post

৩৬ জুলাই রক্তস্নাত গণ-অভ্যুত্থান ও নজরুলের কবিতা-গান

মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের গণমানুষের কবি। তিনি আমাদের জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের রূপকার। একই সাথে তিনি সর্বমানবের কবিকণ্ঠ। তাঁর কবিতা-গান চির-মানুষের উজ্জীবন ও প্রাণের সুর। সাধারণ মানুষের সকল আশা-আকাক্সক্ষা, বেদনা-বিক্ষোভকে তিনি নিজের জীবনে আত্মস্থ করেছেন, নিজের কণ্ঠে ধ্বনিত করেছেন। তা করতে গিয়ে তিনি প্রতিভাত হয়েছেন, একই সাথে বিদ্রোহী রূপে এবং প্রেমিক রূপে। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। শান্তিতে-সংগ্রামে, প্রেম ও বিরহে, আনন্দ ও বেদনায়, চেতনার জাগরণে নজরুল প্রাতঃস্মরণীয়। সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের অগ্নিমন্ত্র বাঙালি জাতির চিত্তে জাগিয়েছিল মরণজয়ী প্রেরণা; আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুকঠিন সঙ্কল্প।

বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের পর অবিশ্রুত, অবিস্মরণীয় ও কল্পনাতীত এক গণ-অভ্যুত্থান সফল করেছেন এদেশের ছাত্রসমাজ ও লাঞ্ছিত-বঞ্চিত, শোষিত-নিপীড়িত সর্বসাধারণ। ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট, ২০২৪) এ সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে বিতাড়িত হয়েছে ১৬ বছরের নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার। মায়ের অশ্রু, বুকে পাথর চাপানো বাবার স্তব্ধতা, বোনের আর্তনাদ, স্বামী হারা বিধবার বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস অভিশম্পাত রূপে পতিত হয়েছে স্বৈরাচারের ওপর। শত সহস্র ছাত্র-জনতার রক্ত পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে সংঘটিত হয়েছে গণবিপ্লব। এই বিপ্লবের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি নজরুলের কবিতা-গান উচ্চারিত হয়েছে বিপ্লবীদের কণ্ঠে। ছাত্র-জনতা একাকার হয়ে কবিতা আবৃত্তি করে, গান গেয়ে রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১ জুলাই’২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিলের দাবিতে যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সূচনা করেছিল, তা আর শান্তিপূর্ণ থাকেনি স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের একগুঁয়েমির কারণে। সরকার প্রধান ও তার মন্ত্রীদের নির্দেশে সশস্ত্রপন্থায় আন্দোলন ঠেকানোর পরিণতি এই সফল বিপ্লব ও বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন। এই স্বাধীনতা কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল  আনেনি; বরং এর সবটারই কৃতিত্ব হার না মানা ছাত্র-সমাজের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ্, আবু সাদিক কায়েম, ফরহাদ প্রমুখ টিএসসির সামনে থেকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে সাথে নিয়ে শাহবাগের দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে বিদ্রোহী কবি নজরুলের ‘চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ কবিতা আবৃত্তি করতে করতে। ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে চাকরিতে কোটাপ্রথা বিলোপের ঘোষণা না দিয়ে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সাথে আন্দোলনকারী ছাত্রদের রাজাকারের নাতি-পুতি বলে অভিহিত করেন। তার এই শ্লেষাত্মক বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সেদিন রাতেই উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। মধ্যরাতে ছাত্র-ছাত্রীরা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে হল থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। গলা ছেড়ে ঝাঁজালো স্লোগান দিতে থাকে- তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার! কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার! স্বৈরাচার! কোটা না মেধা? মেধা মেধা।

এই গণবিপ্লব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সরকারি পেটোয়া বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর হামলায় চরম ও নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে এসে দাঁড়ায় সর্বসাধারণ, পুরোদেশ ও গোটাজাতি। জেন-জি নামে খ্যাত তরুণ প্রজন্মের  শিক্ষার্থীরা সকল বাধা উপেক্ষা করে বুক চিতিয়ে রাইফেল-বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েছিল শহীদ হওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা নিয়ে। একজন গুলি খেয়েছে। অন্যরা ছুটে এসে তাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে। অন্য শতসহস্র ছাত্র-ছাত্রী ডর-ভয়কে পেছনে ফেলে বুক উঁচিয়ে ঝাঁজালো স্লোগানে রাইফেল-বন্দুক-টিয়ারশেল উপেক্ষা করে সম্মুখপানে এগিয়ে গিয়েছে। আর সারাদেশে কারারুদ্ধ হয়েছে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল নজরুলের সে বিখ্যাত গান-

কারার ঐ লৌহ-কপাট/ভেঙে ফেল কররে লোপাট

রক্ত-জমাট/শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী!

ওরে ও তরুণ ঈশান!/ বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ

ধ্বংস-নিশান/উড়–ক প্রাচীর, প্রাচীর ভেদি।

গাজনের বাজনা বাজা!/কে মালিক? কে সে রাজা?

কে দেয় সাজা/ মুক্ত-স্বাধীন সত্য কে রে?

হা হা হা পায় যে হাসি/ভগবান পরবে ফাঁসি?...

লাথি মার ভাঙরে তালা/ যত সব বন্দী-শালায়

আগুন জ্বালা/ আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।

ছাত্র-জনতার এই গণবিপ্লবকে এগিয়ে নিতে ব্যবহৃত হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া। তারা একে অন্যের সাথে বার্তা বিনিময় ছাড়াও গোটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিগ্রাম, ইন্সটাগ্রাম, টিকটক প্রভৃতির মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল বিপ্লবের বার্তা। ১৭ জুলাই রাত থেকে ফ্যাসিবাদী সরকার ইন্টারনেট সপ্তাহখানেকের মতো বন্ধ করে দেয়। এই অবস্থায় আন্দোলনকারী ছাত্ররা ভিপিএন, সুপার ভিপিএন ও ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে আন্দোলন তীব্র গতিতে চালিয়ে নেয়। সেই উৎকণ্ঠার সময়ও বিপ্লবীরা নজরুলের স্মরণ নিয়েছে বারবার। সোশ্যাল মিডিয়ায় যেমন প্রচারিত হয়েছে নজরুলের গান-কবিতা, তেমনি রাজপথে উচ্চারিত হয়েছে ওগুলো বারংবার। যেমন-

মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম/ মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল

মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়/মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল।

মোরা আকাশের মতো বাধাহীন/মোরা মরুসঞ্চার বেদুঈন।

মোরা বন্ধনহীন জন্ম-স্বাধীন/চিত্তমুক্ত শতদল॥

বিদ্যালয় থেকে ছুটে আসা কিশোর শিক্ষার্থী, কলেজ থেকে ছুটে আসা অরুণ-তরুণ ছাত্র-ছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটে আসা অগ্রবর্তী দলের তারুণ্যে উদ্দীপ্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীরা। তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে নজরুলের সে বিখ্যাত গান-

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, রংপুর, পাবনা, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি জেলার আন্দোলনরত বীর বিপ্লবীদের মুখে উচ্চারিত হয় নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার সে সুপ্রসিদ্ধ পঙক্তিমালা:

“বল বীর-  বল উন্নত মম শির!

শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!

বল বীর-  বল  মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’

চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’

ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া

খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,

উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রির!

..............................................

আমি সেই দিন হবো শান্ত

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না

বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।”

জুলাই বিপ্লব ছিল বাংলাদেশের সর্বসাধারণের বিপ্লব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্বৈরাচারের নিষ্পেষণে জর্জরিত জনতা রাজপথে নেমে এসেছিল। দেশের প্রতিটি বিশ^বিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রী ও সব ধর্মের মানুষ; বিশেষত আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ, ফায়াজ, হৃদয় চন্দ্র, ওয়াসিম, ফয়সাল, শিশু রিয়া গোপ প্রমুখ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। সে সংগ্রাম মুখর দিনগুলোতে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছে নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতা-

দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার হে

লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার!...

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ

কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!

“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!

৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট ২০২৪) গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা করেছিল পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর আওয়ামী ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সন্ত্রাসী হেলমেট বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনে বিক্ষুব্ধ হয়ে বেসরকারি (প্রাইভেট) বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও সদলবলে রাজপথে নেমে এসে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে ও ডজন ডজন শাহাদাত বরণ করে। নজরুল, ফররুখ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হেলাল হাফিজ, মতিউর রহমান মল্লিক, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহিব খান প্রমুখের কবিতা ছাড়াও তারা নিজেদের মতো করে ধারালো তলোয়ারের মতো নতুন নতুন স্লোগানে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়। এই গণ-আন্দোলনের গতি  ও স্লোগান তীব্র হয়ে ওঠে বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের জানবাজ মেধাবী ছাত্র বীর বিক্রম আবু সাঈদের শাহাদাতের মাধ্যমে। ছাত্ররা রাজপথ কাঁপিয়ে স্লোগান দিতে থাকে ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে’; ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে’; ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’। যেখানে এই শব্দগুলোই জানিয়ে দেয়া হয়েছে জনতার এই দাবির সঙ্গে আছে প্রাণ হারানোর চরম যন্ত্রণা। ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো’ এবং ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’-এর মতো স্লোগানগুলো।

দিন যত গড়াচ্ছিল আহত-নিহতের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাচ্ছিল। স্বৈরাচারী হাসিনা, তার জেনারেল সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত জনতাকে সরাসরি গুলির নির্দেশ দেয়। মাঠে নেমে আসে সেনাবাহিনী। জারি করা হয় কারফিউ। ঘোষণা আসে দেখা মাত্রই গুলি করো। কিন্তু অকুতোভয় ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারের পতনের জন্য আরো তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’; ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’ প্রভৃতি স্লোগানে মুখরিত করে তোলে রক্তাক্ত রাজপথ। এবার হাসিনা সরকারের পতনের একদফা দাবি নিয়ে ছাত্র-জনতা এগিয়ে যায় তার গণভবন নামক ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর রাজপ্রাসাদের দিকে। মুখে মুখে একটিই স্লোগান-এক দুই তিন চার, হাসিনা তুই গদি ছাড়। হাসিনা তুই স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।

শামসুন্নাহার হলের এক ছাত্রী সানজিদা চৌধুরী সানজু গর্জে উঠে বলেন, আমাদের আর পেছনে যাবার পথ নেই, পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা। আমরা হয় সম্মানের সাথে মৃত্যু বরণ করব, না হয় স্বাধীনতা নিয়ে ঘরে ফিরব।

বীর চট্টলার ছাত্র-জনতার অভাবনীয় ভয়শূন্য বুক চিতিয়ে দিয়ে শহীদ হওয়ার আকাক্সক্ষায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গোটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজ, মুহসীন কলেজ, সিটি কলেজ, কমার্স কলেজ, এমইএইচ কলেজ এবং স্কুল ও মাদরাসার ছাত্ররা প্রতিদিন মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমেছে। ১৬ জুলাই ২০২৪ রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র বীর বিক্রম আবু সাঈদের শাহাদাতের পূর্বেই চট্টগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেন ওয়াসিম আকরাম, ফয়সাল আহমেদ শান্ত, হৃদয় চন্দ্র তাড়ুয়াসহ আরও অনেকে। এই রক্তদানে ফুঁসে উঠে সমগ্র দেশ। চট্টগ্রামের ষোল শহর ২নং গেট, আন্দরকিল্লাহ, চকবাজার, টাইগারপাস, কোর্ট বিল্ডিং ও নিউমার্কেট মোড়ে প্রতিদিন চলে সরকার হটানোর তীব্র গণ আন্দোলন। নতুন নতুন স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়ে দেয়ার পাশাপাশি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় দেয়া “বউত দিন হাইয়্যূ আর ন হাইয়্যূ” স্লোগানটি তীরের ফলার মতো স্বৈরাচারের বুকে বিদ্ধ হয়।

৫ আগস্ট নজরুলের ব্রিটিশ বিরোধী সেই  আগুন ঝরা স্লোগান দিতে দিতে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’র দিকে লক্ষ লক্ষ জনতা কারফিউ উপেক্ষা করে বাঁধভাঙা স্রােতের মতো ছুটে আসে। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়-

এ দেশ ছাড়বি কিনা বল/নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল।

মোরা মারের চোটে ভূত ভাগাব/মন্ত্র দিয়ে নয়,

মোরা জীবন ভর মার খেয়েছি/আর প্রাণে না সয়।

মোরা ফাঁসি প’রে আনব হাসি/মৃত্যু জয়ের ফল,

মোদের অস্থি দিয়ে জ¦লবে দেশে/আবার বজ্রানল।

জনতার এই বাঁধভাঙা অপ্রতিরুদ্ধ স্রােতে হাসিনার সিংহাসন খড়কুড়োর মতো ভেসে যায়। রক্ত খেকো ডাইনির সব অপকৌশল ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ভেস্তে যায়। শেষ পর্যন্ত তাকে রাজা লক্ষণ সেনের মতো পেছন দরজা দিয়ে দেশ থেকে লুকিয়ে পালাতে হয়। তার পালানোর সংবাদে সমগ্র দেশ মুহূর্তের মধ্যে আনন্দে মেতে উঠে। রক্তের পিচ্ছিল পথ বেয়ে পতন ঘটল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী স্বৈরাচারের আর জাতি পেল দ্বিতীয় স্বাধীনতার স্বাদ। তাদের কণ্ঠে আবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকল নজরুলের সেই বিখ্যাত বিজয়ের গান-

আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে/মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে। 

মোর টগবগিয়ে খুন হাসে/আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে

বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার- ভাঙা কল্লোলে।

আসলো হাসি, আসলো কাঁদন/মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,

মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর /তিক্ত দুখের সুখ আসে।

ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে/আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

শুরুতে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলন অহিংসই ছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চড়াও হলে ১৫ জুলাই আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। এরপর ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন প্রবল আন্দোলনে রূপ নেয়। বাড়তে থাকে সহিংসতা। শেষে সরকার পতনের এক দফা দাবি তুলে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলন সফল হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বারুদ হয়ে বিস্ফোরিত হলো নজরুলের কবিতা-গান ও রাজপথের স্লোগানগুলো। ৫ আগস্ট পতন ঘটে বাংলার বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈরতন্ত্রের প্রতিভূ শেখ হাসিনা সরকারের। বাংলাদেশ ফিরে পায় দ্বিতীয় স্বাধীনতা। মানুষের সে কী উল্লাস, যা বর্ণনাতীত। ভয়কে জয় করার বিপুল আনন্দ। অগণিত শহীদের আত্মদানের ফসল এ বিজয়, এ স্বাধীনতা। ঈদের আনন্দের মতো প্রবল উচ্ছ্বাসে সর্বস্তরের নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে।

৩৬ জুলাইয়ের গণ-বিপ্লবে আমাদের ছাত্রীদের ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। লিখিত থাকবে সর্বস্তরের মা-বোনদের অশেষ অবদান। তারা বারবার অপমানিত হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছে, নিষ্ঠুর লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে, শাহাদাত বরণ করেছে, তবুও রাজপথ ছাড়েনি। তাদের এই ঐতিহাসিক অবদানও বারবার উচ্চারিত হয়েছে বিপ্লবের বার্তাবাহকদের কণ্ঠে-

‘‘বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

বিশ্বে যা-কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি

অর্ধেক তার আনিয়েছে নর, অর্ধেক তার নারী।

জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান

মাতা ভগ্নি ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান। ...

কোনো কালে একা হয় নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি,

প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।’’

বিপ্লব তো সফল হলো কিন্তু স্বৈরাচারের সহযোগী অত্যাচারী পুলিশরা হাওয়ার মতো মুহূর্তে গায়েব হয়ে গেল। গোটা দেশ হঠাৎ অরক্ষিত হয়ে পড়ল। রাস্তার শৃঙ্খলা, ভিন্নধর্মীদের উপাসনালয় পাহারা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় এগিয়ে এলো ছাত্র-সমাজ। ভারত কর্তৃক সৃষ্ট আকস্মিকভাবে বিপদগ্রস্ত বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াল সর্বশক্তি নিয়ে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তারা সুন্দর করে সাজাল গোটা দেশ। দেয়ালে দেয়ালে আঁকল গ্রাফিতি, কার্টুন আর লিখে রাখলো শহীদদের স্মৃতি। এই সময়ও আবার ফিরে গেল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে-

‘‘আমরা শক্তি আমরা বল/আমরা ছাত্রদল।

মোদের পায়ের তলায় মুর্সে তুফান/ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।...

মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে/যাত্রা নাঙ্গা পায়,

আমরা শক্ত মাটি রক্তে রাঙাই/বিষম চলার ঘায়!...

আমরা রচি ভালোবাসার/আশার ভবিষ্যৎ

মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায়/আকাশ-ছায়াপথ!

মোদের চোখে বিশ্ববাসীর/স্বপ্ন দেখা হোক সফল।

আমরা ছাত্রদল।’’

নজরুল বাংলা ভাষার অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি, বাংলার জনগণের পথ-নির্দেশক শক্তি ও প্রেরণার উৎস। প্রতিবাদের অবলম্বন উদ্দামতার জন্য নজরুল, সাহসী চেতনার জন্য নজরুল, অধিকারের প্রশ্নে নজরুল, জনবিস্ফোরণের জন্য নজরুল, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদের নজরুলের কাছেই যেতে হয়। নজরুল জেগে ওঠেন বারবার শৌর্য-বীর্য ও গৌরবে।

বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশিদের সৌভাগ্য যে, আমরা নজরুলের মতো একজন মানব দরদি কবিকে পেয়েছি। দরিদ্রতাকে ছুঁড়ে ফেলে নজরুল নিজের সীমাহীন শ্রম ও কাব্য সাধনায় ধন্য করেছেন বাংলা সাহিত্যকে; এদেশকে, এদেশের মানুষকে। তাঁর মতো একজন বিশ্ববিখ্যাত কবিকে আমরা জাতীয় কবি হিসেবে পেয়েছি। আমাদের জাতির প্রতিটি সংগ্রাম সাধনা ও উৎসবে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন, তিনি আছেন এবং তিনি থাকবেন আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার একমাত্র অনুপ্রেরণা দানকারী কবি হিসেবে।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক দ্বীন দুনিয়া ও কিশোর দ্বীন দুনিয়া

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির