post

হাফিজুর রহমান শাহীন দোয়া কবুল হওয়া একজন শহীদ

মো: আফজাল হোসেন

০৬ ডিসেম্বর ২০১৫
মহান আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তার দাসত্ব, আনুগত্য ও তার দেয়া বিধিবিধানকে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। আর এই বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ নবী হিসেবে রাসূল (সা) পৃথিবীর বুকে আগমন করেন। আর নবী-রাসূলের রেখে যাওয়া কাজগুলো আল্লাহর জমিনে বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব এখন মানুষের। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পৃথিবীতে অসংখ্য খোদার সৈনিককে জালেমদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। শহীদ হাফিজুর রহমান শাহীন এমনই একজন খোদার পথের সৈনিক। নবী- রাসূলের রেখে যাওয়া পথকে জমিনে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে জালেমদের হাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ নোমানীর বাসায় যাত্রা ২৪ জানুয়ারি ২০১০ ইংরেজি। তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি শামসুল আলম গোলাপ ভাই, হাফিজুর রহমান শাহীন, সোহেল, ফারুক, আনিস, শেখ ফরিদ, ফাহিম ভাই, অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম সিদ্দিকী ও রাবির অন্যান্য দায়িত্বশীল ভাইসহ আমরা মোট ১১ জন শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানী ভাইয়ের সেজ ভাই ড. মো: ফকরুজ্জামান ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য সকাল ৭টার দিকে তার বাসার উদ্দেশে রওনা হই। আমরা দুপুরের দিকে সেখানকার একটা স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিই। সেখানে প্রথমে শহীদ নোমানীর পিতা ও পরে তার আম্মার সাথে সাক্ষাৎ হয় আমাদের। আমাদের দেখে শহীদ নোমানীর মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। বার বার আমাদের প্রশ্ন করেন “কী অপরাধ ছিল আমার নোমানীর? কেন তারা আমার আদরের নোমানীকে হত্যা করল? আমি কবে আমার নোমানীর হত্যার বিচার পাবো? আমি জানি এই জালিম সরকারের আমলে বিচার পাবো না। আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি, তিনিই তাদের বিচার করবেন। আজ নোমানী বেঁচে থাকলে কত আনন্দ করত বিয়েতে, তোমাদের কত আদর যত্ন করত।” এই কথাগুলোর কোনো জবাব ছিল না আমাদের কাছে, শুধু দুই চোখের অশ্রু ঝরানো ছাড়া। গোলাপ ভাই, শাহীন ভাইসহ আমরা সবাই তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম। পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ ও সাঈদী ভাইয়ের বিদায় এর কিছুক্ষণ পর রাবির সাবেক সভাপতি ও তৎকালীন কেন্দ্রীয় দাওয়া সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ভাই এলেন। এরপর আমরা সকলেই দুপুরের খাবার একসাথে খেতে বসলাম। সাইদী ভাই শাহীন ভাইকে পাশে নিয়ে খেতে বসলেন আমি তার পাশেই বসলাম। শাহীন ভাই ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী। ভালো খেতেও পারতেন। খাওয়া শেষে সাঈদী ভাইসহ আমরা শহীদ নোমানী ভাইয়ের শ্রদ্ধেয় পিতা, বড় ভাই, বোনসহ পরিবারের সকল সদস্যের সাথে সাক্ষাৎ করলাম, কিছু ছবিও তুললাম। সাঈদী ভাইয়ের জরুরি কাজ থাকায় সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের আগেই বের হলেন। শহীদ নোমানীর কবর জিয়ারত এরপর আমরা শহীদ নোমানী ভাইয়ের কবর জিয়ারত করার জন্য সেখান থেকে কবরস্থানের দিকে রওনা হলাম। কবরস্থানটা তার শহরের বাসা থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে অবস্থিত। সেখানে পৌঁছানোর পর তার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দোয়া দুরুদ শেষে মুনাজাত শুরু করলেন গোলাপ ভাই। তার মুনাজাতের মাধ্যমে শহীদ নোমানী ভাইয়ের জান্নাত লাভসহ আল্লাহ যেনো তাকে শহীদ হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেন, তার শাহাদাতের মাধ্যমে যেন আল্লাহতালা বাংলাদেশকে ইসলামী আন্দোলনের দুর্গম ঘাঁটিতে পরিণত করেন এবং আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করেন ইত্যাদি বলে তিনি প্রায় ৮-১০ মিনিট ধরে মুনাজাত করলেন। সে সময় দুই চোখের পানি অঝোরে ফেলে সকলকে কাঁদতে দেখলাম। মুনাজাত শেষে সবাই চোখের পানি মুছি। কিন্তু আমরা অবাক চোখে দেখতে পাই শহীদ হাফিজুর রহমান শাহীন তখনও মুনাজাত শেষ করেননি। নোমানী ভাইয়ের কবর দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে খুব উঁচুস্বরে কাঁদছেন আর বারবার বলছেন “আপনি আমাকে একা ফেলে কেন চলে গেলেন, আমাকে কেন আপনার সাথে নিয়ে গেলেন না, আমি আপনার সাথে যেতে চাই, আল্লাহ কেন আমাকে না নিয়ে আপনাকে নিয়ে গেলেন।” শাহীন ভাইয়ের আবেগটা আমরা বুঝছিলাম, কারণ শহীদ নোমানী ভাইয়ের শাহাদাতের আগে শাহীন ভাই তার পাশেই ছিলেন। অবশেষে আমি ও গোলাপ ভাই দুইজন তার দুই হাত ধরে কবর থেকে তুলে গোরস্থানের বাইরে নিয়ে আসি এবং তাকে শান্ত করি। এরপর সেখান থেকে নোমানী ভাইয়ের গ্রামের বাসাই যেয়ে সবার সাথে সাক্ষাৎ শেষে সন্ধ্যার দিকে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা হই। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষ ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ ইংরেজি। শহীদ নোমানীর হত্যাকারী আসাদ, যার চাপাতির আঘাতে শহীদ নোমানীর মাথা দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। সেই খুনি শেখ মুজিবুর রহমার হলে শিবিরের এক কর্মীর সিট অবৈধভাবে দখল করতে এলে শিবিরের সাথে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ শুরু হয়। মূহূর্র্তে সেই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ক্যাম্পাসে। ছাত্রলীগ ও পুলিশ যৌথভাবে শিবিরের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতন চালানো শুরু করে হলগুলোতে। চারিদিকে শুধু মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। পুলিশ ও ছাত্রলীগের গোলাগুলিতে ভারী হয়ে ওঠে গোটা ক্যাম্পাসসহ তার আশপাশ অঞ্চলগুলো। প্রতিটা হলে যে সকল রুমগুলোতে আমাদের ভায়েরা থাকে সে সকল রুমসহ সাধারণ ছাত্রদের রুমগুলোতে দরজা ভেঙে ঢুকে তাদের নির্যাতন চালিয়ে রুমের সকল জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে যায়। এতে অনেক সাধারণ ছাত্রও হতাহত হয়। এত গুলাগুলির পরও আমরা সামান্য পিছপাও হইনি, কিন্তু পুলিশের প্রচন্ড গুলাগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে আশ্রয় নিই আমরা। তখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসে আমরা ছিলাম। কিন্তু সকালে ফজরের নামাজ শেষ করে আমারা যখন ক্যাম্পাসের গেটগুলোর পাশে অবস্থান করি ঠিক সেই সময় আমরা খবর পেলাম ফারুক হোসেন নামে এক ছাত্রলীগের কর্মীকে কে বা কারা হত্যা করে আমির আলী হলের ম্যান হোলো ফেলে রেখে যায়। এই খবর পেয়ে আমরা আঁতকে উঠলাম। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিভাবে এই ঘটনা ঘটলো। কারণ সারারাত তারা পুলিশকে সাথে নিয়ে ক্যাম্পাসে যে তান্ডব ও হলগুলোতে সাধারণ ছাত্রদের ওপর যে নির্যাতন ও লুটপাট চালিয়েছে এতে করে আমাদের পক্ষে কিছুতেই ক্যাম্পাসে অবস্থান করা সম্ভব ছিলো না। বুঝতে পারলাম এ নিশ্চয় শিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে উৎখাতের জন্য ছাত্রলীগের কোনো পাতানো ফাঁদ ও ষড়যন্ত্র। আমাদের আর বুঝতে বাকি রইল না ছাত্রশিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে তারা ফারুক হোসেন নামে এই নিরীহ ছাত্রকে হত্যা করে শিবিরের ওপরে দায় চাপাবে এবং মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করবে। সুতরাং আমরা যে যেভাবে ছিলাম সেভাবেই নিরাপদ জায়গায় চলে গেলাম। গ্রেফতার ও নির্যাতন পরদিন থেকেই ফারুক হত্যার মিথ্যা সাজানো নাটক দিয়ে শুরু করে ছাত্রশিবিরের ওপরে জুলুম নির্যাতনের স্টিম রোলার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের নির্দেশে সারা দেশে শুরু হয় চিরুনি অভিযান। হলগুলোতে চলে লুটপাট কম্পিউটার, ল্যাবটপ, মোবাইল, টাকা পয়সা, দামি দামি আসবাবপত্রসহ যার যা ছিল সব লুটপাট করে নিয়ে যায় ছাত্রলীগ। এই সুযোগে প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকা মূল্যের জিনিসপত্র লুট করে ছাত্রলীগ। অপর দিকে চিরুনি অভিযানের নামে রাবির সাধারণ ছাত্রসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ও সারা বাংলাদেশে তান্ডব চালায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ। সারাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার জামাত-শিবিরের নেতাকর্মীকে ধরে রিমান্ডের নামে নির্যাতন চালিয়ে অনেককে পঙ্গু করে কারাগারে পাঠায়। সাধারণ ছাত্রদেরকে জিম্মি করে চাঁদা আদায় করে ছাত্রলীগ ও পুলিশ। তারা বলে চাঁদা দে তা না হলে মেরে হাত-পা ভেঙে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেবো। এভাবে অনেক বাড়িঘর ও অফিস ভাঙচুর করে তারা। হাফিজুর রহমান শাহীনের মৃত্যুর খবর ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ ইংরেজি। ঘটনার ১ দিন পর। আমি ফজরের নামাজ শেষ করে কুরআন পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এমন সময় আমার মোবাইল বেজে উঠলো। এতো ভোরে ফোন বেজে ওঠা দেখে আঁতকে উঠলাম। কারণ চারিদিকে শুধু আটক, নির্যাতন ও ভাঙচুরের খবর। ভাবলাম নিশ্চয় কোনো দুঃসংবাদ। ফোন রিসিভ করলাম। ফোন রিসিভ করা মাত্রই যা ভেবে ছিলাম তাই, তৎকালীন মহানগরীর শিবিরের সভাপতি তৌহিদুর রহমান সুইট ভাই আমাকে জানান মেহেরচন্ডীতে বাসা, হাফিজুর রহমান শাহীন নামে রাবির এক দায়িত্বশীল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে পুলিশের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেছেন। রাত ৩টার দিকে তার গলার কাছে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে পুলিশ। এই সংবাদ পাওয়ার পর আমার দু‘চোখ দিয়ে নিজের অজান্তে ঝরঝর করে পানি ঝরতে লাগলো। আমি কিছুতেই এই সংবাদটা মেনে নিতে পারছিলাম না। যে ছিল আমার সংগঠনের সহযোদ্ধা যার সাথে কিছুদিন আগেই আমি ময়মনসিংহে নোমানী ভাইয়ের বাসা থেকে ঘুরে এলাম। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান শহীদ হাফিজুর রহমান শাহীন ভাই। কে নেবে তার বৃদ্ধ পিতা-মাতার দায়িত্ব? নোমানীর কবর ছুঁয়ে যে শাহাদাতের তীব্র আকাক্সক্ষা করেছিলেন শহীদ শাহীন, তাহলে কি আল্লাহতায়ালা সেই দিন তার দোয়া কবুল করেছিলেন?” এরপর আমাদের মতিহার থানা আমির অধ্যাপক আব্দুস সামাদ ভাইকে শাহীন ভায়ের শাহাদাতের খবরটা জানাই। সামাদ ভাই হাফিজুর রহমান শাহীন ভায়ের বাসায় এই সংবাদ নিয়ে গেলে সেখানে শুরু হয় এক আবেগঘন মুহূর্ত। সংবাদ পেয়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তার মা, তার পিতা, বোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ সকলের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে গোটা মেহেরচন্ডী অঞ্চল। হাফিজুর রহমান শাহীন ও নোমানী ভাইয়ের কিছু অলৌকিক মিল শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানীর হাত ধরে এই সংগঠনে আসেন শহীদ হাফিজুর রহমান শাহীন। শহীদ নোমানীর হাতে গড়া কর্মী তিনি। নোমানী ভাই যখন মেহেরচন্ডী অঞ্চলের দায়িত্বশীল ছিলেন তখন তার প্রচেষ্টায় তিনি কর্মী ও সাথী হন। নোমানী ভাইয়ের শাহাদাতের দুই দিন আগে অর্থাৎ ১১ মার্চ ২০০৯ ইংরেজি শহীদ দিবস উপলক্ষে আইয়ুব ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে চুয়াডাঙ্গায় গিয়েছিলেন তার বাসায়। তিনি সেখানে কবর জিয়ারতের সময় দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে শহীদ আয়ুব ভাইসহ যারা এই আন্দোলনের জন্য শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেছেন তাদের মতো শাহাদাতের মৃত্যু কামনা করেছিলেন তিনি। আল্লাহতালা তার দোয়া কবুল করেছিলেন। এর দুই দিন পর অর্থাৎ ১৩ মার্চ ২০০৯ নোমানী ভাই শাহাদাত বরণ করেন। একইভাবে শহীদ হাফিজুর রহমান শাহীন ভাই ২৪ জানুয়ারি ২০১০ নোমানী ভায়ের কবর জিয়ারতের সময় আল্লাহর কাছে শহীদি মৃত্যু কামনা করেছিলেন। মাত্র ১৫ দিন পর আল্লাহতালা তারও দোয়া কবুল করেছিলেন। নোমানী ভাইয়ের শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত হাফিজুর রহমান শাহীন ভাই ঘটনাস্থলে ছিলেন। নোমানী ভাই শাহীন ভাইকে শেরেবাংলা হলের প্রাচীর পার করে দেয়ার পরপরই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তা না হলে হয়ত সেদিন দু’জনকেই শাহাদাত বরণ করতে হতো। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে নোমানী ভাই ও শাহীন ভাই একই গেঞ্জি পরে শাহাদাত বরণ করেন। মেহেরচন্ডীর মান্নান ভাই সৌদি আরব থেকে দুটো গেঞ্জি নিয়ে এসেছিলেন। এবং তার সব থেকে পছন্দের লোক নোমানী ভাই ও শাহীন ভাই দুইজনকে দুটো গেঞ্জি উপহার দিয়েছিলেন। তাদের শাহাদাতের সময় দুই জনের পরনেই সেই উপহারের গেঞ্জি ২টা ছিল। শহীদের লাশ দাফন সন্ধ্যার পরে শহীদ হাফিজুর রহমান শাহীন ভাইয়ের লাশ বাসায় নিয়ে আসা হয়। চারিদিকে শুধু কান্নার রোল, প্রিয় ব্যক্তিকে হারিয়ে সবাই যেন নির্বাক নিস্তব্ধ। গোটা এলাকা র‌্যাব, পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা ঘিরে রাখে। লাশ দেখতে আসা ও জানাজা পড়তে আসা লোকদের বাধার সৃষ্টি করে তারা। খুব দ্রুত তার লাশকে দাফনের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা সত্ত্বেও মানুষের স্রোতকে ঠেকাতে পারেনি তারা। অবশেষে এশার নামাজের পর হজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে জানাজার নামাজ শেষ হয়। দাফনের পরও দুই দিন ধরে র‌্যাব তার কবরকে পাহারা দিয়ে রাখে। এই দৃশ্য দেখে তার মা বলেছিলেন, “আমার শাহীনকে তোমরা এতই ভয় পাও যে তাকে দাফন করার পরও তার কবর পাহারা দিচ্ছ, প্রাণহীন শাহীন তোমাদের ক্ষতি করবে ভেবে?” শহীদ হাফিজুর রহমান শাহীন। তিনি শুধু এই আন্দোলনের দায়িত্বশীলই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমাজসেবক ও জনদরদি, এলাকার প্রতিটা মানুষের দুঃখ-কষ্টের অংশীদার ছিলেন তিনি। তার উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল মেহেরচন্ডী অঞ্চলে অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। ইসলামিক পাঠাগার, মসজিদ নির্মাণ, স্বেচ্ছায় রক্তদান, গরিব অসহায় ছাত্রদের সহযোগিতা, খেলাধুলাসহ নানা ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে হয়তো ইসলামী আন্দোলনের অনেক নেতাকর্মী এই সংগঠনে আসবে কিন্তু শহীদ হাফিজুর রহমান শাহীন ভাইয়ের মতো এমন জনদরদি ও সমাজসেবক দায়িত্বশীল খুব কমই পাওয়া যাবে। আমরা আজও শহীদ শাহীন ভাইয়ের আম্মার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে কান্না ছাড়া তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। তার ফটো, পোস্টার ও কাপড়গুলো বুকে চেপে ধরে সব সময় কাঁদেন। কাঁদতে কাঁদতে তার মা আর চোখে ঠিক মত দেখতে পান না। তার বাবা আজও বাকরুদ্ধ। বৃদ্ধ পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান তিনি, কে নেবে তার বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণ পোষণের দায়িত্ব। একমাত্র ভাইকে হারিয়ে বোনেরা এখনও মর্মাহত। তার বাসায় গেলে তার ছোট বোনটি কাঁদে আর বলে কে আমাকে আমার ভাইয়ার মতো আদর করবে। তার সাথীরা কবর জিয়ারত করতে ছুটে আসে দূরদূরান্ত থেকে। তাদের আহাজারিতে এলাকা স্তম্ভিত হয়ে যায়। আমাদের মাঝ থেকে এক শাহীন চলে গেলে কী হবে, হাজারো শাহীন জন্ম নেবে তার আদর্শে, তুমি আমাদের আদর্শ, তুমি আমাদের প্রেরণা, তুমি আমাদের অহঙ্কার। আমরা মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি- আল্লাহ যেন তোমাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে জায়গা করে দেন। আমিন। লেখক : সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির