post

স্মৃতির পাতায় অম্লান শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

১৪ এপ্রিল ২০২৪

[প্রথম কিস্তি]

আব্বুকে ইলেকশনের ঝামেলার মধ্যে রেখে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে ছিলাম ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। দশ বছর পরে ২০১০ সালের মার্চ মাসে আবার ফিরে এলাম আব্বুর কাছে আরেক মহা ঝামেলার মাঝে। ২০১৬ সালের মে মাসের ১১ তারিখে বহু বছর আগে দেখা আব্বুর স্বপ্নটা সত্য‍ হলো। আমাকে মহা ঝামেলার এ দুনিয়ায় ফেলে আব্বু আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। মানুষের সাথে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি ভাষায় ব্যক্ত করাটা এমনিতেই কঠিন। আর আমার মতো আনাড়ি লেখকের পক্ষে সেটা একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই বলেছেন আব্বুকে নিয়ে কিছু লিখতে,  বহুবার চেষ্টা করেছি কিছু লিখব, কিন্তু লিখতে বসলে হাত থেমে যায়, চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। আজও যখন লিখছি, তখনো চোখের পানি ঝরছে। তাই হয়তো লেখাটা এলেবেলে টাইপের হতে পারে। সুতরাং পাঠকদের কাছ থেকে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আব্বুর সাথে আমার সম্পর্কটা কী রকম ছিল সেটা কোন দিনও হয়ত আমার পক্ষে সঠিক ভাবে ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব হবে না। তিনি ছিলেন আমার পিতা, নেতা, শিক্ষক এবং আরো অনেক কিছু। আব্বু অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন, আমি সেটা পারি না। কিন্তু আমার আর আব্বুর মাঝে একটা সাদৃশ্য হলো- আমরা দু’জনেই কম কথা বলার মানুষ। আব্বু কথা না বলেও অনেক কিছু বোঝাতে পারতেন, তার চোখের একটা ভাষা ছিল, অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তিনি মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকতেন, সেই দৃষ্টি আমাকে ভরসা দিত, প্রেরণা দিত, আরেকটা দিন লড়াই করার সাহস জোগাতো। ছোটবেলা থেকেই আমি অল্পতে মন ভেঙে যাওয়া, হাল ছেড়ে দেওয়া ছেলে, আব্বুর না বলা চোখের ভাষা, মনের কথা ছোটবেলা থেকে শুরু করে বড়বেলা পর্যন্ত, এমনকি চৌদ্দ শিকের ওপার থেকেও বারে বারে ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি জোগাতো। মনে পড়ে আওয়ামী জুলুমতন্ত্রের বৈরী পরিবেশেও আল্লাহর রহমতে অনেকটা নির্বিঘেœ জজকোর্ট আর হাইকোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে নিবন্ধিত হলাম। আব্বু জেলে বসেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন আর বললেন, ‘প্রতিদিন শেষ রাতে তোদের সব ভাইবোনের জন্য নাম ধরে দোয়া করি’। আমি তো জানতামই আব্বু আমাদের জন্য প্রতি শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামাযের পরে দোয়া করেন, ছোটবেলায় কতদিন শেষ রাতে আব্বুর কুরআন তেলাওয়াতের শব্দে, অনুচ্চ কান্নামিশ্রিত দোয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে। আব্বুর শাহাদাতের সময় তাই তো এই স্বার্থপর আমি আমার কী ক্ষতি হয়ে গেল সেই চিন্তায় ব্যস্ত ছিলাম। অতি চালাকে ভরা এ  দুনিয়ায়, এই বোকাসোকা মোমেনের দিকে কেউ আর সেই মায়াভরা প্রশ্রয়ের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকবে না, রবের কাছে শেষ রাতে উঠে দোয়া করবে না, আমি চলব কিভাবে? এটাই আমার কাছে তখন বড় ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 

ছোটবেলা থেকেই কিছু মানুষের অতি প্রত্যাশা আবার কিছু মানুষের ওকে দিয়ে কিছু হবে না টাইপের আচরণ আমার জন্য বেশ ক্ষতির কারণ হয়েছে। আমার গণিত, নাহু ও সরফের শিক্ষকরা আমার ব্যাপারে উচ্চ ধারণা পোষণ করলেও ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকরা- বিশেষভাবে আরবী ও ইংরেজি শিক্ষকরা আমাকে অপদার্থ মনে করতেন। অতি তোষণ, অতি প্রেষণ, অতি প্রত্যাশা আর অতি নিরাশার জাঁতাকলের মাঝে আমার মনে হতো আব্বুই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালো বুঝতেন। কেউ আমার প্রশংসা করলে যেমন তিনি খুব বেশি খুশি হতেন না, ক্ষেত্রবিশেষে অখুশি হতেন, আবার কেউ আমার সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু বললেও তিনি হতাশ হতেন না। টেবিল চাপড়ে, ঝাড়ি দিয়ে দুনিয়া উল্টে দেয়ার নীতিতে আব্বু বিশ্বাস করতেন না। অপ্রয়োজনীয় নীতিবাক্য দিয়ে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করতেন না। মনের কথা আন্তরিকতা দিয়ে, চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন। আবার প্রয়োজনে অল্প কথায় যা বলার বলতেন। যখন আমি ফাঁকি দিতাম, আব্বু বুঝতেন, কিন্তু সেভাবে বকা না দিয়ে বলতেন, ‘অভ্যাস খারাপ করিস না’। কেউ আমাদের আগ্রহ নিয়ে দেখতে চাইলে বলতেন, ওরা কি প্রদর্শনীর ঘোড়া? ছোটবেলায় আব্বুর বুকটা অনেক চওড়া মনে হতো। বুকের উপর কান লাগিয়ে শুয়ে হার্টবিটের শব্দ শুনতে খুব ভালো লাগত। আব্বুর সুঠাম দেহ, সুন্দর চেহারা, তেল দিয়ে আঁচড়ানো ঘন চুল, দাড়ি, ভরাট কণ্ঠ, মোটা চশমা, সাদা পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, উঁচু টুপি সবকিছুতেই একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল। ক্লাস থ্রিতে পড়া ছোট্ট আমি, আব্বুর মতো হবো বলে যখন মাদরাসায় পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, আব্বু অনেক খুশি হয়েছিলেন, আব্বুর চোখে মুখে খুশির ঝলক আমার চোখে আজও ভাসে, ঘুরে ফিরে কয়েকবার শুধু একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘তুই কি সত্যি সত্যি মাদরাসায় পড়বি?’ কালের বিবর্তনে আমি বড় হতে লাগলাম আর দুনিয়ার কঠিন বাস্তবতা যখন একটু বুঝতে শুরু করলাম, হতাশা, নিরাশা আমাকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। আব্বু বিচলিত হতেন না, দরদ নিয়ে বলতেন, “সবকিছু ছেড়ে ভালো আলেম হওয়ার চেষ্টা করতো!” আবার কখনো আমার দাদার গল্প, তার নিজের জীবনের গল্প বলতেন, দাদা তার একমাত্র ছেলেকে আলেম বানাতে চেয়েছিলেন, দোয়া করতেন, আব্বু যেন রাসূল সা.- এর ছায়া হয়ে বেড়ে ওঠেন, আব্বুর মেধা দেখে লোকেরা আফসোস করত আর বলত আহারে এত ভালো ছাত্রটা মাদরাসায় পড়ে ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেলছে! আব্বুও এই সকল কথায় কিছুটা বিভ্রান্ত হওয়ার উপক্রম হলে দাদা আব্বুর মাদ্রাসায় গিয়ে আব্বুর সামনে তার শিক্ষককে বললেন, আমার ছেলেকে বলে দেবেন, সে আমাকে কামাই করে খাওয়াক সেটা আমি চাই না, সে আমার একমাত্র ছেলে, আমার যা আছে সেটা দিয়ে তার চলে যাবে, আমি চাই সে যেন বড় আলেম হয়, রাসূলের ছায়া হওয়ার চেষ্টা করে। কখনোবা আব্বুর লাইব্রেরির আরবী বইগুলোর দিকে তাকিয়ে কোনো এক বিখ্যাত আলেমের গল্প বলতেন, যার ছেলেরা কেউ আলেম না হওয়ার কারণে শেষ বয়সে তার দুষ্প্রাপ্য আরবী বইগুলো মানুষদের মাঝে বিলি করে দিতে হয়েছিল। আবার কখনোবা বলতেন, তার আরবী বইগুলো সময়ের অভাবে  যত্ন নেয়া হয় না, বেশি পড়া হয় না, এই কারণে তারা আল্লাহর কাছে বদ দোয়া করে কিনা! কখনোবা আরেক বিখ্যাত আলেমের গল্প শোনাতেন, যার ছেলে বাবার মতো হতে চাইত, কিন্তু তিনি বললেন, “বাবা আমিতো আলী রা.-এর মতো হতে চেয়ে হয়েছি এই আমি, তাই তুমি আমার মতো হতে চেয়ে আর কতই বা বড় হতে পারবে?” ছোট বেলায় কোনো একসময় আমার কবিতা লেখার বাতিক উঠল। বিষয়টা আব্বুর তেমন পছন্দ না হলেও তিনি আমাকে সরাসরি কিছু বললেন না। আব্বু আমার ভাইকে বললেন, মোমেন কে বলিস এইগুলোর পেছনে সময় বেশি নষ্ট না করতে, প্রসঙ্গক্রমে আব্বু তখন খালেদকে তার জীবনের কবিতা চর্চার গল্প বলেছিলেন, আব্বুও ইন্টারমিডিয়েটে (আলিমে) পড়ার সময় কবিতা চর্চা করতেন, কোনো কারণে পরীক্ষায় অপেক্ষাকৃত খারাপ রেজাল্ট করায় দোষ পড়ল তার সাহিত্যচর্চার ওপর। আব্বুর বড় চাচা এই নিয়ে আব্বুকে বকা দিলে আব্বু তার লেখা সব কবিতা একটা সুটকেসে ভরে নদীতে ফেলে দেন। আবার কখনো আমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললে আব্বু বিচলিত হতেন ঠিকই। মনে পড়ে ক্লাস টেনে ওঠার পরে আমার সদ্য গজানো হালকা দাড়ি শেভ করায় আব্বু বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। সেভাবে কিছু না বললেও বলেছিলেন, তোর চেহারার উজ্জ্বলভাবটা নষ্ট হয়ে গেল। আবার আমার এই কাজের একটা ব্যাখ্যা নিজে নিজেই দাঁড় করাবার চেষ্টা করতেন, বলতেন, মোমেন হয়তো দাড়ি যাতে ভালো করে উঠে এইজন্য শেভ করেছে। আমি এর পরে আর কোনদিন দাড়ি শেভ করিনি। 

সময় গড়িয়ে আমিও বড় হতে শুরু করলাম, আব্বুর চুল দাড়িগুলোও খুব দ্রুত সাদা হয়ে গেল। প্রাকৃতিক নিয়মে আব্বুর সাথে দূরত্ব তৈরি না হয়ে কিভাবে যেন উনার আরও কাছে চলে এলাম। এই সময় আব্বু একদিন স্বপ্ন দেখলেন যে আমার মরহুম দাদা খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছেন আর আব্বু দুর্বল দাদাকে আমার কাছে রেখে হজ্জ করতে চলে গেছেন। এই স্বপ্নের অর্থ সেই সময় বুঝতে না পারলেও আব্বুর শাহাদাতের সময় ঠিকই বুঝতে পেরেছি। যাই হোক বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেল, বড় ভাই পড়তে চলে গেলেন বিদেশে, যমজ ভাইটিও ক্যাডেট কলেজের জীবন শেষ করে বিদেশে পড়তে চলে গেল, ছোট ভাই বেশ ছোট। আমি আর আমার পিঠা-পিঠি ছোট বোনটি হয়ে গেলাম আব্বু আম্মুর হাতের লাঠি। আব্বু মনের দিক দিয়ে সবসময়ই নরম ছিলেন, এই সময় আরও নরম হয়ে গেলেন। আম্মু চাইতেন এই অলস আমি দেশের বাইরে পড়তে যাই। আব্বু কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আসলে আমার অন্য‍ ভাইয়েরা তাদের নিজেদের উদ্যোগে স্কলারশিপ জোগাড় করে বিদেশে পড়তে গিয়েছিলেন, এ বিষয়ে আব্বু খুব একটা রাজি ছিলেন না, নিমরাজি ছিলেন। তিনি চাইতেন আমরা সবাই যেন তার আশপাশে থাকি। আব্বুর প্রশ্রয়ে ২০০১ সালে কামেল পরীক্ষা দেয়া পর্যন্ত আমি আর কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তা করি নাই। ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়টা কঠিনই ছিল। সাংগঠনিক, পারিবারিক, শারীরিক অসুস্থতা সকল কিছু মিলে আব্বু আর আমাদের পরিবারের জন্য ছিল কঠিন পরীক্ষার সময়। পিঠের ব্যথায় আব্বু শয্যাশায়ী হলেন। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো আম্মুকে উনার হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হলো। আম্মুর চাকরিই ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। বিপদে পরিবারের সবাই কাছাকাছি আসে, আমিও আব্বুর আরো কাছে এলাম। কম কথা বলা আব্বু, উনার জীবনের অনেক কিছু আমার সাথে শেয়ার করলেন। আব্বু প্রায় বছর খানেক শয্যাশায়ী ছিলেন, এ সময় আমরা এক সাথে অনেক বই পড়তাম, আব্বুর নিয়মিত অজিফাগুলো শিখলাম। একটার পর একটা বিপদ আসতেই থাকল। আমার টিবি ধরা পড়ল, আব্বুর চোখের ছানির অপারেশন হলো, সেখানেও সমস্যা দেখা দিলো। বহু চিকিৎসার পরও শেষ পর্যন্ত একচোখে আব্বু আর ভালোভাবে দেখতে পেতেন না। ব্যক্তিগত ভাবে সেই সময়টাকে আমি অনেক কারণে ভুলে যেতে চাইব, কিন্তু সেই সময় আমি আব্বুর জীবনে সবর ও ইস্তিকামাতের যে বাস্তব রূপ কাছে থেকে দেখেছি, তাঁর থেকে দ্বীনের মৌলিক বিষয়ের হাতে কলমে যে শিক্ষা লাভ করেছি, সেটা আর অন্য কোনোভাবে সম্ভব হতো কিনা জানি না। 

২০০০ সালে আব্বু জামায়তের আমীর নির্বাচিত হলেন, আর ২০০১ সালে চারদলীয় জোট বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসল। আব্বু আর মুজাহিদ চাচা গুরুত্বপূর্ণ ২টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন। অনেকের কাছে সেই সময়টা বাংলাদেশে জামায়াতের জন্য সোনালি যুগ বলে মনে হতো। কিন্তু আব্বু বলতেন বিপদ আসছে। আব্বুকে উনার নেতাকর্মীরা সেই সময়ের পরিস্থিতির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলতেন, ‘আমি যেন পুলসিরাত পাড়ি দিচ্ছি’। এই সময়ের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকে এর পটভূমি তথা বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের সামগ্রিক ইতিহাসকে বুঝতে হবে। এর বিস্তারিত আলোচনা অন্য কোনো সময় হয়ত করা যাবে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে পটভূমিটা এরকম ছিল, কমিউনিস্ট রাশিয়া যখন মুসলিম বিশ্বে আদর্শিকভাবে বিস্তার লাভ করছিল, ইরাক, মিসর সিরিয়াসহ অনেক দেশে বামপন্থীরা একে একে ক্ষমতা দখল করে ফেলেছিল, পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা তখন একান্ত বাধ্য হয়েই বামপন্থীদের ঠেকাতে ইসলামপন্থীদের সাথে ঐক্য গড়ে তোলে। সৌদি আরব ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্র সমূহের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সারাবিশ্বে ইসলামপন্থীরা একটা অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী সভ্যতার একমাত্র আদর্শিক শত্রু হয়ে দাঁড়ায় ইসলাম তথা ইসলামপন্থীরা। ৯০-এর দশকে এই আদর্শিক লড়াইয়ের অংশ হিসাবে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ২টি ভাবধারার উদ্ভব ঘটানো হয়। একটি হলো জঙ্গিবাদ অন্যটি মডারেট ইসলাম। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী মুভমেন্টকে লক্ষ্যচ্যুত করা, ধ্বংস করা। ’৯০-এর দশকের পূর্বে যারা আফগানিস্তান বা অন্যান্য দেশে জিহাদে লিপ্ত ছিলেন, তাদের সাথে মুসলিম দেশ সমূহের ইসলামী মুভমেন্টসহ অধিকাংশ মুসলিম সরকারগুলোর একধরনের বোঝাপড়া ছিল। মুসলিম দেশ সমূহে এই মুজাহিদ লিডাররা রাষ্ট্রীয় সম্মান লাভ করতেন। ৮০-এর দশকের শেষ দিকে আফগান মুজাহিদ নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের বাংলাদেশ সফরের কথা মনে আছে, তাকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছিলেন। তখন এটাও একধরনের বুঝাপড়া ছিল যে, মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রসমূহে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ সেই দেশের রাজনৈতিক নিয়ম মেনেই চলবে। যার কারণে আমরা দেখি ৯০-এর দশকের আগে মুসলিমপ্রধান দেশসমূহে, শুধু মিসর ছাড়া, কোথাও জঙ্গিবাদের তেমন অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে ৯০-এর দশকে মুসলিমপ্রধান দেশ সমূহে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে এবং দেশী বিদেশী মিডিয়াসমূহে এদেরকে বিশাল কাভারেজ দেয়া শুরু হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশে এই জঙ্গিবাদের ফাঁদে মূলধারার ইসলামী আন্দোলনকে ফেলা সম্ভব হয়নি। এর প্রধান শিকার হয় মূলত কওমী মাদরাসার কিছু সরল সোজা ছাত্র শিক্ষকবৃন্দ। আমি সেই সময়কার মাদরাসার ছাত্র হিসেবে দেখেছি, কিভাবে আফগান ফেরত মুজাহিদদের বেশ ধরে, মাদরাসায় বিশাল অংকের ডোনেশনের লোভ দেখিয়ে কিছু ভিনদেশী গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা মাদরাসার ছাত্রদেরকে বিভ্রান্ত করত, জঙ্গি ট্রেনিংয়ে উদ্বুদ্ধ করত। আল্লাহর রহমতে জামায়াত ও শিবিরের নেতৃবৃন্দ এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক থাকায় জামায়াত শিবিরের কোনো জনশক্তি এই ষড়যন্ত্রে পা দেয়নি। 

ইসলামী আন্দোলনকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর আরেকটি উদ্যোগ ছিল মডারেট ইসলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইসলামী মুভমেন্টের একটা অংশ এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়। তাত্ত্বিকভাবে এই মডারেট ইসলামের উদ্দেশ্য ছিল প্রথমে ইসলামের সুপ্রতিষ্ঠিত কিছু নীতি নৈতিকতার ব্যাপারে প্রশ্নের অবতারণা করা, বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা। এক্ষেত্রে নারীর অধিকার, নারীর ক্ষমতায়নের পশ্চিমা সস্তা স্লোগানগুলোকে ব্যবহার করা হয়। ২য় পর্যায়ে, ইসলামের সর্বজনীন আদর্শগুলোকে পশ্চিমা মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ইত্যাদি আদর্শের সমার্থক হিসাবে প্রচার করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে এসে বলা হতে থাকে যে, ইসলামের আদর্শগুলোকে ইসলামের নাম না নিয়েও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম স্কলারদের পাশ্চাত্য বিশ্বে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো, বিভিন্ন সেমিনার সিম্পজিয়ামের আয়োজন করা হতো। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব প্রাথমিকভাবে এই ফাঁদে পা দেন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০১ সালে নাইন ইলেভেনের পরিপ্রেক্ষিতে এই চক্রান্তের স্বরূপ যখন তিনি বুঝতে পেরে পাশ্চাত্যশক্তির ইসলামী আন্দোলন-বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন, তখন তিনি পশ্চিমা বিশ্বের চক্ষুশূলে পরিণত হন, মডারেট ইসলামের অন্যতম পুরোধা হওয়ার পরেও এখন তার পশ্চিমা বিশ্বে প্রবেশ নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের জামায়াত ঘরনার ২ জন বুদ্ধিজীবীকে আমেরিকায় ’৯০ এর দশকের শুরুর দিকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যাদের একজনের হাত ধরে বাংলাদেশে মডারেট ইসলামের বিস্তার লাভ করে। অপরজন আমেরিকার নেতৃত্বে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার সৃষ্টির প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্রের ব্য‍াপারে বিস্তারিত জানতে পেরে উদ্বিগ্ন হন, এ ব্যাপারে সংগঠনকে সতর্ক করেন। আব্বু এ ব্য‍াপারে প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলেন, উনার কলিগদের অনেকে এ ব্যাপারে আব্বুকে নমনীয় হওয়ার পরামর্শ দিলেও আব্বু ইসলামের মৌলিক বিষয়ে ছাড় না দেয়ার ব্যাপারে সবসময় আপসহীন ছিলেন। এক্ষেত্রে সংগঠনের মহিলা বিভাগের নেত্রী হিসাবে আম্মুর ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্র হিসাবে আমিও অল্পবিস্তর আব্বু আম্মুর এই সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নিতাম। আম্মু দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে অটল থাকার ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কারণে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। আব্বুর অনমনীয় মনোভাবের কারণে গোলাম আযম চাচার উপর একটি গোষ্ঠীর প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও সংগঠনের ভিতরে মডারেট ইসলামের কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য‍ যে, একটি দেশের দূতাবাস ও এনজিওর সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে কিছু লোককে তারা ঠিকই বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়, যার পরিণতিতে আজকে একটি নতুন দলের উদ্ভব হয়েছে যাদের নেতাকর্মীরা একসময় ইসলামের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত থাকলেও  এখন দলের কাগজপত্রে ইসলামের নাম নিশানা পর্যন্ত রাখতে লজ্জা পান। 

নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই মডারেট ইসলাম প্রজেক্টে নতুনমাত্রা যোগ হয়। ইসলামের কিছু মৌলিক পরিভাষা, জিহাদ, শরয়ী আইন- এগুলোকে জঙ্গিবাদের সমার্থক করে ফেলা হয়। প্রেসিডেন্ট বুশ প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, হয় তুমি আমাদের সাথে থাকবে, নতুবা শত্রু হিসাবে পরিগণিত হবে। এ সময় ইসলামী দলগুলোকে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে ক্লিয়ার মে‍সেজ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে জামায়াত ইসলামী ক্ষমতার অংশীদার হওয়ায় তাদের ব্যাপারে আলাদাভাবে নজর দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের ওপর আফগানিস্তান ও ইরাকের অন্যায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু জামায়াত ও বেগম জিয়ার দৃঢ়তার কারণে এই চাপ উপেক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। আব্বু সংসদে পরিষ্কার ভাষায় আমেরিকার চাপিয়ে দেয়া এই ওয়ার অন টেররকে অন্যায় যুদ্ধ বলে সমালোচনা করেন। মডারেট ইসলামপন্থীরা এসময় যেকোনো মূল্যে পশ্চিমা বিশ্বকে আস্থায় রাখার লক্ষ্যে ইসলামী দলগুলোকে ব্যাপক আদর্শিক সংস্কারের ব্যাপারে চাপ দিতে থাকে। এসময় পশ্চিমা স্টেকহোল্ডাররা আব্বুকে বিভিন্ন মিটিংয়ে প্রায়ই প্রশ্ন করত, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে শরীয়তের আইন কায়েম করবে কিনা। এক পর্যায়ে আব্বুসহ বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে লন্ডনে দাওয়াত দিয়ে এনে মডারেট ইসলামের সবক দেয়ার চেষ্টা করা হয়। আব্বুর অবস্থান এক্ষেত্রে পরিষ্কার ছিল, তিনি বলতেন, আমরা ইসলামী রাজনীতি করি আল্লাহর আইন কায়েম করার জন্যই। কারও যদি এই বিষয়ে ভুল বুঝাবুঝি থেকে থাকে আমরা সেটা দূর করার জন্য‍ সংলাপে প্রস্তুত, কিন্তু কারো ডিকটেশনে আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত নই। আব্বু এক্ষেত্রে একটা জিনিস বিশ্বাস করতেন এবং আমাদেরকে বলতেনও, তাগুতি শক্তিকে যতই ছাড় দেয়া হোক তাদের পরিপূর্ণ অনুসরণ না করা পর্যন্ত তারা কখনোই সন্তুষ্ট হবে না (সূরা বাকারা : ১২০)। সুতরাং আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে তাদেরকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টার কোনো মানে নেই। 

আসলে হয়েছেও তাই, বিশ্বব্য‍াপী ইসলামী আন্দোলনের কিছু অংশ পশ্চিমা শক্তিকে আস্থায় নেয়ার জন্য মডারেট ইসলামের প্রজেক্টকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করতে পারে নাই। আজকে তাদের ভাগ্যও জামায়াতের থেকে ভিন্নতর নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে আরও খারাপ। সুতরাং ইসলামই হলো সমস্যা, যতক্ষণ পর্যন্ত এর নাম নিশানা আমাদের মধ্যে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাগুতি শক্তির কাছে আমরা শত্রু হিসাবেই পরিগণিত হব। আব্বু এই বিষয়টিই তাঁর শেষকটি বছর বিভিন্ন লিখনি, বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন, যে আমরা জঙ্গিও না আমরা মডারেটও না। আমরা মধ্যপন্থী ইসলামী দল, আমরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এই পথে চলতে গিয়ে কিছু লোক টিকতে না পেরে ডানে বামে ছিটকে পড়বে, কিছু লোক শাহাদাত বরণ করবে, কিন্তু যারা শত বাধা বিপত্তির মুখে আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর ও ইস্তিকামাতের সাথে টিকে থাকতে পারবে আল্লাহ তাদের হাতেই বিজয় পতাকা দান করবেন ইনশাআল্লাহ। 

আমার দেখা আব্বুর জীবনীটাকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। জ্ঞান হওয়া থেকে ৯৩-৯৪ সাল পর্যন্ত আব্বু ছিলেন আমার কাছে ড্যাশিং হিরো। আব্বুর চেহারা, দৈহিক গড়ন, মাপা কিন্তু আকর্ষণীয়, জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়ার যোগ্যতা, সংগঠনে উল্কার মতো উত্থান, নির্বাচনী এলাকায় উনার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, সংসদের ভূমিকা, মাত্র ৩-৪ ঘণ্টা ঘুমিয়ে সারাদিন কাজ আর অনেক সময় নিয়ে ইবাদত করার অবিশ্বাস্য‍ ক্ষমতা সবকিছু মিলে সন্তান হিসেবে আমার মতো ১২-১৩ বছরের কিশোরের কাছে তিনি ছিলেন একজন পার্ফেক্ট হিরো। এর পরে এল গ্রহণের কাল, আব্বু শারীরিক ভাবে অসুস্থ হতে শুরু করলেন, পারিবারিক ভাবে আমরা কিছু বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া শুরু করলাম, আন্দোলন, সংগঠনে আব্বুর সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ পলিসি মেকারদের কিছু বিষয়ে ভালোই মতপার্থক্য দেখা দিল, পরিশেষে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আব্বুও হেরে গেলেন, সংগঠনও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেল। ১৬-১৭ বছর বয়সী আমি হঠাৎ করেই বুঝতে শুরু করলাম আব্বুতো একজন মানুষও বটে। ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিল আব্বুর জীবনের আরেকটি পর্ব, যখন তিনি ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, শয্যাশায়ী অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সংগঠনের আমীর নির্বাচিত হলেন, এমপি, মন্ত্রী হলেন। যার একটা অংশে ২০০১ সাল পর্যন্ত আব্বুর পাশে থেকে দেখেছি শিখেছি, মানুষকে নিজের দুর্বলতাকে, সীমাবদ্ধতাকে জেনে বুঝে, সেটা অনুযায়ী পরিকল্পনা করে কিভাবে ভবিষ্যতের পথ  তৈরি করে নিতে হয়, বিপদে কিভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর করতে হয়, হকের উপর অবিচল থেকে বাতিলের মুকাবেলা করতে হয়। আব্বুর জীবনের শেষ অধ্যায়টি ছিল ২০০৫-৬ সালের দিকে  অসুস্থতা, ২টি অপারেশন থেকে নিয়ে শাহাদাত পর্যন্ত, এ সময়ের একটা  অংশে ২০১০ থেকে নিয়ে শাহাদাত পর্যন্ত আব্বুর অন্ধের যষ্ঠী আমি। 

এ চারটি উত্থান পতনের অধ্যায়ে আমি আব্বুর ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আমলি জিন্দেগিতে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাইনি। যেকোনো পরিস্থিতিতে হকের উপর টিকে থাকা, সবর করা, দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো ঠিক করার দিকে মনোযোগ দেয়া, সর্বোপরি আল্লাহর কাছে ধর্না দেয়াটা ছিল আব্বুর জীবনের চালিকাশক্তি। এর কোনো পরিবর্তন আব্বুর জীবনে আমার চোখে পড়েনি। আব্বু মন্ত্রী থাকা অবস্থায়ও যেমন কখনো তাহাজ্জুদ নামায কাজা করতেন না আবার জেলে যাওয়ার পরেও কাজা করতেন না। শত ব্যস্ততা, অস্থিরতার মাঝেও আব্বুর নামাযে দাঁড়ালে উনার দুনিয়া থমকে দাঁড়াতো। নামাযে কখনো আব্বু তাড়াহুড়ো করতেন না। আব্বু পিঠে ব্যথার কারণে যে কয় বছর শয্যাশায়ী ছিলেন, সেসময় অন্য কোন কিছুর চাইতে শুয়ে বসে নামায পড়ার বিষয়টা তাঁকে বেশি কষ্ট দিত। কিছুটা সুস্থ হতেই আব্বু কষ্ট করে হলেও দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন, পরিপূর্ণ সেজদা দিতেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে বসা থেকে উঠতে গেলে মাথা ঘুরত কিন্তু কখন আব্বুকে বসে নামায পড়তে দেখিনি। নামাযের প্রতি আব্বুর আন্তরিকতা ছিল এমনই। আজও কানে বাজে নামাযে তেলাওয়াত করা আব্বুর ফেভারেট আয়াতগুলো। একাগ্রচিত্তে তিনি প্রায়ই নামাযে পড়তেন, “ইয়া আয়্যাতুহান নাফসুল মুতমাইন্নাহ, ইরজি’ই ইলা রাব্বিকি রাদিয়াতাম মারদিয়্যাহ, হে প্রশান্ত আত্মা, ফিরে চল সন্তুষ্ট চিত্তে তোমার রবের দিকে।” আব্বুর কাছে শুনতে শুনতে এরকম কত আয়াত আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। একটু সময় পেলে আব্বু সূরা আনআমের শেষ কটি আয়াত তেলাওয়াত করতেন, “কুল ইন্নানি হাদানি রাব্বি ইলা সিরাতিম মুসতাকিম.. বলো, আমার রব নিশ্চিতভাবেই আমাকে সোজা পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। একদম সঠিক নির্ভুল দ্বীন, যার মধ্যে কোনো বক্রতা নেই,” এর পরবর্তী আয়াতের ঈমানের ঘোষণাটি আব্বু যখন বলিষ্ঠ ভরাট কণ্ঠে তেলাওয়াত করতেন, ‘‘কুল ইন্না সালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহয়ায়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন.. বল আমার নামায, আমার কোরবানী, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য, যার কোনো শরীক নেই। এরি নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছে এবং সবার আগে আমিই আনুগত্যের শির নতকারী” আমার ক্লাস এইটের আরবী জ্ঞান দিয়েও এর মর্মার্থ বুঝতে পারতাম। উপলব্ধি করতে পারতাম অন্তরের কত গভীর থেকে দৃঢ়তার সাথে এই ঘোষণাটি আব্বু করছেন। কোরআন শরীফের দোয়া সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো, বিশেষভাবে সূরা আলে ইমরানের শেষের দিকের দুআওগুলোও আব্বুর খুব প্রিয় ছিল, এই আয়াতগুলো পড়ার সময় আব্বু মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতেন, বিশেষ করে যখন তেলাওয়াত করতেন, ‘‘রব্বানা ওয়া আতিনা মা ওয়াদতানা আলা রুসুলিক...” হে আমাদের রব! রাসূলদের মাধ্যমে তুমি যেসব ওয়াদা করেছো আমাদের সাথে, সেগুলো পূর্ণ করো এবং কিয়ামতের দিন আমাদের লাঞ্ছনার গর্তে ফেলে দিয়ো না। নিঃসন্দেহে তুমি ওয়াদা খিলাপকারী নও।” ইব্রাহীম (আ.)-এর দোয়াগুলো আব্বুর বিশেষ ভাবে প্রিয় ছিল, এ সংক্রান্ত সূরা আনআমের ৭৪ থেকে ৭৯ নং আয়াতগুলো, সূরা ইব্রাহীমের শেষের দিকের আয়াতগুলো আব্বু নামাযের মাঝে অনেক সময় তেলাওয়াত করতেন। নামাযের পর আব্বু লম্বা দোয়া করতেন। মাসনুন দোয়া মুখস্থ করাটা আব্বুর একটা অবসেশন ছিল। আব্বু যখন ১৯৯৬-৯৭ দিকে শয্যাশায়ী, আব্বুকে কোনো হাদীসের নতুন দোয়া বের করে দিতে পারলে আব্বু খুব খুশি হতেন। আমরা প্রতিযোগিতা করে তখন দোয়া মুখস্থ করতাম। সেই সময়ই সম্ভবত হিসনুল মুসলিম নামক মাসনুন দোয়ার বইটি বাজারে আসে। আমি বইটি আব্বুকে দিলে আমার আগেই আব্বুর এর অধিকাংশ দোয়া মুখস্থ করে ফেলেন। দোয়া মুখস্থের ব্যাপারে আব্বুকে পেছনে ফেলা আমার পক্ষে কখনই সম্ভব হয়নি। বিপদের দিনগুলোতে আব্বু মাঝে মাঝে আমাকে কুনুতে নাযেলা পড়ার জন্য ইমামতি করতে বলতেন, সেই সময়গুলোতে দোয়া কতটুকু মুখস্থ করতে পেরেছি তার একটা পরীক্ষা হয়ে যেত। আব্বু আমার ভুলগুলো নামাযের পরে সবার অগোচরে সুন্দর করে ধরিয়ে দিতেন, মাঝে মাঝে অনুযোগ করতেন দোয়াগুলো ভালোভাবে কেন মুখস্থ করি না। জীবনের শেষের দিকে জেলখানায় দেখা করতে গেলে আমাকে মাঝে মধ্যে দোয়া পড়ে মাথায় ফুঁ দিয়ে দিতে বলতেন, আবার কখনো কিছু দোয়া লিখে দিয়ে বলতেন, তুইও পড়বি আর সবাইকে পড়তে বলবি। 

রমযান মাসের শেষ দশদিন ছিল আব্বুর কাছে বিশেষ কিছু। দুনিয়ার সব ঝামেলা পিছনে ফেলে আব্বু এই সময়ে এতেকাফে বসে যেতেন, অধিকাংশ সময়ে মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসের কাছের মসজিদটিতে বসতেন। আব্বুর এতেকাফের সাথী হতেন মরহুম মকবুল আহমদ চাচা, ডা. আব্দুস সালাম চাচা, মাজহার চাচা, ফজলু চাচার আব্বা, মুজিবুর রহমান চাচা ও আরো অনেকেই। এসময়ে আব্বুর জন্য ইফতার নিয়ে যাওয়া, আব্বুর সাথে ইফতার করা আমাদের জন্য ছিল বিশেষ কিছু। একটু বড় হলে দু-একটি রাত আব্বুর সাথে মসজিদে কাটাবার চেষ্টা করতাম। আব্বু তাফসীর করতেন আমরা শুনতাম। সৌদী আরবে পড়তে যাওয়ার আগের বছর শেষবার আব্বুর সাথে এক রমযানে রাত কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। আব্বু সূরা লোকমানের কয়েকটি আয়াতের তাফসীর করেছিলেন আমাদের জন্য। যা ছিল হযরত লোকমানের তার সন্তানের প্রতি নসীহত। মনে আছে আমরা তাওহীদ ও শিরক বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছিলাম। আব্বু বললেন তাওহীদের বিষয়গুলো বুঝতে হলে মক্কী সূরাগুলা ভালোভাবে পড়তে হবে। ওই রাতে আমি নাস ফালাকের তাফসীর তাফহীমুল কোরআন থেকে পড়েছিলাম, আব্বু রাব্বিন্নাস, মালিকিন্নাস ও ইলাহিন্নাসের ব্যাপারে বেশ অনেকক্ষণ আলোচনা করলেন। আল্লাহর বিশালত্ব তার সৃষ্টির মাধ্যমে অনুধাবন করার গুরুত্ব বুঝাতে আমপারার আরও কতগুলো সূরা পড়তে বললেন। সেই রাতটি আসলেই অনেক অর্থবহ আর শিক্ষণীয় ছিল আমারা জীবনে। আব্বু কখনোই সারারাত জেগে ইবাদত করতেন না, রাসূল (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী কিছু সময় ঘুমিয়ে আবার উঠে ইবাদত করতেন। আমি ঘুমালে আর উঠতে পারতাম না। আব্বু এটা পছন্দ করতেন না, তিনি বলতেন, তাহাজ্জুদের ট্রেনিংটাই হলো ঘুম থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উঠতে পারার ট্রেনিং। 

মানুষের জীবনের উত্থান পতনে মানুষের চিন্তা চেতনায় আচার আচরণে আকাশ পাতাল পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু বড় মানুষের, প্রকৃত ঈমানদারদের পরিচয় পাওয়া যায় বিপদকালে তার চরিত্রে। প্রকৃত আদর্শবাদী মানুষ বিপদে পড়ে আদর্শের ব্যাপারে হীনম্মন্যতায় ভোগে না। কিন্তু যাদের অন্তরে আদর্শ ঠিকভাবে শিকড় গড়তে পারেনি, খারাপ সময়ে তারাই চিন্তায় পড়ে যায়, আদর্শের ব্যাপারে সংশয় আচ্ছন্ন হয়। আব্বু প্রায়ই বলতেন, যারা আন্দোলন থেকে ছিটকে যায় দেখবি কোরআনের সাথে তাদের সম্পর্কের ঘাটতি আছে। আব্বুদের জেনারেশনে যারা সংগঠনে যুক্ত হয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশই দ্বীন খুঁজতে গিয়ে, দ্বীনের পথে চলতে গিয়েই সংগঠনকে পেয়েছিলেন, যার কারণে সংগঠনকে উনারা দ্বীনের চশমা দিয়ে দেখতেন। তৎপরবর্তী আমরা যারা জামাতী জেনারেশন, আমাদের অনেকেই বিভিন্ন কারণে দ্বীনকে যেন সংগঠনের চশমায় দেখতে চেষ্টা করি, রাজনীতির মাপকাঠিতে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পাই। আব্বুর কাছে বিষয়টা কুরআনের সাথে যথাযথ সম্পর্কর ঘাটতির পরিণতি মনে হতো। (চলবে...)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির