মানুষের অন্তর থেকে ন্যায়বোধ লোপ পেলে সেই মানুষের পক্ষে যেকোনো ধরনের ভুল ও অজনহিতকর সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব। আমাদের দেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এবং তাদের সাথে যারা সখ্য রেখে চলতে অভ্যস্ত বা সুযোগসন্ধানী তাদের অবস্থা বিবেচনায় নিলে আমরা এর প্রকৃত চিত্র দেখতে পাই।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার ৫১তম বছর অতিক্রম করছি আমরা। একটা ভূখণ্ডকে গড়ে তোলার জন্য এরচেয়ে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু বাংলাদেশ যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আরো ১০০ বছরেও এদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে মৌলিকভাবে চিহ্নিত একটি দেশ হিসেবে বিবেচনায় নেয়া কঠিন হতে পারে। একটি দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্য (Sustainable Development Goal’s-SDG) আপনাদের জানা থাকার কথা। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পূর্বে একটি কথা বারবার বলেছে; টানা কয়েক মেয়াদে তার সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে দিলে দেশকে টেকসই উন্নয়নের দেশ হিসেবে উন্নীত করতে পারবে। সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়। উন্নয়নের বাস্তবচিত্র দেখার জন্য আমরা ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার কিছুটা বিশ্লেষণ করতে পারি। জাতিসংঘ নির্ধারিত ১৭টি প্রধান লক্ষ্যমাত্রা এবং বাংলাদেশে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে অর্জনসমূহের কিছু বিশ্লেষণ নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. No Poverty- সর্বত্র সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) গত বছরের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে দারিদ্র্য বেড়ে ৪৩ শতাংশ হয়েছে। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১০-এর চূড়ান্ত রিপোর্টে এর হার ছিলো ৪০ শতাংশ।
২. Zero Hunger- ক্ষুধার অবসান, খাদ্যনিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে, জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ সুষম খাবারের ঘাটতিতে রয়েছে (জাতীয় খাদ্য ও নিরাপত্তার খসড়া নীতি, ২০২০)।
৩. Good Health and Well-being- সকল বয়সী সকল মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, যদি কোনো দেশে একজন নাগরিকের স্বাস্থ্য ব্যয় তার সমস্ত ব্যয়ের ৩০% বা তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সেই দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষাব্যবস্থা দুর্বল বলে বিবেচিত হয়। বিবিসির ২০২০-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় ৩৪ টাকা এবং বাকি ৬৬ টাকা রোগী নিজে বহন করে। সেই ৩৪ টাকা পেতেও বিশেষ সহযোগিতার প্রয়োজন হয়।
৪. Quality Education- সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি গুণগত মানের শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যার দিকে এবং পাঠদানের মানের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়। ২০২১ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় শুধুমাত্র জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৮৯১৬৯ জন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন মাত্র ৬৩ হাজার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদানে মান নিশ্চিত করতে না পারার দোহাই দিয়ে ১০১৫ আসন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
৫. Gender Equality- জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন জেন্ডার সমতা আলোচনা বিশ্বব্যাপী মূল আলোচনার বিষয়, নারীর ক্ষমতায়ন। এদিক থেকে বাংলাদেশ বেশ এগিয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপস ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২১ এ বাংলাদেশ ১৫৬টি দেশের মধ্যে ৬৫তম অবস্থানে রয়েছে। এই উন্নয়ন সূচক বাস্তবায়নের বড় সূচক হওয়ার কথা নারীর নিরাপত্তা। কিন্তু সরকার নারীদের নিরাপত্তা বিধানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। শুধু ধর্ষণের বিষয়টি যদি আলোচনায় আনা হয়, তাহলে মাথা নিচু হয়ে আসবে সবার। পত্রপত্রিকাগুলোতে ধর্ষণ নামে একটি ফিচার চালায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট এক হাজার ৩২১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন নয় জন। ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এক হাজার ৬২৭ জন নারী এবং ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪১৩ জন নারী।
৬. Clean Water and Sanitation- সকলের জন্য পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা শুধু ঢাকা শহরে অর্থাৎ ঢাকা ওয়াসার অব্যবস্থাপনার বিষয় আলোচনায় আনা যাক। যে ওয়াসা নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার পানি কিনে ফুটিয়ে পান করতে হয়। অন্যথায় যার পানি খেতে হলে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে ফিল্টার কিনে রাখতে হয়। যে পানি পাশে রেখে ১৫ টাকা দিয়ে এক গ্লাস পানির সমান বোতলজাত পানি কিনে খেতে হয়। সেই ওয়াসা ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত পানির দাম বাড়িয়েছে ১৪ বার।
৭. Affordable and Clean Energy- সকলের জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, টেকসই ও আধুনিক জ্বালানি সহজলভ্য করা বিশ্ব যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। ফসিল ফুয়েল, উইনড এনার্জির ব্যাপারে এগোচ্ছে। তখন বাংলাদেশ সেদিকে খেয়াল না করে দেশের উন্নয়ন চিন্তা করছে। ফলে বড় বাজেট করতে হচ্ছে তেল-গ্যাস নিয়ন্ত্রণে। মূল ভিক্টিম হচ্ছে পরিবেশ ও সাধারণ জনগণ। গত ২০ বছরে শুধু ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৩ বার, কমানো হয়েছে ৪ বার। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে দেশে দাম বাড়ানো হয়, দাম কমলে কমানো হয় না। সমতা রক্ষার দোহাই দিয়ে গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ পরিবেশ রক্ষা নিয়ে চিন্তার বিপরীতে মারাত্মক ক্ষতিকর অধিক কার্বনি উৎপাদনকারী জ্বালানির ব্যবহারের দিকেই বেশি উদ্যোগ, যার মাধ্যমে ভোক্তা পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতির পরিস্থিতি দিন দিন বাড়ছে।
৮. Decent Work and Economic Growth- সকলের জন্য পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং শোভন কর্মসুযোগ সৃষ্টি এবং স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা শেষ করে বের হয়। কিন্তু এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান তথা বিআইডিএসের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে মাস্টার্স পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ আর অনার্স পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশ। সরকারিভাবে যেসকল কর্মসংস্থান রয়েছে, তা আবার জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। অন্যদিকে বেসরকারি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে জব সিকিউরিটি কিংবা সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিতে কেনো পরিপূর্ণ আইন নেই।
৯. Industry, Innovation, and Infrastructure- অভিঘাতসহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই শিল্পায়নের প্রবর্ধন এবং উদ্ভাবনার প্রসারণ পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষের পথে। শুরুতে এর ব্যয় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ধরা হলেও সর্বশেষ তা তিনগুণ বেড়ে এর ব্যয় আপাতত দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায়। কাজ শেষ হতে হতে ব্যয় আরো বাড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। রোডঘাটের উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও রাস্তার কার্পেটিং টেকে না। ফলে বাজেট করতে হয় প্রতিনিয়ত। ৫০ বছরেও দেশে গাড়ি তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়নি। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিল্পের ক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশের অভাবে বড় বড় দেশ তাদের বিনিয়োগ নিয়ে বারবার ভাবছে।
১০. Reduced Inequalities- অন্তঃ ও আন্তঃদেশীয় অসমতা কমিয়ে আনা দেশে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ এখনো প্রতিষ্ঠিত সত্য বিষয়। স্বয়ং রাজধানী ঢাকাতে যে পরিমাণ বস্তিবাসী রয়েছে, তা নজিরবিহীন। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা নাগরিকদের রিফিউজি ক্যাম্পে রাষ্ট্র হিসেবে যে সেবা এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা, এখনো তা নিতে পারেনি। স্বাধীনতায় সর্বোচ্চ সহযোগিতাকারী দেশ ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ কোনো সম্পর্ক ৫০ বছরেও তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। নতজানু নীতিতে চলার উদ্যোগ দিন দিন মজবুত হচ্ছে। আঞ্চলিক দেশের সবার সাথে চোখে পড়ার মতো কোনো সম্পর্ক নেই।
১১. Sustainable Cities and Communities- অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, অভিঘাতসহনশীল এবং টেকসই নগর ও জনবসতি গড়ে তোলা বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র এবং রাজধানী শহর ঢাকা। সারা দেশের সকল মানুষের স্বপ্নের শহর ঢাকা। এই ঢাকায় বসবাস কতটা নিরাপদ এবং সার্বিকভাবে সকল সুযোগ সুবিধা রয়েছে, তার হিসাব চিত্র জানতে হলে বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরগুলোর যে নতুন তালিকা প্রকাশ করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (EIU), তাতে চোখ বুলাতে হবে। এখানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান হয়েছে নিচের দিক থেকে চার নম্বর। ২০২১ সালের এই তালিকার ১৪০টি দেশের মধ্যে ঢাকার অবস্থান হয়েছে ১৩৭তম। অন্যান্য শহরগুলোর অবস্থা তাহলে কী হতে পারে বোঝার জন্য নতুন কোনো গবেষণার প্রয়োজন থাকার কথা নয়। শুধু দেশের বৃহত্তর সিটি করপোরেশন গাজীপুরের দিকে তাকানো যেতে পারে। অথচ, সরকার গ্রামকে শহরে রূপান্তরের রূপরেখা বাস্তবায়নের পথে অনেক দূর হাঁটছে বলে বলে বেড়াচ্ছে।
১২. Responsible Consumption and Production- পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন ধরন নিশ্চিত করা দেশে তৈরি পোশাক ছাড়া সকল পণ্য উৎপাদনের দ্বারা চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। যদি অসংখ্য পণ্য রফতানি করে বলা হয় চাহিদার বাইরের অংশের দ্বারা দেশে অর্থযোগ হচ্ছে। যেমন, উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশে চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়, তবুও ভারতে কম টাকায় বিক্রয় করা হয়।
১৩. Climate Action- জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরি কর্মব্যবস্থা গ্রহণ নদীগুলো বছরে বছরে খালে পরিণত হচ্ছে। আঞ্চলিক পানি বণ্টননীতির ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের হামলায় বুয়েট ছাত্রকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হচ্ছে। সুন্দরবন তার বৈচিত্র্য হারাচ্ছে। দেশ ও আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহলের উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও সুন্দরবন উজাড় করার স্বার্থে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত না করেই নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে পাবনার রূপপুরে। এই হলো ক্লাইমেট অ্যাকশনের অবস্থা।
১৪. Life Below Water- টেকসই উন্নয়নের জন্য সাগর, মহাসাগর ও সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার সমুদ্রের উপরিভাগে জাহাজ হাঁকিয়ে দখলদারিত্ব কায়েম করা হয়ে গেছে। তবে গভীর সমুদ্র ভারত এবং মিয়ানমারকে অবাধে ব্যবহার করার সুযোগ আছে। ইষঁব ঊপড়হড়সু আলোচনার টেবিলে। বিপরীতে বহুজাতিক কোম্পানির সাথে সমুদ্রভিত্তিক তেল-গ্যাসের দীর্ঘমেয়াদি উচ্চব্যয় সাপেক্ষ চুক্তি হয়ে গেছে।
১৫. Life On Land- স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষা প্রদান এবং টেকসই ব্যবহারে পৃষ্ঠপোষকতা, টেকসই বন ব্যবস্থাপনা, মরুকরণ প্রক্রিয়ার মোকাবেলা, ভূমির অবক্ষয় রোধ ও ভূমি সৃষ্টি প্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবন এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস প্রতিরোধ দেশের বনভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ বলে সংসদীয় আলোচনায় দাবি করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী। এদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূখণ্ডের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য বলে মনে করেন বিভিন্ন পরিবেশবাদীরা। এসব সংগঠনের দাবি, দেশে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহীসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটা বড় অংশ দিন দিন উষ্ণতা বৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে।
১৬. Peace, Justice, And Strong Institutions- টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থার প্রচলন, সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করা এবং সকল স্তরে কার্যকর, জবাবদিহিতাপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রদানকারী ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো আজ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্টে কাজ করছে যেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব বলছে, ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় বিশ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৪০০২ জন মানুষ। এর মধ্যে ২,১৬৩ জন পুলিশের হাতে এবং ১,২২৪ জন র্যাবের হাতে নিহত হয়। ক্যাঙ্গারু কোর্ট তৈরি করে বিচারের নামে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফাঁসি দেয়া হচ্ছে ইসলামী নেতৃবৃন্দকে। অসংখ্য নেতৃবৃন্দকে আটক করে রাখা হয়েছে, সরকারের সমালোচনা করার অপরাধে। আইসিটি অ্যাক্টের বেড়াজালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এমনকি কারা অভ্যন্তরে বিনা চিকিৎসায় নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। দেশে একটি নির্বাচন কমিশন আছে, যা সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান। দিবালোকের মতো স্পষ্ট মিথ্যা-অন্যায় ঘটনার পরও তারা উঁচুগলায় কথা বলে। বিনাভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদীয় কোরাম গঠন করে এদেশে। স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার জন্য সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী মহলের কণ্ঠ যাতে উঁচু না হয়, তার জন্য সবসময় সমন রেডি করে রাখা হয়। আবার কথা যেন বন্ধ না হয়ে যায়, তার জন্য টাকা দিয়ে বুদ্ধিজীবী পোষা হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় যারা কাজ করছেন, তারা তার প্রমাণ। যা প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় প্রকাশ হতে না পেরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
১৭. Partnerships For the Goals- টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব উজ্জীবিতকরণ ও বাস্তবায়নের উপায়সমূহ শক্তিশালী করা নিজ দেশের জন্য কোনো বিশেষ উদ্যোগ না নিয়ে আমেরিকা বলয়, ভারত বলয়সহ নানান বলয় ভারী করার কাজে দেশে দেশে সফর করা হয় বিশাল বহর নিয়ে। বিশেষ ক্ষমতাধর দেশগুলো যে তাকে ব্যবহার করার স্বার্থে সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে না পারার জন্য অন্তরে তালা দিয়ে টাকার উপর ঘুমানোর পরিকল্পনায় বিদেশি অ্যাকাউন্টে ক্যাশ বাড়াতে এবং দ্বিতীয় হোম তৈরিতে উঠে পড়ে লেগেছে সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনৈতিক উন্নতিই যদি প্রকৃত উন্নয়ন হতো, তাহলে কাতার, আরব আমিরাত বিশ্ব উন্নয়ন সূচকে শীর্ষস্থানে থাকার কথা ছিলো। দেশে সরকারের তরফ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক উন্নয়নের যে দাবি করা হচ্ছে তা মূলত একতরফা, গলাবাজি। গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, ব্যাপক দুর্নীতির শোষণ তোষণ নিপীড়নের অভিযোগ নিয়ে অর্ধশত বছর পার করেছে দেশ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র চর্চা ও সুশাসনের অভাব, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে সমালোচনাও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের তকমা বহন করতে হচ্ছে। যার বড় বিষয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্বপরায়ণতা এবং দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার।
খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচারে সেরা দেশগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-এর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪,৪৪০ কোটি টাকা। উচ্চশিক্ষার বেহাল অবস্থা নিয়ে দেশ উন্নত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মোট বাজেটের মাত্র ১ শতাংশ ব্যয় করছে। গবেষণাপত্র চুরির ঘটনা খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়। বিপরীতে জিপিএ ৫ এর হিড়িক। শিক্ষাবিদরা এসব আগত পরিণতির কথা বলে বলে হয়রান হচ্ছে। সরকার থোড়াই কেয়ার করে উন্নয়নের ঢাক বাজিয়ে চলেছে।
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, গণতন্ত্রহীনতা। বর্তমান সরকার এবং তার খয়েরখাঁ যারা, তারা নিজেদের পাগলা ঘোড়ার যাত্রী বানিয়ে মনে করছে, এই ঘোড়া তাকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাকে পিঠে তুলেছে। যার কারণে দুর্নীতি, অন্যায়কে পথের অবলম্বন করে নিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ এবং বিশেষ করে সচেতন ছাত্রসমাজকে এখনই এই করুণ পরিস্থিতি থেকে দেশকে বাঁচাতে সোচ্চার হতে হবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে জোগদান করতে হবে। তবেই এদেশ একটি অবস্থায় আসবে। যেখান থেকে এদেশের মানুষের মৌল পরিচয়, ইসলামী তাহজিব তমদ্দুন পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে পারবো আমরা। স্বাধীনতার ৫১তম বছরে এই হোক অঙ্গীকার। যেই অঙ্গীকার আমাদেরকে একটি সত্যিকারের উন্নত দেশ পেতে সহায়তা করবে। লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
আপনার মন্তব্য লিখুন