post

১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস দিবস আছে, মানবাধিকার নেই!

শাহ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক

০২ নভেম্বর ২০১৭
১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। জাতিসংঘ, সরকার ও বিভিন্ন এনজিওর উদ্যোগে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সারা বিশ্বে এই দিবসটি পালিত হয়। জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র অনুমোদন করে। মানবাধিকার বিষয়টি বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয়। মানবাধিকারের আক্ষরিক অর্থ হলো মানুষের অধিকার। সাধারণত মানবাধিকার বলতে মানুষের সে সকল অধিকার বোঝায় যা নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করে, যা তাকে বিশিষ্টতা দান করে এবং যা হরণ করলে সে আর মানুষ থাকে না। অর্থাৎ মানুষকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যে সকল অধিকার দরকার তাই মানবাধিকার। মানবাধিকার সে সকল অধিকারকে নির্দেশ করে যা স্বাভাবিক ও সহজাত। মানবাধিকার মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এবং সামাজিক জীব হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য। মূলত মানবাধিকার হলো, Freedom from want, Freedom from fear and Assurance of liberty. অর্থাৎ মানবাধিকার হচ্ছে ক্ষুধা ও ভয় থেকে মুক্তি এবং স্বাধীনতার নিশ্চয়তা। এর যেকোনো একটি ছাড়া মানবাধিকার পরিপূর্ণতা পায় না। প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদাকে সম্মান প্রদর্শনেই মানবাধিকার নিহিত। মানবাধিকার ব্যক্তিকে স্বাধীনতা, সমতা এবং মর্যাদা দিয়ে থাকে। মানবাধিকারের ধারণা কিভাবে এলো? UN Declaration of Human Rights (বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা): ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর ৫১টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ যার বর্তমান সদস্যসংখ্যা ১৯২। প্রতিষ্ঠার সময়ই গঠিত হয় জাতিসংঘের সংবিধান যা টঘ ঈযধৎঃবৎ বা জাতিসংঘ সনদ হিসেবে পরিচিত। এই সনদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এতে মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বাস্তবায়ন ও উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু ধারা সংযোজিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এই সনদের মুখবন্ধ, অনুচ্ছেদ ১(৩), ১০, ১৩ প্যারা ১(৯), ৫৫, ৬২, ৬৮ ও ৭৬ নং ধারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তা ছাড়া জাতিসংঘের অধীনস্থ মানবাধিকার কাউন্সিল সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অনুমোদন করে। এই মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে ৩০টি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয় এবং এ সকল অধিকার বাস্তবায়নে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের ঘোষণা দেয়া হয়। এজন্য UDHR-কে মানবাধিকারের পরশপাথর বা মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় ৩০টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর মধ্যে ১ ও ২ নং ধারায় মানবাধিকারের মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে। ৩-২১ নং ধারায় নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং ২২-২৭ নং ধারায় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ২৮-৩০ নং ধারায় এই সনদের প্রায়োগিক দিক উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ও সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রেক্ষাপট : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি মানুয়ের নির্মম মৃত্যু সকলের মনে একটা দাগ কাটে। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৪১ সালের ১৪ আগস্ট আটলান্টিক সনদে স্বাক্ষরদানের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও যুক্তরাজ্যের উইনস্টন চার্চিল ঘোষণা দেন যে তার নাৎসি বাহিনী বা অক্ষ বাহিনীর নির্যাতনের অবসানের পর এমন এক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন যেখানে সকল দেশের সকল মানুষের ভয় ও অভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। অবশ্যই এর কিছু দিন আগে রুজভেল্ট তার চতুর্বিধ স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেন। যার মধ্যে ছিল: বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, স্বীয়পণে ঈশ্বরের উপাসনার স্বাধীনতা, অভাব থেকে মুক্তি এবং সকল প্রকার ভয় থেকে মুক্তি। ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে একে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন দেশে সভা সম্মেলন করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত গঠন করতে থাকেন। এর মধ্যে ক্যাসাব্লাংকা, কুইবেক, মস্কো, কায়রো, তেহরান ও ইয়ালটার উল্লেখযোগ্য। আমেরিকার ডাম্বারটনওকস এর এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় সংগঠনটির নাম হবে সম্মিলিত জাতিসংঘ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন সানফ্রান্সিকোতে ২৫টি দেশের প্রতিনিধি মিলে রচনা করেন জাতিসংঘ সনদ, যা ২৪ অক্টোবর থেকে কার্যকর করা হয়। অবশ্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের এই কমিটমেন্ট এবং বিভিন্ন শান্তিকামী সঙ্ঘের প্রভাব লক্ষ করা যায় জাতিসংঘ সনদের চূড়ান্ত খসড়ায়। এই খসড়ার ৮৫টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ৭টি অনুচ্ছেদে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয় এবং সুপ্রশস্ত হয় মানবাধিকার কাউন্সিল গঠনের পথ। জাতিসংঘ সনদের ৬৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিভিন্ন কমিশন গঠন করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে ১৯৪৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ মানবাধিকার কমিশন গঠন করে। একই বছর কমিশনের প্রথম অধিবেশনে এই কমিশনকে একটি International Bill of Rights তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম অধিবেশনে কমিশনে এই বিল তৈরির জন্য মিসেস এলিনর রুজভেল্টের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটি মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রস্তুত করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের মাধ্যমে সাধারণ পরিষদে পেশ করে। ১৯৪৮ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের তৃতীয় অধিবেশনে খসড়া ঘোষণাপত্রটি আলোচ্যসূচির শুরুতে রাখা হয়। এই সময় সনদের প্রতিটি শব্দ ও বাক্যাংশের ওপর ১৪০০ বার ভোট নেয়া হয়। একই বছর (১৯৪৮) ১০ ডিসেম্বর প্যারিসের ফারি নগরীতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ঘোষণাটি গৃহীত হয়। এই অধিবেশনে জাতিসংঘের ৫৮টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ৪৮ জন পক্ষে ভোট দেন আর সোভিয়েত ব্লকের ৬টি রাষ্ট্রসহ ৮টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ভোটদানে বিরত থাকেন। কেউ ঘোষণাটির বিপক্ষে ভোট দেননি। এই ঘোষণাপত্রে ৩০টি ধারা রয়েছে যা মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন ফ্রান্সের রনে ক্যাসা যিনি একে জাতিসংঘ সনদের এক কর্তৃত্বব্যঞ্জক ব্যাখ্যা বলে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণাটি কার্যকর করার জন্য জাতিসংঘ অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্যরাষ্ট্র নিজ দেশের সংবিধানে এই ঘোষণাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। গঠিত হয়েছে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকা আঞ্চলিক মানবাধিকার কনভেনশন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চুক্তি ঘোষণার মাধ্যমে মানবাধিকার সারা পৃথিবীতে আজ শুধু একটি ঘোষণাই নয় বরং আইনে পরিণত হয়েছে। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রকে (UDHR) মানবাধিকারের মহাসনদ বলা হয়ে থাকে। এটা একটি ঘোষণাপত্র যা পালন করতে রাষ্ট্রগুলোর বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এই ঘোষণাপত্রকে কার্যকরী করার জন্য ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘে দু’টি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয় যা (ICCPR) ও (ICESCR) নামে পরিচিত। এই প্রটোকল অনুযায়ী মানবাধিকারগুলোকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার। যদিও এ ভাগের পেছনে বৈশ্বিক রাজনীতি জড়িত। পশ্চিমা বিশ্ব নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে বেশি সোচ্চার এবং সমাজতান্ত্রিক ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারকে প্রাধান্য দেয়। মূল্যায়ন সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৬৯তম বছরে এসে আজকে এই কথাটি সবাইকে একবাক্যে স্বীকার করতে হবে, যে মানবাধিকার ঘোষণাপত্রটি যে উদ্দেশ্য নিয়ে গৃহীত হয়েছিল এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তা অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ না হলেও অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে। এই কথা ঠিক জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা ও তার মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণাপত্র অনুমোদনের পর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ন্যায় কোনো ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কোরিয়ান গৃহযুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, আবর-ইসরাইল যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, বলকান যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, যৌথবাহিনীর নামে আফগানিস্তান, ইরাকে হামলায় লক্ষ-কোটি মানুষের মৃত্যু মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ও জাতিসংঘের কার্যকারিতাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে চলমান ফিলিস্তিন ও কাশ্মির সমস্যা, সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়াসঙ্কট এবং মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সন্ত্রাসী কর্তৃক সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত গণহত্যা বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষকে আশাহত করেছে। এ ছাড়া বছরের পর বছর ধরে মানবাধিকার দিবস পালন, বিশ্বব্যাপী শত সহস্র মানবাধিকার সংগঠন ও মানবাধিকারকর্মীদের ব্যাপক তৎপরতার পরও ক্রমবর্ধমান ধনী-গরিবের বৈষম্য, নারী-শিশু নির্যাতন, উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবন মানবাধিকার দিবসের উজ্জ্বলতাকে অনেকটাই ম্লান করে দেয়। বাংলাদেশে বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রসহ প্রায় সকল মানবাধিকার দলিলে (গুমবিরোধী চুক্তি ছাড়া) অনুস্বাক্ষরকারী দেশ। বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের প্রায় সকল বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে তৃতীয় অধ্যায়ের ২৭-৪৪ নং ধারায় নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলোকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে; যা লঙ্ঘন হলে যে কোন নাগরিক আদালতের আশ্রয় নিতে পারবে, রিট করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে মানবাধিকার ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নাই’-এর মতো অবস্থা। অতীতের সকল সরকারই বিভিন্ন অজুহাতে মানবাধিকারের এ সমস্ত চুক্তি বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বিশেষ করে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর নামে নিরপেক্ষ নির্বাচনের তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি বাতিল করে জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার; স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোট প্রদানের মাধ্যমে দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলন দমনের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ব্যাপক দমন-নিপীড়ন, ধরে নিয়ে গিয়ে পায়ে গুলি করে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া, সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ইলিয়াছ আলী, জাকির হোসেন, ওয়ালীউল্যাহ, মোকাদ্দাস, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমান আজমী, ব্যারিস্টার আরমানের মতো ব্যক্তিদের চিরতরে গুম করে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে ঠান্ডা মাথায় খুন করা, মিথ্যা মামলা দিয়ে ঘরবাড়ি ছাড়া করা, রিমান্ডের নামে নিষ্ঠুর নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির অজুহাতে বিরোধী দলসমূহকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া এবং আইসিটি আইনের মাধ্যমে জনগণের ন্যূনতম মতপ্রকাশের অধিকারটুকু কেড়ে নেয়ার মাধ্যমে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বর্তমান সরকার। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতন, আত্মহত্যা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো সামাজিক অপরাধ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বেশ ভয়াবহ। নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেড়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে ২০১৭ সালের প্রথম ৯ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে এবং ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ১২৫ জন। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্তত ৫০ জনকে। এই নিখোঁজদের মধ্য থেকে ফিরে এসেছেন মাত্র ৭ জন। আর ২ জনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়েছে। গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ৪২ জন। আসকের এক প্রতিবেদনে জানা যায় কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৩৮ জন। রাজনৈতিক সংঘাতে নিহত হয়েছেন ৪৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৩ হাজার জন। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৮৮ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন নারী। এর বাইরে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয় ৭৭ জন নারীর ওপর। সাংবাদিক সমাজও আক্রান্ত হয়েছেন এ বছরে পূর্বের তুলনায় বেশি। ৮৩ জন সাংবাদিক এ বছরে এখন পর্যন্ত নানাভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে যেয়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। সমকালের স্থানীয় প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম শিমুল সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে মেয়রের গুলিতে নিহত হন। এ ছাড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মারা গিয়েছেন ৩৭ জন। নিখোঁজ বা গুমের ঘটনা নিকট অতীতে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বাইরেও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ নিখোঁজের শিকার হচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে নিখোঁজ হয়েছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মুবাশ্বার হাসান সিজার, কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ ফাহিম, এবিএন গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ সাদাত আহমেদ, সাংবাদিক উৎপল দাস, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসিচব এম এম আমিনুর রহমান, বেলারুশের অনারারি কনসাল ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়, আরাফাত রহমান, জনতা পার্টির সভাপতি মিঠুন চৌধুরী এবং তার সহকর্মী আশিক ঘোষ প্রমুখ। ক্রসফায়ার, নিখোঁজ ও গুমের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিজেরই জড়িত থাকার অভিযোগ ও প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগী পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা প্রায় প্রতিটি ঘটনায় অভিযোগ করেন সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায় র‌্যাবের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন। সেখানে ভিকটিম আওয়ামী লীগ দলীয় হওয়াতে সেটা মিডিয়াতে এসেছে। কিন্তু অন্য অনেক ঘটনার কোনো সুরাহা পাওয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি কক্সবাজারে এক ব্যবসায়ীকে আটক করে ১৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ডিবির ৭ সদস্য। কিছুদিন আগে সরকার দলীয় এমপি ডা: এনামুর রহমান মিডিয়াতে মন্তব্য করেন যে তিনি নিজে ৫ জনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছেন। বিরোধী মতের মানুষগুলো শুধুমাত্র এই গুমের শিকার হওয়া এবং কিছু ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসায় এটা প্রমাণ হয় যে বর্তমান সরকার নিজেই এসব গুম খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের ভয়াবহ মানবাধিকার পরিপন্থী কার্যকলাপের পরও যখন জাতিসংঘ ও তার মানবাধিকার কাউন্সিল এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে; কিংবা কোন কোন ইস্যুতে কিছু বিবৃতি দিয়ে, নিন্দা জানিয়ে দায়িত্ব শেষ করে দিচ্ছে কিংবা অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে ঠিক সেই রকম একটা পরিস্থিতিতে এবারের ১০ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব মানবাধিকার দিবস’ পালন বিশ্বব্যাপী ভূলুণ্ঠিত মানবাধিকার সুরক্ষায় কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে তা বিবেচনার দাবি রাখে। এ জন্য বলতে হচ্ছে মানবাধিকার দিবসে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই। তবে এ কথা ঠিক জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ও অন্যান্য দলিল এবং বিশ্ব মানবাধিকার দিবস থাকার কারণে মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা হয়, চার বছর পরপর মানবাধিকার কাউন্সিলে রাষ্ট্রসমূহের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা হয়, কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তা বন্ধ ও বিচারের দাবি করা যায়। কিন্তু এই কাঠামোই যদি না থাকতো তাহলে পরিস্থিতি আরো নাজুক হতো। তাই মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাগুলো আরও দৃঢ় করতে সচেষ্ট থাকতে হবে। লেখক : মানবাধিকার সংগঠক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির