post

হতাশা ঝেড়ে ফেলুন সম্ভাবনাকে সম্পদ মনে করুন

মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত

০১ জুন ২০১৭
সফলতার চূড়ায় উঠতে গেলে মাঝে মধ্যে হোঁচট খেতে পারেন, ব্যর্থতার পাল্লায় পড়তে পারেন। কিন্তু তাই বলে কাজের শুরুতেই ব্যর্থতার আশঙ্কা করা মোটেই কাম্য নয়। কারণ ব্যর্থতার আশঙ্কা সফলতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। যারা এ ধরনের মানসিকতা পোষণ করেন তারা শুরুতেই হেরে বসেন। শিশুরা যখন হাঁটতে চেষ্টা করে তখন মাঝে মধ্যেই পড়ে যায়, কখনো পড়ে গিয়ে আহতও হয়। কিন্তু সেই পড়ে যাওয়ার অর্থ হোঁচট খাওয়া নয়। সেই পড়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, তারা হাঁটতে শিখবে না, কিন্তু যদি শিশু এবং তার পিতা-মাতা এ ব্যাপারে হতাশ হয়ে হাঁটার প্রচেষ্টাই বন্ধ করে দিত তাহলে তারা কোন দিনই হাঁটতে পারতো না। সফলতার পানে ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেলে আবার দাঁড়াতে হবে আবার ছুটতে হবে লক্ষ্য পানে। একদিন ঠিকই এমনি করে পৌঁছা যাবে সাফল্যের শিখরে। কোন একটি বিষয়ে ব্যর্থ হলে আমাদের মাঝে কিছু ব্যক্তি নিজেকে সব বিষয়েই ব্যর্থ মনে করে হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু সত্যিকারার্থে তারা এটা বুঝতে ব্যর্থ হন যে কোন একটি বিষয়ের ব্যর্থতাই পূর্ণ ব্যর্থতা নয়। একটি বিষয়ের ব্যর্থতা অন্য বিষয়ের সফলতার পাথেয় হতে পারে যদি হতাশ না হয়ে  ভুলগুলো শুধরে নেয়ার উদ্দেশ্যে শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। নিজের মধ্যে কখনো যদি কোন দুর্বলতা দেখা দেয় তা বলে বেড়ানোতে বা অন্যের নিকট প্রকাশ করাতে কোনো কল্যাণ নেই। অবস্থা শোচনীয়- এ কথা কাউকে বলার প্রয়োজন নেই। তাতে কোনো লাভও হবে না বরং হতাশা ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে চলেন দেখবেন শোচনীয় অবস্থা কেটে সাফল্যের দুয়ার খুলে গেছে। কেউ হয়তো আপনাকে ছোট বলবে, দুর্বল ভাববে, আপনাকে দেখলে ব্যর্থতার হিসাব কষবে। তাতে কি যায় আসে বরং আপনি এগুলোকে একেবারেই নিজের মধ্যে না নিয়ে দূরে ঠেলে রেখে কাজ করুন, দেখবেন আপনি সফল হবেন। কেউ আপনাকে তুচ্ছজ্ঞান করুক। আপনি যদি কাজে মগ্ন থেকে এটিকে নিয়ে চিন্তাও না করেন তাহলে দেখবেন আপনিই সফল। হতাশাকে যে লালন করে, অনবরত হা-হুতাশ হায় হায় করে সে মূলত তার দুঃখ কষ্টকেই বর্ধিত করে, ব্যক্তিজীবনে যতই দুঃখ কষ্ট থাকুক না কেন তা যদি আনন্দের সাথে বরণ করে নেয়া যায় তাতেই মূল সার্থকতা। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস তার দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে শক্তিশালী ব্রিটেনের বিরুদ্ধে পাঁচবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে প্রতিবারই পরাজিত হন। অতঃপর লজ্জায়, অপমানে এক গুহায় আত্মগোপনে চলে যান। সেখানে তিনি দেখতে পান একটি মাকড়সা জাল বুনতে গিয়ে পাঁচবার ব্যর্থ হয়ে ষষ্ঠবারে সফল হয়। তিনি চিন্তা করলেন খুদে মাকড়সা যদি সফল হতে পারে তাহলে তিনি কেন পারবেন না। ফিরে এলেন গুহা থেকে, আবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন রবার্ট ব্রুস। ৫২ বছর বয়সে আবরাহাম লিংকন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু তিনি পূর্বে কতবার ব্যর্থ হয়েছেন তার হিসাব কেউ করে না। ২১ বছর বয়সে আবরাহাম ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হন। ২২ বছর বয়সে আইনসভার নির্বাচনে পরাস্ত হন। পুনরায় ব্যবসায় যোগ দিয়ে ২৪ বছর বয়সে আবারো ক্ষতিগ্রস্ত হন। ২৬ বছর বয়সে প্রিয়তমা স্ত্রী মারা যান। ৩৪ বছর বয়সে কংগ্রেসের নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাস্ত হন। ৪৫ বছর বয়সে সাধারণ নির্বাচনে তার ভরাডুবি হয়। ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ৪৭ বছর বয়সে। সিনেটর নির্বাচনে আবার হারলেন ৪৯ বছর বয়সে। তার ৫০ বছর পর্যন্ত শুধু ব্যর্থতা আর পরাজয়ের মধ্য দিয়েই কাটে। তিনি তবুও হতাশ হননি। ৫২ বছর বয়সে ঠিকই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন। অনেকেই আছেন চারদিকে শুধু অন্ধকার দেখতে পান। আলোর রেখা মনে হয় যেন তাদের থেকে যোজন যোজন দূরেই অবস্থান করে। বাতির চারপাশের অন্ধকারকে তারা গোটা জগতেরই অন্ধকার মনে করে। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত অন্ধকারের বিপরীতে আলোও আছে। সূর্যের হিসেবেইতো দেখা যায় পৃথিবীর এক প্রান্ত যখন অন্ধকারে অপর প্রান্ত তখন আলোয় উদ্ভাসিত। এটাইতো বিধির নিয়ম। রাত না এলে কখনো কি প্রভাত আসতো? রাত যত গভীর হয় প্রভাত ততই কাছে আসে। রাত গভীর থেকে গভীরতম হওয়া মানে সব শেষ নয়। অন্ধকার নিকষ কালো হওয়া মানেই আঁধারের অতল গহবরে তলিয়ে যাওয়া নয়। বরং রাত পোহালেই ভোর হবে, আলোয় আলোয় ভরে উঠবে জগৎ। আঁধার কেটে গিয়ে দীপ্তিময় সূর্য জ্বলজ্বল করবে সেই মুহূর্ত বা সেই সময়টুকুর কথা ভেবেই পদক্ষেপ নেয়া উচিত নয় কি? একটি অন্ধকার রজনীই কারো জীবনের শেষ রজনী নয় বরং একটিমাত্র প্রভাতই কারো কারো জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। সাফল্যবঞ্চিত, হতাশাগ্রস্ত কিংবা গভীর রাতে বিপদগ্রস্ত একজন ব্যক্তির জন্য একটি সকাল বা একটি সুবহে সাদিকই বিশাল সম্ভাবনার দ্বার। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা সেই সম্ভাবনাকে হিসেবের মধ্যেই আনতে চান না। হাজারো আঁধার রাতের বিপরীতে একটি সকালই পাল্টে দিতে পারে পরিস্থিতি। পাল্টে দিতে পারে জীবনের গতিধারাকে। অমানিশার ঘোর অন্ধকারে সম্ভাবনাময়ী একটি সকালের প্রতীক্ষাই ব্যক্তির জীবন পাল্টে দিতে যথেষ্ট, যদি সেটিকে সম্পদ বিবেচনা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। মানুষ কাগজে-কলমে কত হিসাবই না করে। কিছু কিছু হিসাব কাগজে-কলমে থেকে যায়। কখনো কখনো আলোর মুখই দেখে না। সব হিসাবই যদি সঠিক হতো তাহলে দুনিয়াতে এত উত্থান-পতন হতো না। যত হিসাব-নিকাশই করা হোক না কেন সাফল্য-ব্যর্থতা, জয়-পরাজয় সব কিছু নির্ধারণের মালিক যিনি, তিনি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান তিনি মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। তিনিই পারেন মাত্র একভাগ সম্ভাবনাকে শতভাগে রূপান্তরিত করতে, নিরানব্বই ভাগ হতাশাকে দূরীভূত করে শতভাগ সাফল্য নিশ্চিত করতে। আবার শতভাগ সম্ভাবনাকে তিনি মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে দিতে পারেন। পৃথিবীতে এরকম বহু উদাহরণ আছে যারা একভাগ সম্ভাবনাকে সম্পদ মনে করে কাজ করেছেন আল্লাহ তাদের প্রচেষ্টাকে শতভাগ সাফল্যে রূপান্তরিত করেছেন। সকাল বেলায় যিনি বাদশাহ তিনি সন্ধ্যা বেলায় ফকির হয়েছেন। আর সকাল বেলার ফকির সন্ধ্যায় বাদশায় পরিণত হয়েছেন। ফকিরের বাদশাহির সম্ভাবনা না থাকলেও তিনি সন্ধ্যায় বাদশাহি পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন, “বলুন, হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। তুমি রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে পরিবর্তন কর আর তুমিই মৃত হতে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটাও। তুমি যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপকরণ দান কর।” (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ২৬-২৭) হতাশার বিপরীত হলো সম্ভাবনা। সম্ভাবনা মানুষের জীবনের এক বিশাল সম্পদ। যারা সম্ভাবনাকে সম্পদ মনে করে পরিকল্পিতভাবে কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন পৃথিবীতে তারাই সাফল্যের বিজয়মুকুট অর্জন করেছেন। অনেকেই আছেন সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে চান না। হোক সেটা ছোট কিংবা বড় ধরনের সম্ভাবনা, হোক সেটা এক ভাগ কিংবা শতভাগ। আবার কেউ আছেন ছোটখাটো সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দেন, শুধুমাত্র তারা নিরানব্বই ভাগ সম্ভাবনাকেই গুরুত্ব দিতে চান, বাকি ছোটখাটো সম্ভাবনাকে তারা এক প্রকার ছুড়েই ফেলে দেন। এ ধরনের লোকজন সাধারণত সফলতা অর্জন করতে ব্যর্থ হন। মনে রাখতে হবে অনেক সময় ছোটখাটো সম্ভাবনাই অনেক বড় সাফল্যের দ্বার উন্মোচিত করে, অনেক বড় অর্জনের ভিত্তি রচনা করে। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় শুধু রাসূল (সা) ছাড়া আর কেউ হুদাইবিয়ার সন্ধিকে সাফল্যের ন্যূনতম সম্ভাবনা হিসেবেও বিবেচনা করেননি। ১৪০০ জন সাহাবী নিয়ে হজ করতে গিয়ে শুধুমাত্র সন্ধি করে ফিরে আসাকেই সবাই বিরাট পরাজয় বলে ধরে নিলেও রাসূলে আকরাম (সা) সেটিকে ভবিষ্যতের বিজয়ের অপার সম্ভাবনাই মনে করেছিলেন। এবং বাস্তবেও তার প্রতিফলন দেখা গেছে। ঐতিহাসিকগণ হুদাইবিয়ার সন্ধিকে মক্কা বিজয়ের ভিত্তি বা সূচনা বলে অভিহিত করেছেন। এটি যে সুস্পষ্ট বিজয় মুসলমানদের জন্য তা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয় আমি আপনাকে এক প্রকাশ্য বিজয় দান করেছি। (সূরা আল-ফাত্হ : ১) ভোরে একটি পাখি যখন তার নীড় থেকে খাদ্যের সন্ধানে বের হয় তখন কতটুকু সম্ভাবনা নিয়ে বের হয়? নিশ্চয় খাদ্য পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা তার থাকে না। কিন্তু তারপরও অনিশ্চয়তা নিয়ে বের হওয়া পাখিটি সন্ধ্যায় ঠিকই ভরপেটে নীড়ে ফিরে! ০% সম্ভাবনাকে ১০০% তথা ভরপেটে উন্নীত করতে যিনি ব্যবস্থা করলেন সেই মহান আল্লাহতো সব কিছুই পারেন। মানুষও যদি মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা করতো তাহলে তিনিও মানুষের হতাশাকে সম্ভাবনায় পরিণত করতেন, তিনিও পাখির মতো মানুষের রিজিকের ব্যবস্থা করতেন। এ প্রসঙ্গে হজরত ওমর (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসূল (সা) বলেছেন, যদি তোমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করার হক আদায় (পূর্ণ ভরসা) করতে তবে তিনি পাখিকে রিজিক দেয়ার মতোই তোমাদেরকেও রিজিক দিতেন। পাখিতো সকালে খালি পেটে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে। (তিরমিজি) সমাজ সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য যারা কাজ করেন কিংবা ব্যক্তির সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধনের লক্ষ্যে যারা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা কতটুকু সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করেন? বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কখনো যার ব্যাপারে শতভাগ সম্ভাবনা নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছিল তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছেন আর যার ব্যাপারে কোনো সম্ভাবনাই ছিল না তিনি জীবনটাকেই পাল্টে দিয়েছেন। সমাজে এরকম বহু ঘটনার সাক্ষী আমি আপনি। কেউ এমন ঘটনা বাস্তবে দেখেছেন কেউবা শুনেছেন। তাই সম্ভাবনাকে অবহেলা করতে নেই হোক সেটা সিকি ভাগ কিংবা শতভাগ। বরং সম্ভাবনাকে সম্পদ মনে করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলুন দেখবেন সাফল্য আসবেই। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা হতাশ হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা সত্যিকার মুমিন হয়ে থাকো।” (সূরা আলে ইমরান : ১৩৯) লেখক : এমফিল গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির