post

স্বাধীনতার ৪১ বছর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণ

০৩ মার্চ ২০১২
ছাত্র সংবাদ ডেস্ক ২৬ মার্চ। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। গৌরবদীপ্ত ও দুর্বিনীত সাহসী জাতি হিসেবে আমাদের কাছে দিনটি অনন্য সাধারণ ও স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ দিনটি শুধু পঞ্জিকার পাতায় কোনো জ্বলজ্বলে লাল তারিখ নয়, নয় কেবল চৈত্রের দগদগে রৌদ্রময় একটি দিন, বাংলাদেশী জাতির কিংবদন্তীতুল্য দেশপ্রেম, অবিরাম সংগ্রাম এবং সংহত শক্তিরও প্রতীক। বছরের একটি মাত্র দিন হলেও জাতির মনে এক ভিন্নতর ভঙ্গী ও অনুভূতি শব্দায়মান হয়ে ওঠে। আলোকোজ্জ্বল এ দিনটি আমাদের সামগ্রিক জীবন ও ইতিহাসে এবং তার সত্তা ও স্বরূপকে পরিব্যক্ত ও পরিধৃত করে বিরাজ করছে বিস্ময়কর অভিভবে। স্বাধীনতা অর্জনে ৪১ বছর পেরিয়ে এলো বাংলাদেশ। পদার্পন করলো ৪২তম বর্ষে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। প্রতি বছরই ডিসেম্বর এবং মার্চ মাসে আমরা একটা হিসাব করতে বসি, স্বাধীনতার মাধ্যমে আমরা কী চেয়েছিলাম এবং তার কতটা অর্জন করতে পেরেছি। হয়ত এর প্রয়োজনও আছে। নিজেদের ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধন করে যাতে আমরা আরও দ্রুত অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি, তার জন্য পেছনে ফিরে দেখা যায়। যুদ্ধ করে আমরা কেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম? এ প্রশ্ন তো আসেই। স্বাধীনতা কারা চায়? স্বাধীনতা চায় তারাই, যে জনগোষ্ঠী শত শত বছরের নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজেরা একটি জাতি হয়ে ওঠে। কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিত্বের বোধ যখন প্রবল হয়, তখন ঐ জনগোষ্ঠী আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য স্বাধীনতা চায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের শাসক নির্বাচন করতে চায়। বাংলাদেশের মানুষের জাতিসত্তার বিকাশ ঘটেছে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে। প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক সব মিলিয়েই তাদের মধ্যে জাতীয় সাজুয্য গড়ে ওঠে। তাদের আশা-আকাক্সক্ষাও হয়ে ওঠে অভিন্ন। ফলে তারা এই অঞ্চলের অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। তাদের আশা-আকাক্সক্ষা আর চেতনাও হতে থাকে ভিন্ন। তাদের এই স্বতন্ত্র জীবনবোধের ওপর যখনই আঘাত এসেছে, তখনই ঐক্যবদ্ধভাবে তা রুখে দিয়েছেন। সেই প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল অষ্টম শতাব্দী থেকেই। ঐ সময় যখন সেন রাজারা এখানে সনাতন বর্ণভেদ প্রথা সংবলিত হিন্দু ধর্ম প্রবর্তনের চেষ্টা শুরু করে, তখন বাংলাদেশ অঞ্চলের মানুষ তা গ্রহণ করেনি, প্রত্যাখ্যান করেছিল। কেন? পশ্চিমবঙ্গ এলাকা ও অন্যান্য এলাকার মানুষ তো সনাতন ধর্মই গ্রহণ করেছিল, তা হলে বাংলাদেশ অঞ্চলের মানুষ তা গ্রহণ করল না কেন? বাংলা ভাষাভাষী মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচই তো একটি জনগোষ্ঠীর সবটুকু পরিচয় নয়। জাতিগত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য আরও বহু ক্ষেত্রে সাজুয্য দরকার। বাংলাদেশ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সে স্বাতন্ত্র্যবোধ ও সাজুয্য ছিল বলেই তারা বলিষ্ঠ জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং স্বাধীনতার প্রয়োজন অনুভব করেছে এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এ ইতিহাস দীর্ঘ। কিন্তু এখানে সংক্ষেপে পটভূমি হিসেবে উল্লেখ করা হলো। আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল প্রধানত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং অর্থনৈতিক মুক্তি। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সঙ্গে গণতন্ত্রের যোগাযোগ ওতপ্রোত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ছিল গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা। তা ছাড়া এ পর্যন্ত প্রায় সকল পণ্ডিতই একই রকম অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, গণতন্ত্র ছাড়া অর্থনৈতিক অগ্রগতি অসম্ভব ব্যাপার। এ দেশের মানুষ অনেক আত্মদান, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা তো অর্জন করল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পতাকা বদল হলো। নতুন দেশ হলো। আনন্দে উদ্বেলিত হলো এ দেশের মানুষ। এদের সহস্র বছরের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু স্বপ্ন ভঙ্গ হতেও বেশি সময় লাগল না। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হলো, তারা ব্যর্থ হলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। রাষ্ট্রক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য তারা ক্রমেই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিলেন। কেড়ে নিলেন মানুষের মত প্রকাশের অধিকার, কেড়ে নিলেন সভা-সমিতি করার অধিকার, কেড়ে নিলেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, কেড়ে নিলেন ভিন্ন মতের রাজনীতি করার অধিকার। সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠলেন শেখ মুজিবুর রহমান। চারটি মাত্র পত্রিকা নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দিলেন। ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমনে নিষ্ঠুর নির্মম সব ব্যবস্থা নিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সকল রাজনৈতিক দলও নিষিদ্ধ করে দিয়ে গণতন্ত্রের কবর রচনা করলেন তিনি। নাম হলো তার বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গলা টিপে হত্যা করার পরিণতি উপলব্ধি করা গেল ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের আগেই। ১৯৭৪ সালে দেশব্যাপী সৃষ্টি হলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সমৃদ্ধ এক জীবন ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে যে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে, তাদেরই ৮ লক্ষ মানুষ সে দুর্ভিক্ষে প্রাণ দিল। পরে নোবেল পাওয়া ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ অন্য গবেষকরাও প্রমাণ করেছেন যে, সে সময় যদি বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকত, বাকশাল কায়েম না হতো, তাহলে ঐ দুর্ভিক্ষ থাকত না। কিন্তু শেখ মুজিবের এই দুঃশাসন খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট সে দুঃশাসনের অবসান ঘটে। এর পর স্বাধীনতার ঘোষক বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন ১৯৭৮ সালে। তার শাসনকাল স্থায়ী হয়েছিল মাত্র চার বছর। এই চার বছরেই ফিরিয়ে দেয়া হয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, একদলীয় শাসনব্যবস্থার বদলে চালু করা হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মর্যাদা ও কর্তৃত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়। ফলে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায় বিপুল কর্মোদ্যম নিয়ে। ফলে এই চার বছরেই কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, খাদ্য ক্ষেত্রে অভাবনীয় ইতিবাচক পরিবর্তন আনে তাদের ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। শুধু তা-ই নয়, শেখ মুজিবের অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সময়ে যারা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যা দিয়েছিল, তারাই বাংলাদেশকে অপার সম্ভাবনার দেশ হিসেবে অভিহিত করতে শুরু করল। শুধুমাত্র শাসকের পরিবর্তন ঘটায় সেই মানুষরাই এই পরিবর্তন এনেছিল, শেখ মুজিবের শাসনকালে যারা হয়েছিলেন ন্যুব্জপৃষ্ঠ। জাদুটা তাহলে কী? শাসকগোষ্ঠী যদি জনগণের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে তা হলে জনগণই তাদের ভাগ্য বদলে নেয়। শাসকের কাজ সেটাই, আর শাসক যদি হন জনপ্রতিনিধিত্বশীল, মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি থাকে, তাহলে জনগণও বলতে পারে কোন ব্যবস্থা তাদের জন্য অনুকূল, কোন ব্যবস্থা নয়। কিন্তু ১৯৮২ সালে সেনাপতি এরশাদ যখন গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করলেন, থমকে গেল দেশ। সাধারণ মানুষ তার আগের চার বছরে অগ্রগতির যে জোয়ার তুলেছিল, সামরিক জান্তার এক থাবায় সে জোয়ারের স্রোত রুদ্ধ হয়ে গেল। শুরু হলো পিছিয়ে পড়ার কাল। সামরিক একনায়কের হালুয়া-রুটির লোভে জড়ো হলো একদল লুটেরা শাসক। লুণ্ঠনে ফোকলা হয়ে গেল দেশের অপার সম্ভাবনা। তারপর ৯ বছর। সামরিক একনায়কের ৯ বছরের শোষণ বঞ্চনায় লুণ্ঠনে-পীড়নে লণ্ডভণ্ড সব কিছু। কিন্তু ’৯০ সালে এসে ঘুরে দাঁড়ালো মানুষ। মাঝখানে সামরিক একনায়ককে যারা সহায়তা করছিল, তারাও ক্রমে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করল। সে নেতৃত্বকে বাদ দিয়েই জনগণ নিজ দেশের সুরক্ষায় সামরিক শাসকদের সহায়তাকারী তাদের নেতা-নেত্রীদের বাদ দিয়েই নেমে এলো রাজপথে। প্রতিরোধের এমন এক ব্যূহ নির্মাণ করল যে, পিছু হটতে বাধ্য হলেন স্বৈরাচারী এরশাদ শাহী। তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে ছাড়ল জনগণ। ১৯৯১ সালে দেশে আবারও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। সে ব্যবস্থার সুফলও আমরা পেতে শুরু করলাম খুব দ্রুত। পছন্দ করি বা না করি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ১৫ বছরের শাসনকালে দেশের ধারাবাহিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিএনপির দশ বছরের শাসনকালে এক বছরেরও বেশি সময় আওয়ামী লীগ হরতাল করেছে। আওয়ামী লীগের শাসনকালে বিএনপি হরতাল করেছে। তারপরও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থেকেছে। উভয় দলই সংসদ বর্জন করেছে। কিন্তু তারপরও উভয় দলকেই জনগণের কথা ভাবতে হয়েছে। জনগণের কাছে যে আবার ভোটের জন্য যেতে হবে, সে কথা মনে রাখতে হয়েছে। ফলে তাদের দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা ভাবতে হয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা ভাবতে হয়েছে। ডিজেল-পেট্রলের দাম বাড়াতে দশবার ভাবতে হয়েছে। কৃষি উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হয়েছে। ফলে এই ১৫ বছরে এরশাদ আমলের চেয়ে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে বহুলাংশে। এরশাদের সাড়ে তিন শতাংশ, গণতান্ত্রিক শাসনের আমলে তা কখনও ৬ শতাংশের নিচে নামেনি, ২০০৬ সালে তা প্রায় ৭ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছিল। কিন্তু বিগত তিন বছরের অগণতান্ত্রিক জনপ্রতিনিধিত্বহীন শাসন দেশের সকল ক্ষেত্রে অবনতি দেখা দিচ্ছে। প্রবৃদ্ধি নামতে নামতে ইতোমধ্যেই হতাশাজনক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। দ্রব্যমূল্য তো শুধু অসহনীয় নয়, জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে পৌঁছে গেছে। তেল ও গ্যাসের মূল্য দফায় দফায়  বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বর্তমান শাসকরা জগণের কথা ভাববার সময়ই দিতে পারছেন না। তাদের অনভিজ্ঞজনোচিত সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্য লাটে উঠতে বসেছে। দেশের একটি বৃহৎ অংশের মানুষের আয়-রোজগারের মাধ্যম পুঁজিবাজার একপ্রকার ধ্বংসই হয়ে গেছে। বিনিয়োগ গেছে কমে। শিল্পায়নের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা সবাই। আসলে স্বাধীনতার ঠিক পরবর্তী সরকার যে পদ্ধতিতে দেশকে পরিচালনা করেছিল এবং যার পরিণতিতে নেমে এসেছিল দুর্যোগের পাহাড়, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারও সেই পথই অনুসরণ করছে বলে মনে হয়। তাদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার কোনে সংযোগ নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো একটি ব্যবস্থা তারা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। পৃথিবীর কোথাও এই ধরনের ব্যবস্থার নজির নেই। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি মুসলিম দেশে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের থেকে তারা শিক্ষা নিতেও বুঝি নারাজ। বরং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একজোট হয়ে কাজ করার বিপরীতে বিভাজনের খেলায় মত্ত একটি মহল। ফলে স্বাধীনতার এই ৪১ বছর পর ৪২ বছরের প্রারম্ভে আমাদের যে অর্জনগুলো ছিল তা ম্লান হতে বসেছে। দেশ, জাতি ও ঐতিহ্য রক্ষার ব্রত থেকে সরে এসে শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হীন মানসিকতা নিয়ে নির্মমতার চরম নিচতা প্রদর্শিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন ও এই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সাথে যে আচরণ করা হচ্ছে তা বোধকরি মানবিকতা সম্পন্ন কোনো সুষ্ঠু মানুষ কিংবা সঠিক পথে চলমান কোনো সরকারের পক্ষে আদৌ সম্ভব না। মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি আর জঘন্যতম অপবাদের যে নজির তারা স্থাপন করে চলেছে, তাতে শুধু সরকারই নয় সমগ্র জাতি আজ কলঙ্কিত হচ্ছে। এ কলঙ্কের দাগ মোছার কোনো আলামত আপাতত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এ লজ্জা তাই দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষের। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, স্বাধীকার আন্দোলনের মুখরতায় টালমাটাল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখ ছিলো পবিত্র জুমাবার। সেদিন সুউচ্চ মিনার থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি, মুক্ত বিহঙ্গের উড়াউড়ি-ডাকাডাকি, নদীর নিঃশব্দে কিংবা কলকল রবে বয়ে চলা, এমনকি শাশ্বত সূর্যোদয়ের মধ্যেও নিহিত ছিলো অন্যরকম দ্যোতনা। কারণ সেদিন এ দেশের নির্বিশেষে মানুষ স্বাধীনতা লাভের অদম্য বাসনা নিয়ে দখলদার পশ্চিম পাকিস্তানিদের সীমাহীন ও অব্যাহত শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন। তাইতো দিনটি আবেগমথিত, মহিমান্বিত ও স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক ক্ষণ এটি। টানা নয় মাসের মরণপণ লড়াই ও সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের পর সাড়ে সাত কোটি মানুষ পেয়েছিলো নিজস্ব মানচিত্র, নিজের মতো করে একটি লাল-সবুজ পতাকা। অযুত জনতার আপসহীন মনোভাব ও বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বতন্ত্র স্বাধীন জাতিসত্তায় বিশ্ববুকে অধিষ্ঠিত। বাংলাদেশ ও এ জাতির পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হবার কৃতিত্ব কোনো বিশেষ ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর একার নয়। সামরিক-বেসামরিক নির্বিশেষে সকল পেশা ও বয়সের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো স্বাধীনতা সংগ্রামে। শরীরের রক্ত ঝরানো ছাড়াও তাদেরকে সহ্য করতে হয়েছিলো বহু জুলুম, নির্যাতন ও নিপীড়নের অব্যক্ত যন্ত্রণা। কিন্তু এখনো ‘দিকে দিকে শকুনিরা ফেলিছে নিঃশ্বাস।’ একটি মহল এ দেশকে সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদীতে ঘাঁটি বানাতে চায়। আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিলো শুধু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া নয়; গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার এ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বিগত চার দশকেও এসবের কোনোটিই পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আজ আমাদের প্রত্যেকের উপলব্ধির সময় এসেছে- ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।’

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির