post

সৌরভ ছড়ানো হৃদয়ের কথা ইয়াসিন মাহমুদ

২৬ জুলাই ২০২১

আমরা মানুষ। সামাজিক জীব। মনের ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমাদের অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। পারস্পরিক কথা বলতে হয় কখনো একান্ত নিজের প্রয়োজনে কখনোবা অন্যের প্রয়োজনে। আমাদের কথা বলার প্রধান সমন্বয়ক হলো জিহ্বা। আমাদের কথার মাধ্যমে কেউ খুশি হয় আবার কেউ কষ্ট পায়। ভারাক্রান্ত হয়। কথা বলার বিধান সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন : “তোমাদের মধ্যে একটি দল থাকবে যারা মানুষকে কল্যাণের (কুরআনের কথার) দিকে ডাকবে, ভালো কাজ করতে আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। তারাই হবে প্রকৃত সফলকাম।” (সূরা আলে ইমরান : ১০৪) কথার মধুরতা ও কটুতা সম্পর্কে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- “একটি মিষ্টি কথা এবং কোনো অপ্রীতিকর ব্যাপারে সামান্য উদারতা ও ক্ষমা প্রদর্শন একটি দানের চেয়ে ভালো।” (সূরা বাকারা : ২৬৩) এ বিষয়ে মহানবী সা. বলেছেন- “তোমাদের কেউই ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ তার হাত ও মুখ থেকে অন্য কোন মুসলমান নিরাপদ নয়।” (বুখারী-৯ ) আরবী ভাষায় একটি প্রবাদ আছে- কালামুর রাযুলু মিজানুল আকলি। প্রবাদটির ভাবার্থ হলো- ব্যক্তির কথা তার জ্ঞানের মাপকাঠি। এ ব্যাপারে আমরা আল কুরআনের নির্দেশনাটা জেনে নিই। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- “যারা কল্যাণকর কথা বলে ও কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ এবং আরো অনেক কিছু। মলিনতা ও অপমান তাদের মুখমণ্ডলকে আচ্ছন্ন করবে না। তারা হবে জান্নাতের অধিবাসী, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। পক্ষান্তরে যারা মন্দ কথা বলে বেড়ায় তাদের প্রতিদান অনুরূপ মন্দ। তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে হীনতা আর অবমাননা। আল্লাহর পাকড়াও থেকে তাদের রক্ষা করার কেউ থাকবে না। তাদের মুখমণ্ডল হবে যেনো রাতের অন্ধকার আস্তরণে আচ্ছাদিত। তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” (সূরা ইউনুস : ২৬-২৭) কথা বলার যোগ্যতা নিঃসন্দেহে আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি এক বিশাল নিয়ামত। আল্লাহ যাদেরকে এই নিয়ামত দেননি কেবল তারাই বোঝে এই শূন্যতা। কথা বলার মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিত্ব ও বংশের পরিচয় ফুটে ওঠে। আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কথাই মানুষকে উচ্চাসনে আসীন করে আবার সামান্য কথাই মানুষের আত্মসম্মানবোধ ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। তবে মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে কথা বলার যোগ্যতা দিয়েছেন বলে আমি হরহামেশা কথা বলেই যাবো? নিশ্চয় না। অনেক সময় আমরা মানুষকে মানুষ বলে মনে করি না। যাচ্ছেতাই বলে থাকি। নিম্নশ্রেণির মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রভাব খাটিয়ে বিনামূল্যে শ্রম দিয়ে নিই। কোনো আলাপ ছাড়াই বেদম প্রহার করি। গালিগালাজ করি। তুই তুকারি করি। ছোটলোক কিংবা নিম্নবংশীয়তার পরিচয় তুলে ধরি সকলের সামনাসামনি। এহেন পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষগুলোর বেদনাহত হৃদয়ের আকুতি প্রকাশে অশ্রুতে চোখ ভিজে যায়। হয়তোবা উচ্চশ্রেণির মানুষেরা তাদের বড়ত্ব ও আমিত্ব প্রকাশে মানুষের প্রতি দাপুটে মনোভাব দেখিয়ে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে নিজেকে সমাজের একজন কর্তৃত্ববাদী নেতা ভাবে। অথচ যার প্রতি খারাপ ব্যবহার করা হলো সে তো ঘুমাতে পারে না। ঐ কথার আঘাত তাকে বারবার দংশন করে। ব্যথায় পাঁজর ভেঙে দেয়। আহা! বুকে বাজে ব্যথার বীণ। অথচ এসব বিষয় নিয়ে আত্মসমালোচনার কাঠগড়ায় নিজেকে কখনো সোপর্দ করি? এখন প্রশ্ন থাকতে পারে তাহলে কি আমরা একবারেই চুপ থাকব? নিশ্চয়, না। আমরা কথা বলব প্রয়োজনে। আবার প্রয়োজনে চুপও থাকব। আমার কথা বলা ও চুপ থাকার উপর আমার পরকালীন মুক্তির গ্যারান্টির নির্ভরতা রয়েছে। সুতরাং কাক্সিক্ষত সেই জান্নাতের পথ আবিষ্কারে রাসূল সা.-এর দেখানো আলোর পথের যাত্রী হয়ে যাই। কী বলেছেন প্রিয় নবী সা.। চলুন জেনে নিই- হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা.কে জিজ্ঞেস করা হলো যে, হে আল্লাহর রাসূল! অধিকাংশ লোক কোন আমলের মাধ্যমে জান্নাতে যাবে? তিনি বলেন: আল্লাহভীতি ও সৎচরিত্র। তাকে আরো জিজ্ঞেস করা হলো যে, কী কারণে অধিকাংশ লোক জাহান্নামে যাবে? তিনি বলেন, মুখ ও লজ্জাস্থানের কারণে। (তিরমিযি, কিতাবুল বির ওয়াস সিলা, বাব ফি হুসনিল খুলক) অন্য আরেকটি হাদীসে এসেছে- হজরত সাহল ইবনে সা’দ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি আমাকে দুই বস্তুর জিম্মাদার হবে। যথা: ১. দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থান তথা জবান এবং ২. দুই পায়ের মধ্যবর্তী স্থান তথা লজ্জাস্থান। আমি তার জন্য জান্নাতের জামিন হবো। (বুখারী-২/৯৫৮) কথার আঘাতে যেমন মানুষ মানুষ থেকে দূরে সরে যায়। আবার কথার সৌরভে মানুষ মানুষকে ভালোবেসে ফেলে। আপন করে নেয়। কথার আঘাত মানুষের বুকে তীর বিদ্ধের মতো বিঁধে যায়। যন্ত্রণা বাড়ায়। বিষণœ করে তোলে। পক্ষান্তরে কথার মধুরতায় মানুষ অন্য মানুষকে কাছে পাবার ব্যাকুলতা ও শূন্যতায় উতলা হয়ে ওঠে। এটাই কথার মোজেজা। আবার কেউ কেউ সারাদিন চিল্লালেও একটি লোকও তার পাশে দাঁড়ায় না। কিংবা কাছে ভিড়ে না। আবার অনাহূতভাবে অনেকে অনেকের পিছু ভিড়ে। এটা হলো ভালোবাসা ও ভালোলাগা। কথার জাদুর সম্মোহনী শক্তির প্রভাব। অবশ্য নিরর্থক কথা বলার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। অন্যদিকে ভালো কথাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেবার তাগিদও এসেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- হে নবী; হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আপনি মানুষকে আপনার রবের পথে ডাকুন। আর তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করতে হলে সুন্দরভাবে করুন। (সূরা নাহল : ১২৫) মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন- ভালো কথা ও কাজ আর মন্দ কথা ও কাজ এক সমান নয়। আপনি অসৎ কাজকে ঐ নেক কথা ও কাজ দ্বারা দমন করুন, যা সবচেয়ে ভালো। তাহলে দেখতে পাবেন যে, যার সাথে আপনার দুশমনি ছিলো সে আপনার প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে। (সূরা হা-মীম সাজদাহ : ৩৪) মহান আল্লাহ তায়ালা সকল সৃষ্টিকুলের মধ্যে মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর করে তৈরি করেছেন। তবে এই মানুষের রয়েছে নানান রঙ ও বর্ণ। রয়েছে মতের পার্থক্য। তবে একটা বিষয় সন্দেহাতীতভাবে সত্য, একজন কুৎসিত চেহারার মানুষকেও সুন্দরের পূজারি হতে দেখা যায়। কারণ চেহারা সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। তবে মানুষের রুচিবোধ ও ব্যক্তিত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্বতা ও জীবনাচরণই কেবল তাকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও অনুকরণীয় তোলে। সুন্দরের প্রতি সবার একটা ঝোঁকপ্রবণতা থাকে। আমরা প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিদিন অসংখ্য কথা বলে থাকি। আর এই কথা বলারও একটা নির্দেশনা দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। কথা বলার আনন্দকে উপভোগ করতে হবে। মহান আল্লাহর ঘোষণা- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।” (সূরা আহযাব : ৭০) আসা-যাওয়ার এই দুনিয়ায় আমরা কেউই চিরস্থায়ী রবো না। এই যে মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ, ভালোবাসা এগুলোই তো কেবল বেঁচে থাকে অনন্তকাল। পক্ষান্তরে রূঢ়তা, ভর্ৎসনা, অবহেলার মতো অসদাচরণগুলো মানুষের বুকে বসবাস করে দীর্ঘকালব্যাপী। ব্যবহারের মাধ্যমেই মূলত মানুষের মনকে জয় করতে হয়। অমায়িক ব্যবহারের কাছে কখনো কখনো কুপোকাত হয় অস্ত্রের ঝনঝনানি। তাই আমাদের উচিত ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে অস্তিত্বের শেকড়কে গ্রোথিত করতে; মৃত্যুর পরেও দুনিয়াতে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে কেবলই প্রয়োজন সকলের সাথে চারিত্রিক মাধুর্যময় কথামালা। আর সে যোগ্যতা অর্জন করাই বোধ হয় একজন মুমিনের জন্য বড়ই সৌভাগ্যের পরশমণি।

লেখক : কবি ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির