বিশাল এবং সীমাহীন আকারের এই মহাবিশ্বের মাঝে আমাদের এই পৃথিবী ছোট্ট একটি গ্রহ মাত্র। আর এই পৃথিবীতেই মানুষসহ হাজার হাজার প্রজাতির প্রাণীর বসবাস। এই সব প্রাণীর প্রত্যেকটির আকার আকৃতি, দৈহিক গঠন এবং স্বভাব প্রকৃতি সবই আলাদা। প্রত্যেকটি প্রাণীই আলাদা একটি প্রজাতি। প্রত্যেক প্রজাতিই আবার পুরুষ ও স্ত্রী- এই দুই লিঙ্গে বিভক্ত এবং তাদের মিলনেই সৃষ্টি হয়ে চলেছে নতুন প্রজন্ম। আবার এক প্রজাতির প্রাণীর সাথে অন্য প্রজাতির প্রাণীর কোনো মিল নাই। প্রত্যেক প্রজাতির প্রাণীই আলাদা বৈশিষ্ট্যে বিদ্যমান। একইভাবে এই পৃথিবীতেই রয়েছে হাজার হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ। এই সব উদ্ভিদের প্রত্যেকটির আকার আকৃতি, দৈহিক গঠন এবং স্বভাব প্রকৃতিও আলাদা। এক প্রজাতির উদ্ভিদের সাথে অন্য প্রজাতির উদ্ভিদের মিল নাই। এই সব প্রজাতির প্রত্যেকটি উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের মতো আলাদা বৈশিষ্ট্যে বিদ্যমান। এসব প্রাণী এবং উদ্ভিদের জীবন ধারণ এবং বেঁচে থাকার জন্য যেসব উপাদান অপরিহার্য, তার সবই আবার এই পৃথিবীতে বিদ্যমান। এই পৃথিবীতে মানুষসহ হাজারো প্রকৃতির প্রাণী ও উদ্ভিদের আবির্ভাব এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদানের উপস্থিতি এমনি এমনি হয়নি। একজন সৃষ্টিকর্তাই এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই এসব পরিচালনা করছেন। কিছু মানুষ এই বিষয়টি স্বীকার না করলেও, ইহাই ধ্রুব সত্য ও বাস্তবতা। মূলতপক্ষে সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এমনি এমনি কোনো প্রাণীর সৃষ্টি হয়নি।
বিশ্বাসের বিবেচনায় এ পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষগুলোকে আমরা প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করতে পারি। একটি শ্রেণি হচ্ছে আস্তিক এবং অপর শ্রেণিটি হচ্ছে নাস্তিক। আস্তিকরা বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী হলেও তারা সবাই বিশ্বাস করে এই মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা রয়েছেন এবং তিনিই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং লালনকর্তা। তারা আরো বিশ্বাস করে যে, মৃত্যুর পর মানুষের আরেকটি জীবন আছে এবং সেখানে দুনিয়ার জীবনের সকল কৃতকর্মের বিচার হবে এবং কৃতকর্মের ফলাফলের ওপর মানুষ সুখের জান্নাত বা দুঃখের জাহান্নামে যাবে। অপরদিকে নাস্তিকরা বিশ্বাস করে, এই মহাবিশ্বের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই এবং মৃত্যুর পরে মানুষের আর কোনো জীবন নেই। তাই মৃত্যুর পরে মানুষের বিচারও নেই এবং জান্নাত বা জাহান্নামও নেই। নাস্তিকরা বিশ্বাস করে, এই দুনিয়ার জীবনই মানুষের একমাত্র জীবন এবং প্রাকৃতিক কোনো এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এই মহাবিশ্বের সবকিছু এবং মানুষসহ পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রাণী ও উদ্ভিদ জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। নাস্তিকরা আরো বিশ্বাস করে আজ থেকে কয়েক লক্ষ বছর আগে সর্বপ্রথম এককোষী প্রাণীর সৃষ্টি হয় এবং কালের বিবর্তনের মাধ্যমে সেই এককোষী প্রাণী থেকে বিভিন্ন প্রকারের প্রাণী সৃষ্টি হয়। নাস্তিকদের মতে এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হলো এবং এই পৃথিবীতে মানুষসহ হাজারো প্রাণী কিভাবে সৃষ্টি হলো, তা নিয়ে আস্তিক এবং নাস্তিকের মধ্যে তর্ক চলছে। এই তর্ক অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আসুন যুক্তির মাধ্যমে বিষয়গুলোকে পর্যালোচনা করি।
মানুষের মাঝে যারা জ্ঞান বিজ্ঞানে সেরা, সে সব বিজ্ঞানীদের মতেই এই মহাবিশ্বে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ নক্ষত্র রয়েছে। মহাবিশ্ব কত বড়, তার সীমা পরিসীমা, তার শুরু এবং শেষ কোথায়- তা কেউ জানে না। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে এ পর্যন্ত মহাবিশ্বের এক-দশমাংশ এলাকাও দৃষ্টিগোচর হয়নি এবং এতেই আবিষ্কৃত গ্রহ নক্ষত্রের সংখ্যা এক বিলিয়ন ট্রিলিয়নেরও বেশি। আবার এসব গ্রহ নক্ষত্রের একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব কয়েক কোটি মাইল। একটি গ্রহ নক্ষত্র হতে আরেকটি গ্রহ নক্ষত্রের দূরত্বকে আলোকবর্ষ দিয়ে পরিমাপ করা হয়। এক সেকেন্ডে আলোর গতিবেগ এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। এ হিসাবে এক আলোকবর্ষের দূরত্ব হচ্ছে ৫.৮৭ ট্রিলিয়ন মাইল। কিন্তু এইসব বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ নক্ষত্র কেন, কখন এবং কিভাবে সৃষ্টি হল তার কোনো সঠিক উত্তর এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাননি। একইভাবে আমাদের বসবাসের এই পৃথিবীটা কেন, কখন এবং কিভাবে সৃষ্টি হল তার সঠিক তথ্যও বিজ্ঞানীরা বের করতে পারেননি। একইভাবে চন্দ্র সূর্যের সৃষ্টি রহস্যও বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেননি। বিজ্ঞানীরা এই মহাবিশে^র সীমা পরিসীমাও আবিষ্কার করতে পারেননি। একইভাবে এই মহাবিশে^র সৃষ্টি রহস্যও বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেনি। আবার বিজ্ঞানীদেরই আবিষ্কৃত এই মহাবিশে^র বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্যের কোনটিই মানুষের হাতে সৃষ্ট নয় এবং মানুষের হাতে নিয়ন্ত্রিত নয়। একইভাবে এই পৃথিবীতে বিদ্যমান পাহাড় পর্বত, নদ-নদী, সাগর মহাসাগর- কোনোটাই মানুষের হাতে সৃষ্ট নয় এবং এসব কবে সৃষ্টি হয়েছে তা কেউ জানেও না। দিন রাত্রির সময়, এদের আবর্তন, চাঁদ- সুরুজের উদয় অস্ত ও মানুষ দ্বারা নির্ধারিত এবং নিয়ন্ত্রিত নয়। আবার এই পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহ উপগ্রহে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারেননি। তার মানে মহাবিশ্বের এই পৃথিবী নামক গ্রহটিতেই কেবলমাত্র প্রাণের অস্তিত্ব আছে এবং এখানে মানুষসহ লাখো প্রাণী বসবাস করে। এই পৃথিবীর জলে, স্থলে এবং অন্তরীক্ষে কত ধরনের প্রাণীর বসবাস তাও এখনো সঠিকভাবে গণনা করা যায়নি। তবে বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত প্রায় ৮৬ লক্ষ প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। আবার এই পৃথিবীতে মানুষসহ এসব লাখো প্রাণীর আবির্ভাব কখন থেকে হল, কিভাবে হল তারও কোনো সঠিক উত্তর বিজ্ঞানীদের কাছে নাই এবং এই তথ্যও বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেননি। এই ধরনের একটি অবস্থার মধ্যে এই পৃথিবীর সময় বয়ে চলছে এবং আমরাও আমাদের জীবন অতিবাহিত করছি।
আজকের এই পৃথিবীতে মানুষের যেসব আবিষ্কার জীবনকে সহজ, সুন্দর এবং সাবলীল করেছে তার কোনটাই হঠাৎ করে একদিনে তৈরি হয়নি। কয়েক হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় হাজারো মানুষের নিরবচ্ছিন্ন ও অক্লান্ত পরিশ্রমে ধীরে ধীরে এসব অর্জিত হয়েছে। বিদ্যুৎ, গাড়ি, ঘড়ি, ক্যালকুলেটর, মোবাইল ফোন, টিভি, ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, কম্পিউটার, কাগজ, কলম সবই মানুষের আবিষ্কার। রোগ নির্মূলের জন্য আজকের পৃথিবীতে বিদ্যমান হাজারো ঔষধ, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসাসেবাও মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। পরিধানের জন্য মানুষেরাই তৈরি করেছে হরেক রকম দৃষ্টিনন্দন কাপড়। শিক্ষা অর্জনের জন্য গড়ে তুলেছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। যাতায়াতের জন্য তৈরি করেছে হাজার হাজার সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, রেলপথ ইত্যাদি। দ্রত সময়ে পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য তৈরি করেছে মোটরসাইকেল, কার, বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চ, জাহাজ এবং বিমানসহ অসংখ্য যানবাহন। বেড়ানোর জন্য গড়ে তুলেছে পার্ক, চিড়িয়াখানা এবং সমুদ্র সৈকতসহ অসংখ্য স্থাপনা। বিনোদনের জন্য তৈরি করেছে গান, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি। সুরম্য অট্টালিকায় মানুষের যে বসবাস তাও একদিনে সম্ভব হয়নি। কিন্তু এসব জিনিসপত্র এমনি এমনি তৈরি হয়েছে- কোনো মানুষই এ কথা বিশ্বাস করে না, বলেও না এবং প্রমাণিতও নয়। আজ পর্যন্ত কেউ এ কথা বলে না যে- একটি গাছ আপনা আপনি চেয়ার, টেবিল বা ফার্নিচারে পরিণত হয়েছে। একইভাবে কেউ এ কথাও বলে না যে- কিছু মাটি আপনাআপনি ইটে পরিণত হয়েছে, কিছু লোহা আপনাআপনি রডে পরিণত হয়েছে এবং কিছু পদার্থ মিক্স হয়ে আপনাআপনি সিমেন্টে পরিণত হয়েছে। আর সবকিছু মিলে অটোমেটিক্যালি একটি বাড়ি নির্মিত হয়েছে সে কথাও কেউ বলে না। কেউ আবার এ কথাও বলে না যে, মানুষের প্রয়োজন অনুসারে কিছু গাড়ি এমনি এমনিই তৈরি হয়ে গেছে। সবাই এক বাক্যে বলে মানুষ এসব কিছু সৃষ্টি করেছে। তার মানে এসব বস্তু বা জিনিসপত্রের একজন স্রষ্টা আছে। সুতরাং একটি জড় পদার্থও যেমন মানুষ ছাড়া সৃষ্টি হয়নি, মানুষ সহ হাজারো প্রাণী, কোটি কোটি গ্রহ, নক্ষত্র এবং চন্দ্র, সূর্যও তেমনি কোনো স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়নি এবং স্রষ্টা ছাড়া এই মহাবিশ্ব পরিচালিতও হচ্ছে না। অর্থাৎ মানুষের একজন স্রষ্টা আছে এবং সেই সৃষ্টিকর্তাই আমাদের সৃষ্টি করেছেন। আমি কিন্তু এখানে কোনো ধর্মের রেফারেন্স বা সূত্র দিয়ে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করিনি। কারণ তখন নাস্তিকরা বলবেন, আমি আস্তিক বিধায় ধর্মের কথা বলে সৃষ্টিকর্তাকে প্রমাণ করেছি। আর এই মহাবিশ্বের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং তিনিই মানুষসহ সকল প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন- তা বিশ্বাস এবং প্রমাণ করতে খুব একটা জ্ঞান বা ডিগ্রি অর্জনের প্রয়োজন হয় না। স্বাভাবিক চিন্তার মানুষ মাত্রই সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পান। সুতরাং বিবর্তনের মাধ্যমে কালের পরিক্রমায় প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে- এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল এবং মিথ্যা। একইভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে কালের পরিক্রমায় মানুষের সৃষ্টি হয়েছে- এ ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল এবং মিথ্যা। আর বিবর্তনের মাধ্যমে একটি প্রাণী হতে আরেকটি প্রাণীর জন্ম হলে তো, প্রথম প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়ে যাবার কথা এবং সেটার আর অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। যেমন বিবর্তনের মাধ্যমে বানর থেকে মানুষের আবির্ভাব হলে, বানর তো বিলুপ্ত হয়ে যাবার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি এবং বানর প্রজাতি এখনো সারা দুনিয়ায় বিদ্যমান। সুতরাং কেউ যদি বলে বানর থেকে মানুষের উদ্ভব হয়েছে, তবে তার বক্তব্য সঠিক নয় এবং পুরোটাই মিথ্যা।
বিজ্ঞানীদেরই মতে এই পৃথিবীতেই মানুষসহ লাখো প্রাণীর বসবাস। এর প্রকৃত কারণ হচ্ছে মানুষসহ যে কোনো একটি প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য যে সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের প্রয়োজন তার সবই এই পৃথিবীতে আগে থেকেই বিদ্যমান আছে। মূলতপক্ষে জীবনের জন্য যাহা প্রয়োজন, তার সবই আয়োজন এই পৃথিবীতে আছে। যেমন প্রাণীর জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। সেই অক্সিজেন এই পৃথিবীতে এত বেশি পরিমাণে বিদ্যমান যে, আজ পর্যন্ত এই পৃথিবীর কোনো ভুখণ্ডে অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি হয় নাই এবং অক্সিজেনের অভাবে কোনো প্রাণী মারা যায় নাই। প্রাণীর জন্য অপরিহার্য উপাদান পানি। সেই পানি পৃথিবীতে এত বেশি পরিমাণে বিদ্যমান যে, বিজ্ঞানীদেরই মতে পৃথিবীর মোট ভুখণ্ডের চার ভাগের তিন ভাগই পানি। এই যে প্রাণের জন্য অপরিহার্য দুটি উপাদানের কথা আমি উল্লেখ করলাম, তার কোনোটিই কিন্তু মানুষ সৃষ্টি করেনি। বেঁচে থাকার জন্য মানুষেরা প্রতিদিন যে খাবার গ্রহণ করে- যেমন ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, তরিতরকারি, ফল মূল কোনটিই মানুষের নিজের হাতে সৃষ্ট নয়। হাজার ধরনের গাছপালা এবং পশুপাখিও মানুষের হাতে সৃষ্ট নয়। ধান, গম, আলু, মরিচ, পেঁয়াজ, আদা, হলুদ, রসুন, বেগুন, মুলা, শিমসহ বিভিন্ন ধরনের তরিতরকারি, নানা ধরনের শাক সবজি, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, আপেল, কমলা, আঙ্গুর, তরমুজ, কলা ইত্যাদি কখন থেকে এবং কিভাবে আবাদ শুরু হল তার কোনো সঠিক উত্তর বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। একইভাবে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় গরু, মহিষ, ছাগল, হাঁস, মুরগি এবং পানিতে বাস করা রুই, কাতলা, কই, মাগুর, ইলিশ, চিংড়ি, বোয়াল, কোরাল, রূপচাঁদাসহ হাজারো মাছ কখন এবং কিভাবে সৃষ্টি হল তার কোন সঠিক উত্তরও বিজ্ঞানীদের জানা নেই। আর এসবের কোনোটিই মানুষের হাতে সৃষ্ট নয়। আবার এসবের প্রত্যেকটিই মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় এবং এসবের উপর নির্ভর করেই মানুষ জীবন ধারণ করছে। মানুষের জীবন ধারণের জন্য যা প্রয়োজন তা এই পৃথিবীতে বিদ্যমান আবার এসব জিনিস মানুষের কাজে লাগছে- এই আন্তঃনির্ভরতা কারো নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কখনো সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে এসবই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি এবং মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টিকর্তা এসব সৃষ্টি করেছেন।
জ্ঞান বিজ্ঞানে মানুষ যতই উন্নত হউক না কেন মানুষের ক্ষমতা এবং এর সীমা-পরিসীমার বিষয়টি নিয়ে আজ ভাবা দরকার। মানুষের জন্মের ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। তার মৃত্যুর ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কে কখন মারা যাবে তা জানার কোনো ব্যবস্থা নেই। মানুষ ইচ্ছা করলে নিজের শরীরটাকে এক ফুট বড়ও করতে পারে না। তার গায়ের রঙটাও পরিবর্তন করতে পারে না। ইচ্ছা করলেই মানুষ আকাশে উড়তে পারে না, সাগরতলে বাস করতে পারে না এবং হাজার বছর ধরে বাঁচতেও পারে না। তবু মানুষের এইসব বিষয়ে কোনো ভাবনা নেই। আচ্ছা মানুষ তো এই পৃথিবীতে অনেক কিছু বানিয়েছে, অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে এবং পৃথিবীকে অনেক উন্নত করেছে। মানুষের এই অবদানকে এক বাক্যে স্বীকার করি এবং সম্মান করি। কিন্তু এসব কি মানুষের একক অবদান? নিঃসন্দেহে তা নয়। কারণ মানুষ যাই বানিয়েছে তার সবকিছুর উপাদান প্রকৃতিতেই বিদ্যমান। মানুষ কেবল চিন্তা, গবেষণা এবং পরিশ্রম করে সেটাকে ব্যবহারের উপযোগী করেছে। কয়েকটি উদাহরণ দিই। আমরা লোহা দিয়ে বাড়ি, বিমান, জাহাজ তৈরি করেছি। কিন্তু সেই লোহা তো মানুষ তৈরি করেনি। সেটা তো প্রকৃতিতেই ছিল। আমরা জ্বালানি তেল দিয়ে গাড়ি, বিমান, জাহাজ, কলকারখানা সবই চালাচ্ছি। কিন্তু সেই জ্বালানি তেল তো মানুষ বানায়নি। সেটা প্রকৃতিতেই ছিল। মানুষ সেটাকে কেবল ব্যবহার উপযোগী করেছে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির প্রধান উপাদান কম্পিউটারের চিপসের মূল উপাদান সিলিকন তো প্রকৃতিরই অবদান। মানুষ গবেষণার মাধ্যমে সেটাকে কেবল ব্যবহার উপযোগী করেছে। এভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে প্রতিটি জিনিসই প্রকৃতির অবদান। যে সূর্য আমাদেরকে আলো দেয় তা নিশ্চয়ই মানুষেরা সৃষ্টি করেনি। একইভাবে যে চন্দ্র আমাদেরকে রাত্রি বেলায় জোৎস্নার আলো দেয় তাও নিশ্চয়ই মানুষ সৃষ্টি করেনি। আবার বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা সব অসম্ভবকে কিন্তু সম্ভব করতে পারে না। চিকিৎসাবিজ্ঞান একজন মানুষের রোগ নিরাময়ে সক্ষম। কিন্তু তাই বলে মানুষকে অমরত্ব দানে সক্ষম নয়। নারীগর্ভে থাকা সন্তানটি ছেলে নাকি মেয়ে তা প্রসবের আগে জানা সম্ভব। কিন্তু তাই বলে ইচ্ছামত ছেলে অথবা মেয়ে শিশুর জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। মানুষ তার ইচ্ছামত দিন রাত্রিকে যেমন বড় ছোট করতে পারে না, ঠিক তেমনি রোদ বৃষ্টি আর শীতকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মানুষ তার প্রয়োজনমত আবহাওয়াটাকে গরম এবং ঠাণ্ডাও করতে পারে না। একইভাবে ভূমিকম্প, অতি বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বন্ধ করার উপায়ও মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। কারণ হচ্ছে মানুষের জ্ঞান এবং ক্ষমতার একটি সীমারেখা আছে, যা অতিক্রম করা কোনো মানুষের পক্ষে কোনোদিনও সম্ভব নয়। তাই মানুষের উচিত বাস্তবতায় ফিরে আসা, বাস্তববাদী হওয়া এবং এই মহাবিশ্বের স্রষ্টাকে জানা। কিভাবে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হল, কিভাবে পথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হল, এই পৃথিবীতে আমাদের কাজ কী এবং মরণের পরে কী হবে সে সব বিষয় জানা এবং সেই অনুযায়ী পথ চলা সবার একান্ত কর্তব্য। তাহলেই কেবল মানুষের জীবন শান্তিময় এবং সুখের হবে। শুধু শুধু স্রষ্টাকে অস্বীকার করে তো কোনো লাভ নেই বরং সব দিকেই ক্ষতি। সুতরাং আসুন সৃষ্টিকর্তাকে মেনে নিই, তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করি এবং তার নির্দেশিত পথে চলে জীবনকে সফল এবং সার্থক করি। মানবজাতির মুক্তির জন্য এর কোনোই বিকল্প নেই।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন