ইন্নাল হামদা লিল্লাহ ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা রাসূলিল্লাহ, ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহি আজমাঈন।
৫ আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। দেশের জনগণ সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে অত্যাচারী শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ অপশাসনামলে। আর দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এই ফ্যাসিবাদী সরকার গুম খুন হত্যা, নির্যাতন এবং মানুষের অধিকার হরণ করে দেশে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল। বাতি নিভিয়ে রাতের আঁধারে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল। দেশের সেনাবাহিনীর জেনারেল, উচ্চশিক্ষিত অ্যাডভোকেট, ব্যারিস্টারসহ হাজার হাজার মেধাবী নাগরিকদেরকে তারা গুম করে আয়নাঘরে বন্দী রেখেছিল। ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে জুডিশিয়াল কিলিং করেছে। মানুষ তার মৌলিক অধিকার হারিয়েছিল। বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দেশের সংস্কৃতিকেও তারা ধ্বংস করেছে। ছাত্ররা যখন তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু করে কোটা বাতিলের দাবিতে তখন তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালিয়েছে, খুন করে পুলিশের গাড়ির ওপর থেকে টেনে হিঁচড়ে ফেলে দিয়েছে। এদেশের মানুষ তাদের কাছে কখনোই নিরাপদ ছিল না। স্বজন হারানো মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। হাসপাতালগুলোতে আহত আর নিহতদের রোনাজারিতে বিবেকবান প্রতিটি মানুষের হৃদয় কেঁপে উঠেছিল। গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করে দেওয়া হয়েছিল। কোথাও মানুষ স্বস্তিতে কথা বলার সুযোগ পায়নি, প্রতিবাদ করলেই দমন পীড়ন চলত। মানুষের অধিকার হরণ করার ইতিহাসে স্বৈরাচারী হাসিনার সরকার ছিল কুখ্যাত। তাই ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের বিপ্লব ছিল অনিবার্য।
বিশ্ব গণমাধ্যমে ৫ আগস্ট
৫ আগস্টের খবর আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশিত হয়েছিল। বিবিসির খবরের শিরোনাম করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আন্দোলনকারীরা প্রাসাদ (গণভবন) দখলে নিয়েছে।’ আল জাজিরা বলেছে, ‘একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছেন। তার সরকারি আবাস গণভবনে হাজারো মানুষ ঢুকে পড়েছে।’ কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি সেনাপ্রধানের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হবে।’ এএফপির খবরেও বোনকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর প্রকাশ করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, ‘নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে তিনি দেশ ছেড়েছেন।’ স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাতে এএফপি বলেছে, ‘হাজারো মানুষ গণভবনে ঢুকে পড়েছে।’
রয়টার্স বলছে, ‘শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়েছেন। বাংলাদেশও ছেড়ে গেছেন।’ দ্য গার্ডিয়ান সেনাপ্রধানের সূত্র দিয়ে সংবাদে বলেছে, ‘শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছে, সেনাপ্রধান নিশ্চিত করেছে।’ সিএনএনের খবরে বলা হয়, ‘এক সপ্তাহের বেশি প্রাণহানি ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর পদত্যাগ করলেন শেখ হাসিনা।’ ওয়াশিংটন পোস্টও সেনাপ্রধানের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে জানিয়েছে, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং দেশ ছেড়েছেন।’
টাইমস অব ইন্ডিয়াও একই সংবাদ প্রকাশ করেছে। এছাড়াও একই সংবাদ প্রকাশ করেছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন। প্রতিবেদনে তারা বলেছে, ‘শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ চালাবে।’ পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সংবাদপত্র আনন্দবাজারের খবরে বলা হয়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে তিনি ঢাকার বাসভবন তথা ‘গণভবন’ ছেড়েছেন। তাকে হেলিকপ্টারে করে ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ের উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারটি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়।’’
ঐক্য স্থাপনই জনগণের সফলতা এনেছিল
৫ আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকে ধরে রাখতে গোটা জাতির মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। খুনি লুটেরা দুর্বৃত্ত নতুন করে যেন ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। জুলাই আন্দোলনের শহীদ এবং আহতদের ইতিহাস সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ রাখতে হবে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও স্বাধীনতার সুফল জনগণ পায়নি। যারা স্বাধীনতার দাবিদার ছিল তারা স্বাধীনতার সুফল জনগণের কাছে পৌঁছতে দেয়নি। তারা নিজেদের এবং দলের স্বার্থ চরিতার্থ করেছে। তারা জনগণের স্বার্থ পূরণ করেনি। তখনকার স্বাধীনতার কথা ছিল বৈষম্য দূর করা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা ও অধিকার আদায় করা। দেখা গেল জনগণের অধিকার তো আদায় করেইনি বরং তারা যাদের সহযোগিতা নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল তাদের গোলামি করা শুরু করল। দেশে পাটের গুদামে আগুন লাগাল। আগুন আর আগুন সারা দেশে শিল্প কলকারখানা ধ্বংস করে দেয়া হলো। পাটের বাজার ধ্বংস করে প্রতিবেশী দেশের বাজার সৃষ্টি করে দেয়া হলো। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সকল দল নিষিদ্ধ করা হলো। বাকশাল কায়েম করা হলো। সকল পত্রিকা নিষিদ্ধ করে সরকারের গোলামি করার জন্য চারটি পত্রিকা রাখা হলো। দেশে অভাব অনটন শুরু হলো। জনগণ না খেয়ে দিন কাটাতে লাগল।
পত্রিকার রিপোর্ট প্রকাশ ‘ক্ষুধার কারণে মানুষের বমি খেয়ে জান বাঁচার চেষ্টা করল।’ ভাগাড়গুলোতে কুকুর এবং মানুষের উচ্ছিষ্ট নিয়ে টানাটানি করতে লাগল। অভাব অনটনের এ চরম দৃশ্য আর ইতঃপূর্বে দেখা যায়নি। পরিস্থিতি এমন হলো নিজের দলের লোকেরা অন্যদের হত্যা করে নিজেরাই ক্ষমতা দখল করল। গণতন্ত্রের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। আন্দোলন শুরু হলো, কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য মানুষ জীবন দিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষ সরকার হিসেবে কেয়ারটেকার সংবিধানে যোগ হলো। পরবর্তী পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পাওয়ার পরে চিরদিন ক্ষমতায় থাকার অভিলাষে নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার এর বিধান বাতিল করা হলো। ১৭ বছর জুলুম অত্যাচার নির্যাতন জেল জুলুম ফাঁসি খুন গুম হত্যা চলতে থাকল। বিরোধী দলকে আর আন্দোলন করতে দেওয়া হলো না। ১৪৪ ধারা জারি, দেখামাত্র গুলি, গোপন ষড়যন্ত্র ও জঙ্গি অভিযোগ দিয়ে অসংখ্য নেতাকর্মীকে জেল দেওয়া হলো। নারী-পুরুষ যুবক শিশু পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ জেল খাটতে লাগল। দলীয়ভাবে প্রতিষ্ঠানসমূহ দখল করা হলো। পুলিশ বিডিআর বিজিবি আনসারসহ বিচারক এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে শুধুমাত্র দলীয় লোককেই নিয়োগ দেওয়া হলো। নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে অন্ধভাবে জুলুমের রাজত্ব চালাতে লাগল। ছাত্র-জনতা জীবন বাজি রেখে প্রতিরোধ প্রতিবাদ শুরু করল। লক্ষ লক্ষ মানুষ জেল খাটল আসামি হলো। গায়েবি মামলা দিয়ে মানুষকে অসহায় করে ফেলা হলো। সবশেষে ছাত্ররা তাদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু করল। ক্রমে ক্রমে সে আন্দোলন ছাত্র-জনতা পেরিয়ে সাধারণ জনগণের বিক্ষোভে পরিণত হলো। দেড় হাজারেরও বেশি শহীদ ও অর্ধ লক্ষ আহত ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে ও অগণিত নারী-পুরুষ-শিশু জেল জুলুমের শিকার হয়ে এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করল। মানুষ কথা বলার স্বাধীনতা ফিরে পেল, রাস্তায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার স্বাধীনতা পেল, আলহামদুলিল্লাহ।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দেশ পথ হারিয়েছিল আর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশ আবার পথের দিশা ফিরে পেয়েছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের শহীদদের পরিবার ও আহতদের বক্তব্য শুনলে পাষাণ হৃদয় নরম হয় ও অজান্তে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। ফ্যাসিস্টরা বিদায় হয়েছে এখন তাদের বিচার নিশ্চিত করার পালা। শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে সাপের মতো করে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর নাচানাচি করা হয়েছিল। ২৮ অক্টোবরের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ছিল আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার প্রথম মহড়া। দ্বিতীয়ত তারা ১/১১ এর ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দিন সরকারের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় গিয়ে পিলখানা হত্যাকাণ্ড দিয়ে গণহত্যা শুরু করে। বিচারিক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ধারাবাহিকভাবে আল্লামা সাঈদী রাহিমাহুল্লার রায় পরবর্তী গণহত্যা, শাপলা চত্বরের গণহত্যা এবং সর্বশেষ ২৪ এর জুলাই-আগস্টের গণহত্যা চালায়। হাজারো ছাত্র-জনতার জীবনের বিনিময়ে ৫ আগস্ট দীর্ঘ ১৭ বছর পর ফ্যাসিস্টসরকার ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
এ গণ-অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। আল্লাহর সাহায্যে এ কৃতিত্ব ছাত্র-জনতার। শেখ হাসিনা অহংকার করে বলেছিলেন, তিনি কখনো পালিয়ে যান না! কিন্তু জান বাঁচানোর জন্য তিনি চোরের মতো পালিয়ে যান।
সুরক্ষিত এবং কঠিন প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, ‘গণভবন’। এই গর্ত থেকে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছে দেশের বাইরে। দেশের কোথাও তার স্থান হলো না। অত্যাচারী হাসিনার ভবিষ্যৎ দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
সারা দেশে ছাত্র-জনতার বিজয়ের রেজাল্ট যেন কোনো নতুন শত্রুর হাতে গিয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের দেশকে হেফাজত করুন।
৭ নভেম্বর ও ৫ আগস্ট একই চেতনা
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে আধিপত্যবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সিপাহি-জনতার সফল বিপ্লব সংঘটিত হয়। সেদিন নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে ইসলামী মূল্যবোধ ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। একদলীয় শাসনের পরিবর্তে এদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।
দীর্ঘ ১৫ বছরে গুম, খুন, ধর্ষণ মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করেছিল। দেশের মানুষ গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারকে সমূলে উৎখাত করেছে। এখন দেশে গণতন্ত্র ও দেশের মানুষকে পূর্ণভাবে মুক্ত করতে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে প্রয়োজন আরেকটি বিপ্লবের। যা এই জাতির ভবিষ্যৎ রচনা করবে। ৭ই নভেম্বর একনায়কতন্ত্র, শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে যেভাবে এদেশের মানুষ সম্মিলিতভাবে গর্জে উঠেছিল একইভাবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা সকল আধিপত্যবাদী শক্তির মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করেছে।
দ্বিতীয় স্বাধীনতা
এই স্বাধীনতা হলো বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ভোটাধিকারের স্বাধীনতা। যার মূল কারিগর ছাত্ররা। তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ১৬ বছরের স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছে। এই স্বাধীনতা থেকে ছাত্রদের মূল চাওয়া হলো বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, সম্প্রীতির একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যেখানে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করবেন। বাংলাদেশ এখন চেতনার ওপর আছে। তাই এটাকে কাজে লাগিয়ে, তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার
দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পেয়েছে। তার মতো অনেক বাংলাদেশি এটিকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মুহূর্তের অঙ্গীকার পূরণ করতে বাংলাদেশকে এখন পুরোনো স্বৈরাচারীকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর আরও অনেক কিছু করতে হবে; অবশ্যই নষ্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে- দুর্নীতি, দলীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীতন্ত্র ও দুর্বল প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর কারণে দেশের অগ্রগতি থমকে গেছে। সেইসঙ্গে নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ে আড়ষ্টতা রাজনীতিকে বিষিয়ে তুলেছে।
এতে বলা হয়েছে, ড. ইউনূসের লক্ষ্য হওয়া উচিত একটি যুক্তিসঙ্গত সময়সীমার মধ্যে সঠিকভাবে নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশ তৈরি করা, কিন্তু প্রথমে তাকে নির্বাচনী সংস্থা, আদালত (বিচার বিভাগ) ও সকল প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশটিকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য ড. ইউনূসের কাছে সময় খুবই কম উল্লেখ করে নিবন্ধে বলা হয়, তার সাফল্য বা ব্যর্থতা ১৭ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশির জীবনযাত্রার সফলতা নির্ধারণ করবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ড. ইউনূস একটি অত্যন্ত কঠিন কাজের মুখোমুখি। তার অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা উচিত আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঢেউ প্রতিরোধ করা, যা অতীতে বাংলাদেশের রাজনীতিকে ধ্বংস করেছে।
অনির্বাচিত কেয়ারটেকার সরকারের খুব বেশিদিন ক্ষমতায় থাকার কোনো সুযোগ নেই, কারণ তাতে তারা বৈধতা হারাতে বা আরও খারাপ কিছু হতে পারে অথবা এর সামরিক সমর্থকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে প্রলুব্ধ হতে পারে।
সাময়িকীটিতে অবশ্য বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সহায়তা করার জন্য ভারতকে দায়ী করেছে। ভারতের লোলুপ দৃষ্টি থেকে দেশকে হেফাজত করতে হবে।
জালেমের পরিণতি
বাংলাদেশের জালেম সরকার পালাইলেও তাদের দোসর তাদের কৃত জুলুম এখনো পালায়নি। যারা জালেম তারা কখনই বাঁচতে পারেনি, এখনো পারবে না।
মহান আল্লাহ জুলুম করাকে হারাম করে দিয়েছেন এবং তা মানুষের জন্য হারাম ঘোষণা করেছেন। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আবু জার গিফারি (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি নিজের ওপর ও বান্দাদের ওপর জুলুম হারাম করে নিয়েছি। অতএব তোমরা পরস্পরের ওপর অত্যাচার করো না।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৪৬৯ )
জুলুম তিন প্রকার:
এক. আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা। এটা সবচেয়ে বড় জুলুম। আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ করুন, যখন লুকমান উপদেশ দিতে গিয়ে তার পুত্রকে বলেছিল, হে আমার প্রিয় বৎস, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। নিশ্চয়ই শিরক মহা পাপ।’ (সূরা লোকমান, আয়াত : ১৩)
দুই. বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পাপ করাও এক ধরনের জুলুম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বস্তুত যারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে, তারাই জালিম।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ২২৯ )
তিন. আল্লাহর সৃষ্টি ও তাঁর বান্দাদের ওপর জুলুম করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় ও আপস-নিষ্পত্তি করে তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে আছে। নিশ্চয়ই তিনি জালিমদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা শুরা, আয়াত : ৪০)
সবচেয়ে ঘৃণিত পাপ অন্যের ওপর জুলুম করা। জালিম তার জুলুমের পরিণতি দুনিয়াতে ভোগ করে আর পরকালের শাস্তি আরো ভয়াবহ।
জালিমের মন্দ পরিণতি : জুলুমের পরিণতি দুনিয়াতে ভোগ করতে হয়। আবু মুসা আশয়ারী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, ‘অবশ্যই মহান আল্লাহ জালিমকে সুযোগ দেন। এরপর তিনি যখন তাকে পাকড়াও করেন তখন তাকে ছাড়েন না। এরপর তিনি তিলাওয়াত করেন : ‘এমনই তোমার রবের পাকড়াও, যখন কোনো অত্যাচারী জনপদবাসীকে তিনি পাকড়াও করেন। নিশ্চয়ই তার পাকড়াও চরম মর্মান্তিক, অতিশয় কঠোর।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৪৭৫ )
আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত : জালিম আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত থাকে। জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, ‘আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না, যে মানুষের প্রতি দয়া করে না।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৩৭৬)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সাবধান! জালিমদের ওপর আল্লাহর লানত।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ১৮) ঐকবদ্ধভাবে আমাদেরকে জুলুম বন্ধ করতে হবে।
উপসংহার
আজকে ঐক্যের খুবই প্রয়োজন। জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে সকল বিপদ মোকাবিলা করা সম্ভব। যদি জাতীয়ভাবে ঐক্য না থাকে তাহলে শত্রু সহজেই প্রবেশ করতে পারে এবং পরাজিত করে দিতে পারে। আজকে ঐক্য সময়ের খুবই প্রয়োজন, কোনো অবস্থায় বিচ্ছিন্ন বা বিভক্ত থাকা উচিত হবে না। ইসলাম ঐক্যের ওপর খুবই জোর দিয়েছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে ইউনাইটেড উই স্ট্রং, ডিভাইডেড উই ফল। ঐক্য হলো শক্তি বিভক্তি হলো পতন। দ্বিতীয় স্বাধীনতার সুফল ঐক্যের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। বিচ্ছিন্ন হলে সুফল পাওয়া যাবে না বরং তা ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই সকলকে ছোটখাটো বিভেদ বিতর্ক ভুলে গিয়ে জাতীয় স্বার্থে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তাহলে সফল হবে ছাত্র-জনতার রক্তদান, সফল হবে দ্বিতীয় স্বাধীনতার স্লোগান, আদর্শভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান। আল্লাহ তায়ালা এই জাতিকে তার হারিয়ে যাওয়া আদর্শকে ফিরিয়ে আনার তৌফিক দান করুন। আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ সাধনে ঐক্যবদ্ধ থাকার তৌফিক দান করুন- আমিন।
লেখক : সাবেক এমপি
আপনার মন্তব্য লিখুন