‘মুজাদ্দিদ’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘তাজদিদ’ থেকে। যার অর্থ হলো, নবায়ন করা, সংস্কার করা। অর্থাৎ মুজাদ্দিদ মানে নবায়নকারী বা সংস্কারক। এটি একটি ইসলামী পরিভাষা। স্বার্থান্বেষীদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধন অথবা দ্বীনের মূলনীতি ও কার্যাবলির মধ্যে ভ্রান্তনীতি ও কাজের অনুপ্রবেশ ঘটানো কিংবা দ্বীন-বিরোধী নব উদ্ভাবিত বিষয় তথা বিদাআতের প্রচলন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, দ্বীনকে পরিশোধন বা সংস্কার সাধন, দ্বীনকে যথার্থ অর্থে ও মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা- এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের মুজাদ্দিদ বলা হয়। মুসলমানের চিন্তা, চেতনা, রুচি, অভ্যাস, পছন্দ, গ্রহণ-বর্জনের দৃষ্টিভঙ্গি, ভালো-মন্দ বাছাইয়ের স্বাধীনতা প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। একজন মুজাদ্দিদ এর সমুদয় ও সামগ্রিক ক্ষেত্রেই যেকোনো ধরনের বিকৃতি, ক্ষয়ক্ষতি কিংবা অসম্পূর্ণ অবস্থাকে প্রতিহত ও প্রতিরোধ করেন এবং যথার্থ প্রতিবিধান করেন, মূল বিষয়কে যথাস্থানে পুনঃস্থাপন করে থাকেন।
মুজাদ্দিদের প্রয়োজনীয়তা
আবু দাউদ শরিফে উল্লেখ আছে, আবু হুরায়রা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেন। এতে রাসূল (সা.) বলেন- আল্লাহ তায়ালা উম্মতের জন্য প্রতি শত বছরের মাথায় এমন এক ব্যক্তির উত্থান ঘটাবেন, যিনি উম্মতের জন্য তাদের দ্বীন নবায়ন করবেন। এর প্রেক্ষিতে ‘মুজাদ্দিদ’ পরিভাষার উদ্ভব ঘটেছে। উম্মতের চিন্তাবিদ ও গবেষক, আলিম ও মুসলিম সমাজের মধ্যে প্রতি শতাব্দীতে এক বা একাধিক ‘মুজাদ্দিদ’ আবির্ভূত হওয়ার ধারণা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এর আলোকে প্রথম মুজাদ্দিদ হিসেবে ওমর বিন আবদুল আজিজকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। মুজাদ্দিদ এর ধারণার উপর বিশ্বাস বা সমর্থন কোনো মৌলিক আকিদাভুক্ত বিষয় নয়। কোনো ব্যক্তি বিশেষকে মুজাদ্দিদ হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়ও বাধ্যতামূলক নয়।
মুজাদ্দিদ-ই-আলফেসানি
আলোচ্য মুজাদ্দিদ-ই-আলফেসানি অর্থগত দিক থেকে ‘হিজরি দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক’ হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। যাঁর প্রকৃত নাম শায়খ আহমদ সরহিন্দ (রহ.)। হিজরি ৯৭১ সাল থেকে ১০৩৪ সাল- এই ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। মুজাদ্দিদের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে মনীষীদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও শায়খ আহমদ একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ‘মুজাদ্দিদ’ অভিধায় সর্বসম্মতভাবেই সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।
এই উপমহাদেশে পৌত্তলিকতার শ্রেষ্ঠত্ব বিরাজমান ছিল এ কথা সকলেরই জানা। তার প্রাধান্য ক্ষুণœ করে তওহিদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ইসলামী জীবনধারা ও সংস্কৃতির বিকাশ এই বিরূপ পরিবেশে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চারশত বছর অতিবাহিত হবার পর রাষ্ট্রীয়ভাবেই তা বিপন্ন হয়ে পড়ে মোগল শাসনের স্বর্ণযুগে এসেই। ইতিহাসে তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
মোগল সম্রাট আকবরের দ্বীন-ই-ইলাহি’র রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রতিষ্ঠা লাভ উপমহাদেশে ইসলামের মূল ভিতকেই উপড়ে ফেলার জন্য কাজ করছিল। এটা ছিল নানা অপশক্তির মিলিত কর্মকাণ্ডের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ভারতের বাইরে ইরান, আরব, মধ্য এশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে বলতে গেলে ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল সময় অতিবাহিত হচ্ছিল। অন্যদিকে ভারতেও মুসলিম শাসনের একটা বৃহৎ সময় অতিবাহিত হয়েছে। সেদিক থেকে ভারতে ইসলামের জন্য একটি অনুকূল সময় স্রোত প্রবাহিত হবার কথা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অন্য পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। ফণা বিস্তার করে চলছিল বহু ভ্রান্ত মতবাদ ও নাস্তিক্যবাদ। জাগতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি, বিলাসিতা ও আরামপ্রিয়তা, নৈতিক শৈথিল্য এবং ধন ও যশ নিন্সা উদ্বাহু নৃত্য মুসলিম সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছিল। ইরান থেকে বিতাড়িত ‘আজমি নবুয়ত’ মতবাদের ধারক হায়াতে কা’শি সম্রাট হুমায়ুনের উদারতায় ভারতে পালিয়ে এসে আস্তানা স্থাপন করে। এদের অন্য নেতা শরিফ আমিলি সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভায় স্থান নিয়ে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। অন্যদিকে ভেতরে জৈনপুরের মাহদি হবার দাবিদার সাইয়্যিদ মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফের সমর্থক সংখ্যাও বেশ বেড়ে যায়। সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে ইরান থেকে বিতাড়িতদের মতবাদ প্রচারের অবাধ গতি। তারা রীতিমতো কুফুরি ও নাস্তিকতার পক্ষে প্রকাশ্য প্রচারণা চালায়।
এসব কর্মকাণ্ডের প্রভাবের প্রধান শিকার হন প্রথম জীবনে ইসলামের পাবন্দ বলে পরিচিত সম্রাট আকবর। নিরক্ষর আকবরকে তার নবরত্ন সভার প্রভাবশালী সদস্য আবুল ফয়েজ ও ফৈজি কবজা করার জন্য তাকে নয়া ধর্মের প্রবর্তক হতে উদ্বুদ্ধ করে। তৈরি হয় দ্বীন-ই-ইলাহি। হিন্দু-মুসলমানসহ সব ধর্মের মানুষকে একই আদর্শের পতাকাতলে সমবেত করার নামে মূল ইসলামের উপরই কুঠারাঘাত হানা হয়। আকবরকে ইমাম ও মুজতাহিদ পদে বরণের আয়োজন চলে। এর অনিবার্য পরিণতিতে যে সকল বিষয় বৈধতা লাভ করে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-ক্রমান্বয়ে অগ্নিপূজা ও সূর্যপূজা চালু, গঙ্গাজলের পবিত্রতা বিধান, ইবাদতের নতুন সময়সূচি নির্ধারণ, বাদশাহকে সিজদা করার পদ্ধতি প্রবর্তন, হিজরি সনকে বিদায় করে নতুন সনের প্রবর্তন, নতুন করে ঈদ ও পর্ব প্রবর্তন, জাকাতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, গরু জবাই নিষিদ্ধ করা, শূকর ও মদ বৈধ করা, ইসলামের মূল স্তম্ভ ও বিধিবিধানের প্রতি উপহাস করা, নামাজের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, সালাম দেবার সুন্নত রীতির পরিবর্তন করে নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করা প্রভৃতি। বস্তুত এসবই ছিল ইসলামী সংস্কৃতির উপর কুঠারাঘাত। ধর্মের নামে ইসলামের চরম বিকৃতি সাধন এবং ক্রমান্বয়ে এর উচ্ছেদ সাধন করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য।
শায়খ আহমদ সরহিন্দ (রহ.)-এর একজন জীবনী লেখক উল্লেখ করেন- “(ভারতে) ইসলামের চারশত বছর বয়সের সময় সম্রাট আকবরের শাসনকালে আরাবি দ্বীনের সহস্র বর্ষপূর্তি ঘটিয়াছে, এখন এক ‘উম্মি মহাসম্রাট’ দ্বারা উম্মি নবির দ্বীন রহিত করিবার এবং দ্বীন-ই-ইলাহির আত্মপ্রকাশের সময় সমাগত, এমন ধারণা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলে।”
মোটকথা ভারতে দশম শতাব্দীতে এই সময়টা ছিল একজন মুজাদ্দিদের আগমনের একটি সংগত প্রেক্ষাপট। অসহায় মুসলিম মানস এমন একজন ত্রাণকর্তার অসহনীয় প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছিল, যার পরশ পাথরের স্পর্শ ও তেজ কুফর-নাস্তিকতা ও জঘন্য অপসংস্কৃতি ও বিদআতের সকল জুলুম দূর করতে পারবে। এমনই এক উপযোগী সময়ে শায়খ আহমদ সরহিন্দের আবির্ভাব। যাঁর সকল কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে অনতিবিলম্বেই অর্থাৎ আকবরের পর জাহাঙ্গীরের জীবনের শেষ পর্যায়ে ইসলামী সংস্কৃতি তার পূর্ব ভাবমর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। আর সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেব তাঁর প্রচেষ্টা দ্বারা একে ফুলে-ফলে সুশোভিত করেন।
মুজাদ্দিদের অবদান
উপরিউক্ত প্রেক্ষাপট সামনে রাখলে যেকোনো চক্ষুষ্মান মানুষই দেখতে পাবেন, কী এক ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী। কোনো যুদ্ধে পরাজিত হবার চেয়ে অনেক বেশি গ্লানিকর ছিল এই ঘটনা। নবি করিম (সা.)-এর পর এক হাজার বছরের প্রান্তে এসে দ্বীন ইসলামের বিকৃতি এবং মুসলমানদের মধ্যে যে কুফুরি, শিরক, বিদআত, কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি প্রভৃতির প্রবল প্লাবনে বিশেষ করে উপমহাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির বিপন্ন দশা হয়েছিল, তা থেকে রক্ষার পথ প্রদর্শনে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের শিকার মুসলিম সমাজকে সুসংস্কৃত করে ঢেলে সজ্জিত করেন। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে ভারতের বাইরেও, প্রায় সর্বত্র। মুসলমানদের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বলতে গেলে নবায়নের ধারার প্রবর্তন ঘটে।
হযরত শায়খ আহমদ সরহিন্দ (রহ.) তাঁর কর্মপ্রচেষ্টা কীভাবে পরিচালনা করেছিলেন, তা এখানে আলোচনা করা হচ্ছে না। তবে তিনি যে এককভাবে বহু গুণসম্পন্ন ও অসম সাহসী ব্যক্তিত্ব ছিলেন- তা বলাই বাহুল্য। একটি প্রতাপশালী রাজশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং সাফল্য অর্জন বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও অটল থেকে তিনি বিভ্রান্ত জনগণকে যথারীতি তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন-এটা গবেষণা না করেও বলা যায়।
শায়খ আহমদ যে সমস্ত ক্ষেত্রে বহুদর্শীতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে সফল হয়েছিলেন, তার একটি তালিকা দেওয়া যেতে পারে-
ক. তাঁর গৃহীত কার্যক্রম ভারত উপমহাদেশে ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটায়- যা মুসলমানদেরকে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব থেকে পরবর্তী অন্তত দুই শতাব্দী রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে।
খ. সুফিবাদের নামে কতিপয় ভ্রান্ত আকিদা ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে শরিয়তকে সংরক্ষণ ও তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
গ. যুক্তিবাদের নামে ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাসের উপর আঘাতকারী ধারার সর্বগ্রাসী আক্রমণ থেকে ইসলামের সাক্ষ্য ও বিশ্বাসভিত্তিক ধারার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই তিনটি মৌলিক কাজ করার ফলস্বরূপ একাধারে আল্লাহর একত্ব তথা তাওহিদ, মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়ত বা রিসালাত এবং নানাবিধ বিদআতমুক্ত ইসলামী আকিদা ও শরিয়তের ভিত্তি মজবুত হবার পথ সুগম হয়েছে। পুনঃস্থাপিত হয়েছে ইসলামী সংস্কৃতি।
হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফেসানির মতো একজন মহান মুজাদ্দিদের এই কর্মতৎপরতার ফল পরবর্তী কমপক্ষে শত বছর মুসলিমরা ভোগ করেছেন; যদিও মোগলদের শাসনামলের বিদায় ঘণ্টা সহসাই বেজে গিয়েছিল।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের তওবা
দ্বীন-ই-ইলাহির প্রবর্তক সম্রাট আকবরের পুত্র ও পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রথমদিকে পিতার ধর্মমতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকলেও অচিরেই তাঁর মোহভঙ্গ হয়। তিনি মুজাদ্দিদের কাছে তওবা করেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এরপর বাদশাহ শাহজাহান, বাদশাহ আলমগীর প্রমুখের শাসনকালজুড়ে ইসলামের শরিয়ত ও সাংস্কৃতিক অনুশীলন অব্যাহত থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ঈমান-আকিদাগত দিক দিয়ে মুসলমানরা মূলধারায় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল দীর্ঘকাল। ব্রিটিশ শাসনের প্রায় দুশো বছর মুসলমানদের পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার কু-প্রভাব আজও বিদ্যমান; বরং এক অন্য রঙ ধারণ করে বর্তমানে ইসলামের চেতনা, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে উদ্যত- এক কালসাপের ফণা। অনুকরণপ্রিয়তার প্রাবল্য ও সভ্যতার চাকচিক্য আমাদের দ্বিধান্বিত করে ফায়দা লুটতে চাচ্ছে মিথ্যা অপশক্তি। এ সময়ে মুজাদ্দিদ-ই-আলফেসানির মতো একজন অভিভাবকের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে কিনা-তা সত্যানুসন্ধানী ইতিহাস ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলতে পারবেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গ্রন্থপ্রণেতা
আপনার মন্তব্য লিখুন