আম্রকাননের সবুজ পল্লবে আবৃত চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জেলা। এখানকার ‘নিমতলা ঈদগাহ ময়দান’ মুসলিম উম্মাহ্র অন্যতম মিলনের স্থান। দুই ঈদে প্রতি বছর সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আনন্দঘন মিলনমেলা ঘটে এ ময়দানে। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই ধারাবাহিকতা। কিন্তু আজ থেকে ৩৪ বছর আগে (১৯৮৫ সালে ১১ মে) এক হৃদয় বিদারক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে এ ময়দান। এর পাশে কালো পিচ ঢালা রাস্তাকে ফুটফুটে চেহারার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র শীষ মোহাম্মদের কচি রক্ত দিয়ে লাল করা হয়েছিল। দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র আব্দুল মতিনের রক্ত দিয়ে সবুজ ঘাসের আবরণকে রাঙিয়ে দেয়া হয়েছিল। অন্যের বিপদে সবার আগে ছুটে আসা বালক সেলিম রেজা ও রিকশাচালক মুক্তার হোসেনকে মসৃণ জমিনের ওপর চিরদিনের জন্য ঢলে পড়তে হয়েছিল। আলতাফুর রহমান, রাশেদুল হক ও শাহাবুদ্দীনকে এই ময়দানে শহীদ করা হয়েছিল। কী অন্যায় করেছিল তারা? কী অপরাধে এতিম হলো শ্রমিক নজরুল ইসলামের সন্তানেরা? পুলিশ কিসের নেশায় তাদের প্রিয় বাবার প্রাণ-পাখিটা বের করেছিল নবাবগঞ্জ থানা চত্বরে? মিথ্যা ও বাতিলের অনুসারীদের নিকট থেকে এর উত্তর পাওয়া যাবে না। তারা জানে না কোন কারণে কুরআনের সৈনিকদের ১১ মে’সহ যুগে যুগে জুলুম-নির্যাতন ও শহীদ করা হয়েছে? তবে একথা সত্য যে হক-বাতিল ও সত্য-মিথ্যার সংঘাত চিরন্তন। জান্নাতে আদম (আ:)কে সৃষ্টির পর তাঁর পেছনে লেগে যায় অভিশপ্ত ইবলিস। শুরু হয় সত্য ও অসত্যের সংঘাত। সেই থেকে শুরু হয়ে হাবিল-কাবিল, বদর, উহুদ, খন্দক হয়ে ১৯৮৫ সালের ১১ মে’র লড়াই। এখনো অব্যাহত রয়েছে সে চিরন্তন লড়াই, চলবে কেয়ামত অবধি। সত্যের আলো ফুটে ওঠা মাত্রই মিথ্যার আঁধার তাকে গ্রাস করে ফেলতে উদ্যত হয়, কিন্তু সত্যের প্রখর আলোর তীব্রতায় টিকতে না পেরে মিথ্যা ও বাতিল অন্ধ কুঠিরে মুখ লুকাতে বাধ্য হয়। আল্লাহ তায়ালার বাণী- “তারা তাদের মুখের ফুৎকার দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। অথচ আল্লাহর ফয়সালা হলো তিনি তার নূরকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন। কাফেররা তা যতই অপছন্দ করুক না কেন?” (সূরা আস সফ : ৮) অতীত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় অন্যায়-অসত্যের প্রবল আক্রমণের মুখে সত্য ও ন্যায় কখনো পরাজয় বরণ করেনি। বরং যত বাধা-প্রতিবন্ধকতা এসেছে, সত্যের সৈনিকরা তত দৃঢ়তার সঙ্গে তার মোকাবিলা করেছেন। পরিণামে আল্লাহ তায়ালা কুরআনপ্রেমী ও সত্যের কেতনধারীদের ‘সম্মানের মুকুট শাহাদাতের মর্যাদা’ নয়তো ‘বিজয়’ দান করেছেন। পবিত্র কুরআন এভাবেই বলে- “আর ঘোষণা করে দাও, সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবারই কথা।” (বনি ইসরাইল : ৮১) আর অসত্যের বাহকদের কপালে জুটেছে লাঞ্ছনা ও পরাজয়ের গ্লানি তারপরও তারা সত্যের বিরোধিতা করেছে যুগ যুগ ধরে; চেয়েছে কুরআনের আন্দোলনকে সূচনাতেই ব্যর্থ করতে। মক্কার কাফেররা নানাবিধ ষড়যন্ত্রের ভয়াল জাল বুনেছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো কুরআনের হৃদয়গ্রাহী তিলাওয়াত শুনতে বাধা দেয়া। নিজেরাও শুনবে না, অন্যকেও শুনতে দিবে না। যেখানেই মুসলিম মিল্লাতের প্রাণে ঈমান জাগরণের মহান উৎস, হেদায়েতের অমিয় বাণী আল কুরআন তেলাওয়াত করা হয় তখন-সেখানেই হইচই করে, তালি বাজায়, বিদ্রুপ করে, আপত্তি ও সমালোচনার ঝড় তোলে। তাদের মনের গহিনে লুক্কায়িত ষড়যন্ত্রের কথা কুরআন এভাবে প্রকাশ করে- “এসব কাফের বলে, এ কুরআন তোমরা কখনো শুনবে না। আর যখন তা শুনানো হবে তখন হট্টগোল বাধিয়ে দেবে। হয়তো এভাবে তোমরা বিজয়ী হবে।” (সূরা হামিম আস সাজদাহ : ২৬) কিন্তু যে ঐশী কিতাবের আহ্বান এসেছে মানবতাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতে সে নিদর্শনকে বলহীন মাকড়সার জাল কিংবা বিশাল পাহাড়সম ষড়যন্ত্র দিয়ে বিরত রাখা যায় কি? কোন কালে সম্ভব হয়নি বিরত রাখা। তাইতো সেদিন আবু জাহেলকে উতবা বিন রাবিয়া বলেছিলেন, “তাঁর (নবীজি) কাছে যে কালাম আমি শুনলাম তাতে আল্লাহর আজাবের হুমকি আছে।” আর তোফায়েল বিন আমর নিজেকে কবি পরিচয় দিয়ে কুরআনকে জাদুবিদ্যা মনে করে কানের ভেতরে কাপড় ঢুকিয়ে কাবা শরিফ তাওয়াফ করছিলেন। সে সময় মহানবী (সা.) নামাজরত ছিলেন। তোফায়েল ভেবেছিলেন, আমিতো কবি, শুনি না একটু কুরআন। কান থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলে নবীজির (সা.) মুখে কুরআন তেলাওয়াত শুনে তিনি বিমোহিত হয়ে ইসলাম কবুল করেন। এমন হাজারো ঘটনা রয়েছে কুরআন তার আপন মহিমায় চুম্বকের ন্যায় অনেককেই টেনে নিয়েছে। কবির কলমের অঙ্কন- “কোন সে বাণী ঐশী কিতাব কোন সে সুরের টান সারা বিশ্বের মুসলিম বাঁধে কোন সেতারের তান।” মহাগ্রন্থ আল কুরআন প্রেরিত হয়েছে নির্ভুলভাবে। শুরুই করেছে নির্ভুলতা এবং সন্দেহ-সংশয়কে বাতাসের সাথে উড়িয়ে দিয়ে। আবার কেউ যদি কুরআনের মত করে সূরা বা আয়াত তৈরি করতে চায় তাও পারবে না। এই চ্যালেঞ্জও কুরআন দিয়েছে, আজ পর্যন্ত কেউ এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেনি। আল কুরআনের ঘোষণা- “বলে দাও, যদি এই কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনয়নের জন্য মানুষ ও জিন এক সাথে হয় এবং তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা ইহার অনুরূপ আনয়ন করতে পারবে না।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৮৮) অতীতে আবু জাহেল থেকে শুরু হয়ে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানিরা ব্যর্থ হয়েছে, বর্তমানে ইহুদি-খ্রিষ্টান ও নাস্তিকরা ব্যর্থ হচ্ছে আর ভবিষ্যতে কোন কালে কারও দ্বারা কুরআনের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। কারণ এর হেফাজতের দায়িত্ব সরাসরি আল্লাহর হাতে রয়েছে। সাড়ে চৌদ্দ শত বছর আগে কুরআনের ঘোষণা- “আর এই বাণী, একে তো আমিই নাজিল করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” (সূরা আল হিজর : ৯) তারপরও তাগুতের অনুসারীরা কোন যুগেই থেমে থাকেনি। তারা আল কুরআনের আলোয় আলোকিত সত্য-সুন্দরে সুশোভিত এই ধরণীকে কাঁটাযুক্ত মহীরুহের আবরণে বার বার আটকাতে চেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ১০ এপ্রিল ১৯৮৫ সালে কুরআন বাজেয়াপ্ত করার জন্য কলকাতার হাইকোর্টে মামলা করে উগ্রবাদী হিন্দুরা। কুরআনের বিরুদ্ধে এ যেন ১৪ শত বছর আগের মক্কার মুশরিক আবু লাহাব, আবু জেহেলদের করা প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করে ভারতের দুই ব্রাহ্মণ্যবাদী নাগরিক পদ্মমল চোপরা ও শীতল সিং। আল কুরআনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো যে, কুরআন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম দেয়। যে কিতাব মানুষের হেদায়েতের জন্য এলো, যে গ্রন্থ সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মাঝে সম্প্রীতি আনয়নের জন্য প্রেরিত হলো। তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির কাল্পনিক অভিযোগ। কল্পনাপ্রসূত অভিযোগ দিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মিসেস পদ্ম খাস্তগীরের আদালতে কুরআনের সকল আরবি কপি ও অনুবাদ বাজেয়াপ্ত করার আবদার জানিয়ে একটি রিট আবেদন করে মিথ্যা-অন্যায়ের ধ্বজাধারী পদ্মমল চোপরা ও শীতল সিং। দুনিয়াবাসীকে হতবাক করে আগ-পর কোন মূল্যায়ন না করে বিচারপতি আবেদনটি গ্রহণ করেন। বিশ্বের ইতিহাসে এমন জঘন্য ঘটনা পূর্বে ঘটেছে কি না জানা নাই। আর তাদের দ্বারাই এমন ন্যক্কারজনক কাজ করা সম্ভব। কারণ যারা অতীতে মুসলমানদেরকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্য আন্দোলন করেছে, মসজিদের মাইকে আজান নিষিদ্ধ করেছে, বাবরি মসজিদকে ভেঙে খান খান করেছে, কাশ্মির ও আসামের মুসলমানদের ওপর সামান্য কারণে জুলুম-নির্যাতনের সাইক্লোন প্রবাহিত করেছে। ছোট ছোট কারণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে পুলিশি ছত্রছায়ায় নির্যাতন করেছে। ভারতীয় মুসলমানদেরকে এবং বারবার মা-বোনদের ইজ্জতের ওপর আঘাত হেনেছে। ভারত শুধু নামে মাত্র ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু বাস্তবে সাম্প্রদায়িকতা লালন করে। বিশেষ করে মুসলমানদের প্রতি তাদের একপেশে নীতি বহু পুরনো, যা আজ অবধি বিদ্যমান। তারা ভেবেছিল মুসলমানদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন, ঘর-বাড়ি ছাড়া করা, দেশ ত্যাগে বাধ্য করার চেয়ে বহু গুণ বেশি ব্যথিত হবে কুরআনের ওপরে কোন আঘাত এলে। আর এ জঘন্যতম কাজটির আয়োজন করে পদ্মমল চোপরা ও শীতল সিং। ফলে তড়িৎ বেগে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো গোটা বিশ্বে। মুসলমানদের পবিত্র জীবনবিধানকে অপমান করে যেন পুরো দুনিয়ায় মুসলমানদের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছিল। সারা বিশ্বে কুরআনের সৈনিকরা হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। শুরু হয় দেশে দেশে বিক্ষোভের ঝড়। প্রতিবাদের দামামা বেজে ওঠে ৯০% ধর্মপ্রাণ মুসলমানের লালন রেখা আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে। শহীদি সংগঠন ১০ মে জুমার নামাজ শেষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা নিয়ে এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ করে। তাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। রাজশাহীতে ইমামদের নেতৃত্বে কুরআনের অবমাননার বিরুদ্ধে মিছিল হয়। পুলিশ সেখানেও কুরআনের ডাকে উন্মাদ জনতার কণ্ঠকে রুখতে পারেনি টিয়ার গ্যাস আর লাঠিচার্জ করে। বাংলাদেশের রাজধানী থেকে এই প্রতিবাদের সুর ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিভাগীয় শহর থেকে জেলা শহর হয়ে গ্রাম হতে গ্রামান্তরে। আল কুরআনের সম্মোহনী আকর্ষণ যেন মুমিনের ঈমানী বাগানে ভ্রোমরের মত বিস্তার লাভ করলো। এই ঘটনা চাঁপাইনবাগঞ্জের ইসলামপ্রিয় কুরআন প্রেমে পাগলপারা তৌহিদি জনতাকে ব্যাপকভাবে ব্যথিত করে। হৃদয়ে প্রতিবাদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। তৎকালীন নবাবগঞ্জ কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ হোসাইন আহমদ, ফকিরপাড়া মসজিদের ইমাম ইসারুল হক, মাস্টার মোজাম্মেল হকসহ অন্যান্য আলেম, মসজিদের ইমাম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে গঠন করা হয় ‘প্রতিবাদ কমিটি’। প্রতিবাদ সভার প্রচারকাজ শুরু হয় প্রচারপত্র বিলি ও মাইকিংয়ের মাধ্যমে। কুরআন অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর ইচ্ছা শুধু আলেমদের মনের মাঝে রেখাপাত করেনি বরং সকল শ্রেণি-পেশার ধর্মপ্রাণ মুসলমান ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১০-১২ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের অতিশয় বৃদ্ধের প্রতিবাদী কণ্ঠে কুরআনের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা বেজে ওঠে। তাইতো মসজিদের ইমামগণ জুমার খুতবায় বা নামাজ শেষে কুরআনের মহিমা বর্ণনা দিয়ে প্রতিবাদী সভায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করেন। প্রতিবাদী সমাবেশের প্রচার থেকে বিরত থাকেনি মুয়াজ-মুয়াব্বালের উত্তরসূরি প্রিয় কাফেলার সঙ্গী শীষ মোহাম্মদ, আব্দুল মতিন, রাশিদুল হক আর শাহাবুদ্দিনেরা। আব্দুল মতিন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে অনুমতি নিয়ে সহপাঠীদের নিকট কুরআনের মিছিলে অংশগ্রহণে আহ্বান জানান। স্কুল থেকে ফিরে কুরআনের মিছিলে সবার আগে যাওয়ার জন্য দুপুরে না খেয়ে রওয়ানা দেয় মতিন। পেছন থেকে মমতাময়ী জননীর ডাক “আব্দুল মতিন খেয়ে যাও বাবা” জবাবে মতিন বলে, “আমি যে পেছনে পড়ে যাবো মা!” হজরত জাফর ইবনে আবু তালেবের অনুগামী আলতাফুর রহমান সবুর কুরআনের মর্যাদা রক্ষার ডাকের কথা শুনে ক্ষেতে ফসল ফেলে রেখে রওনা হয়েছেন বাড়িতে। সেদিন জুমার দিন ট্রেনে বাড়িতে এসেছে। সভায় অংশগ্রহণের জন্য পাড়ায় যার সাথে দেখা হচ্ছে সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন। দীর্ঘ দিনের হৃদয় নয়নে লুক্কায়িত স্বপ্ন শাহাদাতের তামান্নায় বিভোর আলতাফুর রহমান সবুজ স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে শেষবারের মত বিদায় নিয়ে কুরআনের ময়দান নিমতলার পথে রওয়ানা হলেন। লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত রাসূলের শ্রেষ্ঠ মোজেজার অবমাননায় নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি রিকশাচালক মুক্তার হোসেন ও শ্রমিক নজরুল ইসলাম। আল্লাহর কিতাবকে বাজেয়াপ্ত করা হবে আর বসে থাকবে শহীদ সেলিম রেজা তা কী করে হয়? পূর্ব দিগন্তে উদিত হওয়া সূর্য সবেমাত্র হালকা পশ্চিম গগনে হেলে পড়েছে। রোদের তীব্রতা কিছুটা শিথিল হতে শুরু করেছে। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে মসজিদের মিনার চূড়ায় তখনো আসরের আজান বেজে ওঠেনি। কিন্তু কুরআনপ্রেমী তৌহীদি জনতার ঢল ঈদগাহ ময়দানকে করেছে মুখরিত। কোন অদৃশ্যের কারণে ৯০ ভাগ মুসলমানদের দেশে মোমিনের বুনিয়াদি প্রেরণার হাতিয়ার মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে বাজেয়াপ্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সমাবেশ করতে দিবে না। তা কি মানা যায়! শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ক্ষোভ বহু গুণে বেড়ে যায়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রেমে আশেক মুসলমানেরা আল কুরআনের অবমাননায় দগ্ধ হয়ে হৃদয় গভীরে না বলা কষ্টধারাকে প্রকাশ করতে চেয়েছিল কিন্তু সে সুযোগ দেয়নি কপালপোড়া মুসলিম নামধারী সরকার। আয়োজকেরা ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লাকে বলেন, আমরা উপস্থিত জনতাকে ‘সভা হবে না’ জানিয়ে দিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করে চলে যাবো। এখনি চলে যান বলে গালাগালি করে প্রশাসন। কুরআনের মহব্বতে আসা হাজার হাজার ছাত্র, যুবক, কিশোর, শ্রমিক, আলেমসহ সর্বস্তরের তৌহিদি জনতার ওপর পাষণ্ড পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল হতভাগা ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা। চিরন্তন কিতাব আল কুরআনের বিরোধীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে পাপিষ্ঠ ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লারা ছুড়তে লাগলো বুলেট আর গুলি। অপর দিকে সত্য-ন্যায়ের সিপাহসালার বীর সেনানীরা আল্লাহর কালামের মর্যাদা রক্ষার জন্য ঈমানের দাবি পূরণ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। শহরের সমস্ত মানুষ যেন কুরআনের মিছিলে শামিল হলো। দেহ মনের সকল শক্তি দিয়ে নারায়ের তাকবিরের ধ্বনিতে সমীরণের গতিকে শীতল করছে আর অন্য দিকে পাপিষ্ঠ ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার বাহিনীর গোলাবারুদ বাতাসকে দূষিত করছে। সময় গড়ার সাথে সাথে সে দিনের অবস্থা রীতিমতো ভয়ঙ্কর ও হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে। শতাধিক আহত গাজির রক্তে নবাবগঞ্জের মাটি রঙিন হলো। পুলিশের গুলি শেষ হলে যোগ হয় বিডিআরের গুলিবর্ষণ। পুলিশ আর বিডিআরের বুলেট আর গুলিতে ঝরে যায় কুরআনের বাগানের সুশোভিত ৮টি ফুল। মোমিনেরা জীবন দিতে রাজি কিন্তু কুরআনের অমর্যাদা হতে দিতে রাজি না। এ যেন কুরআনের সম্মোহনী অদৃশ্য শক্তির টান। শহীদদের জীবন ভুবনে গেয়ে যাওয়া গান- বুলেট গুলি বুল ডোজারে বুকের পাঁজর যায় কি ভাঙা! যে পাঁজরে কোরআন ধরে ভাঙছি সিঁড়ি সলিল রাঙা। সে দিনের শহীদ আর আহতদের ত্যাগের মহিমা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে নবচেতনা জাগ্রত করে তোলে। মাজলুম পরিবারের দোয়া ও শহীদি রক্তের স্রোতধারা বৃথা যায়নি। নতুন করে ভারত সরকারকে ভাবতে বসায়। তাই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ মামলা খারিজের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দেয়। দুই দিন না যেতেই ১৩ মে ১৯৮৫ কলকাতা হাইর্কোট মামলাটি খারিজ করে দেন। কিন্তু ঘাতকেরা নিয়ে গেল মায়ের কলিজা ছেঁড়া সোনার মানিক সন্তান বিয়োগের বুক ভরা আহাজারি, বোনের ভাই হারানোর হৃদয়ফাটা কান্না, ভাইয়ের ভাই হারানোর ব্যথা, সন্তানকে পিতার চির বিদায়ের বেদনা, স্ত্রীর স্বামী না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার যন্ত্রণা, আত্মীয়-স্বজন ও সহপাঠীদের কষ্ট, প্রিয় সংগঠনের সাথীদের বুক ভরা হাহাকার ও নয়নভরা অশ্রু। তবুও সান্ত¡না খুঁজে পাই সে মামলা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু সে রায় খারিজ হলেও যুগে যুগে নতুন আঙ্গিকে কুরআনের বিরোধিতা রয়ে গেছে। আজকের তথাকথিত প্রগতিবাদীরা কালজয়ী কুরআনের আদর্শকে সেকেলে বলে অচল বুলি ছড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন, কুরআন আজ তাকের ওপর ফুলদানির দাবি পূরণ করছে। অথচ কুরআনের সোনালি শাসনের কথা কে না জানে? তাই কুরআনের নাজিল ও প্রিয় কাফেলা কর্তৃক ঘোষিত কুরআন দিবসের মাসে একুশ শতকের পাঞ্জেরীদের শপথ নিতে হবে কুরআনের প্রতিটি বিধান দিয়ে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সাজাবার। মনে রাখতে হবে গভীর অন্ধকার মানেই সামনে সোনালি প্রভাত অপেক্ষমাণ। আল কুরআন ডাক দিচ্ছে জাতির এই ঘোর দুর্দিনে সুদক্ষ কাণ্ডারিরা তার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে কালিমার পতাকা হাতে নিয়ে অগ্রসর হলে মুক্তির সূর্যোদয় হবে। মুসলিম জাতিকেই সমাজ থেকে অন্ধকার বিদায় করে আনয়ন করতে হবে আলোর মশাল। প্রত্যয় হোক আমাদের, কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে- “আল কুরআনের আহ্বানে দ্বীন কায়েমের প্রয়োজনে নতুন করে আবার আমি শপথ নিলাম আজ।” লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মন্তব্য লিখুন