুক বেঁধেছে। কিন্তু ‘গুড়ে বালি’ পড়তে সময় লাগেনি। জনগণের কাছে কাজ বাগিয়ে নেয়ার পর রীতিমত ‘অর্ধচন্দ্র’ই দিয়েছে এসব জনগণের স্বঘোষিত ভাগ্য বিধাতারা। ভাগ্যাহতদের ভাগ্যে এর চেয়ে বেশি কিছু জোটেনি। রাষ্ট্র ও সমাজের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বাজিকরদের হাতে। আর এই লুটেরা ও বাজিকররাই স্বঘোষিতভাবে ভাগ্যের বরপুত্র। এখন সবকিছুর নিয়ন্ত্রণই তাদের হাতে। রাষ্ট্রের এমন কোন সেক্টর নেই যে, যেখানে এই বাজিকরদের আঁচড় লাগেনি। এরা দেশ ও জনগণের জন্য মায়াকান্নায় অভ্যস্ত হলেও বাস্তবে এরা আত্মকেন্দ্রিক। তারা জনগণের রক্ত শোষণ করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ছে। সে সম্পদ আবার দেশে রাখা নিরাপদ মনে করছে না। যদি কখনো গনেশ উল্টে যায় সে আশঙ্কায়। মূলত দেশের অর্থনীতিতে কালকেতু উপাখ্যান চলছে। সর্বগ্রাসী আর সর্বভুকরা তাদের জঠর জ্বালা মেটাতে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ লুণ্ঠন করছে। সর্বত্রই চলছে লুটপাট ও পাচারের মহোৎসব। রাক্ষসরাজ কালকেতু এবং তাদের চেলাচামুন্ডারা এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। আর এদের কদর্য চেহারাটা দেখার জন্য আমাদেরকে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কালকেতু উপাখ্যানের দিকেই ফিরে যেতে হবে। কবি তার উপাখ্যানে রাক্ষসরাজ কালকেতুর বীভৎস রূপের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘মোঁচারিয়া গোঁফ দুইটা বান্ধিলেন ঘাড়ে এক শ^াসে সাত হাঁড়ি আমানি উপারে আশি মণ মহাবীর খায় খুদ যাউ... ...কচুর সহিত খায় করঙ্গ আমড়া’॥ সম্প্রতি গণমাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকে অর্থপাচার সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার ও লুটপাটের ঘটনায় মোটেই অভিনবত্ব নেই বরং এটি এখন রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। এর আগে শেয়ারবাজার থেকে লক্ষ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা গঙ্গাজলে ভাসানো হলো। ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের কেলেঙ্কারি বিষয়টি ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আমাদের বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী এসব ঘটনাকে আমল দেয়ার মতো নয় বলে মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকে অর্থপাচারের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যে পাচারের ঘটনাকে অতিশয়োক্তি বলে মন্তব্য করেছেন। এর আগেও তিনি হলমার্ক কেলেঙ্কারির ৪ হাজার কোটি টাকা কোন টাকা নয় বলে মন্তব্য করে বেশ লোক হাসিয়েছিলেন। যা তার ব্যক্তিত্ব ও পদমর্যাদার সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদে বাংলাদেশ থেকে মুদ্রা পাচারের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। ১৬ কোটি জনসংখ্যার আমাদের এ দেশ থেকে গত বছর সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে পাচার হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত থেকে পাচার হওয়া অর্থের প্রায় সমান। পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপালের মতো দেশগুলো থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশের তুলনায় যৎসামান্য। এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে ৯৩৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বেশি পাচার হয়েছে। এই হিসাব ইঙ্গিত করে যে বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকগুলোতে যে হারে অর্থপাচার বাড়ছে, তাতে আগামী বছরই ভারতকে টপকে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ পাচারকারী দেশ হিসেবে শিরোপা অর্জন করবো। যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য মারাত্মক অশনিসঙ্কেট। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই অর্থপাচারের লাগাম টেনে ধরা না গেলে জাতীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, এমনকি আমাদের জাতিসত্তাও মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি হবে। জানা গেছে, সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক দেশটির ব্যাংকগুলোর ২০১৬ সালের সামগ্রিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড, ২০১৬ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকে কী পরিমাণ অর্থ ওই দেশে পাচার হয় তার একটা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের উল্লিখিত পরিমাণ অর্থপাচারের তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। নগদ অর্থের পাশাপাশি সোনাসহ অন্যান্য মূল্যবান ধাতুও সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে রাখে বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা। পাচার হওয়া অর্থের হিসাবে ওই সব ধাতুর মূল্য যোগ করা হয়নি। তাই অর্থপাচারের পরিমাণটা আরও অনেক বেশিই হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। যা শুধু আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্যই ক্ষতিকর নয় বরং বহির্বিশ্বেও জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদাহানি ঘটছে। আমার এক ভারতীয় বন্ধু ফোন দিয়ে বললেন, সকাল থেকে বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো দেখছি। কিন্তু তোমাদের দেশে কোনো ভালো মানুষ আছে বলে মনে হলো না। এই হলো বহির্বিশে আমাদের সম্পর্কে মূল্যায়ন। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা পাচার নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পরও সরকারের টনক নড়েছে বলে মনে হয় না বরং বিষয়টি নিয়ে তারা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। দেশের অর্থসম্পদসহ সবকিছুই দেখভাল করার দায়িত্ব সরকারের হলেও তারা এ বিষয়ে অনেকটাই নির্লিপ্ত। কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে যে, অর্থপাচারের বিষয়টি সরকার সংশ্লিষ্টদের সাথেই জড়িত। তাই তারা বিষয়টি নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতে চান না। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সুইস ব্যাংকে অর্থপাচারের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যে এ সংবাদকে ‘অতিশয়োক্তি’ বলে দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী। তার দাবি হলো, বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে যে লেনদেন হয়, তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, বাস্তবে এটি মোটেই অর্থপাচার নয়। অর্থমন্ত্রীর দাবি, সাংবাদিকেরা ‘অত্যন্ত অন্যায়ভাবে’ বিষয়টিকে পাচার বলছেন। তবে কিছু অর্থ পাচার হয়। সেটি অতি যৎসামান্য। এটা নজরে নেয়ার মতোই নয়। আসলে গণমাধ্যমে সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু প্রকাশ হলে তা গঠনমূলক বা ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ না করে এর দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয় গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর। যা সরকারের আদর্শিক দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করে। তার দাবি, ২০১৬ সালের শেষে বাংলাদেশীদের জমা করা অর্থের পরিমাণ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে ৬৯৪.১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০১৫ সালে যা ছিল ৫৮২.৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইন্টেলিজেন্স ইউনিট অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং তা বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিদেশে অর্থ যে পাচার হয় না, সে কথা আমি বলব না। কিন্তু এসব সংবাদমাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে বলে বলা হয়েছে, সেটা বাস্তবেই অতিশয়োক্তি বলে বিবেচনা করা চলে।’ প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় অর্থমন্ত্রীর দাবি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হয় না। ২০১৩ সালেই প্রায় ৯৭০ কোটি ডলার (৭৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি) সমমূল্যের অবৈধ সম্পদ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে জ্ঞাত হওয়া গেছে। ২০০৪ সাল থেকে এ অর্থের পরিমাণ ৩৩০ কোটি ডলার বা ২৫৮৬১ কোটি টাকা বেশি। ওই অর্থ ছিল ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশেরও বেশি। বিদেশী উন্নয়ন সাহায্য হিসেবে বাংলাদেশের প্রাপ্ত অর্থের ৩.৫ গুণ পাচার হয় বলে পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়! গত ২০১৬ সালে সুইচ ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় বাংলাদেশীদের অবৈধ সঞ্চয়ের পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৫,৬৮৫ কোটি টাকা। গত এক বছরে অবৈধ সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১,১৫০ কোটি টাকা, বৃদ্ধির হার ঊনিশ শতাংশ। সুইচ ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায় যে, সুইচ ব্যাংকে ভারতীয় নাগরিকদের আমানত কমলেও বাংলাদেশীদের অবৈধ সঞ্চয় প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। অবৈধ পন্থায় জনগণের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অর্থ পাচার করে সুইচ ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে অবৈধভাবে সঞ্চয় করা অর্থ রাখছে। তারা সরকারি ব্যাংকগুলোতে সীমাহীন লুটপাট করে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। সরকারি দলের রাঘববোয়ালরাই যে এসব লুটপাটের সাথে জড়িত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা জমার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেল, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশী নাগরিকদের জমানো টাকার পরিমাণ শুধু এক বছরে বেড়েছে ৩৯৫ কোটি। সুইস ব্যাংকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশীদের জমার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ কোটি ৮ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকে ২০১৪ সালে বাংলাদেশীদের জমার পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে এক বছরে বাংলাদেশীদের জমা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ১০ শতাংশ। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। এটা লক্ষণীয় যে, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট আমানত গত এক বছরে কমে গেছে। একই সঙ্গে কমেছে বিদেশী আমানতের পরিমাণ। এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, ভারতের আমানতের পরিমাণও কমেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, এই সময়ে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশী নাগরিকদের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে! ফলে সংশ্লিষ্টরা যখন এমনটিও বলেছে যে, বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে টাকা পাচার এবং বিদেশে কর্মরত অনেক বাংলাদেশী নাগরিক সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা রাখায় সেখানে বাংলাদেশীদের জমা টাকার পরিমাণ বেড়েছে। তখন বিষয়টি পর্যবেক্ষণ ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণই জরুরি বলেই মনে করা হচ্ছে। স্মরণযোগ্য যে, বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কেউ টাকা নিয়ে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে রাখতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কেউ এই ধরনের কোনো টাকা নিতে পারে না। কেউ নিলে তা হবে দেশ থেকে টাকা পাচার। আর যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের কাউকে অর্থ রাখার কোনো অনুমতি দেয়নি বলেই জানা যাচ্ছে, তখন দেশ থেকে কেউ যদি টাকা কোনো চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠিয়ে থাকে সেটি পাচার বলে গণ্য হবে। মনে রাখতে হবে, অনেকেই আশঙ্কা করছেন সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশী নাগরিকদের নামে রক্ষিত অর্থের বড় অংশই বাংলাদেশ থেকে বিভিন্নভাবে পাচার করা! ফলে এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক, কেননা যদি ক্রমাগত তা-ই হয় যে, দেশ থেকে বড় ধরনের অর্থ পাচার হচ্ছে তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে ৫৫৮ কোটি হিসাবে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এমনকি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে! আমরা মনে করি, এই তথ্য খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্টদের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য। আমরা চাই, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করা হোক যেন অর্থপাচার রোধসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় গতিশীল হয়। শুধুমাত্র সুইস ব্যাংকে অর্থপাচারের বিষয়টিই আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত নয় বরং তা ধারাবাহিকভাবেই হচ্ছে। দেশের অর্থভান্ডার যেন রাজরাক্ষসরা পেয়ে বসেছে। গত বছর ৪ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয় হ্যাকাররা। মূলত এ জন্য হ্যাকারদের দায়ী করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ছাড়াও সরকার সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। পাচারকৃত অর্থের মধ্যে এখন পর্যন্ত দুই কোটি ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। দেশের রিজার্ভের এ অর্থ কেলেঙ্কারিকে বলা হচ্ছে ব্যাংক ডাকাতির ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ ঘটনা। তবে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে কোটি কোটি ডলার লোপাটের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। দেশের আর্থিক ব্যবস্থার নৈমিত্তিক লুটতরাজের ঘটনা বরং নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভের অর্থ লুটের ঘটনাকে ম্লান করে দিয়েছে। এমন অনেক ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত ও সরকার সংশ্লিষ্টদের। মূলত ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট সম্পদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সরকারের সঙ্গে সংযোগের কারণে দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব আরও বেশি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, আইএমএফের তথ্যানুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে অলস ঋণের পরিমাণ অতিমাত্রায় বেশি। দেশের সার্বিক ব্যাংকিং খাতে এর গড় পরিমাণও অনেক বেশি, প্রায় ১১ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে এর পরিমাণ প্রায় চার শতাংশ। এর কারণ হিসেবে বলা যায় ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের দুর্বল পরিচালনা ব্যবস্থার কথা। তবে এর পেছনের মূল কারণ হলো বাংলাদেশের পক্ষপাত ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সংস্কৃতি। যা আমাদের জাতীয় জীবনকে একেবারে দুর্বিষহ করে তুলেছে। ব্যাংকিং খাতের কেলেঙ্কারির মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ব্যাংক। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এই ব্যাংকের একটি শাখা থেকে অবৈধভাবে ৫৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার (৪২৬৩ কোটি টাকা প্রায়) ঋণ দেয়া হয়। গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এর মধ্যে ৩৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার (প্রায় ২৭০০ কোটি টাকা) দেয়া হয় টেক্সটাইল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হলমার্ক গ্রুপকে। হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির মাহমুদ শাখা ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগসূত্রের মাধ্যমে কাল্পনিক একটি কোম্পানির নামে ঋণের চিঠি ইস্যু করান। এই কেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশিত হয়ে পড়ার পরও সোনালী ব্যাংক অলস ঋণের অনুপাত অতিমাত্রায় রেখেই কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ২০১৪ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৭ শতাংশ। সোনালী ব্যাংকসহ বাংলাদেশের অন্য পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়মিতভাবে সরকারের কাছ থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে থাকে। ২০১৪ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৬৪ কোটি ডলার। ২০১৫ সালে এর পরিমাণ আরও ৭০ কোটি ডলার বেশি হওয়ার কথা। এসব ব্যাংকের দায়িত্বহীন ঋণদান এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে এগুলোকে ছাড় দেয়ার চর্চা মূলত অভিজাত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের যোগসাজশের ফলাফল বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এক তথ্যবিবরণী থেকে জানা যায়, ২০০৮ সালে বাংলাদেশ বেসামরিক শাসনে ফিরে এলে ঋণের কাগজপত্রগুলো মূল্যায়ন করা হয় ঋণগ্রহীতার প্রভাব বা কানেকশনের ওপর ভিত্তি করে, ব্যবসার সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে নয়। এতে উল্লেখ করা হয়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার ব্যাংকের পরিচালকরা যেসব ঋণ অনুমোদন করেন, তার সবগুলোই খেলাপিতে পরিণত হয়। যা জাতীয় অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মূলত বাংলাদেশের কর বনাম জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশেরও কম। যা বিশ্ব অর্থনীতিতে নজিরবিহীন ঘটনা। অবকাঠামোগত দুর্বল অবয়বের কারণে আয়কর আদায়ে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। করপোরেশনের ওপর অসংখ্য ধরনের কর রয়েছে। কিন্তু কাউকে ঘুষ দিয়ে ওই কর প্রদান থেকে বিরত থাকা খুব সহজ। আমদানির ওপর মাত্রাতিরিক্ত করারোপ করার অন্যতম কারণও এটি। এ বিষয়টিই আবার আয়কর দেয়া থেকে বিরত থাকতে আমদানিকারকদের উৎসাহ জোগায়, যা দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরের দুরবস্থা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির প্রমাণ বহন করে। মূলত দেশের অর্থনীতির ওপর শকুনির শ্যান দৃষ্টি পড়েছে। যে যেভাবে পারে সবকিছু লুটপুটে খাচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব থাকলেও তারা সে দায়িত্ব পালন করছে না। দেশের অর্থভান্ডার উজাড় হয়ে গেলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। কমিশন বিশেষ মিশন নিয়েই কাজ করছে বলে মনে হয়। আসলে আমাদের দেশে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার একটা সংস্কৃতি চালু হওয়ার কারণে দেশে লুটপাটসহ অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলেছে। এতে রাক্ষসরাজ কালকেতুসহ তার চেলাচামুন্ডারা এবং বাদগাদের চোরদের অপতৎপরতা এখন অপ্রতিরোধ্য। তাই এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ও দেশ এবং সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় জাতি হিসেবে আমরা আত্মপরিচয়হীন হতে খুব একটা সময়ের প্রয়োজন হবে না। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির